না ঘুমানোর দল —- কাজী মুহাম্মদ সোলাইমান

ঘুমিয়ে আছে সবাই এখন, ঘুমিয়ে আছে দেশ

ঘুমের ঘোরে চলছে ঘড়ি, যাচ্ছে জীবন বেশ।

‘ওরা কত বৎসর ঘুমিয়ে ছিল, তোমরা কি জান?’ জানতে চাইলেন রাকিব স্যার।

ছাত্ররা সবাই নীরব রইল।

‘ওরা শত বৎসরের অধিক ঘুমিয়েছিল।’ রাকিব স্যার বলতে লাগলেন। ‘এক সময় তাদের ঘুম ভাঙল। তাদের মনে হলো তারা গতকাল ঘুমিয়েছে। এখন ঘুম ভেঙেছে। তারা ছিল ক্ষুধার্ত। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। পরস্পরের মধ্যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করল। সিদ্ধান্ত নিল একজনকে বাজারে পাঠাবে। সে খাবার কিনে আনবে। তাকে খুব সাবধানে যেতে হবে। কারণ, রাজার লোকদের কাছে ধরা পড়লে রক্ষে নেই। রাজার লোকেরা হন্যে হয়ে খুঁজছে তাদের। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের একজন বেরিয়ে আসলো গুহা থেকে। বেরিয়ে লোকটা অবাক হয়ে গেলো। পথঘাট সব অচেনা মনে হচ্ছে। একদিনে কি পৃথিবী এতো বদলে যেতে পারে? পারে না। লোকটি কিছুই বুঝতে পারল না। তারপরও বাজারে চলে গেল। তার চেহারা বেশ রুক্ষ্মসূক্ষ্ম। এমন রুক্ষ্মসূক্ষ্ম চেহারার মানুষ দেখে বাজারের লোকগুলো তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। লোকটি আরো সাবধানতা অবলম্বন করে। একটা দোকানে গিয়ে কয়েকপদের খাবার কিনে দোকানির দিকে পয়সা এগিয়ে দিল লোকটি। পয়সাটি দেখে দোকানি চমকে উঠল। এটা একটা অচল পয়সা। একশ বৎসর আগেকার রাজার মুদ্রা। দোকানি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই তো একশ বৎসর আগের পয়সা। এই পয়সা পেলেন কোথায়?’

‘একশ বৎসর?’ কেমন যেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লোকটি। ‘আমরা তো গতকাল রাজার ভয়ে আত্মগোপন করেছিলাম। একশত বৎসর হতে যাবে কেন?’ লোকটি বিস্মিত কন্ঠে বলল।

মুহূর্তে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। সবাই দৌড়ে আসতে লাগল লোকটিকে এক নজর দেখার জন্য। এই বিস্ময়কর ঘটনায় জড়িতদেরকে বলা হয় আসহাবে কাহাফ। ওরা ঘুমিয়েছিল দুচোখ বন্ধ করে জনবিচ্ছিন্ন একটা গর্তের মাঝে। আর আমরা ঘুমিয়ে আছি দুচোখ মেলে।’

‘মানুষ কি চোখ মেলে ঘুমাতে পারে?’ -প্রশ্ন করল সায়িদ।

‘আমরা দেখেও দেখি না, শুনেও শুনি না, বুঝেও বুঝি না। এটি কি ঘুম নয়?’

রাকিব স্যারের এই প্রশ্নের পর শ্রেণি কক্ষে নীরবতা নেমে আসে। ছাত্ররা পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকায়।

রাকিব স্যার সে নীরবতায় হানা দিলেন। ‘সত্যিই আমরা ঘুমন্ত জাতি। আমরা দীর্ঘকাল নীরবে ঘুমিয়ে আছি। আমাদের এই অন্তহীন ঘুম কবে ভাঙবে, কীভাবে ভাঙবে, তা কারো জানা নেই।’

একটা দীর্ঘশ্বাস স্যারের দু’নাকের ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসল। সবাই শুনতে পেল স্যারের সে যন্ত্রণাময় নিঃশ্বাস। স্যার খুব ব্যথিত হয়ে পড়েছেন। এরপর একটু থেমে আবার বললেন, ‘আসহাবে কাহাফের ঘুম ভেঙেছিল একশত বৎসর পর , আর আমাদের ঘুম কবে ভাঙবে কে জানে? আমরা মনে হয় কখনো মানুষ হতে পারব না। পশু সাম্রাজ্যের অধিবাসী থেকে যাব।’ কথাগুলো বলে তিনি কিছুক্ষণ কেদারায় বসে থাকলেন। তারপর উঠে বললেন, ‘একটা জাতিকে জাগানোর জন্য সবাইকে জাগতে হয় না। একজন জেগে উঠলে তার ছোঁয়ায় পুরো জাতি জেগে উঠে। তোমাদেরকে জেগে উঠার দায়িত্বটা হাতে নিতে হবে। তোমরা পারবে না?’

ছাত্ররা সমস্বরে জবাব দিলো ‘হ্যাঁ।’

তাদের উত্তরে রাকিব স্যার হাসলেন। বড্ড করুণ সে হাসি। হাসিটা প্রমাণ করছে, এটা প্রকৃত হাসি না। তিনি মনের সাথে লড়াই করে হাসিটা মুখে ফুটিয়ে তুলেছেন। তারপর ছাত্রদের মাঝে ষান্মাসিক পরীক্ষার রুটিন বিলি করে বেরিয়ে গেলেন।

রাত্রে পড়ার টেবিলে বসে পরীক্ষার রুটিন দেখছিল সায়িদ। বার বার ওটা দেখছিল সে। কখনো বা শিবলুর খাঁচার পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তার মনটা ঢেউয়ের দোলায় কম্পমান নৌকার মত অস্থির। কি একটা চিন্তা তাকে গ্রাস করে রেখেছে। এই সময় ভিতর হতে তার মায়ের কন্ঠস্বর ভেসে আসল, ‘কি করছ, সায়িদ?’

‘মা, আগামী মাসে আমার পরীক্ষা।’

‘ঘুমের মধ্যে তোমার পাঁচ মাস চলে গেল। খুব ভাল। যত ঘুমাতে পারবে তত ভালো। এখন পড়তে বস। তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেভাবে দিন কাটিয়ে দিয়েছ, তাতে আশা করা যায় পরীক্ষায় সবচেয়ে বড় ঘোড়ার ডিমটা তুমি পাবে। ওটা রান্না করে তোমাকে খাওয়াব। যাতে আরো বেশি ঘুমাতে পার।’ মায়ের কন্ঠে তীব্র রাগ ঝড়ে পড়ছে।

রাকিব স্যার ঘুমের কথা বলেছিলেন। এখন মা ঘুমের কথা বলছে। ‘আমি কি পাঁচ মাস ঘুমিয়ে ছিলাম?’ আত্মজিজ্ঞাসা সায়িদের। এটা কোন ধরনের ঘুম। একজন মানুষ কীভাবে পাঁচ মাস ঘুমাতে পারে? অদ্ভুত ধাঁধায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে সায়িদ।

সায়িদ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মায়ের রাগ দেখে থমকে গেল । পড়ায় মনোযোগ দিল। তার কানে রান্না ঘরের টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। মা রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ পর দরজার বাহির হতে বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। সায়িদ দরজা খুলে দিল। বাবা ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা দৈনিক পত্রিকা। বাবা হাত মুখ ধুয়ে আসার পর পত্রিকাটা নিয়ে টেবিলে বসলেন পড়তে। পড়তে পড়তে বাবা বলে উঠলেন, ‘কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে এত কিছু হলেও তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাদের এই ঘুম কবে ভাঙবে কে জানে?’

বাবার মুখে কথাটা শুনে চমকে উঠল সায়িদ। আজ সারাদিন সে ঘুমের একটা নতুন ব্যাখা শুনেছে। রাকিব স্যার, মা, বাবা তিনজনই আজ এমন ঘুমের কথা বলেছেন, যে ঘুমের সাথে তার এখনো পরিচয় ঘটেনি। নিশ্চয় এই ঘুম সাধারণ ঘুম নয়। এটা কোন ধরনের ঘুম? সায়িদ ভাবে আর ভাবে। কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। এমন সময় মা সেখানে আসলে সায়িদ মাকে প্রশ্ন করল, ‘মা, ঘুম কী?’

সায়িদের প্রশ্নটি শুনে পাশে বসে থাকা বাবা হেসে দিলেন। বললেন, আমার দিকে তাকাও। দেখ ঘুম কাকে বলে।’ বাবা চক্ষু বন্ধ করলেন। কিছুক্ষণ পর আবার চোখ খুলে বললেন, ‘এটাকে ঘুম বলে।’

বাবার কান্ড দেখে সায়িদ হাসল। ‘বাবা, আমি এই ঘুমের কথা বলছি না।’

‘কোন ঘুমের কথা বলছ? ঘুম তো ঘুমই। ঘুমের সামান্য প্রকারভেদ আছে। দিনে ঘুমালে দিবানিদ্রা ও রাতে ঘুমালে নিশি নিদ্রা। তফাত শুধু এতটুকু।’

‘বাবা, আমি এই ঘুমের কথা বলছি না।’

‘নতুন কোন ঘুম আমদানী করেছ? শুনি।’

রাকিব স্যার, মা ও কিছুক্ষণ আগে বাবার বলা কথাগুলো বাবাকে বলে সায়িদ বলল, ‘আমি এই ঘুম সম্পর্কে জানতে চায়।’

তার কথা শুনে বাবা ফিক করে হেসে বললেন, ‘ও তুমি মৎস্য নিদ্রার কথা বলছ।’

‘মৎস্য নিদ্রা কী, বাবা?’

‘মাছের চোখের পর্দা নাই। ফলে এরা চোখ বন্ধ করতে পারে না। তারা যখন ঘুমায় তখনও চোখ খোলা থাকে। কিন্তু এই খোলা চোখ দিয়ে কিছুই দেখে না।’

‘না বাবা, আমরা তো সব দেখি। আমরা আড়াইশ বৎসর যাবত কীভাবে ঘুমিয়ে আছি? একজন মানুষ কি এত বৎসর ঘুমিয়ে থাকতে পারে?’

‘রাকিব স্যার, আমি বা তোমার মা সাধারণ ঘুমের কথা বলিনি। তোমার মা তোমার সময় জ্ঞানহীনতা, লেখাপড়ার প্রতি তোমার উদাসীনতার কথা বলেছে। আমি কর্তৃপক্ষের অসততার ও অবহেলার কথা বলেছি। রাকিব স্যার এ জাতির বুদ্ধিহীনতা, অদূরদর্শিতার কথা বলেছেন। একটা জাতি যুগ যুগ ধরে ঘুমিয়ে থাকতে পারে। আমরা ঘুমন্ত ছিলাম বলে, একটা কোম্পানী ব্যবসা করতে এসে আমাদের দেশটা দখল করে নিতে পেরেছিল। আমরা বুঝতে পারিনি যে, আমাদের দেশ খুব সসত্মায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এই যে আমাদের ঘুম তা কি আজো ভেঙেছে? ভাঙেনি।’

‘তা ভাঙেনি মানে?’

