জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে নির্মম ঘটনার কথা মনে পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে খোকন। কী এমন অপরাধ তার যে কারণে এতো অল্প দিনে নিয়তি তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল। জীবনের এরকম করুণ পরিণতি নিরবে নির্ভৃতে অসহায়ের মতো মেনে নিতে হবে- একথা ভুলেও ভাবেনি সে। খোকন সবেমাত্র পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে। বি.এ পাশ। বেসরকারী কোম্পানীতে সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। ঢাকাতেই থাকে। চাকরি পাওয়ার পর বাড়িতে যাওয়া হয় না বেশ কিছুদিন। আগে থেকেই ইচ্ছে ছিলো একবারে কুরবানীর ঈদেই বাড়ি যাবে।
কিন্তু তা আর হলো না। একমাস আগেই বাড়িতে যেতে হলো। সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বিয়ে। তাই না গিয়ে তার আর করারও কিছু ছিলো না। হাজার হোক জাহিদুলের বিয়ে বলে কথা। সেই ছোটবেলা থেকে যার সাথে ওঠা বসা তার বিয়েতে খোকন যাবে না ভাবাই যায় না। নতুন চাকরি পাওয়ার পর এই প্রথম বাড়িতে আসা। একবারে ঈদে বাড়িতে আসলে যেভাবে হাতটা গরম থাকতো একমাস আগে চলে আসায় তা আর সম্ভব হলো না।
তারপরও যথাসম্ভব হাতটা একটু গরমই থাকলো তার। ঢাকায় আসার পর যে মানুষটাকে সব সময় কাছে পেয়েছে, খোকনের পথ চলার গতি একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। বিপদে আপদে যে মানুষটা সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেই মানুষটার নাম সেলিম। বাড়িতে আসার সময় সেলিমকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ব্যর্থ হলেও বাড়তি কিছু টাকা আনতে ব্যর্থ হতে হয়নি তাকে। সেলিম আগে থেকেই ঢাকায় থাকে। টাকা-পয়সা ওয়ালা বাড়ির ছেলে সে। খোকন, সেলিম আর জাহিদুল একই সাথে শফিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস,এস,সি পাশ করে। পরে একেক জন এক এক জায়গায় চলে যায়। ঢাকাতে আসার আগেই খোকন সেলিমের সাথে যোগাযোগ করে এসেছিলো।
খোকনের চাকরি পাওয়ার পেছনেও যে সেলিমের অসামান্য অবদান বিদ্যমান তা খোকন কখনোই অস্বীকার করে না। জাহিদুলের কথা মতো খোকনের শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাসর ঘরটা নিজ হাতে সাজাতে পারলোনা সে। ঠিক বিয়ের দিন সকালে গিয়ে পৌঁছায়। বিয়ের আগের দিনই বাসর ঘর সাজানোর কাজ সম্পন্ন করেছে জাহিদুলের চাচাতো-মামাতো ভাই-বোনেরা। তবে খোকন যদি উপস্থিত থাকতো তবে এ দায়িত্ব তার কাঁধে এসেই পড়তো। চাকরি-বাকরী করা মানুষ ছুটি-টুটির ব্যাপার থাকে আর এই ভেবেই জাহিদুল মনে প্রশান্তি পেল। দু’দিন আগে না আসায় তেমন কিছুই মনে করেনি। বরং তার বিয়েতে খোকন আসতে পেরেছে এটাই জাহিদুলের অনেক বড় পাওয়া। এই জাহিদুলের বাড়িতে খোকন কত এসেছে, থেকেছে তার হিসেব কারোরই জানা নেই। শফিপুর গ্রাম থেকে নলডাঙ্গা গ্রাম খুব বেশি দূর না হলেও বর পক্ষ তাড়াতাড়িই যাত্রা আরম্ভ করলো।
