নিস্তব্ধ স্মৃতি—-মোঃ সোহরাব হোসেন বিটুল

খুলনার ব্যস্ততম বাইপাস সড়ক দিয়ে হাঁটছিলাম। সেদিন ছিল শুক্রবারের ছুটির দিন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, পড়াশোনার চাপ নেই। দিনভর এক রকম অবসর পেয়ে গেলাম। আমি একজন সিনিয়র ভাইয়ের সাথে বেশ কয়েকদিন আগে থেকে দেখা করবো বলে কথা দিয়ে ছিলাম। কিন্তু ক্লাস, পরীক্ষা আর ভাইভার ব্যস্ততার কারণে তার সাথে আমি দেখা করার সময় হয়ে ওঠেনি। আগেরদিন মোবাইলে ঐ ভাইয়ের সাথে কথা বলে সময় ঠিক করে নিয়েছিলাম। সেদিন একটা জরুরী বিষয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলার জন্য দেখা করতে গিয়েছিলাম। সোনাডাঙ্গায় ইজিবাইক থেকে নেমে সামনে আমার গন্তব্যের দিকে হাঁটছি। যদিও সরকারির ছুটির দিন তবুও সবরকম দোকানপাট খোলা ছিল।

এরই মধ্যে হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন খুব জোরে জোরে প্রদীপ আংকেল, প্রদীপ আংকেল.. .. বলে ডাকছে। মনে হচিছল কোন শিশুর কণ্ঠ। কথাগুলি আমার কানে এসে বাজছিল কোমল কণ্ঠের মতো। কিন্তু সেদিকে খেয়াল না করে আরো দ্রুত সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। আবার ডাকছে শিশুটি একইভাবে। এবার আমি পিছন ফিরে তাকাতেই ততক্ষণাৎ শিশুটি দৌড়ে আমার সামনে এসে হাজির। দেখতে পেলাম বাচচা মেয়েটির সাথে পিছন পিছন আরো দুজন, একজন ভদ্রলোক আর একজন ভদ্র মহিলা। বাচচা মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘প্রদীপ আংকেল তুমি কেমন আছো? এতোদিন কোথায় ছিলে? আমি তোমাকে কত খুঁজেছি।’ আমি অবাক হয়েছিলাম তার মুখ থেকে এসব কথা শুনে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমার এই মুহূর্তে কি করা উচিত কিংবা কি বলা উচিত এমন চিন্তা মাথায় ভর করল।
কি একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলাম। এরকম পরিস্থিতি আগে কখনো আসেনি চলার পথে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কে? তোমার নাম কি? কথাগুলো শুনে মেয়েটি হাসতে হাসতে তার আম্মুর কাছে চলে গেল। সে তার আম্মুকে বলছিল, ‘আম্মু প্রদীপ আংকেল এসব কি বলছে? আমার নাম জিজ্ঞেস করছে কেন? আংকেল আমার সাথে এমন করছে কেন? ও বুঝেছি আংকেল আমার সাথে মজা করছে তাইনা আম্মু।’ ভদ্রমহিলার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ার উপক্রম হল। এরপর ভদ্রলোকটি আমার কাছে এসে বললেন, ‘ভাই দুঃখিত। আপনি কিছু মনে করবেন না আমার মেয়েটি এখনো অসুস্থ। একটা ঘটনায় সে মেন্টালি ডিজঅর্ডার হয়ে পড়েছে।’ লোকটি তার পরিচয় দিলেন।