‘তা ভাঙেনি মানে হলো, আমরা এখনো সচেতন হইনি। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটা স্থানে। ওখান হতে আমরা পেছনের দিকে তাকিয়ে আনন্দ পাই। আমরা আইন মানি না। আবার এদেশে প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য আইন সৃষ্টি করা হয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা যখন পশুশক্তির উপর ভর করে, মানুষের বিবেক যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্র এই রকম উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’

‘এ ঘুম কীভাবে ভাঙবে?’

‘তোমরা জেগে উঠলে সে ঘুম ভাঙবে।’

‘আমরা কীভাবে জেগে উঠবো?’

‘সে পথটা তোমাদেরকে বের করতে হবে। ইতিহাসের বাস্তবতা হতে শিক্ষা নিয়ে।’

‘আমি এই পথটা খুঁজে বের করতে চাই।’ -স্বগতোক্তি করল সায়িদ।

 

তাহসিন এক সপ্তাহ যাবৎ বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। রাকিব স্যার তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন উর্দি না পরার কারণে। যা শৃঙ্খলার লংঘন। তাকে পোষাকের কথা বললে বলত, স্যার, আগামী সপ্তাহ হতে পড়ে আসব। তাকে বারবার বলেও উর্দি পরানো গেল না। শেষ পর্যন্ত রাকিব স্যার শাস্তি দিতে বাধ্য হলেন। সে শাস্তির পর হতে আজ অবধি বিদ্যালয়ে আসেনি তাহসিন। তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি অনেককে ভাবিয়ে তুলে। রাকিব স্যার সায়িদকে পাঠালেন তাহসিনদের বাড়িতে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। সায়িদ গিয়ে দেখে তাহসিন গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। সায়িদ তার অবস্থা জানতে চাইল। তাদের কথাবার্তার সময় ঘরের ভিতর হতে বেরিয়ে আসলেন আবদুল গফুর। তাহসিনের বাবা। গায়ে একটা ছিন্ন গেঞ্জি। আবদুল গফুর বললেন, ‘দোষটা আমার। আমার সামর্থ্য নেই বলে তাকে কাপড় কিনে দিতে পারছি না। ওকে বলেছি যে দিন আমি তোমাকে কাপড় কিনে দিতে পারব সেদিন তুমি বিদ্যালয়ে যাবে।’ -কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে উঠলেন আবদুল গফুর।

সায়িদ লক্ষ্য করল, তাহসিনের চেহারাটা কেমন যেন শুকনো। একটা বিষণ্ণতা, প্রচন্ড রকমের দুর্বলতা তার মলিন চেহারায় ফুটে উঠেছে। এই সময় অন্দর মহল হতে একজন বালিকার কন্ঠ ভেসে আসল, ‘বাবা, দু’দিন যাবত তো কিছুই খেলাম না। আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকব। আর তো পারছিনা বাজান।’ -ও তাহসিনের বোন চম্পা। কথাটা শুনে আতকে উঠল সায়িদ। তাহসিনদের পরিবার দুদিন যাবৎ অনাহারে। সে দ্রুত বাড়ি ফিরে এসে বাবা মাকে সব খুলে বলল। শুনে মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি দ্রুত রান্না ঘরে গিয়ে কিছু খাবার তৈরি করে পাঠিয়ে দিলেন তাহসিনদের বাসায়। খাবারগুলো পেয়ে আবদুল গফুর যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

পরদিন বিষয়টা জানতে পেরে রাকিব স্যার খুব ব্যথিত হলেন। তিনি কালবিলম্ব না করে তাহসিনদের বাড়িতে গেলেন। সেখান হতে তাহসিনকে নিয়ে গেলেন বাজারে। পোষাক পেয়ে তাহসিন বিদ্যালয়ে আসতে লাগল। বিদ্যালয়ে তাহসিনের উপস্থিতি দেখে সহপাঠিদের সবার মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল।

বিকেলে সায়িদ ও শাকিল তাদের বাড়ির উঠোনে ক্রিকেট খেলছিল। ঐ সময় তাদের বাড়িতে একজন বৃদ্ধা হাজির হলো। সাথে তার ছেলে। সায়িদ জানতে চাইলেন, ‘কি জন্য এসেছেন আপনি?’

‘বাবা, আমার ছেলেকে লেখাপড়া করানোর জন্য সাহায্য চাই।’

মহিলার সাথে কথা বলে জানা গেল, তার এ ছেলেটি যখন ছোট তখন ছেলের বাবা অর্থাৎ মহিলার স্বামী মারা যায়। এরপর হতে ভিক্ষাবৃত্তি করে ছেলেটাকে সে মানুষ করার চেষ্টা করছে। ছেলেটি বিদ্যালয়ে যায়। পড়ার প্রতি তীব্র টান রয়েছে কিন্তু আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত মহিলাটি ছেলের শিক্ষা ব্যয় বহন করতে পারছে না। কথা বলতে বলতে মহিলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘মনে হয়, শেষ পর্যন্ত আমার ছেলে রিকশাওয়ালা হবে।’ কথাগুলো বলতে বলতে মহিলার কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা। মহিলার দীর্ঘশ্বাস দেখে সায়িদ খেলা ফেলে দৌড়ে ঘরে চলে গেল। মাকে এই দরিদ্র মহিলার সব কথা বলল। মা দৌড়ে বেরিয়ে আসলেন। মা মহিলার ছেলেটার জন্য সাহায্য করতে চাইলেন, কিন্তু বাধ সাধলেন বাবা। বাবা বললেন, ‘এ সবই ছলনা। ভিক্ষা পাওয়ার পদ্ধতি। এ দেশের ভিক্ষুকরা ভিক্ষা পাওয়ার জন্য নিজের শরীরে ক্ষত বয়ে চলে।’

বাবার কথাগুলো শুনে মা নিভৃত হলেন।

মহিলাটি চলে গেল। যাওয়ার সময় অঝোর ধারায় কাঁদল সে। তার কান্না দেখে সায়িদও কেঁদে উঠল। মায়ের চোখও ছলছল করে উঠল। কিন্তু বাবা ছিলেন নিশ্চুপ। তার বক্তব্যে অটল।

বাবা দৈনিক পত্রিকা নিয়ে এসেছিলেন। ওখানে ফিলিস্তিনের উপর বিশেষ প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে জঘন্য নির্যাতনের শিকার হল ফিলিস্তিনিরা। বর্বর ইসরাইলী বাহিনী নারী, বৃদ্ধ, শিশুসহ গণহারে হত্যা করছে ফিলিস্তিনীদের। ইহুদীরা তাদের বিবেক বিক্রি করে দিয়েছে অনেক আগে। ফিলিস্তিনীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে ঠিক, তবে তা নামমাত্র।

পত্রিকায় ফিলিস্তিনী নির্যাতনের চিত্র পড়তে পড়তে বাবার চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠল। ‘এভাবে কি ফিলিস্তিনীরা চিরকাল মার খেয়ে যাবে।’ -দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন বাবা।

বাবার দীর্ঘশ্বাস দেখে বিস্মিত সায়িদ বলল, ‘ভারী আশ্চর্য তো’।

‘আর্শ্চয মানে?’ কী হয়েছে? আশ্চর্যের বিষয়টা কী?’ বাবা জানতে চাইলেন সায়িদের কাছে।

সায়িদ বাবার চোখে লেপ্টে থাকা অশ্রু ও কিছুক্ষণ আগের ভিক্ষুককে তিরস্কার দু’টোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের চেষ্টা করল।

‘বাবা, আপনি হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ফিলিস্তিনীদের দুঃখে অশ্রু সংবরণ করতে পারছেন না। কিন্তু চোখের সামনে এদেশের মানুষের দুঃখে আপনি মোটেও ব্যথিত নন।’

‘তুমি এ কথা বলছ কেন?’

‘এই যে বিকেলে যে ভিক্ষুকটি আসল, আপনি তাকে কোন সাহায্য করতে দিলেন না।’

‘তুমি কিছু বুঝ না কেন? ফিলিস্তিনীদের কষ্ট আছে আর এসব ভিক্ষুকরা হচ্ছে প্রতারক। বেশি ভিক্ষা পাওয়ার জন্য নানান ধরনের ভান করে থাকে।’

‘বাবা, আপনি কি যাচাই করে দেখেছেন ও প্রতারক কি না?’

‘এটা যাচাই করতে হয় না। এদেশের প্রতিটি ভিক্ষুক এ পদ্ধতিতে ভিক্ষা করে।’

‘আমার বিশ্বাস এই মহিলা পেশাদার ভিক্ষুক নয়। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করছে।’

‘পড়।’ -বাবা আর কোন কথা বললেন না।

সায়িদ পড়ায় মনোযোগ দেয় কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্যখানে। সে দুটি দুঃখকে এক পাল্লায় মাপতে চায় না, কিন্তু বাবার অনুভূতিকে সম্মান দেখাতে পারে না। ভেবে ভেবে সে একটা উত্তর পেতে চায়। ফিলিস্তিনীরা পরাধীন। নিজ দেশে পরবাসী। আগাছা। এই পরাধীন ব্যক্তিদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনীদের জন্য পুরো পৃথিবী সহানুভূতিশীল। তারপর আরেকটা প্রশ্ন তার মনে উঁকি দিল। ওদের দুঃখে আমরা কাঁদছি, কিন্তু আমাদের দেশের লোকদের দুঃখে আমরা হাসছি কেন? যে সব মানুষ রেলস্টেশনে ঘুমায়, ময়লাগার হতে খাবার খুঁজে খায়, ওরা কি ফিলিস্তিনীদের চেয়ে কম কষ্ট পাচ্ছে? ওদের কাছে স্বাধীনতার কী মুল্য? ওদের জীবন তো অরক্ষিত। অরক্ষিত স্বাধীনতা মানেই তো পরাধীনতা। -প্রধান শিক্ষক আহমদ রেযা এ কথাটি বারবার বলেন। ওরা স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষ।

এই উত্তরটাও কেমন যেন যুৎসই মনে হল না তার কাছে। এরপর তার মনে নতুন উত্তর আসল।

‘ফিলিস্তিনীরা মুসলমান। পুরো পৃথিবীর মুসলমানরা এক শরীরের মতো। শরীরের কোন এক অঙ্গে বেদনা অনুভূত হলে পুরো শরীরে তা অনুভূত হয়।’ কয়েকদিন আগে ওয়াজ মাহফিলে যেমন হুজুর বলেছিলেন। কিন্তু না। এই উত্তরও তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। ফিলিস্তিনীরা মুসলমান কিন্তু এদেশের রাস্তাঘাটে, পথে পথে যারা অরক্ষিত জীবন যাপন করছে, তারা কি মুসলমান নয়? যদি ফিলিস্তিনী মুসলমানদের জন্য আমরা কাঁদতে পারি, বাংলাদেশি মুসলমানদের জন্য আমরা কাঁদব না কেন?

