নিঃশব্দ–নিঃশব্দ

মামা ?
মুখের ভাত চিবুতে চিবুতে তাকায় শফিকের দিকে– কি?
তুমি নাকি প্রায়ই – থেমে যায় শফিক।
হাসে আতাউর রহমান– তোরা এ যুগের ছেলেমেয়েরা এতো ভিতু যে একটা কথাও সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারিস না। মাঝ পথে আটকে যাস।
শফিকের দিকে তাকায় শম্পা, দিপু আর মন্টি। ওদের সঙ্গে মামী নীলুফারও। এতগুলো চোখের কড়া দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যায় শফিক। বিশেষ করে শম্পার দৃষ্টি অসহ্য। অন্ধকারেও ওর চোখ হুল ফোটায়। আজকের এই সূক্ষ্ম অপমান দীর্ঘদিন তাড়িয়ে বেড়াবে তাকে। বিশেষ করে শম্পা কথায় কথায় ওর দিকে তীর ছঁুড়বে।
না, মানে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। সেই কথাটা কি?
তুমি নাকি মাঝেমধ্যে তোমার বেডরুম আটকে ভেতরে একা একা থাকো বেশ কিছুক্ষণ! সে সময়ে কাউকে এলাউ করো না। কি করো ভেতরে? টাকা পয়সা গোন বুঝি?
তোমাকে কে বলেছে এসব? কড়া গলায় প্রায় ধমকে ওঠে আতাউর রহমান। তাকায় একে একে টেবিলে উপস্থিত সবার দিকে। মন্টির ওপর চোখ পড়তেই মন্টি স্প্রিং দেয়া পুতুলের মতো দাাঁড়িয়ে যায়। পাশে বসা দিপু পা দিয়ে খোঁচা দেয়। কিন্তু মন্টি থোড়াই কেয়ার করে – বাবা, আমি জানি শফিক ভাইয়াকে কে বলছে? তোমাকে নাম বলব?
না থাক– আরও গম্ভীর স্বরে কথা বলে ভাত খাওয়া অসামাপ্ত রেখে ওঠে পরে আতাউর রহমান।
সবটা খেলে না যে! নীলুফার সামলানোর চেষ্টা করে।
তুমি খাও।
আতাউর টেবিল ছেড়ে চলে যায়। হাসিখুশি ডাইনিং টেবিলটায় নেমে আসে গভীর নির্জনতা। মন্টি ছাড়া সবাই থালার ভাত নাড়া চাড়া করছে। বিব্রত শফিক মাথা তুলতে পারছে না। মনে হচ্ছে মাথাটা হঠাৎ ভীষণ ভারি হয়েছে। কে যেন মাথার উপর কয়েক মন পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। দুপুরে বাসায় আসার পর কথায় কথায় শম্পা বলে, জানো শফিক ভাই, আমাদের বাসায় একটা অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে।
কান্ড? কোন গাছের কাণ্ড? আম জাম না সিরিজ গাছের কাণ্ড? শফিক খুব উচ্ছল টাইপের ছেলে। কঠিন কথাকেও অবলীলায় হজম করতে পারে। পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যনথ্রোপোলোজিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক দলের নেতা সে। প্রচুর পড়াশুনা করে। শম্পার প্রতি খুব দুর্বল। শম্পা সেটা জানে। আর জানে বলে শফিককে নিয়ে খেলে। শম্পার খেলাটা বুঝতে পারে না শফিক। এতোবড় মেধাবী এবং পড়ুয়া একটা ছেলে শফিক খেলাটা বুঝতে পারে না কেনো– ভেবে কষ্ট পায় শম্পা। কারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শম্পা তার ডিপার্টমেন্টের ছেলে কিরনের সঙ্গে অলরেডি ইনভলড। সেটা অনেকবার আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছে শম্পা কিন্তু বুঝতে চায় নি শফিক। যুক্তিবাদি শফিক এইখানে বড় অবুঝ এবং একরোখা। মানুষ বোধহয় কখনও কখনও বোকা হয়ে আনন্দ পায়। যেমন শফিক।
আতাউর রহমান তার এই ভাগ্নেটাকে খুব পছন্দ করে। বড় বোন তার একমাত্র চিহ রেখে পরকালে যাত্রা করেছিল প্রায় একুশ বছর আগে। তারপর থেকে মামারাই শফিককে লালন পালন করেছে। শফিকও কখনও মামাদের অবাধ্য হয় নি। খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেছে।
আমও না জামও না– কাণ্ডটা করছেন তোমার মাননীয় মামা– কিছুটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে শম্পা।
মামা?
