নিরন্তর—জোবায়ের রাজু

মাঝরাতে হুটহাট ঘুম ভেঙে যাওয়ার একটা বাতিক আছে আমার। আজো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। ব্যালকনির মৃদু আলোয় আবছায়া আমার ঘর। ঘুম ভাঙার পর আমি চমকে উঠলাম। কে যেন আমার ঘরের দরজার ওপারে ঠায় দাঁড়িয়ে। তার মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আমার ভয় করছে। এমনিতে শুনেছি আমাদের বাড়িতে নাকি ভূত-প্রেতের আসর আছে। এটা ভাবতেই এই রাতে ভয়ে গা আরো হিম হয়ে এলো। চিৎকার দেয়ার আগে মিহি গলায় প্রশ্ন করলাম- ‘কে ওখানে? কে?’ ওপার থেকে আমার বাবা আবু হাসানের কণ্ঠস্বর- ‘আমি। তোর বাবা। ভয় পেলি আবিদ?’ আমার আতঙ্কিত গলার প্রশ্ন- ‘বাবা, তুমি? এত রাতে এখানে কেন? কী করছ?’ বাবা হাসির অভিনয় করে বললেন- ‘তোকে দেখতে এলাম। ঘুমন্ত তোকে দেখতে বড় ভালো লাগে।’ বাবার কথা শুনতে পাইনি, এমন ভঙ্গিমায় বললাম- ‘যাও শুয়ে পড়ো। সকালে অফিসে যাবে তো।’ আবছায়ায় আমি দেখতে পেলাম- বাবা শিশুর মতো দুলতে দুলতে নিজের ঘরমুখী হলেন।
আমার ঘুম ভাঙল। রাত তখন সাড়ে তিনটা। আকস্মিক আমার মনে হলো, পাশের ঘর থেকে বাবার উঁচুগলার কথা আসছে। এত রাতে বাবার ঘরে কে? আমাদের এ বাড়িটা সত্যি সত্যি ভৌতিক হয়ে যাচ্ছে না তো?
বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ভয়ে ভয়ে বাবার কাণ্ড দেখতে যাচ্ছি। সেগুনের দরজা খুলে উঁকি দিলাম বাবার ঘরে। টিউব লাইট জ্বলছে। বাবা বেতের চেয়ারে বসে টেলিফোনে কার সাথে কথা বলছেন- ‘আসতে চাও মানে? আমায় চোখ দেখাতে তোমার লজ্জা করবে না? দেখো শবনম, আমাকে আর কল করবে না। জানতেও চাইবে না। আমার আবিদ কেমন আছে। আমার জীবন থেকে তোমার সব স্মৃতি মুছে ফেলেছি। আবিদেরও মা লাগবে না। আমি ওকে মায়ের মমতায় বড় করে তুলেছি। কী? তুমি একদিন হুট করে এখানে আসবে? খবরদার বলছি, শবনম। হ্যালো… হ্যালো…।’ আমি অবাক হলাম। মা তাহলে বাবাকে কল করেছেন? আমার মাথা ঘুরে আসছে। এতটা কাল পর মায়ের ফোন?
-বাবা, কার সাথে কথা বললে? মা?
-ইয়ে মানে…। আ… আবিদ!
-বলো, বাবা। মা ফোন করেছেন?
-হুঁ।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এই মাঝরাতে এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াটা আমার কল্পনাতীত। বহু বছর আগে, যে মা আমাকে আর বাবাকে ফেলে চলে গেছে, সেই মায়ের সাথে বাবার যোগাযোগ আছে? ‘তোর মা চার দিন আগে আমায় চিঠি লিখেছে।’ বাবার মরা গলার এমন কথা শুনে আমি ছট করে বললামÑ ‘কই চিঠি? দেখি?’ বাবা ধীরে হেঁটে আলমারি থেকে চিঠি বের করে এনে আমার হাতে দিলেন।
‘প্রিয় হাসান, কেমন আছো? এত বছর পর আমার চিঠি পেয়ে অবাক হলে? তোমাকে তো আর ভুলতে পারলাম না। যে বিধর্মী শ্রীকান্তের সাথে জড়িয়ে তোমাকে আর আমার চার বছরের ছোট্ট আবিদকে ফেলে চলে এলাম, সেই শ্রীকান্তই একসময় আমার সাথে প্রতারণা করল। সে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। ভালো বেসেছে আমার রূপ-সৌন্দর্য। আমাকে এসিড মেরে মারতে চেয়েছে। অনেক ঘটনার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আমি শ্রীকান্তের থেকে সরে দাঁড়ালাম। হাসান, আমি তোমার কাছে আবার আসতে চাই। আমার আবিদকে দেখতে চাই। ও কত বড় হলো? নিশ্চয়ই এবার কলেজে পড়ে? তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে? তোমার অফিসের কলিগ জহির ভাইয়ের কাছ থেকে আমি তোমার সব খবর রাখি। তোমার ফোন নাম্বার তার কাছ থেকে নিয়েছি। যেকোনো সময় তোমায় কল করব। যেকোনো সময় তোমার দুয়ারে এসে আমার সাজানো সেই সংসার ভিক্ষা চাইব। আশা করি তুমি আমায় নিরাশ করবে না।’
চিঠি পড়া শেষ না হতেই বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে মাতালের মতো কাঁদতে লাগলেন- ‘ও আবিদ, তোর আর আমার জীবনটা এমন হয়ে গেল কেন রে, বাপ?’
