নিদ্র এক রজনী—-মুহাম্মদ ইব্রাহীম

নিস্তব্ধ নিঝুম রাত। ভয়ঙ্কর অন্ধকার। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণী গভীর নিদ্রায় অচেতন। এমনকি একটি বৃক্ষপত্রও নড়াছড়া করছে না। ঘন্টা দু’য়েক আগে হুতুম পেঁচার যে ডাক শোনা গেল তাও খুব ভংঙ্কর। সারা শরীরে লোম খাড়া হয়ে উঠে। এমন পিনপতন নিশ্চুপ রাতে এই ডাক কি কোন অশুভ বার্তা নিয়ে এল?

রহিম মিয়ার ঘুম আসছেনা। চোখের পাতা বন্ধ হতে চায়না। এপাশ-ওপাশ করে এক অস্বস্থিকর অবস্থায় নীরব নিথর জীর্ণ দেহ ঘুম রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হয়ে মসনদে বসেছে। তার এই জগতের কিছুরই খবর নেই। পরের বাড়িতে সারাদিন কাজ করে অনেক রাতেই বাড়ি ফিরে। পরিশ্রান্ত ক্লান্ত শরীরে ঘুমের মগ্নতা ছেড়ে এই জগতের খবর রাখার অবকাশই-বা কোথায়?

জানালার ফাঁক দিয়ে খোলা আকাশটা দেখা যাচ্ছে। আকাশ ভরা তারার মাঝে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে না। অনেক কষ্ট করেও চাঁদটা খুঁজে পাওয়া গেল না, মনে হয় কোন কালো মেঘের আড়ালে নিজের অপরূপ রূপকে ঢেকে রেখেছে। সমস্ত আকাশ জুড়ে মিটমিট নক্ষত্ররাজি হাসছে। অবশ্য রহিম মিয়ার কাছে এই হাসি উদ্দীপ্ত চঞ্চলতার হাসি নয়, এই হাসি ম্লানতার হাসি। এই হাসির সাথে পূর্নিমা চন্দ্রের মোহনীয় রূপের ছটা নেই। রহিম মিয়ার হৃদয়াকাশের মাঝে যদিও রঙিন স্বপ্নের স্বাদ আছে কিন্তু যে রঙিন স্বপ্নের বাস্তাবতার চোখে ছাই, সে স্বপ্নে চঞ্চলতার হাসির জোগাড় হবে কোথায়?

অনেকক্ষণ পর্যন্ত একদৃষ্টে আকাশ পানে চেয়ে আছে রহিম মিয়া হয়তো-বা আকাশের বিশালতা নয়তো-বা বিশাল আকাশের গর্ভে বৈচিত্র্য মন্ডিত সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা দেখে তার বিস্ময়! এয়ো হতে পারে তার ভারাক্রান্ত হৃদয়ের সমস্ত দুঃখ গুলো নীল আকাশের কাছে জমা রাখছে। যদি একটু স্বস্তি মিলে? তবেই দুঃখ ভরা হৃদয় একটু হালকা হয়।

হায়রে দুনিয়া মানুষের জীবন লড়াইয়ের খেলা বড়ই বিচিত্র, বড়ই অদ্ভত! মানুষের জীবন প্রজাপতি কিংবা পাখিদের জীবনের মত নয়, আকাশে উড়ে বেড়ানোর সেই ক্ষমতা মানুষের নেই, তবুও মানুষ কেন জানি আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখে! আকাশের নীল ছুতে চায়। তারার মেলায় হারিয়ে যেতে চায়। নিষ্ঠুর বাস্তবতা কি মানুষকে সে স্বপ্ন রাজ্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দেবে? বাস্তবতা বড়ই নির্মম, বড়ই দুরূহ, নইলে কেন এক মুঠো অন্নের জন্য হন্য হয়ে পথে-প্রান্তরে ঘুরতে হয়। কেনইবা কাজের খোঁজে গিয়েও কাজ জুটেনা, যদিও বা কাজ জুটে তার পারিশ্রমিক দিয়ে কি সংসার চলে, এখানেই কি শেষ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে উপযুক্ত পারিশ্রমিক কি জুটে? সব খানেই গরীব শ্রমিকের উপর নির্যাতন নিপীড়ন শোষণ! হায়রে আজব দু’নিয়া, গরীবের ঠাঁই কোথাও নেই।

রহিম মিয়ার কানে পাখির কিছির মিছির ডাক শোনা গেল। রাত শেষ। শোকাহত গভীর বেদনায় বিনিদ্র রজনী কেটেছে রহিম মিয়ার। সকাল হয়েছে। সকল প্রাণী জেগে উঠেড়েছে নব উদ্দমে। আকাশের প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। একটু পরেই আকাশের জঠর থেকে ভূমিষ্ট হবে প্রদীপ্ত উজ্জ্বল রক্তাক্ত সূর্য। মানুষের কর্ম ব্যস্ততা শুরু হবে। শুরু হবে জীবন লড়াইয়ের সংগ্রাম। বাঁচার জন্য সংগ্রাম। এই সংগ্রামে যোগ দিতে হবে রহিম মিয়া ও তার স্ত্রী রহিমা বেগমের। এই সংগ্রাম ব্যতিত ক্ষুধা মিটবেনা, বাঁচা যাবেনা। তিনজন অবোধ শিশু সন্তান নিয়ে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সংসারটি চলবে না।

‘‘নুন আনতে পান্তা পুরায় এমন সংসারে ক্ষুধার ধ্বংস নেই। যতই অভাব ততই ক্ষুধা’’ ক্ষুধার যন্ত্রনা সহ্য হয়না। অবুঝ শিশুদের কান্না কিছুতেই থামানো যায়না শুরু হয় কান্না থামাবার অপার চেষ্টা। ক্ষুধা নিবারণের নিরলস প্রচেষ্টা।

রহিম মিয়া তার প্রত্যহ প্রাতঃকালীন কাজ কর্ম সেরে ছুটে চলে গঞ্জের পানে। শুরু হয় সংগ্রাম, শুরু হয় লড়াই। বাঁচার জন্য সংগ্রাম, বাঁচার জন্য লড়াই। নিপীড়িত নিস্পেষিত দরিদ্র মানুষের এছাড়া আর উপায় নেই।

দুঃখিত!