হ্যাঁ, তোমার মামা।
কি করেছে আমার মামা? তোদের পাকা ধানে মই দিয়েছে? নাকি –
এতক্ষণ চুপচাপ থাকা দীপুর পক্ষে আর চুপ থাকা সম্ভব হলো না, সে তার মুখের সঙ্গে দু হাত প্রদর্শন করে বড় বড় চোখে তাকায় – বাবা না প্রায়ই বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।
হো হো হাসিতে ফেটে পরে শফিক– এর মধ্যে কান্ডের কি হল ? যে কোন মানুষ বেডরুমে ঢুকলে প্রাইভেসির জন্য সে বেডরুমের দরজা বন্ধ করতেই পারে। এবং সেটাই স্বাভাবিক–
তুমি জানো ঘোড়ার আনডা– হঠাৎ ক্ষেপে যায় মন্টি। বাবা সব সময়ে দরজা বন্ধ করে না।
কখন করে?
এইতো শফিক ভাই জায়গামতো এসেছেন– কিছুটা ঠেস দিয়ে কথা বলে শম্পা– বাবা দরজা বন্ধ করে হঠাৎ হঠাৎ একদিন।
দরজা বন্ধ করে ভেতরে কতোক্ষণ থাকে?
বেশি সময় থাকে না – এই ধর, পনেরো বিশ মিনিটের জন্য দরজা বন্ধ রাখে।
তাই? এবার সত্যি অবাক হওয়ার পালা শফিকের।
হারে বাবা, জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না – নীলুফার মামি কাতরভাবে বলে। আমার মনে হয় কি জানো?
কি মনে হয় আপনার?
কেউ তোমার মামারে যাদুটোনা করেছে! মামির কণ্ঠ ভারি লাগে।
কি আশ্চর্য! শফিক তার মাথাটাকে প্রবলবেগে দুদিকে নাড়ায়– মামাকে যাদুটোনা করবে কে? আর কেনো করবে? মামা আপাদমস্তক একজন সরল আর সাদাসিদে মানুষ। মামার কোন শত্রু থাকতে পারে আমি বিশ্বাস করি না।
বিশ্বাসতো আমিও করি না – কিন্তু তোমার মামার অফিসে নাকি – নীলুফার মামী থেমে যায়। কাতর চোখে তাকায় শম্পার দিকে। শম্পা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। কোথাও মস্তবড় একটা ঝামেলা তৈরি হয়েছে বুঝতে পারে শফিক কিন্তু কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না ।
শম্পা!
শফিকের গম্ভীর ডাকে সে বড় বড় চোখে তাকায়, ঠোটে উপহাসের মৃদু হাসিটা লেগেই আছে। শফিক সেদিকে মনোনিবেশ না করে বলে– আসলে কি হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলবে?
মায়ের ধারণা- বাবার অফিসে সম্প্রতি আসা এক অতিশয় সুন্দরী রমনীর প্রেমে পরেছে বাবা। সেই অতিশয় সুন্দরী রমনী বাবাকে যাদুটোনা করেছে, যার প্রতিক্রিয়ায় বাবা বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে কোনো অশুভ কাজ করে। যাতে আমরা সহসাই ধ্বংস হই আর সেই অতিশয় সুন্দরী রমনী মায়ের সাজানো সংসার দখল করতে পারে ।
শম্পার কথার শেষে নীলুফার মামি ফুপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে – বাবা শফিক, জীবনের শেষ বেলায় এসে যদি এইসব ঘটে মানুষকে মুখ দেখাবো কি করে?
