এক
আমগাছের নিচে মানুষটি ঝুড়ি হাতে কিছু একটা তুলছিল, ঢেঁকিশাক বোধহয় । আমাকে দেখে মুখ তুলে চাইল , কি করছ দিদি ? আধবয়েসি মানুষটির মুখ থেকে দিদি ডাক শুনে কেমন অস্বস্তি লাগছিল । ‘দিদি’ সম্বোধন এক ধরনের সম্ভ্রম জাগায় । আমি এগিয়েগিয়ে বললাম , আপনি কি করছেন ? শাক তুলছেন?– তিনি বন আঁতিপাঁতি করে শাক খুঁজছিলেন ।
–কিকরে শাক তুলব বল , বাচ্চাগুলো এমন প্যান প্যান করে ! সত্যি ওর ঝুড়িতে দু তিনটে শাকের আগা । আমার বাড়িতে ভালকরে জমি খুড়ে দেয়ার পর কচি কচি শাক , দ্রোণ , ঢেঁকি শাক ঝাক বেঁধে উঠেছে । –আসুন এদিকে এখান থেকেই একটুশাক তুলে নিন । মানুষটি এল না , ঠায় দাঁড়িয়ে আছে । –আসুন আসুন শাকগুলো নাহলে বুড়োহয়ে যাবে , কে খাবে এত ? দুদিন পর গোবর দিয়ে নতুন বিচি ফেলতেই হবে । খুব সংকোচ হচ্ছে ওর । তা থেকে তিনগুণ সংকোচ নিয়ে আমার আগ বাড়িয়ে দেয়া চায়ের কাপ থেকে চা খাচ্ছে । যাওয়ার জন্যে উঠে বলল , দিদি , আমার ওদিকে একদিন একপাকমেরে আসবেন তো ! ––যাব নাহয় , একদিন বিকেলে যাব । মানুষটি যেন চমকে উঠল ঃ এমনিগিয়ে আর কি করবেন ? কোথায় বসাব ? কি খেতে দেব ? কোন অনুষ্ঠান হলে জানাব । একটু হেসে বিদায় নিল সে । সদর দরজা পেরোবার সময় মানুষটির উড়তে থাকা মেখলায় আঁকা শুকনো কাল ফুলগুলো ও সদর দরজার বাঁশের খুঁটি গুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য রইল না ।
বাড়ির সীমানাতেই ওর ঘর । তাই অনবরত ওকে দেখি । এখানে সবাই ওকে শর্মানী বলে জানে । ওর চোখে চোখ পড়লে মেঘাছন্ন আকাশের কথা মনে হয় ।গায়ের রঙ কাল , ঠোঁট দুটো প্রশস্ত , হাসলে আরও ছড়িয়ে পড়ে , দাঁতের গোঁড়া গুলো ঢিলে হয়ে বেরিয়ে আসছে , আধপাকা আধকাঁচা চুলগুলোউড়ছে । চোখে বড় মায়া । মেঘে ঢাকা আউসি আকাশের দিকে একটু মরমী চোখে তাকালে , মনে হয় যেন একটি তারা তিরতির করছে । টানা টানা চোখগুলো বড় করুণ , ভয় পাওয়া হরিণের মত । শরীর ভীষণ ক্ষীণ । যখনই দেখা হয় তখনই দেখি কিছুনা কিছু কাজ করছেই।
ওর ঘরের ফুটো চাল , সীমানায় বেড়া না থাকা একটিউদলা বাড়ি , বস্তা ঝুলিয়ে কাচা পায়খানারদরজা , থক থকে নরম কাদায় ভরা কুয়োর পাড়–সব কিছু থেকেই মানুষটির ঘরের দারিদ্র প্রকট হয়ে ওঠে । ওর স্বামী সুদর্শন , ছেলে তিনটে ও মেয়ে , বাবার চেহারাই পেয়েছে । ছেলেগুলো স্কুলের চৌকাঠ ও পেরোতে পারেনি । কিন্তু পাঁয়তারা আছে ষোলআনা । দামী জামাকাপড় পরে যখন বেরোয়, কে বলবে ম্যাট্রিকের দরজাও পেরোয়নি ! মেয়েটির গঠন মায়ের মত হলেও , গায়ের রঙ বাবার মত । আমি আসা যাওয়া করার সময় প্রায়ই শর্মানির মেয়েকে টানা টানা চোখ দুটো নাচিয়ে একটি লম্বা চুল ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখি । শর্মানির স্বামীরও শহরের মধ্যে একটি বড়দোকান ছিল , মদ জুয়ায় সেটি উড়ে গেছে । তেনার চেহারাটি খুব সভ্য ভব্য , তিনকুল গিয়ে এক কুলে ঠেকা লোকটি এখনও মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে , হাত কচলে ঠ্যাং নাচিয়ে কুল পায় না । শুনছি