‘তুমি এমন করে কি ভাবছ?’ -চিন্তিত ছেলের মুখপানে তাকিয়ে জানতে চাইলেন বাবা।

‘বাবা, আমার ভাল লাগছে না। আমি আজ আর পড়ব না।’

‘ঠিক আছে। ভাল লাগলে আবার পড়তে বসিও।’

বাবার সম্মতি পেয়ে টেবিল হতে উঠে পড়ল সায়িদ। উঠে শিবলুর খাঁচার দিকে এগিয়ে গেল সে। শিবলু ওদের পোষা তোতা পাখি। সায়িদ শিবলু, ফিলিস্তিন ও বিকেলে আগত দরিদ্র মহিলাটির মধ্যে তুলনা করতে চেষ্টা করল। শিবলুর জন্য ওদের পরিবারের সবার ভালবাসা আছে। কিন্তু ঐ দরিদ্র মহিলার জন্য কয় জনের সহানুভূতি আছে। ঐ মহিলা তার যন্ত্রণার কথা দশজনকে বললে, একজন হয়ত সাড়া দিচ্ছে। কেন এই অসামঞ্জস্য সহানুভূতির ধারা? সে এর একটা উত্তর খুঁজে পায়। যারা দৃশ্যমান পরাধীন থাকে, তারা বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা, সহানুভূতি পেয়ে থাকে, কিন্তু যারা অদৃশ্যভাবে পরাধীনতার শিকলে বন্দি জীবন অতিবাহিত করে তাদের সাহায্য সহানুভূতি প্রদর্শন করার কেউ থাকে না। আমাদের দেশের ফকির মিসকীনদের এই অদৃশ্য পরাধীনতার যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। এ সব লোকদের জন্য আমাকে কিছু করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? -ভাবতে থাকে সায়িদ।

 

ভবগঞ্জে ব্যাপক চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়েছে। পুরো এলাকা হঠাৎ এক জীয়ন কাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে। এলাকায় একজন মহান ফকিরের আবির্ভাব ঘটেছে। যার ফুঁক দেওয়া পানি পান করলে যে কেউ সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। লোকটি বটতলার পাশে আস্তানা গেড়েছে। আগত লোকদের সেবা শশ্রুষা করছে তার কয়েকজন শিষ্য। এই চিকিৎসার জন্য লোকটির কোন দাবী নেই। তার আস্তানা ঘিরে অস্থায়ী পানের দোকান, চায়ের দোকান ও পানির দোকান বসেছে। তবে পানির দোকান বেশি। দূর দূরান্ত হতে লোকেরা এখানে এসে ভীড় করছে। সায়িদ মাহবুবের বরাতে জানতে পারল, গোবিন্দপুর গ্রামের একজন অন্ধলোক সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। নাসিরনগরের একজন বোবা লোক কথা বলতে শুরু করেছে। একজন ক্যান্সার রোগী আরোগ্য লাভ করেছে। আরো কতজনের কত রোগ ভাল হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সব শুনে লোকটির ব্যাপারে সায়িদের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হলো। আরমান, তাহসিন, মাহবুব, মিন্টু, ইকবাল মাহফুজ সবাইকে নিয়ে সায়িদ হাজির হল লোকটির দরবারে। তারা সেখানে গিয়ে দেখে হাজার হাজার লোকের ভীড়। সবার হাতে পানির বোতল। সবাই ফকিরের ফুঁক দেওয়া পানি পেতে উঠে পড়ে লেগেছে।

সায়িদ একজনের কাছে জানতে চাইল, ‘এই পানি পড়া খেয়ে কয়জন লোক ভাল হতে দেখেছেন?’

লোকটি জবাব দিল শুনেছি পাশের গ্রামের আবুল খায়েরের ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে।

সায়িদ আরেকজনের কাছে জানতে চাইল, ‘কেউ ভাল হয়েছে এমন প্রমাণ আপনার আছে?’

‘বাবা, শুনেছি অনেকে ভাল হয়েছে।’ -বলল লোকটি।

সায়িদ আরো কয়েকজনকে প্রশ্ন করে একই উত্তর পেল।

এই সময় একজন শিষ্য এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবারা তোমরা কী জানতে চাও, আমাকে বলো।’

‘এখানে এত লোক কেন এসেছে?’ -প্রশ্ন করল সায়িদ।

‘আপনি কি প্রশ্ন করছেন, বাবু! আপনি কি শুনেননি আমাদের বাবার পানি পড়া যে পান করে, সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।’

‘ভালো হয়েছে এ রকম কয়েকজনের ঠিকানা কি আপনি আমাকে দিতে পারবেন?’

‘অবশ্যই।’

‘আপনি দু’তিনজনের ঠিকানা দেন, আমরা যাচাই করে দেখব।’ সায়িদ বলল।

লোকটি কয়েকজনের ঠিকানা বলল।

সায়িদ বলল, ‘ঠিক আছে। আমরা যাচাই বাচাই করে আপনার কাছে আসব।’ -সায়িদের কথা শুনে লোকটির চেহারা কেমন যেন বির্বণ হয়ে গেল।

বিকেলে সায়িদ, আরমান,তাহসিন, মাহবুব, মিন্টু, ইকবাল ও মাহফুজ বের হয়েছে ফকিরের পানি পড়া পান করে সুস্থ হওয়া লোকদের খোঁজ খবর নিতে। ওরা গোবিন্দপুর যাবে। পথে ভবগঞ্জ সড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে। কাঁচা সড়কে ইট বিছানোর কাজ চলছে। দেখলে বুঝা যায়, অত্যন্ত নিম্নমানের ইট ব্যবহার করা হচ্ছে।

‘এই ইটগুলোতো অত্যন্ত নিম্নমানের।’ -আরমান সায়িদকে বলল।

‘এই রাস্তাতো দুই মাসও ঠিকবে না।’ -সায়িদ প্রত্যুত্তর করল।

‘এখানে বিশাল অংকের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। এরা এভাবে নিজেদের স্বার্থের জন্য দেশকে বরবাদ করে দিচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করতে হবে।’ -আরমানকে খুব প্রতিবাদী দেখাচ্ছে।

‘আমরা ছোট, আমরা কি করতে পারি?’ -মাহবুব বন্ধুদের কাছে অসহায়ত্ব তুলে ধরতে চেষ্টা করল।

‘আমরা চেষ্টা করলে, অনেক কিছু করতে পারি।’ -জবাব দিল সায়িদ।

তারা আরো নানান কথা বলতে বলতে এগুচ্ছিল। পথে একটা জটলার মধ্যে হৈচৈ দেখে সবাই সেখানে থমকে দাঁড়াল। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে, একটা লোককে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে লোকটাকে দেখছে আর নানান মন্তব্য করছে। সায়িদ লোকটাকে বেঁধে রাখার কারণ জানতে চাইলে উর্দি পড়া দারোওয়ান বলল, ‘ব্যাটা পাকা চোর। ইট চুরি করে পুকুরে ফেলার সময় হাতেনাতে ধরে ফেলেছি।’

দারোওয়ানের কথা শুনে কথিত চোরটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘মুখ সামলে কথা বল। তোরাই এক নম্বর চোর। তিন নম্বর ইট দিয়ে রাস্তা বানাচ্ছিস। এই ইট যতদিন থাকবে ততদিন আমার এই চুরি চলবে।’

-লোকটির প্রতিবাদের ধরন বলে দিচ্ছে, লোকটি চোর নয়। সায়িদ মনে মনে ভাবল। তাছাড়া তারা নিজেরাও দেখেছে, এই ইটগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের। সায়িদ লোকটির নিকটবর্তি হয়ে জানতে চাইল, ‘আপনি বলুন, কী হয়েছে?’

দারোওয়ান বলল, ‘চোরের সাথে কি কথা? চোর কি কখনো নিজেকে চোর বলে?’

সায়িদ দারোওয়ানের কথা কানে তুলল না। বেঁধে রাখা লোকটির আরো নিকটবর্তি হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে বলুন তো।’

লোকটি অসহায় দৃষ্টিতে সায়িদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা, ওরা তিন নম্বর ইট দিয়ে রাস্তা বানাচ্ছে। সরকার তাদেরকে এক নম্বর ইট দিয়ে রাস্তা বানাতে বলেছে। আমি এর প্রতিবাদ করেছি বলে, ওরা——’ -লোকটি ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল।

তারা জটলা হতে বেরিয়ে আসল। নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, এই লোকটি ঠিকাদারের অসৎ কর্মের প্রতিবাদ করায় ষড়যন্ত্রের শিকার। তবে বিষয়টা আরেকটু তদন্ত করা দরকার। যদি আরো তদন্তে প্রমাণ করা যায় যে লোকটি নির্দোষ, তবে লোকটিকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। না হলে কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে লোকটিকে কারাগারে যেতে হবে।

সায়িদ আরমান আরো কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য লোকটির নিকট যেতে চাইলে দারোওয়ান আবার বাধা দিয়ে বলল, ‘এই ছেলেরা চোরের প্রতি তোমাদের এত দরদ কেন? চোরের সাথে কথা বলা যাবে না। যাও, তোমরা যেখানে যাচ্ছ, এক্ষুণি চলে যাও। না হলে তোমাদেরকে সোজা লাল দালানের বাসিন্দা করে দিব।’

‘উনি চোর হলেও মানুষ তো। মানুষ হিসেবে কৈফিয়ত দেবার অধিকার তো তার আছে।’ -আরমান প্রতিবাদ করে বলল।

‘চুরি করার আগে সে মানুষ ছিল, এখন সে চোর।’

‘এই ব্যাটা, মুখ সামলে কথা বলিস। তোরাই এক নম্বর চোর। পুরো দেশ চুরি করছিস।’ -বেঁধে রাখা লোকটি আবার প্রতিবাদ করল।

‘আচ্ছা ভাই, আপনি ইটগুলো কোথায় ফেলছিলেন? কেন?’ -সায়িদ জানতে চাইল লোকটির কাছে।

‘আমি তাদের সামনে এই পঁচা ইটগুলো ঐ পুকুরে ফেলছিলাম। আমি চোর না। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। আমার বাড়ি গোবিন্দপুর। এখান হতে পাঁচ মাইল দূরে। আমি বেঁচে থাকতে তাদেরকে এই ইট দিয়ে রাস্তা বানাতে দিব না।’ -লোকটি চেঁচিয়ে বলল।

‘আমরাও এই ইট দিয়ে রাস্তা বানাতে দিব না।’ -সায়িদ লোকটির কথায় সমর্থন জানাল।

‘দিবি না মানে। রাস্তা কি তোর বাপের।’ -দারোওয়ান লোকটি বলল।

‘রাস্তা আমার বাপের না। কিন্তু এই ইটের রাস্তা দুমাসও টিকবে না।’ -সায়িদ দৃঢ় কন্ঠে বলল।

‘আমাদেরকেও চোর হিসেবে বেঁধে ফেলুন।’ -আরমান প্রতিবাদ জানালো।

সায়িদদের প্রতিবাদের পর মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যপট বদলে গেল। উত্তেজিত লোকেরা পাশের স্ত্তপ হতে ইটগুলো পুকুরে ছুড়ে মারতে শুরু করল। সায়িদ লোকটির বাঁধন খুলে দিল।

অবস্থা বেগতিক দেখে দারোওয়ানটি পালাতে শুরু করল। সবাই দারোওয়ানটিকে চোর চোর বলে তাড়া করল। কিন্তু ধরতে পারল না।

পরিস্থিতি একটু শান্ত হবার পর সায়িদরা লোকটিকে নিয়ে গোবিন্দপুরের দিকে চলতে শুরু করল।