বিয়ে-টিয়ের ব্যাপার শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলা ভালো, মুরববীদের একথার প্রতি শ্রদ্ধা রাখাটাও সবার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। দুপুরের আগেই বরপক্ষ কনে পক্ষের বাড়িতে হাজির। প্রাথমিকভাবে নাশতা পর্ব সেরে বিয়ের মূল পর্ব শুরু হলো। নলডাঙ্গা গ্রামে জাহিদুলের বিয়ে একথা আগেই জেনেছিলো খোকন। কিন্তু তার খালাতো বোনদের বাড়ির একেবার পাশে তা তার জানা ছিলো না। মনে মনে খুশিই হলো খোকন। বিয়ে বাড়িতেই খালাতো বোন মরিয়মের সাথে দেখা। পেছন ফিরে তাকাতেই খোকনের খালার সাথে দেখা। কুশল বিনিময় শেষে কিছুটা অনুযোগের সুরেই মরিয়ম খোকনকে বলে বসলো, -কি ব্যাপার খোকন ভাই, চাকরি বাকরী পেয়ে ভুলে গেলে নাকি? -না রে ভুলিনি। তোদেরকে কি কখনো ভোলা যায়! আসলে….. খোকনের কথা শেষ না হতেই খোকনের খালা বলে, -তো খোকন চল্ বাবা আমাদের বাড়িতে যাই।
– না খালা, গিয়ে আর কিই বা করবো। এখানেই তো সবাই আছে। তোমরাও থাকো। বিয়ে পর্ব শেষ হতে আরও কিছু সময় বাকী। বিয়ে শেষ করেই খাওয়া দাওয়া সম্পন্ন হবে। এরি মাঝে জাহিদুলের চাচাতো ভাইয়েরা খোকনকে ধরে বসলো তারা কনে দেখতে যাবে। কিন্তু তা কখনোই সম্ভব না। তবে সহযোগী হিসেবে মরিয়মের বিকল্প আর কে হতে পারে। আর এ এলাকা খোকনের কম বেশি পরিচিত। খোকন ছোটবেলা গ্রীষ্মকালে চলে আসতো আম কাঁঠাল খেতে। গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিলো খালা বাড়ি। -এই মরিয়ম চল্ বউ দেখে আসি। বরের ছোট ভাহয়েরা ভাবী দেখবে। -এখনো তো বিয়ে হয়নি, বউ দেখানো যাবে না। কিছুটা রসিকতার ছলে বললো মরিয়ম। অবশেষে খোকনের জোরাজুরিতে মরিয়ম তাদের এক হবু ভাবী দেখাতে নিয়ে গেল। খোকনও গেল সাথে। ঘর থেকে বের হবার পর খোকন মরিয়মকে ডেকে বললো, -এই মরিয়ম, বউয়ের বামপাশে বসেছিলে ওই মেয়েটা কে রে? -ও মোহ্রিন। আমাদের সাথে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বউয়ের ছোট বোনের বান্ধবী।
খোকন সবসময়ই সহজ সরল একটি ছেলে। মেয়েদের সাথে কীভাবে গুছিয়ে কথা বলতে হয় তাও তার জানা নেই। অথচ মোহ্রিনকে দেখে খোকনের ভালো লেগে যায়। মনের ক্যানভাসে স্বপ্নের রং তুলিতে অাঁকতে শুরু করে মোহ্রিনের ছবি। অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হয় তার মনের ভিতর। ভালো লাগার কথাটা জানানোর একমাত্র মাধ্যম মরিয়মকে ডেকে বলে, -আমি তো মেয়েটি পছন্দ করে ফেলেছি। বিয়ে করতে চাই। কিছুটা তামাসা করেই মরিয়ম খোকনকে বলে, -বা-বা, দেখেই ভালো লেগে গেল আর অমনি বিয়ে করে ফেললে। -আমি সিরিয়াসলি বলছি। তুই ওর পরিবারে কথা বল। তারপর আমাকে মোবাইল ফোনে জানাস। মোহ্রিন নামের মেয়ের ছবি হৃদয়ের ফ্রেমে অতি যত্নে বাঁধা হয়ে গেছে খোকনের। খোকন তো আর প্রচলিত প্রেমের জন্য তাকে