শর্মানিও যোরহাটের ভাল ঘরের মেয়ে । চেহারা দেখে সকলেপালায় । বড় দিদির জন্যে সব ভাইবোনের বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হওয়ায় বাবা শর্মাকের খুঁজে বার করলেন । শর্মার ধনী–মানি চক্রবর্তী পরিবারের জামাই হওয়ার যোগ্যতা ছিল দুটো ব্যপারে – সাদা ফটফটে রঙও দু গাছি পৈতে । শর্মানির পরিবার পরিজনখবর পেল চক্রবর্তীর বড় মেয়ের জাত পাতে মেলা, ‘বিজনেস’ করা একটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে । শর্মানির বাবা-ই এই ভিটেও দোকানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । শ্বশুরের দেয়া সব জিনিসই সে খতম করেছে ,তারপর ছেলে বড় হয়ে বাকিটুকু লাটে তুলল । এখন শুধু ফুটো চাল বাড়িটি ও আঁধকাঠা ভিটেটা রয়েছে । সেখানে লংকা , বেগুন , বারান্দার পাশে টগর , জবা , সন্ধ্যামালতি হাসে – অনাবৃষ্টির শুকনো দিনে কুঁয়োর পাড়কে লালমাটি লেপে ফু দিয়ে ভাত খাওয়ার মত ফটফটে করে রাখে , সন্ধ্যায় তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালিয়েস্থলপদ্মকে আলোকিত করে তোলে ।
প্রায়ই শর্মানির সন্ধ্যামালতি , স্থলপদ্ম , টগরের গন্ধ , মদ মাংসের গন্ধে ডুবে যায় । ওর দুর্বল গলায় পড়া লক্ষ্মীর পাঁচালীর সুর হইহল্লার মধ্যেডুবে যায় , কার জুতোর তলায় তুলসিতলার প্রদীপ মড় মড় করে ভেঙ্গে যায় জানিনা । এরকমসময়ে ওর বাড়ীর ও আমার বাড়ির মাঝের আমগাছের তলার খালি যায়গাটিতে চুপ করে গালে হাতদিয়ে বসে থাকে । পাড়াটির খালি অংশ বলতেএটুকুনই আছে । ছেলেমেয়েরা দাপিয়ে বেড়ায় , তাই বনজঙ্গল আর গজায় না , মানুষটিও সাপ ব্যাঙ ভয় না পেয়ে বসে থাকে । শর্মারবাড়ীতে উদ্দাম শব্দ শুনলেই আমার বুকটা ধড়ফড় করে । মানুষটি কোথায় !! হাঁটুতে মুখগুঁজে বসা মানুষটি !! বাড়ির সীমানায় চুপ করে বসে থাকা মানুষটিকে দেখে কে চুপ করেবসে থাকতে পারে ? প্রায় ই ওকে আমার কাছেনিয়ে আসি , কথা বলার বৃথা চেস্টা করে এক কাপ চা দি , খায় , ভাত খাওয়ার কথা বলে হাজার জোর করলেও খাওয়ান যেত না । বাড়িরহুলুস্থুল কমলে নিজে নিজেই চলে যেত । যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে একটা কথাই বলত ,যাই । আপনাকে একদিন আমাদের বাড়িতে ডাকব , যেতে হবে কিন্তু । আমিওসঙ্গে সঙ্গে বললাম , হবে , নিশ্চয়ই যাব ।
দুই
শর্মানিদের ঘরের ভেতরটা আমার বারান্দা থেকেই দেখা যায় , ঘরের ভেতরে জিনিসপত্র বেশী নেই ।আশপাশ থেকে শুনেছি শর্মানি ট্রাক ভর্তিযৌতুক এনেছিল , ছেলে , স্বামী মিলে সব শেষ করেছে । মানুষটির একটি শরাই অসমীয়া ঐতিহ্য ফুল-জালি কাটা । একটিমানুষের কোমর সমান উঁচু , তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে , মাঝে মাঝেই টক ও ছাই দিয়ে মেজে চকচকে করে রাখে শর্মানী । শরাইটা নিশ্চয়ই খুব ভারী , তুলতে খুব কষ্ট হয় ওর । ভাঙাচোরাঘরের উঠোনে শরাইটা রোদে দিয়ে হাতে একটি লাঠি নিয়ে বসে থাকে সে , কাক তাড়ায় ।শর্মানি যেন শরাইটা নয় ওর অবিবাহিত বেলাটাকেই ধরতে চায় , পাহারা দেয় ।