যেতে যেতে আলাপ করতে করতে তারা জানতে পারল, লোকটির নাম আলী হাকিম। তিনি এই রকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করে অনেকবার লাঞ্ছিত হয়েছেন। কিন্তু প্রতিবাদ করা কখনো বন্ধ করেননি। আলী হাকিম তাদের সামনে ঘোষণা দিলেন, তিনি আমৃত্যু অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাবেন। সায়িদ আলী হাকিমকে তাদের গোবিন্দপুর যাওয়ার উদ্দেশ্য বর্ণনা করল। আলী হাকিম আফসোস করে বললেন, হায়রে জাতি! তোমরা চিরকাল ঘুমের মধ্যে থেকে যাবে।’ একটু বিরতি নিয়ে আলী হাকিম বললেন, ‘এটা আমাদের হুজুগ প্রীতির ফল। আমরা তো আকর্ষণীয় কোন কথা শোনামাত্র দৌড়তে শুরু করি। একজনকে দৌড়তে দেখলে দশজন দৌড়তে আরম্ভ করি। ঐ লোকটা কেন দৌড়াচ্ছে এর সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন অনুভব করি না। আমি তোমাদেরকে আমার দাদার একটা গল্প বলি।

আমার দাদার স্বচক্ষে দেখা ঘটনা এটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে দাদারা দূরের এক গ্রামে পালিয়ে যাচ্ছিল। মানুষের দীর্ঘ সারি ছিল ওঠা। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ শোনামাত্র সবাই দৌড়তে শুরু করল। কয়েকজন লোক তাদেরকে না দৌড়ার পরামর্শ দিতে চায়। কিন্তু কে শুনে কার কথা? জীবনের সেরা কাজ হলো প্রাণ বাঁচানো। প্রায় দু’ঘন্টা দৌড়ে যখন সব শক্তি হারিয়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে গেছে অনুভব করল, তখন নানা জন নানা মন্তব্য করতে লাগল। কেউ বলল, সে শুনেছে হানাদার বাহিনী পাশের গ্রামে অবস্থান করছে। কেউ বলল, আমি নিজ চক্ষে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে দৌড়ে এগিয়ে যেতে দেখেছি। কেউ বলল, দৌড়তে দৌড়তে আমি পাঁচজন পাকিস্তানি সৈন্যের লাশ দেখেছি—–ইত্যাদি, ইত্যাদি।

তখন দাদা এগিয়ে গিয়ে প্রকৃত সত্যটা বর্ণনা করলেন। পথে ইস্পাতের ব্রীজটা পাড়ি দেওয়ার সময় একজনের হাত হতে একটা পানির মগ সেতুর উপর পড়ে বিকট শব্দ হয়েছিল আর তাতেই এত হৈচৈ আর গুজবের ডালপালা।

এইভাবে সব কিছু বিচার বিবেচনাহীনভাবে গ্রহণ করি বলেই তো আমরা হুজুগে বাঙালি। এই ফকিররাও মানুষের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে ধান্ধা করছে। ওরা টাকা নিচ্ছে না কিন্তু মানুষ তো টাকা দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হবার আশায় বেশি বেশি টাকা দিচ্ছে। এটা ব্যবসার একটা বিশেষ পদ্ধতি। আমি তাদের ভন্ডামীর মুখোশ উন্মোচন করতে তোমাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্ত্তত। তোমরা যেভাবে বিষয়টা যাচাই করতে এসেছ, তাতে আমি খুব আনন্দিত। আমরা হলাম ঘুমন্ত জাতি। শত শত বৎসর যাবৎ সূর্যের আলো এড়িয়ে ঘুমিয়ে আছি। কিন্তু তোমাদের কাজে কর্মে আমি জেগে উঠার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি।’ -আলী হাকিমের চেহারায় চাঁদের মতো আলো ছড়িয়ে পড়ল।

আলী হাকিম তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা চলে যাও, পুরো বিষয়টা আমি দেখব।’

 

দু’দিন পর বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় দু’জন লোকের কথাবার্তা সায়িদের কানে আসে। এ লোকগুলো রাস্তায় বেঁধে রাখা এক চোরের কথা বলছিল। তাদের কথা শুনে সায়িদের অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া হলো। তার মন বলতে লাগল, ঐ বেঁধে রাখা লোকটা আলী হাকিম ছাড়া কেউ হতে পারে না। সায়িদ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর লোকগুলোর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘লোকটাকে কোথায় বেঁধে রাখা হয়েছে?’ তারা জানাল, ‘এখান হতে আধাকিলোমিটার দূরে একটা পুকুর পাড়ে।’ -উত্তর শুনে সায়িদের সন্দেহ আরো ঘনিভূত হলো। সে দ্রুত বিদ্যালয়ে গিয়ে সবাইকে বিষয়টা অবহিত করে বের হতে বলল।

বিদ্যালয়ের ২০/২৫ জন ছাত্র একযোগে ছুটে গেল ঘটনাস্থলে। সায়িদের সন্দেহটাই ঠিক। আলী হাকিমকে আবার চোর সাব্যস্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার নাক ও কপাল হতে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সায়িদদের দেখে আলী হাকিমের মুখে গোলাপের মতো হাসি ফুটে উঠল। আরমান আলী হাকিমের বাঁধন খুলে দিতে গেলে আগের সেই দারোওয়ানটা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কেডা? চোরের ছেলে না কি?’

‘চিনতে পারছেন না। গতবারের কথা মনে নেই।’ -লোকটির দিকে চেয়ে বলল আরমান।

লোকটি আরমানকে চিনতে পেরে বলল, ‘এবার কিছু করতে পারবা না। সোজা গারদে পাঠামু।’

লোকটিসহ আরো তিনজন দারোওয়ান আরমানের দিকে এগিয়ে গেলে সহপাঠিরা সবাই প্রতিরোধ গড়ে তুলল। সায়িদ উপস্থিত মানুষদের সামনে গতবারের ঘটনা তুলে ধরলে জনতা উত্তেজিত হয়ে দারোওয়ানদের মারতে শুরু করল। দু’জন দারোওয়ান কোন রকমে পালিয়ে গেল সেখান হতে। কিছুক্ষণ পর ঠিকাদারসহ তারা ফিরে আসলে উত্তেজিত জনতা তাদেরকে চোর চোর বলে তাড়া করল। তারা ঘোষণা দিল এ ঠিকাদারকে কোন কাজ করতে দেওয়া হবে না। সবগুলো ইট পুকুরে ফেলে দেওয়া হলো। পরে আহমদ রেযার মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতা হলো। ঠিকাদার লিখিতভাবে অঙ্গিকার করল নিম্নমানের ইট দিয়ে সে রাস্তা বানাবে না।

আলী হাকিম সায়িদদের সাথে দেখা করতে আসার সময় দারোওয়ানদের হাতে পাকড়াও হয়েছিল। তিনি কথিত ফকিরের শিষ্য কর্তৃক প্রদত্ত ঠিকানাগুলো যাচাই শেষে সায়িদদের সাথে দেখা করতে আসছিলেন। পথে খারাপ ইটগুলো দেখে আর সহ্য করতে পারেননি। ঐ ইটগুলো পুকুরে নিক্ষেপ করতে শুরু করলেন। এই সময় দারোওয়ানরা তাকে ধরে ফেলে। ছাড়া পেয়ে আলী হাকিম সায়িদদের সাথে বিদ্যালয়ে চলে আসলেন। তাদেরকে জানালেন, ফকিরের দেওয়া তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। তারা সবাই ছুটল ফকিরের আস্তানায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারল, দুদিন হতে ফকির ও তার শিষ্যদের কোন খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। -সায়িদ ঘোষণা দিল এটা আমাদের দ্বিতীয় বিজয়।

‘ইংরেজদের দুইশত বৎসরের শাসনকালে এদেশবাসী যে একদম ঘুমিয়ে ছিল তা নয়। এই সময় যুগে যুগে কিছু মানুষ জেগে উঠেছিল। সরকারের বিরুদ্ধে যে নানা ধরনের বিদ্রোহ হয়েছিল, তা ছিল এই জেগে উঠা মানুষদের প্রচেষ্টার ফল। হাজী শরীয়ত উল্লাহ, মীর নিসার আলী তিতুমীর, ফকির মজনু শাহ, মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, টিপু সুলতান, সুর্যসেন, প্রীতিলতা এই সব জাগ্রত মানুষদের মধ্যে অন্যতম। তারা বিভিন্ন সময় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাদের ডাকে অনেকে সাড়াও দিয়েছিল। তবে আন্দোলনগুলো ব্যক্তি নির্ভর ছিল বলে, তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে আন্দোলনেরও মৃত্যু ঘটেছিল। তারা আন্দোলনগুলোর স্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আন্দোলনগুলোর এই পরিণতি ঘটেছিল। তাদের মৃত্যুর পর লোকেরা আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। কোন আন্দোলন সৃষ্টি করলে হয় না, এর একটি স্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো দিতে হয়। এই যে এতগুলো আন্দোলনের মৃত্যু ঘটল, এদের কোন একটিরও যদি স্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়া যেত, তবে আমাদের দেশ অনেক আগে স্বাধীন হয়ে যেত। মানুষের মধ্যে ক্ষণিকের আবেগ তৈরি করে কোন মহৎ উদ্দেশ্যে সফল হওয়া যায় না।’ -বলতে বলতে থামলেন প্রধান শিক্ষক আলী রেযা। তিনি পঞ্চম শ্রেণির ইতিহাস ঘন্টা নিচ্ছিলেন। বিষয়বস্ত্তর ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলনের বিবরণ দিচ্ছিলেন। সায়িদ আহমদ রেযা স্যারের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনতে শুনতে ভাবনার অতলে হারিয়ে গেলেন। তাকে এই রকম কিছু একটা করতে হবে। যাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। এই সময় আহমদ রেযা স্যার বললেন, এই যে তোমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে খন্ড খন্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলছ, ভন্ড ফকিরকে তাড়িয়েছ, ঠিকাদারকে ভাল ইট দিতে বাধ্য করতে পেরেছ, এভাবে কি সফল হওয়া যায়? যায় না। বরং তোমরা নিজেরা বিপদগ্রস্ত হচ্ছ। ঠিকাদাররা যে কোন সময় তোমাদের ক্ষতি করতে পারে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চাই স্থায়ী কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা। যাতে অন্যায়কারী সমাজে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

‘স্যার, আপনার এই পরামর্শটা খুব মুল্যবান।’ -স্বগতোক্তি করল সায়িদ। ‘আমাকেও স্থায়ী কিছু করতে হবে।’

‘কেউ ভিক্ষা চাইল, আর তাকে দশটা টাকা দিলাম। এটা কোন সমাধান নয়। সমস্যাকে জিইয়ে রাখা। সমাধান হলো, ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করার মধ্যে। তাকে কুঠার কিনে দেওয়ার মধ্যে।’ বলল আরমান।