পছন্দ করিনি বরং বিয়ে নামের বৈধ সনদে বেঁধে জীবন সঙ্গী করতে চায়। তাই দোষের কিছু আছে বলে সে ভেবে পায়না। ঢাকায় চলে আসার পর শত কর্মব্যস্ততায়ও মোহ্রিনের অশরীরী আত্মা ভর করতে থাকে খোকনের উপর। স্বপ্নিল সংসার বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হতে থাকে তার ভিতর, তার বাহির। আর সম্মতিসূচক মন্তব্য পাবার আশায় মরিয়মের ফোনের প্রতীক্ষায় থাকে। একদিন সকালে অফিসের যাওয়ার প্রস্ত্ততি চলছে ঠিক এরক সময়ে খোকনের মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইল স্ক্রিনে অন্য কোনো নম্বর ভেসে উঠলে নিশ্চিত কলটা কেটে দিত কিন্তু এ যে মরিয়মের কল! সাথে সাথে রিসিভ। -হ্যালো, কি খবর মরিয়ম? উৎসুক কণ্ঠে খোকনের কথা। -খবর ভালো।
তোমার জন্য সুখবর আছে। খোকনের বুঝতে বাকী থাকার কথা নয়। যে কথাটা ছটফট করতো সে কথা বলার ইঙ্গিত কী আর খোকন না বুঝে পারে! -কি সুখবর? -মোহ্রিন তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এর বেশি আর কথা বলতে পারলোনা খোকন। অফিসে যেতে হবে। তিন দিন পর। শুক্রবার। খোকনের অফিস বন্ধ। শুক্রবারটা সারাজীবন নিজের মতো করে কাটায় সে। সকালের নাশতা শেষ করে মরিয়মের কাছ থেকে মোহ্রিনের মোবাইল নম্বরটা জোগাড় করলো সে। শেষ যেদিন মরিয়মের সাথে তার কথা হয় এতো ব্যস্তই ছিলো যে সে সময় নম্বরটি জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। শুরু হলো মন দেয়া-নেয়ার পর্ব। আর এখান থেকেই যে খোকনের জীবনের নির্মম একটি মুহূর্তের শুরু হবে তা কখনোই তার জানা ছিলো না। আস্তে আস্তে জীবনের সব হিসাব নিকাষ পাল্টে যেতে থাকে। এভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন।
মোহ্রিনকে নিয়ে স্বপ্নের বাসর গড়তে থাকে খোকন। মোহ্রিনের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যায় সে। জীবনের সব চাওয়া পাওয়া এখন তাকে নিয়েই। মাকে ও জানিয়েছে মোহ্রিন নামের একটি মেয়েকে তার খুব পছন্দের। বাবা-মরা একমাত্র ছেলের পছন্দের দামটা বিধবা মায়ের কাছে সবসময়ই অমূল্যের। খুব ছোটবেলায় বাবা হারায় খোকন। বিধবা মা তিলে তিলে মানুষ করেছেন ছেলেকে। বাবার ভালোবাসা আর মায়ের মমতা সবটুকুহ ওই মার কাছেই পেয়েছে খোকন। চাকরী পাওয়ার পর মা যে তার কত খুশি হয়েছিলেন তা নিজেও জানে না খোকন। তার পছন্দ-অপছন্দ সব মাকে ঘিরেই। মা ছাড়া তার আর কেইবা আছে! বাবা মারা যাওয়ার পর মামারাও তেমন খোঁজ খবর নিত না।