একদিনরাত্তিরে আমতলায় উচুগলার কথা শুনে উঠে গেলাম , বুকে চকচকে কি একটা নিয়ে বসে আছে ।টর্চ মারার সঙ্গে সঙ্গে শরাইএ মাথা রেখে ফোঁপাতে থাকা ওর মুখটি স্পষ্ট হল । একটুদূরে অস্থির ভাবে দাড়িয়ে আছে শর্মা । আমাকে দেখে একটু হড়বড় করে চলে গেল , যাওয়ার সময় বক বক করতে লাগল ,– কালি পেঁচির ঘ্যাম দেখ । বাপের সম্পত্তির অহঙ্কার ! আজএতো দিনে কে কি নিয়ে এসেছে তোর কাল মুখ দেখবার জন্যে ? – ছুরির জিভ — বক বক করতেকরতে অদৃশ্য হল শর্মা , কোনমতে দুহাতে শরাইটি নিয়ে আমার বেড়ার সীমানায় এসে দাঁড়াল ঃ আমার যা ছিল সবদিলাম , এটা দেব না , কিছুতেই না ,তিনটে ছেলে আছে একটি মেয়ে , বাড়িতে কখন না কখনোউৎসব অনুষ্ঠান লাগতে ই পারে , শরাই সাজাতে হবেই । রোগা শরীর কোন মতে টেনে হাতে আঁকড়ে রাখা শরাইটি নিয়ে ঘরে ঢুকল । আমার দেখান টর্চের আলোয় জেগে রইল শর্মানীর কেঁপে কেঁপে ওঠা শরীর । মুখ না দেখেও বুঝছিলাম ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও ।
একদিনসকালে দেখলাম আমার বারান্দায় বসে আছে ! দরজা খুলেই ওকে দেখে চমকে উঠলাম !”শর্মানি!” আমি বোধহয় একটু চেঁচিয়ে উঠে ছিলাম । মানুষটি আঁতকে উঠল । মা শত্রু আসছে দেখলেযেমন তাড়াতাড়ি সন্তানকে সরিয়ে ফেলে ঠিকসেরকম শাড়ি দিয়ে কি যেন একটা লুকিয়ে ফেলল । নিচের অংশটি দেখে বুঝতে পারলাম সেইশরাইটি । এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম সে নাছোড় পায়ে দাঁড়িয়ে আছে কি না , নেই।শর্মানিকে দেখে বসার জন্যে মোড়া এগিয়ে দিয়ে আমি গেট খুলতে গেলাম , গেটের কাছেলুঙ্গি পরা চাদর গায়ে একটি ফর্সা মতন যুবক দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । গেটটাখলার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল শর্মানীর বড়ছেলে । ও এসে মায়ের দিকে তাকাল । শর্মানিগায়ের কাপড় দিয়ে শরাইটা ঢেকে চুপ করে বসে রইল । ছেলেটা মায়ের গা ঘেঁসে দাঁড়াল,স্বয়ংক্রিয় ভাবে আমিএগিয়ে গেলাম কি হল ? –ছেলেটি হাসতে চেষ্টা করল ঃ এস ডি।সিস্যারের দিদি আমায় খুব ভালবাসে , দিদি স্যারকে বলে আমাকে অফিসে একটা চাকরি দেবেনবলছেন । মানে কথা পাকা হয়ে আছে ই , শুধু…, ও থামল । পাড়ার সবাই জানে শর্মার বড়ছেলে লটারির টিকিট বিক্রি করে , দুবার পুলিশ ধরেছে । মধ্যে শুনেছিলাম সরকারী কোয়ার্টারে থাকা মহিলারা ডীলাক্স লটারির নেশায় পড়েছেন । শর্মার ছেলের এসডি সি র স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশার কথা অস্বীকার করে নি । সে আবার মায়ের কাছ ঘেঁসে এল ঃ নে এবার শরাইটা দে , দিদি পুরনো জিনিস ভালবাসে । চাকরিটা হয়ে গেলে তোকে কিনেদেব । না ! কাকে দেবে ? সে মায়ের দিকে তাকাল , চোখ জ্বলছে ওর ঃ বল, তিনটে ছেলেআছে … একটি । ছেলেটির মুখ এতহিংস্র লাগছে । নতুন বাচ্চা হওয়া কুকুরেরঘেউ ঘেউ করার মত শর্মানি ওর ছেলেকে ধমকে উঠল ঃ দেব না বলছি না , বক বক করিস না ।ছেলেটি বেরিয়ে গেল ।