লোকটির নাম মজিবুল ইসলাম। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে চাকরি করেন। আর ভদ্রমহিলা তার স্ত্রী। তিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা। আমি আমার পরিচয় দিলাম। লোকটি আমাকে আরো কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু পরক্ষণে কি মনে করে থেমে গেলেন। এরপর আমি কোনো কিছু বলার আগেই বাচচা মেয়েটি এসে আমার হাত ধরে তার আববুকে বলছে, ‘আববু, প্রদীপ আংকেল আমাকে না চেনার ভাণ করছে।’ তুমি আংকেলকে বলে দাও, আমি কিন্তু মাইন্ড করবো।’’ আমি এমন বিব্রতকর অবস্থায় এর আগে কখনো পড়েনি। কি একটা ঝামেলা এসে পাছে জুড়ে বসে সে চিন্তায় আমি দ্রুত সরে পড়তে চাইলাম। কিন্তু হলো তার উল্টো। মজিবুল সাহেবকে বললাম ভাই আমার একটা জরুরী কাজ আছে আমি এখন যাই। একথা শোনামাত্রই বাচচা মেয়েটি কান্না শুরু করে দিল। তারপর ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা আমাকে ইশারায় কি বলতে চাইলেন আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু একটু একটু আন্দাজ করতে পারছিলাম। লোকটি আমার আরো কাছে এসে বললেন, ‘আমার মেয়ের নাম সুমি। আমার একটি ছোট ভাই মানে সুমির আংকেল ছিল দেখতে প্রায় আপনার মতো, তাছাড়া আপনার গায়ের টি শার্টটি আর পরর্ণের জিনস্ ওর আংকেলের মতো, সে তাকে আদর করে ‘সুমু’ বলে ডাকতো।’ আপনি কিছু মনে না করলে তাকে একবার সুমু বলে ডাকবেন? এতে সে অনেক বেশি খুশি হবে।’ আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না এখন আমার কি করা উচিত বা কি বলা উচিত। আমি মেয়েটিকে সুমু বলে ডাকতেই সে কান্না থামিয়ে দিল। দৌড়ে আমার হাত ধরে বলতে লাগলো, ‘চলো আংকেল আমরা সবাই মিলে আজ রেষ্টুরেন্টে খাবো। কত দিন আমি তোমার সাথে খাইনা । এরপর বাসায় গিয়ে তুমি আমাকে ইন্টারেস্ট্রিং স্টোরি শোনাবে।’ আমি কি করবো চলে যাবো না আরো কিছুক্ষণ থাকবো এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। এ দিকে দেরি হওয়ায় ভাই আমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে যা তাড়া করছিল। এরপর ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক আমাকে তাদের সাথে রেষ্টুরেন্টে যেতে অনুরোধ করলেন। আমি অগত্য উপায় না দেখে শুধু বুঝাতে চেষ্টা করছিলাম কিভাবে এটা সম্ভব? মেয়েটির কি সুন্দর হাসিমাখা কচি মুখ, মায়াবী চেহারা, কোমল কালো দুটি চোখ, মিষ্টি চাহনি, চমৎকার বাচনভঙ্গি, দেখে মায়া লেগে গেল। কেননা আমার বড় আপুরও মেয়ে আছে তার বয়স এখন ৮ বছর। বাসায় যখন যায় সে যদি জানতে পারে আমি এসেছি ব্যস সে আমার কাধে চড়বে, আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে তার বই, খাতা, কলম, পেন্সিল, নতুন জামা-কাপড় সবকিছু দেখাবে। সে যা যা করেছে সব কিছু এক এক করে বলবে, দেখাবে। যাহোক বাচচা মেয়েটির কথাবার্তায় আমার একদমই মনে হয়নি সে মেন্টালি ডিজঅর্ডার। রেষ্টুরেন্টে সুমু আমাকে পাশে নিয়ে বসলো। পরে জানতে পারলাম, সুমু ছিল একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। সে পড়াশুনায়ও ভালো ছিলো। বাবা-মায়ের একমাত্র সস্তান। এরপর ভদ্রমহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি খাবেন’? আমি উত্তরে বললাম,‘আমি কিছু খাবোনা’। কথাটি শুনামাত্রই সুমি আবারও কান্না শুরু করে দিল। একি বিপদে পড়লামরে বাবা। এদিকে ভাই আমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘সুমু মা মনি এইতো আমি জুস খাবো। এবার খুশিতো? আমি জানতাম না সুমু জুস খুব পছন্দ করে’। কথাটি শুনে সুমি আমার হাতে চিমটি কেটে হাসতে লাগলো।