ভোর বেলা। এই সময়ে কলবেল বাজল। আমার এই বাইশ বছর জীবনে কখনো এত ভোরে আমাদের কলবেল বাজতে দেখিনি।
ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখি, বাইরে বিশাল এক লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মেরুন কালারের সুতির শাড়ি পরা আশ্চর্য রূপের এক ভদ্র মহিলা। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। কাঁপা গলায় বললেন- ‘তুমি আ…আবিদ?’ আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াতেই তিনি পাগলের মতো ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। একি কাণ্ড! ঘুমকাতর চোখে বাবা ছুটে এলেন। ভদ্র মহিলার কাণ্ড দেখে বাবা নিথর গলায় বললেন- ‘শবনম, তু… তুমি?’
ভদ্র মহিলা আমার মা, এটা জেনে আমার তেমন আগ্রহ জন্মায়নি। অথচ এই অদেখা মাকে একসময় কতনা কল্পনা করেছি। কল্পনায় তার মুখ বহুবার মানসপটে এঁকেছি। কিন্তু আমার সেই কল্পনার মায়ের ছবির সাথে এই মহিলার চেহারার কোনো মিল নেই। আমি তৃষিত চোখে আমার বহু দিনের অদেখা মাকে দেখছি। দেখছি তার চোখেমুখে মাতৃস্নেহের কোনো ছাপ আছে কি না। তার সোনালি ফ্রেমের চশমা ভিজে একাকার।
মায়ের ফিরে আসায় বাবার যতটা ক্ষোভ দেখানোর কথা ছিল, বাবা ততটা ক্ষোভ তো প্রকাশই করেনইনি, বরং সবকিছু খুব সহজে মেনে নিলেন। মায়ের ফিরে আসাতে বাবার মনে হলো তার পুরনো দিনগুলোও ফিরে এসেছে। কিভাবে আমাকে বড় করেছেন, কিভাবে তার স্মৃতিগুলো বুকে আগলে রেখে দিন কাটিয়েছেন, সব ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। মা সোফায় বসে মাথা নিচু করে বাবার গল্প শোনেন আর নীরবে চোখের জল ফেলেন। মায়ের এই চোখের জল আমাকে স্পর্শ করে না। এত দিন কোথায় ছিল এই জল?