শর্মানি আমার সংগে বসে চা খাচ্ছে ঃ দিদি ! মেয়ে আমার ‘বড় ‘ হয়েছে ।, আমি একলাই নামগানকরে ওকে চান করালাম । তখনই গোপিনী মানত করেছিলাম । তা ও এক বছর হয়ে গেল …। যেনসব কিছু এক সাথে চেপে ধরেছে ঃ মা –বাবার মৃত্যু তিথি এক পুর্নিমাতেই পড়ে , সেদিনই সত্যনারায়ণ পুজো করব ভেবে রেখেছি কতদিন ধরে । সেদিন স্বপ্নে দেখলাম আমাদের বাড়িরঠাকুরঘরের প্রতিমা হাতে প্রদীপ নিয়ে আমাকে তেড়ে আসছেন । আমার পাপ হয়েছে দিদি !ভাবছি একদিনেই পুজো দিয়ে সব মানত পুর্ন করার জন্যে প্রদীপ জ্বালাব ।
–আপনাদেরবাড়িতে বোধহয় সব সময় পুজো পার্বন লেগে থাকে । আমি আসলে কথা ঘোরাতে চাইছিলাম ।
–আমারবাবা আসলে খুব সাত্ত্বিক মানুষ ছিলেন, আমাদের বাড়িতে সপ্তাহে একবার কখনও দুবার–তিনবারও পুজোর আয়োজন হত । বোনেরা ব্যস্ত থাকত পড়াশুনো নিয়ে , মা -ও সবসময় পারতেন না ,সব কাজ আমকেই করতে হত । সবাই বলত আমার মত সিন্নি কেউ বানাতে পারে না , আমি শরাই না সাজালে বাব ঠিক বুঝতে পারতেন । — শর্মানির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল , সলজ্জ হাসিতে ভরে উঠছিল ওর মুখ।
চায়ের কাপটা নামিয়ে শর্মানি যাবার জন্যে উঠেদাঁড়াল ঃ আমার বড় ইচ্ছে করে আশপাশের সকলকেডাকি , নামগান করি , পরমান্ন রান্না করি , মানতের ঘিয়ের বাতি জ্বালিয়ে মনটা পাতলাকরি । দেবী মা হয়ত আমাকেই দায়ী করবেন – সে কারনেই হয়ত ! গলাটা বুঁজে এল , কথা হারিয়ে গেল । একটু থেমে মানুষটি গায়ের গরম কাপড়দিয়ে শরাইটিকে জড়িয়ে ধরল ঃ ওরা চাইলেই কিদিয়ে দেব ! ওর দুর্বল কথা আসলে ফোঁপানো , কান্নায় ভেসে যাওয়ার এক ধাপ ।
৩
একদিনরাত্তিরে শুনলাম শর্মা বড় বেশি হাল্লা চিল্লা করছে , মদ খেয়েছে বোধহয়, সজ্ঞানে ঃ ওমরে গেছে বলে ধরে নে , পরগাছা ঘাড়ে চেপেছে ,আসুক সে –তাকে দু টুকরো করব । ভাই দুটোও বাবার সঙ্গে ধুয়ো দিচ্ছে ঃ ও ঢুকলেআমরা বেরিয়ে যাব , স্বামী বিতাড়িতা পরগাছা অপদার্থ মেয়েমানুষ , মৃত বলে ধরে নে । এওসব উত্তপ্ত কথার ফাকে ফাঁকে একটি কান্নারশব্দ বাতাসে পাক খাচ্ছিল । পরদিন চারদিকে ফিসফাস শুনছিলাম , শর্মার বড় ছেলেটা স্বামী পরিত্যক্তা এক মহিলার সঙ্গে জড়িয়েপড়েছে । মহিলার স্বামীর গালামালের দোকান ছিল , ওই দোকানে অনেকেই শর্মার বড় ছেলেকে বসে থাকে দেখেছে । কেউ কেউ বলছে ওরাকামাখ্যায় গিয়ে বিয়ে করেছে , কেউ কেউ বলল এক সঙ্গে সিনেমা দেখতেও দেখেছে । আমি ওইদিন বিকেলে বেরোলাম , শর্মানির বাড়ির পাস দিয়ে একটু হেঁটে আসার জন্যে, উদ্দেশ্য মানুষটির একটু খোঁজ খবর করা ।শর্মানির ঘরের ভেতর মুখ বাড়িয়ে দেখলাম মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় কোনায় বসে আছে । আমাকে দরজার কাছে দেখে এগিয়ে এল । –দিদি!কোথায় যাচ্ছ ? তিনি নিজেই কথাটি পাড়লেন ,আমার বাড়ির খবর শুনেছেন নিশ্চয়ই … একটাএকটা করে সব কথা বলে গেল । দাঁড়িয়ে দারিয়ে আমার পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল , একবারেরজন্যেও আমায় ভেতরে দাক্ল না । কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে হুংকার ভেসে এল ,– আসুক সে …আমি তাকে …আমি তাকে …