বাবা যেদিন সৎ মাকে বাসায় আনবে সেদিনই সেই মহিলাকে কেটে টুকরো টুকরো করবো আমি- মন্টি খুব কড়া গলায় বলে। আমাদের ক্লাশের রিপনের সৎ মা আছে। মহিলা রিপনকে ঠিকমতো খেতে পর্যন্ত দেয় না। আমরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ওকে দেই…
মন্টির কথা শেষ হতে পারে না – নীলুফার মন্টিকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে ড্রয়িংরুমটা একটা কান্নার রুমে রূপান্তরিত হয়। শম্পা ছাড়া মন্টি দিপু মামির সঙ্গে কাঁদছে। বেচারা শফিক হতম্ভব। এতো কান্নার মধ্যে মৃদু মৃদু হাসছে। বেশ কিছুক্ষণ কান্নার পর সবার কান্না থামে। মামী আঁচলে চোখ মোছে।
মামা এসব কদিন পরপর করে শম্পা?
ঠিক নেই– মাসে দু একবার করে ।
ভেতরে কি করে তোরা দেখার বা বোঝার চেষ্টা করিস নি?
অনেক করেছি কিন্তু কোন হদিশ পাই নি।
ভেতরে ঢোকার সময়ে হাতে কি কিছু থাকে?
কি থাকবে?
এই ধর তসবি বা আগরবাতি অথবা কোন সুঘ্রাণ জাতীয় পদার্থ!
না – বাবা সিম্পলভাবে ভেতরে ঢুকে আমরা কেউ থাকলে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
সেদিন মুড কেমন থাকে মামার?
নীলুফার উত্তর দেয় – যেদিন বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দেয় সেদিন সে খুব গম্ভীর থাকে। কথা কম বলে। আর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে।
শফিক তার মামার এই ব্যাপারটাকে কোনভাবে মেলাতে পারে না। যতদূর জানে তার আতাউর মামা মানুষ হিসেবে খুবই আধুনিক। ধর্মের খুব একটা ধার ধারে না। দুনিয়ার যাবতীয় ধর্মকে আতাউর রহমান উর্বর মস্তিস্কের কল্পনার বিষ বৃক্ষ মনে করে। তবে হঁ্যা তার ধারণা – সেই প্রাচীনকালে যারা ধর্মের চাষাবাদ করেছিল, তারা অসম্ভব মেধাবী ছিল। তা না হলে তারা কিভাবে ধর্মের নামে পাপ পূর্ণের, স্বর্গ নরকের ফাঁদ পেতে দুনিয়ার তাবৎ মানুষকে বেঁধে ফেলল? ধর্ম প্রণেতারা পৃথিবী থেকে অনেক আগে হারিয়ে গেলেও এখনও তাদের রেখে যাওয়া ধর্ম দুনিয়ার মানুষের মাঝে সগৌরবে বিরাজ করছে। সেই আতাউর মামা এ জাতীয় কোন কাজ করতে পারে বিশ্বাস করতে পারে না শফিক।
আচ্ছা মামী – মামা কি টাকা পয়সা–
শফিকের মুখের কথা শেষ হতে পারে না– নীলুফার প্রবল বেগে মাথা নাড়ায়– নারে শফিক, না। প্রথম দিকে আমি সেটাই মনে করতাম। যদিও খটকা লাগতো মানুষটিতো সব কথা আমাকে আদ্যেপান্ত বলে। সেই মানুষ আমাকে না জানিয়ে কেনো টাকা-পয়সা লুকিয়ে রাখবে? তারপরও ভেবেছি – মানুষের মনতো, লুকিয়ে রাখলেও রাখতে পারে। সেই সন্দেহ থেকে তোমার মামা অফিসে যাবার পর তন্ন তন্ন করে প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজেও কোথাও কিছু পাই নি।