যা একটু করতো খোকনের বড় খালা মরিয়মের মা। আর তাই মোহ্রিনের ব্যাপারটা মাকে না বলে বেশিদিন থাকতে পারলো না খোকন। মা যে এতে দ্বিমত করবে না তা তার আগে থেকেই জানা। মা তার আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছেন, জীবনে যা-ই করিস সব সময় ভেবে চিন্তে করিস। নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখবি সবসময়। ঈদের আর বাকী নেই। দু’সপ্তাহ পরেই ঈদ। কত কাজ! কেনা কাটা করতে হবে। তাছাড়া চাকরি পাওয়ার পর প্রথম ঈদ। বাড়ির প্রতিবেশী দাদী, চাচাদের জন্যও তো কিছু নিতে হবে। তাছাড়া গ্রামের সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তির অন্যতম প্রতিবন্ধী বোরহান আগে থেকেই বলে রেখেছে, -ভাই তুমি চাকরি পাওয়ার পর আমার জন্য একটু….. এ কথাও ভুলতে পারেনি সে। কিন্তু এতো কথার ভিড়ে সবচেয়ে বেশি যে কথাটি বারবার তাকে নাড়া দেয় মোহ্রিনের কথা। তাকে যে বিশেষ কিছু না দিলে অধিকার আদায়ে সংকীর্ণতা থেকে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বাম চোখে যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা আরম্ভ হলো। বেশ ক’দিন ধরেই চোখটা লাল। কাজের ব্যস্ততায় সেরকম খেয়াল করেনি সে। খোকনের অস্ফুট ইতস্ততার কথা শুনে পাশের রুম থেকে সেলিম ছুটে আসলো। -কিরে, কি হলো? কৌতুহলী কণ্ঠে সেলিমের জিজ্ঞাসা।
-না, মানে, হঠাৎ চোখে পেইন করতেছে। ক’দিন ধরে অবশ্য চোখটা লাল। রাতের বেলা আশে পাশে চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা না থাকায় ঠান্ডা পানি দিয়ে ভালোভাবে চোখ ধো ছাড়া কিছু করার ছিলো না। বারবার চোখে পানি দেওয়ায় কিছুটা সস্ত্বি আসলো। সকাল সকাল সেলিমকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে রওনা দিলো খোকন। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিয়ে খোকনকে জানালো, -আপনার চোখের কন্ডিশন ভালো না। দ্রুত ভালোভাবে চেকআপ করিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিতে হবে। আপাতত এগুলো ব্যবহার করুন। -জ্বি, আচ্ছা। চোখের ড্রপ ব্যবহার আর ওষুধগুলো নিয়মিত খাওয়াতে এক সপ্তাহের মধ্যে চোখ ভালো হয়ে গেল। আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। ঈদের দু’দিন আগেই বাড়ি চলে গেল খোকন। খালাদের বাড়িতে ঈদের আগের দিন যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মা যেতে দেয়নি। তবে ঈদের পরের দিন যাওয়ার সম্মতি ছিলো মার। বহুদিন পর নলডাঙ্গা গ্রামে খোকনের আসা। সবকিছু কেন যেন অন্য রকম লাগছে। ভিতরটার মধ্যে নতুনত্বের আবর্তনে ওলোট-পালোট লাগছে। রঙে রঙিন হয়ে উঠছে হৃদয়াঙিনা। এর আগে মোহ্রিনই তার মার সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দেয় খোকন। তাই খোকনের মোহ্রিনকে পাওয়ার বাসনাটা বেড়ে ওঠে বহুগুণে।
খালাবাড়ি এসে কুশল বিনিময় করেই মরিয়মকে সাথে করে চলে যায় মোহ্রিনদের বাড়িতে। বাড়িতে মোহ্রিন, মোহ্রিনের মা আর ছোট ভাই শিমুল। বাবা নাসির উদ্দিন ব্যবসার কাজে প্রায়ই বাড়ির বাইরে থাকেন। ঈদে বাড়িতে আসলেও ছোট-বেলার বন্ধু শফিউলের সাথে দেখা করতে তার বাসায় গেছেন। আজ নাও আসতে পারেন। খোকনকে যে হবু জামাই হিসেবে মোহ্রিনের মা মেনে নিয়েছে তা শুধু খোকন নয়, খোকনের খালা-খালু, মরিয়ম সবারই জানা হয়ে