মদ্যপ হুঙ্কার মানুষটিকে মাটিতে মিশিয়ে দিল । মাথা নিচু করে বসে রইল সে । আমি আস্তেআস্তে বললাম, যা হয়েছে হয়েছে এবার বৌমাকে বরন করে ঘরে তুলে নিন । ওর মুখে আলোজ্বলে উঠল ঃ আমিও সেটাই ভাবছিলাম … আর কিছু নাহলে অন্ততপক্ষে গোপিনী পার্বন ইনাহয় …পরে কি হবে বাপ- ছেলেরা ওর নামে সাত কোপ মারবে আর ও এই ঘরে পা দেবে না । — শেষদিকে সব সময়ের মত ওর কথাগুলো যেন ধরে আসছিল ।
আমার পাদুটো সত্যি ই ঝিন ঝিন করছিল । শর্মানি ব্যাপারটা বুঝল । ভেতর থেকে আবার জড়ানজিহ্বা বলে চলল , সব ঐ মেয়েমানুষটার জন্যে হয়েছে …আশকারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে…বড়মানুষের বেটি … অহংকারে মট মট । –শর্মানি আবার অধোবদন । আমি চলে যাচ্ছি দেখেও ওকিছু বলল না , মাথাটা নিচু করে রইল । ‘যাচ্ছি’ বলাতে চোখ তুলে চাইল , চোখের মধ্যে একটি দোষী দোষী ভাব ! আপনাকে ঘরের দরজায় দাঁড় করিয়ে … আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়িফিরে এলাম , ফিরে এসে একবার ওদের ঘরের দিকে চাইলাম , দেখলাম সেভাবেই বসে আছে বারান্দার ধারে । ওকে না দেখে দেখছিলাম ফেঁসেযাওয়া চাদরে ঢাকা ওর পিঠের ওঠা নামা দেখছিলাম , রোগা শরীরটির কেঁপে কেঁপে ওঠার মতসেই চেনা ভঙ্গিমা ।
৪
শর্মানির মেজো ছেলেটিকে খুব কমই দেখেছি , ঢ্যাঙ্গা ছেলেটিকে বাড়িতে প্রায় দেখা-ই যায় না। ওর সম্পর্কে বিভিন্ন কথা কানে আসে। কেউ বলে , ও একটা সন্ত্রাসবাদী দলের সদস্য ,কারো মতে এগুলো গুল , ও কোন দুনম্বরি ধান্দা করা ছেলে । কারোর মতে ও সাত ঘাটের জলখাওয়া জীব । ও আসলে পুলিশের চর । শহরের অনেক ছেলেকেই ও পুলিশ – মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েছে । কারো মতে ও অস্ত্র শস্ত্র বাড্রাগসের ব্যবসা করে । ওকে দেখলে মোটরসাইকেলের ওপরেই দেখি , পরনে থাকে সৌখিন জামা কাপড় , অবশ্য শর্মার বাড়ির লোকজনদেরকাপড় চোপড় দেখে বাড়ির অবস্থা অনুমান করা যায় না । কদিন ধরে ওকে বাড়িতেই দেখছি ।একটু লক্ষ্য করে দেখলাম শর্মার বাড়িরসামনে একটি চকচকে মারুতি ভ্যান দাঁড়িয়ে । কয়েকদিন ধরে শর্মার বাড়ির সামনে এরকম আরওদু তিনটি নতুন গাড়ি ও গাড়ির মালিক একঝাক কম বয়েসি ছেলে ঘরের ভেতর জবর আড্ডা দিচ্ছে । বিকেল হলেই বাড়িতে গান-বাজনা ও অশ্লীল চিৎকার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল ।
শর্মানির ধুয়ে মুছে রাখা চাতাল কাঠের গুদামে পরিনত হল । প্রথমে মাঝরাতে মাটি কাঁপান গুরুম গুরুম শব্দ শুনে ধড়মড়করে বিছানায় উঠে বসেছিলাম , পরে আস্তে আস্তে সয়ে গেল । প্রত্যেকদিন রাতে শর্মার চাতালে দুই- তিন ট্রাক কাঠের তক্তা ঢালাহয় । শর্মার বাড়িতে টি ভি এন্টেনা বসল , দুটোপাকা ঘরও হল । শর্মানির মেয়ের পোশাকআশাকের বাহার এলাকার আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল ।ওকে আর লম্বা চুলের সেই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে দেখা যেত না , বিভিন্ন রঙের গাড়ি ও বাহারি মোটর-সাইকেল করে বিভিন্ন ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় আজকাল ।