 

তারপর জুস খেতে খেতে মজিবুল ভাইয়ের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনলাম। সবকিছু শুনে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। প্রদীপ পড়াশুনা করতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে ছুটিতে প্রায় বাসায় আসত। আসার সময় সুমির জন্য অনেক রকম উপহার সামগ্রী কিনে নিয়ে আসতো। সুমি তাকে অনেক বেশি পছন্দ করতো, ভালোবাসতো, মিষ্টি কণ্ঠে সে তার আংকেলকে ডাকতো, হাসাতো। প্রদীপও সুমিকে অনেক বেশি আদর করতো, কখনো তার সাথে খেলতো, কখনোবা গল্প, গান. কবিতা-ছড়া, কৌতুক বলে শুনাতো। কখনোবা গানের তালেতালে তার সাথে নাচতো। সে আদর করে তাকে ‘সুম’ু বলে ডাকতো। কখনোবা প্রদীপ সুমিকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেত পার্কে, চিড়িয়াখানায় ও ঐতিহাসিক কোন স্থানে। ‘গত পাচ মাস আগে প্রদীপ এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সড়ক দুর্ঘটনার পর প্রদীপকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমরা সবাই সে সময় উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েছিলাম। সুমি হাসপাতালে যখন তার আংকেল দেখেছিল তখন প্রদীপ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। নাকে অক্সিজেনের নল, সমস্ত শরীরে ব্যান্ডেজ, হাতে স্যালাইনের নল লাগানো ছিল। সুমি তার এ অবস্থা দেখে মানসিক ভাবে ভয় পেয়েছিল। তাছাড়া প্রদীপের মৃত্যুর পর তার বিমর্ষ লাশও দেখেছিল সুমি। এতে সে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল তা আমরা বুঝতে পারেনি।’ তারপর থেকে সে মেন্টালি ডিজঅর্ডার হয়ে পড়ে। ডাক্তারের  পরামর্শে তাকে আমরা সুস্থ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচিছ।’ কথাগুলি বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন মজিবুল ইসলাম। লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সে সুখে নেই, নেই শান্তিতে তার পরিবার। যাহোক সুমুকে নিয়ে আমি তার পছন্দের কিছু গ্রিফ্ট কিনে দিলাম। অনেক কৌশলে চলে আসতে হয়েছিল সেদিন আমাকে।

আসার সময় সে আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো, ‘আংকেল তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো আমি তোমার কাছ থেকে ইন্টারেস্ট্রিং স্টোরি আর সং শুনবো।’ মজিবুল সাহেব তার বাসায় আসার জন্য দাওয়াত দিলেন। আমি সুমুর মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে তার বাবা মায়ের কাছে রেখে চলে এলাম। ভাবছি আর ভাবছি, একটা দুর্ঘটনা, একটা মৃত্যু, একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে পড়া, একটা পরিবারের সুখ-শান্তি নষ্ট……। তারপর অনেকদিন হয়ে গেছে। আর যাওয়া হয়নি সুমুদের বাসায়। তাকে শুনাতে পারেনি কোনো মজার গল্প কিংবা কোনো মজার গান। সুমুর কথাগুলি আজও আমার মনের মধ্যে নিস্তব্ধ স্মৃতি হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

আরো পড়তে পারেন...

রাখী — সিক্তা দাস

“দিদি, দাও না বানিয়ে, আর ত মাত্র কয়েকটা দিন” সামনের সোমবারই রাখীপূর্ণিমা। মিমির একটাও রাখী…

অধ্যাপক-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রথম পরিচ্ছেদ

কলেজে আমার সহপাঠীসম্প্রদায়ের মধ্যে আমার একটু বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। সকলেই আমাকে সকল বিষয়েই সমজদার বলিয়া…

রক্তাক্ত শৈশব”—শুচিস্মিতা দাস

ছোট্ট চারাগাছ টা ধীরে ধীরে ডাল পালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠছে। পাতা গুলো সবুজ, আরও সবুজ…