গেছে। ঘণ্টা দু’য়েক খোকন অবস্থান করেছিল। পরে মরিয়মদের বাড়িতে চলে আসে। প্রিয় কোনো মূল্যবান কিছু যেন রেখে যাচ্ছে খোকন, মোহ্রিনদের বাড়ি থেকে বিদায়বেলায় এরকমটিই ভাবতে ছিলো সে। ক’দিন পরেই তো নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে তাকে এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো খোকন। এর মধ্যে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে পারতো সে। বাধ সাধলো মোহ্রিনের মা। -ওর এইচ.এস.সি পরীক্ষাটা হয়ে যাক তারপরই সব দেখা যাবে। এরকম আশ্বাসের বাণী দিয়েই আটকে রেখেছে মোহ্রিনের মা। সে আশায়ই বুক বেঁধে আছে খোকন; খোকনের মা ও উন্মুখ হয়ে আছে পুত্রবধূ দেখার আশায়।
ঢাকায় এসে আগের মতো কর্মব্যস্ত দিনে ফিরে এসেছে খোকন। শত ব্যস্ততায় মায়ের খোঁজ নিতে ভুল হয়না তার। অনেক আগেই মাকে একটি মোবাইল কিনে দিয়েছে সে। তাই মার সাথে যোগাযোগ করার কোনো সমস্যাই হয়না। মোহ্রিনের সাথেও প্রতিনিয়ত কথা হয় তার। মাঝে মাঝে হবু শাশুড়ির সাথে কথা বলতেও ভুল হয় না তার। অথচ এতো কিছুরপরও খোকনের মন ভালো নেই। চোখের সেই সমস্যা আবার দেখা দিয়েছে। যখনই একটু সমস্যা দেখা দেয় তখনই আগের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করে অমনি ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এবার যে বিধি বাম ! ওষুধে কোনো কাজ হচ্ছে না। বরং চোখের অবস্থা আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। ও দিকে মা জানতে পেরে মার মনে অজানা ভয় কাজ করছে। একমাত্র ছেলে। কী জানি কী হয়! -খোকন, বাবা আমার, তুই তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যা। আগে যে ডাক্তারের কাছে দেখিয়েছিলি। কাল রাতে বলা মার এই কথাটা বারবার খোকনকে ভাবিয়ে তুলছে। শুক্রবার হাসপাতালে ঠিকমতো ডাক্তার না থাকায় সেলিমকে সাথে নিয়ে চলে যায় ডাক্তারের চেম্বারে। এ ক’দিনে খোকনের চোখের অবস্থা দেখে সেলিমও কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ডাক্তার দেখা মাত্রই খোকনকে উদ্দেশ্য করে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করতে থাকে। -আপনাকে না ঈদের পরপরই আসার কথা ছিলো! এতো দেরি হলো কেন? আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন। সেলিম ডাক্তারকে বুঝিয়ে বললো, -স্যার, মানে ব্যস্ত মানুষ তো! তাছাড়া দেহের প্রতি ওর একটু কমই মায়া। অনেকগুলো টেস্ট দিয়ে তাদেরকে পরের দিনই আসতে বলেন। রিপোর্ট দেখা মাত্রই ডাক্তারের মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল। -খুব একটা সমস্যা নেই। আপনি যান। খোকনকে উদ্দেশ্য করে ডাক্তার নরম গলায় বললেন। সেলিমকে ভেতরে থাকতে হলো আরও কিছুক্ষণ। এবারই সন্দেহ আর সংশয়ের দানা বাঁধলো খোকনের মনের ভেতর। ওদিকে ডাক্তার সেলিমকে সকরুণ কণ্ঠে বললেন, -রোগী আপনার কে? -বন্ধু। -আপনার বন্ধুর