শর্মানিআগে বাড়িতে কাজিয়া লাগলেই আম গাছের তলায় বসে থাকত , আজকাল বেশীর ভাগ সময়ই সে আমঝোপের তলায় বসে থাকে। কখন হাতে থাকে কুরুশ কাটা কখনও থাকে উলের কাটা , বেশীরভাগসময় এমনই বসে থাকে । মানুষটি দিনে দিনেশুকিয়ে যাচ্ছে । একদিন আমতলায় বসে শরাই ঢাকনি রাখা দেখে আমি এগিয়ে গেলাম । ওর মুখ থেকে কথা বেরোতে যে কত সময় লাগে , দুটো শব্দ উচ্চারণ করেই ফোঁপাতে থাকে । আমি একসুযোগে বলেই ফেললাম ঃ নতুন গাড়ি নিয়েছেন , ঘর সাজিয়েছেন , টি ভি কিনেছেন—আমকেকিন্তু মিষ্টি খাওয়াননি । আসলে ওর মুখে আমি হাসি দেখতে চাইছিলাম । তিনি হাতের কুরুশ কাটা গুছিয়ে রেখেবল্লেনঃ আমিও ভাবছিলাম মানত করা প্রদীপ দিয়ে বুকটা পাতলা করব । আসুন চা এক কাপ খান। শর্মানির আজকাল বেড়া পেরোতে হয় না , আসা যাওয়া করতে করতে একটি পায়ে হাঁটা পথ তৈরি হয়ে গেছে । শর্মানি পুরো দু গেলাস জল খেল । মানুষটি মাঝে মাঝে বুক চেপে ধরে ,কি যেন একটা কষ্ট হচ্ছে ।
–আপনার কি শরীর খারাপ না-কি ?
–না মাঝে মাঝে বুকটা ভারি ভারি লাগে , ভাল করে শ্বাস নিতে পারিনা ।
–ডাক্তার দেখিয়েছেন ? ও চুপ করে রইল !
এক কাপ চাখেয়ে যেন কিছুটা সুস্থির হল । আমার দিকে তাকাচ্ছে । চাউনিটা কেমন ঘোর লাগা ।
–দিদি ! কালভোর বেলা একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম । দেখলাম আমার বাড়ির বেদীর প্রদীপগুলো চাতালে নেচেবেড়াচ্ছে , হঠাৎ ডাই করে রাখা কাঠ গুলোতে আগুন লেগে গেল । আগুনের মধ্যে দুহাত ওপর করে রাখা কাকে দেখলাম জানেন ? শর্মানি যেন কেঁপেউঠল ।
–কাকে দেখলেন আপনি ?
–আমার কাকাকে ।
–কাকাকে !!
— হ্যা আমার কাকাকে আগুন যেন ঢেকে দিচ্ছে , উনি আমার বাবার নাম ধরে ডাকছিলেন। আমার কাকা কাঠের ব্যাপারি ছিলেন । উনি কি করেমরেছিলেন জানেন ? শর্মানির চোখদুটো জ্বরের ঘোরলাগা । কেটে আনাকাঠের লরি সামনে বসে আসছিলেন কাঠের খোঁচা খেয়ে তার চাপেই মারা গেলেন । কাঠের ধাক্কায় থেঁতলান ওর শরীরটা …। ফুঁপিয়ে উঠল সে ।
–আপনি আর কথা বলবেন না । শর্মানি বিনা আপত্তিতে আর এক কাপ চা খেল ।
–দিদি ! বাবা বলেছিলেন গাছের প্রান আছে । গাছ ও জীব।,এই গাছের অভিশাপেই আমার কাকা মরলেন।
আমি আজকাল প্রায়ই কাকার রকে লাল , কাঠে চেপে মেরে ফেলা থ্যাঁতলান শরীরটা আমারচাতালে ডাই করে রাখা কাঠগুলোর মাঝে পড়ে থাকতে দেখি ।শর্মানি কথাগুলো বলে আমার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ।
— আপনি মানত করা শরাই সাজিয়েপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিন , আমরা যাব । আমি হাসবারচেষ্টা করলাম । জানতাম এই কথাগুলোই ওকে সান্ত্বনা দেবে
ওর মুখ উজ্জল হয়ে উঠল ঃ ঠিকই বলেছেন , পুরুতকেখবর দিয়ে একটা দিন দেখি কি বল । যাওয়ার জন্যে উঠল । ঃ আপনাকেআগের দিনই জানিয়ে দেব , একটু সাহায্য করবেন, আমার শরীরটা তো বেশি ভাল নয় ।
–ঠিক আছে , আপনি বললেই হবে , দরকার হলে আগের দিন রাতে গিয়ে থাকব । । আমি জোরে হাসলাম, শর্মানিও !