‘তাদের জন্য স্থায়ী কিছু করতে হবে।’ -বলল মিন্টু।

‘আমি তো এই কথায় বলছি।’ -আরমান বলল।

কথা হচ্ছিল সায়িদ, তাহসিন, আরমান, মাহবুব ও মিন্টুর মধ্যে। এরা সবাই সহপাঠি। নবজাগরণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সবাই। এক মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে আলোচনায় বসেছে। তাদের আলোচনার বিষয় দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য করা। যাতে এই দরিদ্র ছাত্ররা নির্বিঘ্নে অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। এই বৈঠকের প্রস্তাব সায়িদ প্রথম তাদের দিয়েছে। তাহসিনের বাবার আর্থিক অবস্থা, বাবার সাথে ফিলিস্তিন ও দারিদ্র মহিলার ঘটনা নিয়ে আলোচনা, ইতিহাস ঘন্টায় আহমদ রেযা স্যারের আলোচনার পর সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত যে, এদের জন্য একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করা দরকার। তার চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে সবাই আলোচনায় বসেছে।

‘সব ঠিক আছে। কিন্তু আমরা কি করতে পারি? আমরা তো ছাত্র। মুরববীরা তো কিছু করছে না।’ -বলল মাহবুব।

‘ওরা কিছু করছে না বলে, আমরাও কি কিছু করব না? এইভাবে আর কতদিন ঘুমিয়ে থাকব? -আরমান বলল।

আরমানের মুখে ঘুম শব্দটি শুনে সায়িদ হাসল।

‘আমরা কি করব?’ -জানতে চাইল মাহবুব। তার মাথায় কিছু আসছে না। ‘আমরা এক টাকার জন্যও বাবার কাছে বায়না ধরি।’

‘কেউ ভালো কাজের উদ্যোগ নিলে, দশজন তার সহায়তায় এগিয়ে আসে। তবে একজনকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হয়। রাকিব স্যারের কথা বলি। স্যার বলেছিলেন, ‘পুরো জাতিকে জাগিয়ে দিতে শুধুমাত্র একজনের ঘুম ভাঙতে হয়।’ -সায়িদ বলল।

‘আমরা যত চেষ্টা করিনা কেন, কিছু করতে পারব না।’ -বলল মাহবুব।

‘আমরা কি করতে পারি, তাই নিয়ে প্রত্যেকে চিন্তা করব। প্রত্যেকে নিজ নিজ মতামত পেশ করব। যেটা ভাল মনে হয় তা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী এগিয়ে যাব।’ -বলল সায়িদ। ‘চেষ্টা করলে আমরা অবশ্যই কিছু করতে পারব।’

কি করা যায় এ নিয়ে তারা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। আরেকটা সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈঠক শেষ করল।

প্রত্যেক মানুষ অনন্য মানুষ। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ নিজেকে চিনতে পারে না, জানতে পারে না। সে জন্য নিজেকে বিকাশ করতে পারে না। তার অমিত সম্ভাবনা তার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে। ওটা জাগ্রত হয়ে উঠে না। বিকাশ লাভ করে না। এই গুপ্ত মহামানুষটাকে ঘুমিয়ে রেখে মানুষটা কবরে চলে যায়। মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এটাই। নিজের ভিতরে যে অনন্য মানুষটা বাস করে তাকে বিকশিত করার অন্যতম শর্ত হলো, আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার পরিহার। মানুষ যখন আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা পরিহার করে এগিয়ে চলতে শুরু করে, সমাজের বৃহত্তম কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে তখন হতে তার মনুষ্যত্ব বিকাশ হতে শুরু করে, এটাই মানুষের অনন্যতার প্রথম ধাপ।

-বলতে বলতে থামলেন রাকিব স্যার। তিনি ছাত্রদের দিকে তাকালেন। হয়ত ছাত্রদের মধ্যে অনন্যতার খোঁজ করছেন, তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দ্বারা। তিনি পঞ্চম শ্রেণির শ্রেণি শিক্ষক।

‘স্যার, আমরাও কি অনন্য মানুষ হতে পারব?’ -জানতে চাইল সায়িদ।

‘অবশ্যই। তুমিও একজন অনন্য মানুষ। তবে শর্ত হলো, তোমাকে সে অনন্যতার বিকাশ ঘটাতে হবে।’

‘স্যার, কীভাবে এর বিকাশ ঘটাতে পারি?’ মিন্টু জানতে চাইল।

‘এর বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে বিভিন্নতা দেখা যায়। সবাই যদি একটা বিষয় নিয়ে পড়ে থাকে, তবে তো অনন্যতা হলো না। সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্প, মানব সেবা, অর্থনীতি, শান্তি, রাজনীতি, ইতিহাস, গবেষণা, উদ্ভাবন, ইত্যাদির মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তোমাকে এরূপ একটা ক্ষেত্রে নির্বাচন করতে হবে। নিজের অনন্যতাকে প্রকাশ করার এটাই একমাত্র শর্ত।’

‘স্যার, দরিদ্র ছাত্রদেরকে কীভাবে সাহায্য করা যায়, তাই নিয়ে আমরা কয়েকজন চিন্তা ভাবনা করছি—-সায়িদ কথা শেষ করতে পারল না।

‘যদি তোমরা সফল হও তবে আমি বলব, তোমরা যারা এই প্রক্রিয়ায় জড়িত, তোমরা সবাই অনন্য মানুষে পরিণত হবে। তোমাদের জন্য শুভ কামনা রইল। দরকার হলে আমাকেও তোমাদের দলভূক্ত করিও।’

স্যারের অনুপ্রেরণা পেয়ে তাদের উৎসাহের মাত্রা আরো বেড়ে গেল।

সায়িদ,তাহসিন, আরমান, মাহবুব, মিন্টু, ইকবাল ও মাহফুজ আবার বৈঠকে বসেছে। পূর্ববর্তি বৈঠকের ধারাবাহিকতায় এই আলোচনা সভা। তারা বিদ্যালয় কেন্দ্রিক কিছু একটা করতে চায়।

‘তোমরা শুধু আমি তাহসিনকে দেখেছ। আমাদের এখানে শত শত তাহসিন আছে, যাদেরকে সাদা চোখে দেখা যায় না। আমি তাদের অনেককে চিনি।’ -বলল তাহসিন।

‘সে দিন একজন আমাকে বলল, সে সকালে কিছু না খেয়ে বিদ্যালয়ে চলে আসে। দুপুরেও বাড়িতে গিয়ে ভাত খায়।’ -বলল মাহবুব। আরো যোগ করল, ‘তারা এতো গরীব যে, রাত্রে এক মুঠো ভাত সবাই ভাগ করে খায়। কিন্তু আমরা কী করতে পারব, আমরা এখনো ছাত্র?’

‘তুই, বারবার শুধু নিরাশাটাকে দেখিস। কোথাও আশার আলো দেখিস না। কারণটা কী?’ -সায়িদ জানতে চাইল মাহবুবের কাছে।

‘আমরা কী করতে পারব? কিছু করতে পারব না।’ -আবার বলল মাহবুব।

‘অবশ্যই করতে পারব। এটা চাঁদে যাওয়ার মতো জটিল কোন কাজ নয়।’ -আরমান বলল।

‘মাহবুব তোর বাজে কথা বাদ দে। আমরা অবশ্যই কিছু করতে পারব। আমাদের দায়িত্ব হবে অসহায় ছাত্রদের চিহ্নিত করা। যাতে তাদের সাহায্য করতে পারি। এখন এ ব্যাপারে আমাদের আলোচনা শুরু হোক। তোর বাজে কথা নিয়ে নয়।’ -বলল সায়িদ।

‘আমি চিন্তা করেছি, আমরা প্রত্যেকে একজন করে দরিদ্র ছাত্রের দায়িত্ব নিব। যার দায়িত্বে যে থাকবে সে তাকে সাহায্য করবে।’ -মিন্টু প্রস্তাব করল।

‘না। তা হয় না।’ -প্রতিবাদ করল তাহসিন। ‘আমরা যেখানে মা-বাবার উপর নির্ভরশীল, সেখানে আরেকজনের দায়িত্ব কীভাবে নিব?’

‘হ্যাঁ, এটাই তো মূল কথা। আমরা শুধু ওদের নিয়ে বড়জোড় আলোচনা করতে পারি। কোন লাভ নেই।’ -বলল মাহবুব।

‘আমরা একটা সমিতি গঠন করব। সমিতির সদস্যরা প্রতিমাসে দশ টাকা হারে চাঁদা দিব। সে টাকা দিয়ে আমরা অসহায় ছাত্রদের সাহায্য করব।’ -ইকবাল তার মতামত পেশ করল।

ইকবালের মতামতটাতে মাহবুব ভেটো প্রয়োগ করল। বলল, ‘আমরা অনেক সমিতি করেছি, একটাও টিকে থাকেনি।’

‘তবে আমরা কী করতে পারি?’ -প্রশ্ন করল ইকবাল।

‘একটা কাজ করা যায়। আমরা প্রতি মাসে বাড়ি হতে টাকা নেবার সময় ১০/১৫ টাকা বেশি করে নেব। তা এক জায়গায় জমা করব।’ প্রস্তাব দিল আরমান।

‘ওটাই তো সমিতি।’ -বলল মাহবুব।

আরো কয়েকটা প্রস্তাব আসল। কিন্তু মাহবুবের যুক্তিতে সব বাতিল হয়ে গেল।

একের পর এক প্রস্তাব বাতিল হতে থাকায় সায়িদ কিছুটা হতাশ হয়ে উঠল।

সায়িদ, মাহফুজ ও তাহসিনের প্রস্তাব জানতে চাইল।

তারাও কোন প্রস্তাব দিতে পারল না।

‘তাহসিন হচ্ছে দারিদ্র্যতার শিকার একজন ছাত্র। আমরা তার কাছ থেকে ভাল প্রস্তাব আশা করি।’ -বলল মিন্টু।

‘ঠিক আছে। আমরা যেহেতু কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি, তাই আমরা আরেকটা বৈঠকে মিলিত হবো।’ আরমান প্রস্তাব দিল। আরো বলল, ‘ওখানে প্রত্যেকের প্রস্তাব দেওয়া বাধ্যতামূলক।’

নির্ধারিত সময়ে পরবর্তি বৈঠকে বসতে পারল না তারা। কারণ, একটা দুর্ঘটনা। ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যে দুর্ঘটনার কবলে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে অনেক কিছু। ফুটবল খেলা চলছিল। মাহবুব ও তাহসিন ছিল দু’বিপরীত দলে। তাহসিন বল নিয়ে প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের কাছে পৌঁছে যায়। একটা হেড যথাযথ হলে গোল যাবে। সম্ভাব্য গোল বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসে মাহবুব। তাহসিন হেড করতে যাবে ঐ সময় কিক করে বলটা বাইরে ফেলে দিতে চেয়েছিল মাহবুব। মাহবুবের পা গিয়ে আঘাত হানল তাহসিনের মুখে। এই আঘাতে মাহবুবের পা কেটে গেল তাহসিনের দাঁতের আঘাতে। আর তাহসিনের দুটো কাঁচা দাঁত পড়ে গেল মাহবুবের পায়ে লেগে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর দেখা গেল তাহসিনের বাবার ওষুধ কেনার সার্মথ্য নেই। তাই কয়েকদিন বিনা ওষুধে থাকতে হল তাকে। এতে তাহসিনের মুখের ব্যথা মারাত্মক আঘাত ধারণ করল। মিন্টু হচ্ছে তাহসিনদের নিকটতম প্রতিবেশী। মিন্টুর বাবা আকরাম একটা ভাল চাকুরী করেন। আকরামের কাছে আব্দুল গফুর কিছু টাকা ধার চেয়েছিলেন ছেলের চিকিৎসার জন্য। আকরাম জানালেন, তার হাতে কোন টাকা নেই। তিনি খুব অভাবে আছে। টাকার অভাবে তাহসিনের চিকিৎসা হল না। তাহসিনের অবস্থা বেগতিক দেখে তার সহপাঠিরা এগিয়ে আসল। তারা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে তাহসিনকে ডা. মুনতাসিরের কাছে নিয়ে গেল। ডা. মুনতাসিরের ফি পাঁচশ টাকা। সায়িদরা টাকা তুলেছে তিনশ। আরো দু’শ টাকা কম। ডা. মুনতাসির যখন জানল দু’শ টাকা কম তিনি তাহসিনের চিকিৎসা করাতে অস্বীকার করলেন। সবাই তাকে অনেক বুঝাল, কিন্তু কাজ হলো না। তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসল। পরে তারা আরেকজন ডাক্তারের কাছে তাহসিনকে নিয়ে গেল। তার চিকিৎসাতে ভাল হয়ে উঠল তাহসিন। এই ঘটনার পর ছেলেরা সবাই শপথ করল, ডা. মুনতাসিরকে শাস্তি দিবে।