শফিকের মাথাটা এই মুহূর্তে অচল। কোন ভাবনা কোন ক্লু মাথায় ঢুকছে না– কেনো তার আতাউর মামা এমন রহস্যপূর্ণ আচরণ করবে? নিশ্চয় কারণ একটা আছে। কিন্তু সেই কারণ কি? সত্যি কি মামীর কথানুসারে মামা কোন নারীর প্রেমে পরেছে? মানুষের মন বোঝা বড় কঠিন। আজকাল এসব প্রচুর হচ্ছে। তা ছাড়া মামার রুচির সঙ্গে মামির তেমন কোন মিল নেই। মামা আতাউর রহমান ধর্ম মানে না বিপরিতদিকে মামি অসম্ভব ধার্মিক। এ নিয়ে প্রায়ই দুজনার মধ্যে ঝগড়া হয়। তাছাড়া মামার যে সূক্ষ্ম মনন চর্চা আছে মামি তার ধারে কাছেও নেই। মামা সমাজ সংসার নিয়ে অনেকভাবে– মামী সংসার আর নিজেকে নিয়ে সীমাবদ্ব একজন খুব সাধারণ মানুষ। মামাকে সে বুঝতেই পারে না– সুতরাং মামার মধ্যে অপ্রাপ্তি কিংবা তীব্র দুঃখবোধ থাকতেই পারে। সেই অপ্রাপ্তি আর নিজস্ব দুঃখবোধ থেকে মামা এই প্রায় পৌঢ় বয়সে কোনো নারীর প্রেমে ……
শফিকের ভাবনার মধ্যে ঢুকে পরে নীলুফার – এখন আমাকে বল তোমার মামা দরজা বন্ধ করে ভেতরে করেটা কি! আর এসব কথা মানুষকে বলা যায়?
মামী সত্যি আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, তুমি কিছু জিজ্ঞেস করো নি?
অনেকবার করেছি।
কি বলে মামা?
তোমার মামা বলে – আমার অতি গোপনীয় ব্যক্তিগত একটা কাজ করি দরজা বন্ধ করে। এবং তোমাদের বিচলিত হওয়ার দরকার কি? আমার কাজে তোমাদের কারো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। খামোখা চিন্তা করছো কেন?
শম্পা তোর ধারণা কি?
আমার ধারণা? শম্পা ঠোঁট উল্টায় – আমার ধারণা – বাবা দরজা আটকিয়ে র্প্রাথনা করে।
কি করে?
প্রার্থনা।
তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না । মামা যদি প্রার্থনাই করবে – দরজা আটকাবে কেনো? দরজা আটকিয়ে কি কেউ প্রার্থনা করে?
খেকিয়ে ওঠে নীলুফার– এই মেয়েকে নিয়ে হয়েছে আমার আর এক যন্ত্রনা। উদ্ভট সব কথা বলে বাসাটাকে রাখে গরম করে।
শফিক ভাইয়া – আমি উদ্ভট কি বললাম? শম্পা তার যুক্তি উপস্থাপন করে – তুমি জানো বাবা ধর্ম মানে না। এদেশের মুসলমানদের দৌড়তো জানো– বয়স যখন কম থাকলে ধর্মের বিরুদ্বে নানা কথা বলে। কিন্তু বয়স হলে কিংবা প্রৌঢ় হলে ধর্মের আস্তাবলে ঢুকে যায় কঠিনভাবে। ফেলে আসা দিনের অধার্মিক কাজের হিসেব গোনে আর বিপুল উৎসাহে নও ধার্মিকের মতো তিনগুন চারগুণ কখনও কখনও পাঁচগুণ বেশি ধর্ম পালন করে প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করে। আমার ধারণা– বাবা গোপনে গোপনে ধার্মিক মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে।
বুঝলাম– তোর কথানুসারে মামা এখন একজন নওমুসলিম?
মাথা ঝাঁকায় শম্পা– হ্যাঁ।
সেজন্য মামা যদি প্রার্থনা করে , তাহলে দরজা বন্ধ করবে কেনো?
করবে লজ্জায়।
একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। কেউ বুঝতে পারছে না শম্পার কথা। মন্টি হাসে। নীলূফার মুখ ভেংচায়– তোমাকে বলেছি না শফিক ওর মাথার স্কু ঢিলা হয়ে গেছে।
হাসে শফিক নিজেও –কিসের লজ্জা শম্পা?