৫
একদিন বিকেলবেলা শর্মানির বাড়ির সামনে একটার পর একটা গাড়ি এসে জমা হতে লাগল , সন্ধ্যে হতেই ইংরেজি গানের ঝড় বয়ে গেল । একটু পর ই শোনা গেল চার চারটে গুলির শব্দ । সমস্ত পাড়াটা কেঁপে উঠল , দরজা জানালা গুলো আগেই বন্ধ হয়েছিল , আস্তে আস্তে মানুষজনওঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল । গুলির শব্দের পর শোনা গেল সন্মিলিতহাসি, ঠিক হাসি নয় টিটকিরি, শেয়াল কুকুরের মত চিল্লাচিৎকার । কানে তালা ধরা এই শব্দ এই আনন্দ প্রকাশ মানুষকে আশ্বস্ত করল যে নিশ্চয়ই কোন মৃত দেহ পড়ে নেই । শর্মার বাড়ির এই হই হল্লা এলাকার জন্যেপ্রায় অসহ্য হয়ে উঠেছিল । চুপ করে মানুষজন ঘরের ভেতর দাঁত কামড়েপড়েছিল । আমি বাড়ির পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে কানে তুলোগুঁজে রাখার উপক্রম হল ।
আমি ঠিক বুঝেছিলাম , শর্মানি গা –মাথা ঢেকে আমগাছের তলায় বসে আছে । মানুষটি কাঁপছে ।
–আসুন এরকম করে বসে থাকলেঠাণ্ডা লেগে যাবে । বিনা প্রতিবাদে ও উঠে এল । কোন কথানা বলে চা এক কাপ খেল , ও সাধারণত চায়ের সঙ্গে যা দেই তার অল্পই খায় । আজ দুটো বিস্কুট খেল । বিকেলে খাবার জন্যে রুটি করেছিলাম , ভাজা দিয়ে খেতে দিলাম , খেল ।
–আর একটু দি । ও পুরো একগেলাস জল খেল । না , অনেক খেলাম । শর্মানি আমার পেতে দেয়া বিছানায় শুয়ে পড়ল, পেছন দিককার খিড়কি বন্ধ করার সময় মুরগীর হাড় চেবানর শব্দ পেলাম । শর্মানি চাতালে মুর্গি উঠতে দেয় না , যদি তুলসী বেদীতে উঠে পড়ে ! তুলসী বেদী । ওখানে এখনচকচকে লাইট জ্বলছে , লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্তূপীকৃত মরা মুরগী। ভেতরে এসে দেখলাম সে হাতের ওপর মাথা রেকে কাত হয়ে শুয়ে আছে ।
সকালে ওকে নেবার জন্যে শর্মা এল । মানুষটি জিন্সের প্যান্ট , নীল রঙের পুলওভারে বয়েস অনেক কমে গেছে মনে হচ্ছিল। শর্মানিকে বসে থাকতে দেখে বলে উঠল ঃ এর কথাআর বলে লাভ নেই । সব কথাতেই খালি পুজো আর মানত , বিধি –বিধান । কাল ঘরেশুভ কাজ হল , মা হয়ে ঘর ছেড়ে চলে এল গেল। শর্মানি বারান্দায় মাথা নিচু করে বসে ছিল । শর্মা চলে যাওয়ার পর কাঁপা কাপা পায়েসিঁড়ি থেকে নেমে বাড়িরদিকে রওয়ানা হল । এই প্রথম আমাকে কিছু না বলে চলে গেল। খবরটা পেতে বেশী সময় লাগল না , শর্মার মেজ ছেলেটি একটি মেয়ে নিয়েচলে এসেছে । আগে থেকেই চেনা জানা ছিল , ঝামেলা হওয়ায় বাড়ি নিয়ে এসেছে । আর একটি কথাও বাতাসে ভাসছে , শর্মার মেয়েরও বাড়ি থেকে বেরবার মত উপায় আর নেই !