চোখে ইনফেকশন হয়ে প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে চোখের কর্ণিয়া। আগে থেকে হলে কিছু একটা করা যেত। কিন্তু ওই চোখের জন্য এখন আর করার কিছু নেই। তবে বাকী চোখটাকে বাঁচাতে হলে ওই নষ্ট চোখটাকে অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে। এ কথা শুনবার সাথে সাথে সেলিমের গা হাত পা অবশ হয়ে যেতে লাগলো। কী শুনলো সে? নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। সম্বিত ফিরে পেয়ে সেলিম বললো, -কেমন টাকা লাগবে? -শুধু অপারেশনে খুব বেশি….. ডাক্তারের কথা শেষ না হতেই সেলিম তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-স্যার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা….. হাত তুলে থামিয়ে দিলেন সেলিমকে। ডাক্তার বললেন, -এটাও যথাসম্ভব দ্রুত করতে হবে। নইলে….. -আসি স্যার। বাকী কথা শুনার প্রয়োজন বোধ করলো না সেলিম। চেম্বার থেকে বেরিয়ে সেলিমকে কেমন যেন বিমর্ষ লাগছিলো। -চল্ বাসায় গিয়ে সব বলবো। খোকনের কিছু বলার আগেই সেলিম বললো কথাটি। কথা গুলো শুনার সাথে সাথে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে খোকন। কী হলো তার! কী করে তার মাকে এ কথা জানাবে সে। সহমর্মিতার আশায় মোহ্রিনকে ফোন দিলো। কথাটা শুনার সাথে সাথেই কিছুটা নীরব হয়ে গেল মোহ্রিন। ফোনটাও কেটে গেল। মোবাইলে চার্জ না থাকায় সেদিন রাতে এর বেশি আর কথা হয়নি। সেলিমই সবাইকে বিষয়টি বলেছে। মাকেও ঢাকায় আনার ব্যবস্থা হয়ে গেল। সন্তানের চোখের অপারেশন এ কথা মাকে জানানো হলেও তার সন্তান যে ওই চোখে আর কোনো আলো ফিরে পাবে না তা বলা হয়নি। বলা হয়নি মোহ্রিন কিংবা তার মাকেও। অপারেশনের এক সপ্তাহ পর চোখ খোলা হলো। কিছুতেই বাম চোখ মেলতে পারছে না খোকন। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে খোকন। মাকে বলে, -মা, মাগো, আমি বাম চোখ খুলতে পারছিনা কেন? মা আমার বাম চোখ খুলে দাও। এতক্ষণে মা বুঝলেন। বাম চোখ খোলা থাকার পরও কেন তার বুকের ধন বারবার আকুতি করে বাম চোখের পাতা খুলে দেয়ায় কথা বলছে। মা ও তার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পাশে দাঁড়ানো সেলিম কি করবে ভেবে পায় না। তার জানাও নেই এখন তার কী করা উচিত।
পিছন থেকে পিঠের উপর হাত রাখতেই সেলিমকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে খোকন, -আমি কানা হয়েগেছিরে আমি…….। পৃথিবীর সবকিছু আমার কাছে অর্ধেক মনে হচ্ছে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা সেলিমের জানা নেই। তবু সহমর্মিতার কণ্ঠে বলে ওঠে, -কোনো কিছুই অর্ধেক হয়ে যায়নি। এই দেখ আমি, তোর মা আমরা সবাই আগের মতোই আছি। দেখ, দেখ- কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলতে থাকে সেলিম। বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। কোনো খোঁজ নেই