মিন্টুর বোন মরিয়মের বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্র আব্দুল জববার। পাত্র কোন কিছু চায়নি। তবুও পালং, আলনা, টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, আলমারী, টিভি, ফ্রিজ, সোফাসেটসহ আরো নানান কিছু দিয়েছেন আকরাম। সাথে আপ্যায়ন করানো হয়েছে পাঁচশ বরযাত্রীকে। যে আকরাম তাহসিনের চিকিৎসার জন্য পাঁচশ টাকা দিতে পারেনি, সে আকরাম দেখা গেল টাকার কুমির। বিয়ের জন্য ষাট হাজার টাকা দিয়ে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করেছে শহরে। গায়ে হলুদের জন্য প্যাকেজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্যাকেজ দলকে দিয়েছে পনের হাজার টাকা। এই অল্প টাকাতে তারা খুশি না হওয়ায়, আরো পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তিনি তাদেরকে খুশি করলেন। বরপক্ষের দাবী ছিল না, তবুও আকরাম দু’হাত মেলে দিয়েছেন। তারপরও মরিয়মকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। অনেকে মন্তব্য করেছে, আকরাম সাহেব কিপ্টা। মেয়েকে ঠকিয়েছেন। এইসব কথা কানে আসার পর আকরাম অপমানিত বোধ করলেন। এতে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মেয়েকে আরো অনেক কিছু দিবেন। তার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে সায়িদরা ছুটে আসল। তারা বিষয়টি নিয়ে আকরাম সাহেবের কাছে আলোচনা করতে চায়।

‘তোমরা কেন এসেছ?’ -আকরাম তাদের কাছে জানতে চাইলেন।

‘আপনি নাকি মরিয়ম আপুকে আরো যৌতুক দিতে যাচ্ছেন?’ -আরমান প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ, মান সম্মান বাঁচাতে আমাকে তাই করতে হচ্ছে।’

‘কিন্তু বিষয়টাতো অন্যায়।’ -সায়িদ বলল। ‘আপনি মেয়েকে যৌতুক দিয়ে পুরো জাতিকে বিপদে ফেলছেন।’

‘কীভাবে?’

‘আপনি আপনার মেয়েকে দিচ্ছেন। এতে আরো দশজন পুরুষ উৎসাহিত হয়ে, শ্বশুরের কাছে যৌতুক দাবী করবে। অন্যায়টা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।’

‘বাবা, আপনাকে এ পথ হতে ফিরতে হবে। পুরো সমাজের দিকে তাকিয়ে আছে।’ -মিন্টু বাবাকে বলল।

‘তুমি এক পাতা হতে দুই পাতা হওনি। এই সময় আমাকে উপদেশ দিতে এসেছ।’ -ছেলেকে ভৎর্সনা করলেন আকরাম।

সায়িদরা বুঝতে পারল, আকরামকে উপদেশ দিয়ে লাভ হবে না। তার ফিরে আসল।

আকরাম পরে জামাইয়ের জন্য ল্যাপটপ, মোবাইল, ঘড়িসহ আরো বিভিন্ন জিনিস পাঠিয়ে সমালোচনাকারীদের মুখ বন্ধ করে দিলেন। এরপর মেয়ের নাইয়্যরের সময় আরো দু’শ লোককে তিনি খাওয়ালেন। এই সময় সায়িদ অনুভব করল, একটা সংঘবদ্ধ শক্তি থাকলে আজ এই জঘন্য অপরাধটা প্রতিরোধ করা যেত।

মরিয়মের বিয়ের কিছুদিন পর ঠিক হলে আবদুল গফুরের মেয়ে চম্পার বিয়ে। বোনের বিয়ের কথা শুনে তাহসিন খুশি হলেও আবদুল গফুরের চেহারায় নেমে এল রাজ্যের অন্ধকার। বিয়ের বাজারে গেলে পাত্র পক্ষের একটা অলিখিত বা লিখিত দাবী থাকে। কন্যার বাবার কি অবস্থা তা ছেলে পক্ষ বুঝতে চায় না। এখন পাত্র মানে বাজারের গরু। যে পাত্র যত বেশি শিক্ষিত, অবস্থাশালী, তার বাজার দরও তত বেশি।

চম্পার বিয়েটা অনেকদিন যাবৎ ভাগ্যচক্রে ঘুরছিল। পাত্রপক্ষ আসে, কন্যা পছন্দ করে, তারপর দাবী দাওয়া নিয়ে বসে। আবদুল গফুরের আর্থিক দুর্বলতা বাঁধ সাধে। পাত্রপক্ষ পলায়ন করে। এখন লুৎফুরের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। লুৎফুর একটা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। যখন কন্যা দেখতে এসেছিল, তখন লুৎফুরের কোন দাবী ছিল না। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায়। পরে একটা দুইটা করে দাবী আসতে থাকে। পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে পরামর্শ করে আবদুল গফুর। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে চম্পার জোড়াগাঁথা হয়ে গেছে। এরপর লুৎফুর বেঁকে বসে। তাকে দুই লক্ষ টাকা দিতে হবে। শুনে আবদুল গফুর আকাশ হতে পড়ে। চোখের সামনে বিপদের ঘনঘটা দেখতে পান তিনি। তিনি বুঝতে পারলেন, এই সময় বিয়ে ভেঙে যাওয়া মানে বিপদ। মেয়ের নামে কুৎসা ছড়িয়ে পড়বে। পরবর্তীতে মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে ভারী সমস্যায় পড়তে হবে।

বাবার কাছে সব শুনার পর তাহসিন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

চম্পার বিয়ে অনুষ্ঠান। পাত্র এসে হাজির। তাকে দুই লক্ষ টাকা নগদ প্রদানের পর আকদ হবে। চারিদিকে হাসির জোয়ার বইছে। যেহেতু আরেকটা অনুষ্ঠান হবে, তাই এটা সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান। তাহসিন হবু দুলাভাইকে ফুল দিয়ে বরণ করে মিষ্টি মুখ করালো। আরমান, সায়িদসহ আরো অনেকে পুষ্প দিয়ে তাকে বরণ করে নিল। প্রত্যেকটা ফুলে একটা কাগজের স্টিকারে মার্কার কলম দিয়ে একটা একটা বাক্য লেখা হয়েছে। তারা এক যোগে এসেছিল, বরকে পুষ্পমাল্য অর্পণের পর এক যোগে সরে গেল। তারা চলে যাবার পর একটা ফুলের মালার কাগজের স্টিকারে ভয়ঙ্কর একটা কথা ভেসে উঠল। ‘উপযুক্ত মূল্যে বিক্রিত পশু।’ বিয়ের আসরে হৈচৈ পড়ে গেল। লুৎফুর পুষ্পমাল্য ছিড়ে বিয়ের মঞ্চ ছেড়ে নেমে গেল। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সেখানে হতে চলে গেল।

অন্দরমহলে সে খবর গিয়ে পৌছা মাত্র ক্রন্দনের রোল পড়ে গেল। যেহেতু নিজের ছেলে তাহসিনও পুষ্পমাল্য দাতাদের একজন, নিশ্চয় সে জানে এ কাজ কে করেছে। তাই আবদুল গফুর তাহসিনকে খুঁজতে লাগল হন্যে হয়ে। ঘরের ভিতর হতে চম্পার গগণবিদারী চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। ঘটনাটা চারিদিকে প্রচার হয়ে যাওয়ায়, পুরো এলাকার মানুষ এসে ভীড় করল আবদুল গফুরের আঙিনায়। তারা এই নষ্ট ছেলেদেরকে খুঁজতে লাগল শাস্তি দেবার জন্য। আবদুল গফুর দুচোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলেন।

সায়িদদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহমদ রেযা এসেছিলেন আমন্ত্রিত হয়ে। এই ঘটনার পুরো স্বাক্ষী তিনি। তিনি লুৎফুরের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নকীবের সাথে যোগাযোগ করে পুরো বিষয়টা তাকে অবহিত করলেন। নকীব যোগাযোগ করলেন থানা শিক্ষা কর্মকর্তা বারীর সাথে। বারী যোগাযোগ করলেন লুৎফুরের সাথে। তিনি লুৎফুরকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, যৌতুক ছাড়াই এ বিয়ে হতে হবে। না হলে লুৎফুরকে শিক্ষকতা বাদ দিয়ে অন্য কাজ খোঁজ করতে হবে, বিশেষ করে পশু পালন হলে ভাল হয়।

‘কিন্তু তো স্যার, আমাকে অপমান করা হয়েছে?’ -লুৎফুর মুঠোফোনে কথা বলছিল বারীর সাথে।

বারী বললেন, ‘লুৎফুর সাহেব, আপনি নিজেই বলুন, আপনি কি বিক্রি হননি?’

লুৎফুর কোন উত্তর দিল না। কেউ কি নিজকে বেচা গরু ভাবতে পারে?

‘আপনি কথা বলছেন না কেন? বিয়ের নামে যৌতুক নেওয়া, এটা কি আত্মবিক্রি নয়?’