৬
শর্মানিকে আমতলায় , ঘরে বারান্দায় কোথাও দেখা গেল না । মেয়েটাকেও দেখিনা যে জিজ্ঞেস করব । পাশের বাড়িরবরুয়ানির কাছ থেকে শুনলাম , শর্মার মেয়েটাকে নাকি ছেলেটি নিতে চায় নি, সে দায়িত্ব ই নিতে চায়নি । ছেলেটির মা এসে শর্মানিকে ‘ নটির মা ‘ বলে খুব একচোট বকাবকি করে গেছে । ওকে বন্দুক দেখিয়ে রাজি করান গেছে। মেয়েচলে যাওয়ার পরই শর্মানি বিছানা নিয়েছে , সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে ।
আমি সেদিন টপকে আমগাছ পেরিয়ে শর্মানির বাড়িতে পা রাখলাম । ঘরে কেউ ছিলনা । আবর্জনা মাড়িয়ে,মেখলাটা তুলে কাঠের গুঁড়ির ওপর পা ফেলে ফেলে কোন রকমে ঘরে ভেতর ঢুকলাম । সমস্ত জায়গাটা জুড়েই কেমন আঁশটে আঁশটে গন্ধ। ভেতরের ঘরের বিছানায় শর্মানি , মুখটি যেন মরা মানুষের ।আমাকে দেখে কথা বলল –দিদি , পুরুতকে বলে আমাকে একটু শান্তিজল এনে দাও না ? হঠাৎ চোখদুটো উদভ্রান্তের মত এদিক অদিক তাকাতে লাগল ঃ ওইওই দেখ গাছটা নেচে নেচে বেড়াচ্ছে , আগুন আগুন , এক্ষুনি আগুন লাগবে । শর্মানির হাতটা ধরতে গিয়ে ছ্যাকা খেলাম ,মনে হল একটি কঙ্কালের হাত স্পর্শ করেছি ! বেড়ার দিকেমুখ করে মুখে বিড় বিড় করতে লাগল । মনে হচ্ছিল হাত থেকে কিছু ফেলতে চাইছে , তাই বার বার হাতটা ঝাকাচ্ছে । আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম ।
৭
আমি কিছুদিন বাড়িতে ছিলাম না । এসে শুনলাম শর্মানি মারা গেছে । আশ্চর্য হলাম না । সেই দুর্গন্ধময় , অন্ধকার ঘরটিতে আমি ওকে শেষ বিদায় জানিয়েছিলাম । শর্মা আমাকেশ্রদ্ধার সঙ্গে শ্রাদ্ধে নেমতন্ন করল । যাবনা যাবনা ভেবেও শর্মানির শ্রাদ্ধ বলেই বাড়িটিতে পা দিলাম । কাঠের স্তূপ , আবর্জনা , খালি বোতল সব সরিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে ঘর-দোর চাতাল । ধূপ-ধুনো জ্বলছে , চলছে মন্ত্রপাঠ– শর্মানির বড়ছেলেবড় বউমা এসেছে , মেয়ে- জামাই এসেছে, মেজ ছেলে মেজ বৌমা সব কিছু তদারকি করছে । ব্যস্তভাবে ঘোরা ফেরা করছে । শর্মানির বাড়ি থেকে দিদি জামাইবাবু , দাদা বৌদি , বোন সবাই এসেছে । খাওয়া দাওয়া , দান দক্ষিণা সব কিছুতেই হাত খুলে খরচ হচ্ছে ।ভেতর থেকে একজন স্ত্রীলোক প্রায় কুঁজো হয়ে একটি শরাই তুলে আনছে , সেই জালিকাটা শরাইটা । কেউ যেন …গম্ভীরমুখে শরাইটিতে নৈবেদ্য সাজাচ্ছে । কেউ একজন সুদর্শন,… মানুষ শরাইটির গায়ে হেলান শর্মানির নতুনকরে বাধিয়ে আনা পুরনো আকাশের…মত চোখদুটো টলটল করে তাকিয়ে আছে। এক্ষুনি বলে উঠবে দিদি , এসেছেন ? আসুন আসুন , বসুন…।