ক’দিনের মধ্যে আমাদের বাড়ির পরিবেশ বদলে গেল। মা তার পুরনো সংসার গুছিয়ে তুললেন। বাবার সেই দুঃখী দুঃখী মুখটা এখন আর দেখি না। আমি আগের মতো রাতভর ফেসবুকের দুনিয়ায় ডুবে থাকি।
আজ ফেসবুকে ঢুকতেই প্রতিদিনের মতো ‘মেঘ বালিকা’ নামের আইডি থেকে আমার ইনবক্সে মেসেজ- ‘আজ আপনি সাদা শার্ট পরে ভার্সিটিতে এসেছেন কেন? সাদা শার্টে আপনাকে বুড়ো বুড়ো লাগে। আর কখনো সাদা শার্ট পরবেন না। মনে থাকবে তো?’ মেসেজের রিপ্লাই দিলাম- ‘আচ্ছা, তুমি কি কখনো তোমার নাম বলবে না? এভাবে আড়ালে থাকো কেন? আমি কি কখনো তোমাকে জানতে পারব না?’ মেসেজ সেন্ট করার আধা মিনিট পর মেঘ বালিকার জবাব- ‘ভার্সিটির সবচেয়ে কালো মেয়েগেুলোর মধ্যে আমি একজন। চিনলে আপনি আর কখনো আমাকে মেসেজ লিখবেন না। কালো মেয়ে বলে অবহেলা করবেন। তার চেয়ে বরং আমি আড়ালেই থাকি। জানেন, কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো ছাদে গিয়ে আপনার সাথে একটু জলে ভিজতে।’ ফেসবুকে এলে মেঘ বালিকার এসব মেসেজে আমি এলোমেলো হয়ে যাই। কে এই মেয়ে? প্রায় দুই মিনিট পর মেঘ বালিকাকে রিপ্লাই দিই- ‘এসব কবি কবি কথা রাখো। নাম-ঠিকানা বলো। কালো মেয়েদের ঘৃণা করব কেন? আমি কালো-ফর্সা বিচার করি না।’ মেঘ বালিকার মেসেজ-‘আপনি এত সুন্দর করে কথা বললে আমি আরো ব্যাকুল হয়ে যাই। জানেন, ফেসবুক থেকে আপনার সবগুলো ছবি আমি ডাউনলোড করে রেখেছি।’
মেঘ বালিকা আমার মতো একটা হাবাগোবা টাইপের ছেলেকে এত পাগলের মতো ভালোবাসতে গেল কোন দুঃখে, আমি বুঝি না। গত ক’মাস ধরে নাম-পরিচয় গোপন রাখা এই মেয়ে আমাকে মেসেজের মহাসাগরে ডুবিয়ে রাখে। বহু চেষ্টা করেও আমি তার পরিচয় জানতে পারি না। আচ্ছা, ভার্সিটির কোন কালো মেয়েটি হতে পারে এই মেঘ বালিকা? কেয়া? স্বর্ণা, নাকি সেঁজুতি? কিন্তু তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ নামে তো ফেসবুক আইডি আছে। মেঘ বালিকা কি চিরকাল আমার কাছে অচেনা হয়ে থাকবে?

আজ বাসায় কেউ নেই। আমি একা। মা-বাবা দু’জনেই গেছেন ছোট চাচার বাসায়। এমন সময়ে কে যেন বাসায় এলো। ভদ্রলোকের বেশভূষা দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি হিন্দু ধর্মালম্বী। পরনে সাদা ধবধবে ধুতি। চেহারা বেশ ভালো। ভরাট গলায় প্রশ্ন করলেন- ‘তুমি আবিদ, তাই তো?’ আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াতেই বললেন- ‘তোমার মা বাসায় আছেন? বাবা কোথায়?’ নিচু গলায় জবাব দিলাম- ‘উনারা ছোট চাচার বাসায় গেছেন। সন্ধ্যার পর ফিরবেন।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভদ্রলোক বললেন-‘তুমি একটা কলম আর কাগজ আনো তো?’
সোফায় বসে ভদ্রলোক বেশ সময় নিয়ে কাগজে কী যেন লিখে সেটি ভাঁজ করে আমার হাতে দিয়ে বললেন- ‘এটা তোমার মা এলে তাকে দিয়ো।’ ভদ্রলোক চলে গেলেন। উনি কে, আর কেনই বা মাকে চিঠি লিখলেন- এমন আগ্রহ নিয়ে আমি চিঠিখানা চোখের সামনে মেলে ধরলাম। অসুন্দর হাতের লেখায় তিনি লিখেছেন- শবনম, তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। একজন বিধর্মী হয়েও তোমার সুখের সংসার আর হাসান ও ছোট্ট আবিদের কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে আমি পাপ করেছি। হয়তো এই কারণেই ভগবান আমার ক্যান্সার রোগ দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে তোমার কাছে ক্ষমা না চেয়ে পারলাম না। আশা করি আমাকে ক্ষমা করবে। ইতি- শ্রীকান্ত ব্যানার্জি।
না, এই চিঠি মায়ের হাতে যাবে না। শ্রীকান্ত ব্যানার্জি এখন মায়ের জীবনের অতীত স্মৃতি। স্মৃতি সব সময় বেদনার। আমার মায়ের সেই বেদনা আবার জেগে উঠুক, এ আমি চাই না।
আমি চিঠিখানা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিলাম। ওই তো, বাতাসে উড়ে যাচ্ছে চিঠিতে করে শ্রীকান্ত ব্যানার্জির শেষ কথাগুলো, যিনি আমার বাবার সংসার ভেঙে মাকে প্রতারকের মতো এই ঘর থেকে একদিন বের করে নিয়েছেন।

দুঃখিত!