‘স্যার, আমার ভুল হয়ে গেছে। এই অন্যায় আর করব না। আমি এক্ষুণি যাচ্ছি চম্পাকে তুলে আনতে।’

লুৎফুর ফিরে আসলেন বিয়ের আসরে। কিছুক্ষণ পর সেখানে হাজির হলেন বারী। বর ফিরে আসাতে বিয়ে বাড়িতে আবার আনন্দ বন্যা বইতে শুরু করল। তাহসিনরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এদিকে বর ফিরে এসেছে শোনার পর তাহসিনদের বাড়িতে ভীড় আরো বেড়ে গেল। ঘরে তিল ধারণের জায়গাও নেই। সবাই বরও কনেকে এক নজর দেখতে চায়। এই সময় আরেকটা ঘটনা ঘটল। চম্পা মঞ্চে এসে ঘোষণা করল, ‘আমি কোন পশুকে বিয়ে করতে রাজি নই।’

চম্পার ঘোষণা শোনার পর বিয়ে বাড়িতে আবার হৈচৈ পড়ে গেল।

চম্পাকে অনেক বুঝানো হল। থানা শিক্ষা কর্মকর্তা বারী তার দুতিয়ালির কথা তুলে ধরলেন। কিন্তু চম্পার এক কথা, ‘লুৎফুর নিজের আলোতে পথ দেখেনি। যে নিজের আলোতে পথ না দেখে বাধ্য হয়ে আলোর পথে চলে, সে বিবেকহীন, সুযোগের অভাবে সৎ। বিবেকহীন মানুষকে বিয়ে করা মানে আগুনকে বরণ করে নেওয়া। আমি এ প্রজ্জ্বলিত আগুনে আত্মহনন করতে চায় না।’

 

নৈশভোজের টেবিলে বসেছে সায়িদ, শাকিল, বাবা, মা। কথাটা তুললেন মা। প্রসঙ্গ চম্পার চূর্ণিত বিয়ের আসর।

‘সায়িদ, তুমি মনে হয়, আবার ঘুমিয়ে গেছ।’ -মা সায়িদকে লক্ষ্য করে বললেন।

‘মা, ঘুম মানে? আমি তো রাত দিন লেখাপড়া করছি। এবং পরীক্ষায় ভাল ফলও করেছি।’

‘হ্যাঁ, তাইতো দেখছি। এত বেশি লেখাপড়া শিখেছ যে, এখন যে কারো বিয়ের আসর পর্যন্ত নষ্ট করছো কোন দ্বিধা ছাড়াই?’ -মা বললেন।

‘আমি চম্পাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আবদুল গফুরের চোখে অশ্রু ছাড়া কোন ভাষা নাই। বেচারা গরীব মানুষ। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা সংগ্রহ করেছিল, সব মাটি করে দিলে তোমরা।’ -সায়িদকে গালে থাপ্পর মারতে চাইলেন বাবা। বাধা দিলেন মা। ব্যর্থ বাবা দৌড়ে রান্না ঘরের দিকে গেলেন । সায়িদ বুঝতে পারল তার জন্য ভয়ঙ্কর অন্ধকার অপেক্ষা করছে। কিন্তু না, তার আগে বাবার পথ আগলে দিলেন মা। বললেন, ‘ছোট মানুষ। ভুল করে ফেলেছে। এর জন্য তাহসিনের বাবার যে খরচ হলো তা আমরা পূরণ করার চেষ্টা করবো।’

‘তোমার মাথায় এতগুলো শয়তান কোত্থেকে আসে?’ -বাবা সায়িদের কাছে জানতে চাইলেন।

সায়িদ চুপ থাকল।

‘লেখাপড়া না করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে এমনি হয়। তখন মাথায় তো শয়তান ছাড়া আর কিছুই থাকে না।’ -বললেন বাবা। ‘তোমরা কোন ধরনের মানুষের উপকার করছ? কারো বিয়ে ভেঙে দেওয়া কী উপকার?’

পরদিন সায়িদ শুনতে পেল, এই ঝড় শুধু তার উপর দিয়ে নয়, সংগঠনের অনেকের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। সংগঠনের সবাইকে মুরববীরা খারাপ চোখে দেখছে। সবাই ছি ছি করছে তাদের।

রাকিব স্যারের ঘন্টা । ছেলেমেয়েরা সবাই বসে আছে। তিনি তার প্রিয় ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি ছড়িয়ে দিলেন দু’ঠোঁটের উপর। স্যারের এই হাসি দেখেও আজ অনেকে বেদনাসক্ত। কারণ, তাদের উপর দিয়ে কালবোশেখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

‘সায়িদ, তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে।’ -থেমে গেলেন রাকিব স্যার। একটা বই হাতে নিলেন।

স্যার সুখবর দিবে বলেছেন। কিন্তু তা সায়িদের কাছে মনে হলো আরেকটা জীবন্ত দুঃখ তার জন্য অপেক্ষা করছে। স্যার সবার মনে কৌতুহল সৃষ্টি করে বইয়ে মনোযোগ দিয়েছেন। কোন সুখবর না দিয়ে রাকিব স্যারের বইয়ের প্রতি মনোযোগ দান সবার মনে বিস্ময়ের জন্ম দিল। অনেকক্ষণ যাবার পর আরমান দাঁড়িয়ে গেল। -বলল ‘স্যার, আপনার সুখবরটা কী? তা কি আমাদেরকে বলবেন না?’

স্যার বললেন, ‘অবশ্যই বলব। তাহসিনকে দেখছি না যে, এই সুখবরের অধিকাংশ তারই প্রাপ্য।’

-স্যারের কথা শুনে সায়িদ আরো ভড়কে গেল।

তবে কি ডা. মুনতাসিরের ব্যাপারটাও স্যারের চোখের সামনে চলে এসেছে। ডা. মুনতাসিরের চেম্বারে তারা দু’দিন যাবৎ বর্জ্য ত্যাগ করে এসেছে। একটা মাটির পাতিলে করে নিয়ে গিয়ে পাতিলটা চেম্বারের সামনে ভাঙা হয়েছে। কাজটা তাহসিন নিজ হাতে করেছে। এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল জড়িতরা সবাই।

স্যার তাহসিনের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন। তাহসিন এখনো আসে নি। কি একটা কাজে সে বাড়িতে আটকা পড়ে আছে। মিন্টু একটু দেরিতে আসল। দেরিতে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলল, ‘স্যার, তাহসিনের অপেক্ষায় ছিলাম। তার বেশি দেরি হচ্ছে দেখে চলে আসলাম।’

‘তার তো আজ দেরি হবে। প্রভু তাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন।’ স্যার বলতে শুরু করলেন। ‘তোমরা যারা নানান অন্যায়ের প্রতিবাদ করছ, তাদেরকে কীভাবে ধন্যবাদ দিব তা আমি বুঝতে পারছি না। তোমরা যা করেছো, তা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।’

রাকিব স্যারের কথা শুনে সায়িদের মনে ব্যথা আরো বেড়ে গেল। কারণ, দ্বিতীয় দফায় ডা. মুনতাসিরের চেম্বারের সামনে বর্জ্য ফেলার সময় একটা অঘটন ঘটে গিয়েছিল। বাজারের দারোওয়ানের হাতে ওরা অল্পের জন্য ধরা পড়েনি। তবে কি দারোওয়ান তাদের তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে?’ -ভাবল সায়িদ।

‘আজ অনেক পত্রিকায় ঘটনাটি ছাপা হয়েছে। তোমাদের সবাইকে আমার পক্ষ হতে অভিনন্দন জানাচ্ছি। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থা তোমাদের জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছে। আরো একটা সুখবর হলো, চম্পার জন্য অনেক সুপাত্র আসতে শুরু করেছে। তার মধ্যে একটি প্রস্তাব হলো ছেলেটি ওলিমা খাওয়াবে। স্যার একটি পত্রিকা বের করে তাদের সামনে পড়লেন। চম্পার বিয়ে সংক্রান্ত খবর এটি। সাথে চম্পার ছবিও ছাপানো হয়েছে।

সায়িদের মনে লুকানো যন্ত্রণাটা লাঘব হলো। যাক স্যার ডা. মুনতাসিরের বিষয়টা সর্ম্পকে জানতে পারেননি।

‘ওলিমা কী?’ -জানতে চাইল মিন্টু।

‘আমাদের দেশে কন্যা পক্ষ খানা পিনার আয়োজন করে। ওলিমা হচ্ছে বরপক্ষ কর্তৃক খানাপিনা খাওয়ানো।

‘এটা তো খুব সুন্দর।’

‘অবশ্যই। একজন বাবা অনেক কষ্টে একটা মেয়েকে লালন পালন করে। তাকে শিক্ষা দিয়ে বড় করে। এরপর যখন তার বিয়ের ব্যাপার আসে, তখন বাবার মাথায় দুঃচিন্তার বলিরেখা ফুটতে শুরু করে। একটা বিয়ে মানে একরাশ যন্ত্রণা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার দেনার দায়ে আটকে পড়া। বাবা এত কষ্টে একটা মেয়েকে মানুষ করল, সে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাবাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে হয়। যৌতুক নামক অসভ্য প্রথা সমাজে আছে বলে এখন মেয়ে মানে অভিশাপ। লুৎফুরকে পশুর সাথে তুলনা করে তোমরা সঠিক কাজ করেছ। সে জন্য আমার পক্ষ হতে তোমাদেরকে অভিনন্দন। অন্যায় প্রতিরোধ করতে হবে। যদি সম্ভব হয় জোর করে বন্ধ করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় বলে কয়ে বন্ধ করতে হবে। তাও যদি সম্ভব না হয়, অন্যায়কে ঘৃণা করতে হবে। অন্যায়ের সাথে আপস করা যাবে না। তোমরা সে কাজটা করেছ।’

বিকেলে বাড়ি ফিরে সায়িদ দেখল বাবা তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময়ও অনেকে তাদেরকে অভিনন্দিত করেছিল। এটা মেঘ তাড়িয়ে সূর্যের আলো দানের মতই সুন্দর।

মহা ধুমধামের সাথে চম্পার বিয়ে হয়ে গেল। ঠিকাদার ও ভন্ডফকিরের বিরুদ্ধে যে সফলতা, বর্তমান সফলতা এর চেয়েও বেশি। এই সফলতার ফলে তাদের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। তারা সিদ্ধান্ত নিল, তাদের বিবেচনাধীন ছাত্র সহায়তা বিষয়ক প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিবে। এর জন্য তারা স্থায়ী কাঠামো গড়ে তুলবে। বিষয়টি নিয়ে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পেরে রাকিব স্যার ও আলী হাকিমকেও বৈঠকে নিমন্ত্রণ করল। আলী হাকিম বললেন, তোমরা সমাজের অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করছ। তাই আমি তোমাদের এই সংগঠনটির নাম রাখতে চাই ‘অতন্দ্র প্রহরী।’ কীভাবে সংগঠনটি স্থায়ীত্ব লাভ করবেন, এই বিষয়ে তিনি কিছু পরামর্শও দিলেন।

মাহবুব বললেন, আমরা অনেক সমিতি করেছি, একটাও টিকে থাকেনি।’

সমিতি যে টিকে থাকেনি, এটা নেতৃত্ব সমস্যার কারণে। ‘ভাল নেতৃত্ব পেলে মৃত সংগঠনও জীবিত হয়ে উঠে।’ বললেন আলী হাকিম। ‘একটা মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা জটিল কোন কাজ নয়। ধরুন আপনারা বিশজন ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে বই বিতরণ করবেন। আপনাদের দরকার হলো দুই হাজার টাকা। এই গ্রামের জনসংখ্যা দু’হাজার। প্রত্যেক গ্রামবাসী একটাকা করে দিলে আপনারা সেই দুই হাজার টাকা সহজে পেতে পারেন। কেউ একজন দশ টাকা দিলে আর নয়জন যদি দিতে না চায়, তবে কোন সমস্যা নেই। ঐ নয় টাকার ভার একজনেই নিয়ে ফেলেছে। তবে এই টাকা উত্তোলনের দায়িত্ব একজনকে অবশ্যই নিতে হবে। কেউ যদি দায়িত্ব কাঁধে না নেয়, তবে এই কাজটা বাস্তবায়ন কখনো সম্ভব নয়। তোমরা সে দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছ। আমাদের অবশ্যই তোমাদের পাশে পাবে। আমি আশা করি, তোমাদের এই সংগঠনটি টিকে থাকবে।