মোহ্রিনের। ফোনে একটা কলমাত্র দেয়নি। এরই মাঝে খোকন নিয়তির নিষ্ঠুরতাকে মেনে নিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কী আর করা! ভাগ্যের লিখন কখনো খন্ডানো যায় না। ভাগ্যকে মেনে নিতে হয়, সবাই মেনে নেয়। খোকনও যে তার ব্যতিক্রম নয়। দিন আসে রাত যায়। এভাবেই চলতে থাকে খোকনের জীবন। মোহ্রিনও আগের মতো খোঁজ খবর নেয় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সম্ভব খোকনই ফোন দেয়। কথাটাও ঠিকভাবে বলে না মোহ্রিন। এই কলেজে আছি। একটু ব্যস্ত আছি কিংবা বাইরে আছি এরকম কথা বলে ফোনটা কেটে দেয়। মরিয়ম খোকনকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে আগের মতো মোহ্রিন তার সাথে দেখা করে না। মরিয়মদের বাড়িতে আসাও বন্ধ করে দিয়েছে মোহ্রিন।
সেদিন কলেজে এক ফাঁকে দেখা হয়ে যায় মরিয়মের সাথে মোহ্রিনের। কথা না বললেই নয় এরকমভাবে কথা বলে কাজের অজুহাত দেখিয়ে বিদায় নেয় মোহ্রিন। খোকনের সম্পর্কে কিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও মোহ্রিন সুযোগ না দেওয়ায় তা আর সম্ভব হয় না। খুব দ্রুতই মোহ্রিনের বদলে যাওয়া চেহারা ফুটে ওঠে সবার কাছে। এতদিন খোকন নিজেই চেষ্টা চালিয়েছে মোহ্রিনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সেদিনের কথা আকাশ ভেঙে পড়লো খোকনের মাথার উপর। শুক্রবার। তাই খোকনের ইচ্ছে ছিলো একটু বেশি সময় ধরে মোহ্রিনের সাথে কথা বলবে, তাছাড়া তার মায়ের সাথেও বেশ কিছুদিন কথা হয় না। ফোন দিতেই অপর প্রান্তে মোহ্রিনের কণ্ঠ। -কি ব্যাপার তুমি এত ফোন দাও কেন? -মা…নে! আশ্চর্য হয়ে পড়লো খোকন। একী কথা শুনতে হলো তাকে। কোথায় একটু ভালোভাবে খোঁজ খবর নিবে, তা নয় বিরক্তিস্বরে কথা। চোখটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর একদিনও তো খোঁজ নেয়নি খোকন কেমন আছে। তার শরীরের অবস্থা কেমন। যে মানুষটার সাথে প্রতিনিয়ত ফোনে কথা হতো, মোহ্রিনের এস.এম.এস এর উত্তর দিতে কুল পেত না, আর সে কিনা তাকে ফোন দেওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারী করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মানুষ এতো নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে কীভাবে। কথাটি বেশিদিন আর খোকনের মধ্যে আটকা থাকলো না। চলে গেল খোকনের খালার কান পর্যন্ত।
বিষয়টার একটি সুরাহা হওয়া দরকার। একদিন ……. বিকেলে মরিয়মকে সঙ্গে নিয়ে তার মা মোহ্রিনদের বাড়িতে যায়। খোকনের প্রসঙ্গ তুলতেই মোহ্রিনের মা সাফ জানিয়ে দেয়, মোহ্রিনের সাথে খোকনের বিয়ে হচ্ছে না। সেদিন অনেকগুলো খোড়া যুক্তি দেখায় মোহ্রিনের মা। খোকনের খালারও যে কিছু বলার নেই। পরের মেয়ে তাদের ছেলের সাথে যদি বিয়ে না দেয় তবে কী-ই বা করার আছে! ‘খোকনকে বুঝিয়ে বলে অন্য জায়গায় বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।’ মরিয়মকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে ওঠে তার মা। ‘কিন্তু এটা কি সহজভাবে মেনে নিতে পারবে খোকন ভাই।’ মরিয়মের সংশয় ভাবনা। খোকনকে কখন কীভাবে কথাগুলো বলবে ভেবে উঠতে পারছেনা মরিয়ম। ওদিকে আজ ক’দিন ধরে মোহ্রিনকে ফোনে পাচ্ছেনা খোকন। একবার মরিয়মকে ফোন দেওয়ার কথা ভাবলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। মরিয়মই একদিন ফোনে সবকিছু জানিয়ে দেয় খোকনকে। কথা গুলো শুনার সাথে সাথে নির্বাক হয়ে যায় সে। সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসে। ‘রাখি’ বলে ফোনটা রেখে দেয়। সেদিন এর বেশি আর কথা বলতে পারেনি খোকন। ‘এটা কী করে সম্ভব! আমি মেনে নিতে পারবোনা। আমি বাঁচতে পারবোনা মোহ্রিনকে ছাড়া। আমি মরে যাব, আমি মরে যাব।’
খোকনের এই আর্তনাদ সেদিন সেলিম আর তার মায়ের কান ছাড়া আর কোনো কানে গিয়ে পৌঁছায়নি। যাদের কানে পৌঁছেছে তাদের যে করারও কিছুইনেই। মোহ্রিনের মা কি কারণে খোকনের সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দেবেনা তার প্রকৃত কারণ কাউকে না বললেও এটা যে সবারই জানা। খোকনের সাথে তার মেয়ের বিয়ে হলে লোকে জামাই দেখে বলবে …………। অথচ আজ যদি মোহ্রিনের বিয়ের পর এরকম একটি দুর্ঘটনার শিকার হতো তার জামাই, তবে কি সে তার মেয়েকে ছাড়িয়ে নিতে পারতো? কিংবা তার মেয়ের বেলায়ও যদি এরকমটি ঘটতো, তবে কি সেই জামাই তার মেয়েকে ছাড়িয়ে দিত? কি জবাব দেবে এ প্রশ্নের, কি জবাব আছে মোহ্রিনের মার কাছে। মোহ্রিনইবা কি রকম মেয়ে? যে ছেলে তাকে এত ভালোবাসে, এক চোখ চলে গেছে তাতে দুঃখ নেই বিন্দুমাত্র শুধু মোহ্রিনের পাবার আশায়। অথচ সেও কিনা ভুলে গেল। মোহ্রিন কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে এর জন্য সেও দায়ী নয়। ঈদের ওই সময়ে খোকন মোহ্রিনের কথা না ভেবে যদি নিজেকে নিয়ে ভাবতো।
নিজের শরীর নিয়ে ভাবতো, তবে বিকল্প কিছু হলেও হতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। ভালোবাসার মানুষকে খুশি করতে চেয়েছিলো, আপন করতে চেয়েছিলো। কিন্তু এটা যে তার অদৃষ্টের পরিহাস! ভালোবাসার প্রতিদান যে এরকম হয়-তা খোকনের জানা ছিলো না। ভালোবাসলে এরকম প্রতিদান পেতে হয় ভুলেও ভাবেনি সে কখনো। ৬ মাস পর। মরিয়মের ফোন।
কুশল বিনিময় শেষে মরিয়ম বলে, -কাল মোহ্রিনের বিয়ে! মরিয়ম ভেবেছিলো এতদিনে সবকিছু ভুলে গেছে খোকন। এই একটি মাত্র কথা খোকনকে এতটুকু ভাবিয়ে তুলতে পারে তা মরিয়মের জানার সীমানার বাইরে। তাইতো কথাটা শুনার সাথে সাথে খোকন নিশ্চুপ হয়ে যায়। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অঝর ধারায় পানির ফোয়ারা বইতে থাকে তার দু’চোখ বেয়ে। এ কান্না কি তার মোহ্রিনকে না পাওয়ার হতাশায়, নাকি তার অমূল্য সম্পদ একটি চোখের আলো ফিরে পাওয়ার আর্তনাদে তা কাউকে বলতে পারেনি খোকন।