দেখো শফিক ভাই, বিষয়টা খুব সোজা– বুঝতে পারছো না বলে ব্যাপারটাকে টেনে টেনে লম্বা করছো। বাবা সারা জীবন ধর্মের বিরুদ্ধে বলে আজ যদি হঠাৎ ধার্মিক বনে যায়, প্রার্থনায নত হয়–স্বাভাবিকভাবে আমাদের কাছে মুখ দেখানো কঠিন তার জন্য। আমরা তাকে নানা কথা শোনাবো– সে কারণেই বাবা দরজা বন্ধ করে প্রার্থনা করে গোপনে, লুকিয়ে।
আমি মামাকে যতটুকু চিনি তাতে মামা এমন করতে পারে না। আর যদি মামা সত্যি ধার্মিক হয়ে যায় – মামা তার প্রার্থণা প্রকাশ্যেই করবে। কিন্তু বিষয়টা আমি সরাসরি মামাকে জিজ্ঞেস করতে চাই– শফিক দাঁড়ায়।
কোথায় যাচ্ছো? নীলুফার জানতে চায় ।
মামার কাছে – শফিক চলে যায়। মন্টি শম্পা আর নীলুফার টেবিলে থমথমে মুখে বসে থাকে। এসব বিষয় আতাউরের কাছে খুবই স্পর্শকাতর। শফিক কি জিজ্ঞেস করতে কি জিজ্ঞেস করে তার কি প্রতিক্রিয়া হয় – ভেবে ব্যকুল হয় নীলুফার। শম্পা বরাবরের মতো নির্বিকার।
শম্পা?
কি মা?
শফিককে কি যেতে দেয়া ঠিক হয়েছে? তোর বাবা কি মনে করে!
ঠোঁট মোচড়ায় শম্পা– কেন তোমরা না শফিক সাহেবকে খুব পছন্দ করো? তোমাদের যেকোন বিপদে তাকে ডেকে আনো! ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াও! এখন প্রশ্ন কেনো?
শম্পা এটা ঠাট্টার সময় নয়– নীলুফারের কথা শেষ হতে পারে না রুদ্বশ্বাসে ঢোকে শফিক – মামি এদিকে এসো , হাত ধরে শম্পার– আয় আমার সঙ্গে। সবাইকে প্রায় টেনে নিয়ে যায় শফিক আতাউর রহমানের শোবার ঘরের পাশের বারান্দায়। বারান্দার ছোট্ট জানালার পাশে একটা বড় স্টিলের আলমারি আছে শোবার ঘরে। জানালা সামান্য ফাঁক করা– বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেতরে দৃষ্টি ফেলে দেখে সবাই– আতাউর রহমান তার বাবা মশিউর রহমানের পুরোনো কিন্তু আকারে বেশ বড় একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে করজোড়ে এবং বিড়বিড় করছে – বাবা, য়ৌবনে তোমাকে অনেক কটু কথা বলেছি। ঠিকমতো লেখাপড়ার টাকা দিতে পারতে না বলে ব্যর্থ পিতা বলে তোমাকে উপহাস করেছি। তোমার ব্যর্থতার ভেতরে হাহাকারের প্রতিধ্বনি শুনতে পাইনি। তোমাকে আযোগ্য পিতা বলে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছি– বাবা তোমার কষ্ট , অপত্য স্নেহ, নিবিড় মমতা বোঝার চেষ্টা করি নি। আজ নিজে পিতা– বুঝতে পারি সংসারের ভার বহন করা কত কঠিন। আগামীকাল শম্পার ভার্সিটিতে পাঁচ হাজার টাকা লাগবে– তুমি জানো, কত কষ্ট করে, অফিসের বসের অপমান সহ্য করে টাকাটা সংগ্রহ করেছি। বাবা, তুমিও তো এমন অপমান অনেক সহ্য করেছো আমাদের জন্য। আমাদের চার ভাই আর তিন বোনকে লেখাপড়া শিখিয়েছো– যথাসাধ্য চেষ্টা করেছো – আমাদের প্রতিষ্ঠার জন্য। বাবা, সবার হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, প্রায়ইতো চাই , বাবা- আমাদের ক্ষমা করে দাও…আতাউর রহমান নিঃশব্দে কাঁদছে।
কিন্তু সে জানে না তার সন্তান, স্ত্রী এবং আদরের ভাগ্নেও কাঁদছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে।

দুঃখিত!