আলী হাকিমের বক্তব্যের সমর্থন করলেন রাকিব স্যার। বললেন, আলী হাকিমের সব কথায় বাস্তব সম্মত। তবে আমি অতন্দ্র প্রহরীদের নাম ‘না ঘুমানোর দল’ রাখার পক্ষে। অর্থ একই। তবে নামের সৌন্দর্যটা বেশি। আল মাহমুদের একটি কবিতার নাম ‘না ঘুমানোর দল।’ আলী হাকিমসহ সবাই নামটি সমর্থন করলেন। এই নামটিই নির্ধারিত হয়ে গেল সংগঠনটির জন্য। নতুন আশায় বুক বাঁধল সায়িদরা।

কিন্তু মাহবুবকে দেখা গেল কেমন যেন গুমরামুখো হয়ে আছে।

সায়িদ, তাহসিন, আরমান, মাহবুব, মিন্টু, ইকবাল ও মাহফুজ বৈঠকে বসেছে। না ঘুমানোর দলের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। বৈঠকে প্রথমে মিন্টুর বাবা আকরামের কথা উঠেছিল। মিন্টু বলল, ‘বাদ দাও আমার বাবার কথা। আমার বাবা কেমন তা সকলে জানে। তিনি কৃপণ। আমি চিন্তা করছি কীভাবে বাবাকে সৎপথে আনা যায়। ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও।’

এ ব্যাপারে কথা আর এগিয়ে গেল না। তারা মূল আলোচ্য সূচিতে ফিরে আসল। অনেক পর্যালোচনা করে তারা একটা সিদ্ধান্ত নিল। সেটা হলো

০১. প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে একটা করে বিশেষ কৌটা দেওয়া হবে। ছাত্র ছাত্রীরা তাদের বেঁচে যাওয়া খুচরো ২/৫ টাকা ওখানে সঞ্চয় করবে। মাসের শেষে তা রাকিব স্যারের হাতে দিবে। এর সর্বনিম্ন পরিমাণ হবে দশ টাকা। এর কম হলে তা নিজের পকেট হতে দিয়ে পূরণ করে দিতে হবে।

০২. দারিদ্র ছাত্রদেরকে ঐ টাকা হতে দুপুরে হাল্কা নাস্তা পরিবেশন করা হবে।

০৩. তাদেরকে বৎসরে এক জোড়া ড্রেস ও জুতা প্রদান করা হবে।

০৪. বৎসরের শুরুতে এক সেট বই সরবরাহ করা হবে।

০৫. সায়িদ ও আরমান রাকিব স্যারের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে।

পরে দুপুরের হাল্কা নাস্তা শব্দটি বাদ দেওয়া হলো এই শর্তে যে, যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা প্রতিমাসে সংগ্রহ করা যায় তবে ঐ খাদ্য পরিবেশন করা হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ হলে মাহবুব বলল, ‘এগুলো কাগুজে সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা এত টাকা কোথায় পাব? আমরা মনে হয় ভুল স্বপ্ন দেখছি।’

রাকিব স্যার যখন তাদের প্রস্তাবের কথা শুনলেন, অত্যন্ত আনন্দিত চিত্তে তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘সত্যিই তোমরা ঘুম ছেড়ে জেগে উঠছ। আমি আশা করছি, এভাবে একদিন পুরো জাতি জেগে উঠবে। আমি সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম। তোমরা যারা এমন একটা মহৎ উদ্যোগ নিয়েছ, তোমাদেরকে আমরা পুরস্কৃত করব।’

স্যার বিষয়টা নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করলেন। বিষয়টা নিয়ে প্রধান শিক্ষক আহমদ রেযাও অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি উদ্যোক্তা ছাত্রদের সবাইকে ডাকালেন। তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, ‘আমি বিদ্যালয়ের সব ছাত্রদের নিয়ে আগামী মাসে একটা সভা করব। এরপর অভিভাবকদের নিয়ে আরেকটা বৈঠক করব। আমি চাই সবাই এই মহতি উদ্যোগের সাথে শরীক হোক।’

 

নব জাগরণ প্রাথমিক বিদ্যালয় নতুন সাজে সেজেছে। সব ছাত্র জড়ো হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি ও চতুর্থ শ্রেণির মধ্যে যে বিভক্তি দেওয়া হয়েছিল তা তুলে নেওয়া হয়েছে সবার বসার সুবিধার্থে। ফলে ওটা একটা বিশাল অডিটোরিয়ামের রূপ ধারণ করেছে। নানা রকমের ফেস্টুন, বেলুন ও কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো বিদ্যালয় প্রাঙ্গন। এখানে উপস্থিত হয়েছে থানা শিক্ষা কর্মকর্তা বারী, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীবৃন্দ ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ। সবাই উৎফুল্ল না ঘুমানোর দলের এমন মহতী উদ্যোগে। কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘‘আমরা জেগেছি।’’

আয়োজনে, ‘না ঘুমানোর দল।’

ওরা জেগেছে। এটাই তো জেগে উঠা। আপনি লক্ষ লক্ষ তত্ত্ব বলতে পারেন, কিন্তু একটা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হাজারো তত্ত্বের চেয়ে উত্তম। আজ ওরা তাই প্রমাণ করতে যাচ্ছে।

বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের প্রধান তরীকুল ইসলাম বললেন, ‘তোমাদের এই উদ্যোগটা অসাধারণ। পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল কাজ হলো মানব কল্যাণ। এর উপর কোন ভাল কাজ থাকতে পারে না। তাই তোমাদের এই উদ্যোগের সাথে আমি একাত্মতা ঘোষণা করছি। শুধু আমি নই, এই আয়োজনে যদি পুরো পৃথিবী থাকত, তবে সবাই একাত্মতা ঘোষণা করত।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমি তোমাদের অন্তরে যে আলোক দেখতে পাচ্ছি, তা অসাধারণ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তোমরা যদি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর এ রকম কোন মহতী উদ্যোগ অব্যাহত রাখ, তবে এদেশ হতে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, দারিদ্র্যতা, অসাম্য, বৈষম্য সব দূরীভূত হয়ে জাতির ভাগ্য ললাটে নবীন রবির উদয় হবে। তোমাদেরকে আমার পক্ষ হতে অভিনন্দন।’

অভিভাবকমন্ডলীর পক্ষ হতে ফুরকান বললেন, ‘আমি আমার ছেলের দুষ্টুমিতে খুব বিরক্ত ছিলাম। সে একের পর এক এমন ভুল করে যে, আমাকে মানুষের নানান কথা শুনতে হয়। তবে এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে, আপাত দৃষ্টিতে খারাপ কাজ হলেও বৃহত্তর দৃষ্টিতে কিছু ভাল কাজ তারা উপহার দিয়েছে। চম্পার বিয়ের ব্যাপারটা অনন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের ছেলেরা যে এমন মহৎ উদ্যোগ নিতে পারে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমাদের দেশে হাজার হাজার শিশু আছে, যারা যথাযথ পৃষ্টপোষকতার অভাবে শিক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে প্রত্যেক স্বচ্ছল ছাত্ররা যদি মাসে দশ টাকা করে দেয়, আর সে টাকা দিয়ে যদি প্রত্যেক বিদ্যালয়ে ১০জন করে দরিদ্র ছাত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়, আমার বিশ্বাস অন্তত এক লক্ষ অসহায়, দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষার সংস্পর্শে আসবে এবং যে সব বিদ্যালয়ে শিক্ষা ব্যয় বেশি সে সব বিদ্যালয় যদি অন্য কোন বিদ্যালয়ের ১৫/২০ জন ছাত্রের দায়িত্ব নেই, এতে জাতি অনেক উপকৃত হবে।’

রাকিব স্যার বললেন, ‘আমাদের জাতি ঘুমিয়ে আছে। ইংরেজরা আমাদের উপর যে এত সহজে চেপে বসতে পেরেছিল, তার কারণ আমাদের ঘুম। বলা যায়, আমাদের এ জাতি হচ্ছে নিদ্রামগ্ন জাতি। আমার তো কখনো কখনো মনে হয়, আমরা হচ্ছি গিয়ে একটি বিলুপ্ত সভ্যতার অবশিষ্ট নিদর্শন। আমাদের উপর যা চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমরা তা ভক্ষণ করতে অভ্যস্থ। গুজবে কান দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। আমাদের এই ঘুম আসহাবে কাহাফের ঘুমকে হার মানায়। কারণ, আমরা জেগে জেগে ঘুমাচ্ছি। এই ঘুমন্ত জাতির মধ্য হতে কিছু বালক জেগে উঠেছে, বিছানা ছেড়ে বাহিরে চলে এসেছে, এটাই আমাদের পাওনা।’

না ঘুমানোর দলের পক্ষ হতে সায়িদ তার বক্তব্যে বলল, ‘আমরা তিনশ কৌটা সংগ্রহ করেছি। এই কৌটাগুলোর মুখ ছিদ্র করে সিলগালা করে দিয়েছি। আমি প্রত্যেককে অনুরোধ করব প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবারে কৌটাগুলো নিয়ে আসার জন্য। ঐ দিন ছুটির পর সবগুলো কৌটা খোলা হবে। প্রাপ্ত টাকাগুলো প্রধান শিক্ষকের কাছে জমা রাখা হবে। স্যার সে অর্থ দিয়ে দরিদ্র তহবিল নামে একটা তহবিল গঠন করবেন। ঐ তহবিল হতে দরিদ্র ছাত্রদের বই, ড্রেস ও অন্যান্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। এতে অনেক হতদরিদ্র ছাত্রের ঝরে পড়া রোধ হবে বলে আমার বিশ্বাস।’

প্রধান শিক্ষক আহমদ রেযা বললেন, ‘মাটির নিচে যে শুকনো বীজটির অঙ্কুরোদগম হয়, অর্থাৎ যে বীজটি জেগে ওঠে, সে মাটির নিচে আর পড়ে থাকে না। কঠিন মাটি ভেদ করে বেরিয়ে এসে পৃথিবীবাসীকে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। শিশু তরুটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। কালের পরিক্রমায় সেটি মহিরুহে পরিণত হয়। এই যে বৃক্ষের বেড়ে ওঠা, এই প্রক্রিয়াটিতে আমাদের জন্য বিশাল শিক্ষা রয়েছে। এই শিক্ষা হলো জেগে উঠার মন্ত্র। আমি তোমাদের মাঝে সে শিক্ষাটা বলতে চায়। প্রথমে বীজটার কথা চিন্তা করি। বীজটার যখন অঙ্কুরোদগম হয়, সে নিজেকে আর মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে না। অসহায় চারাটি, যেটিকে একটা টোকা দিলেই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, সেটি কিভাবে কঠিন মাটির পর্দা ভেদ করে সেটি আশ্চর্যের বিষয়। এর চেয়েও বড় কথা হলো, চারাটি মাটি ভেদ করে ওঠে কেন? কারণ, যে সত্যিকারভাবে জেগে উঠে, তার কাঁথার নিচে লুকিয়ে থাকার সুযোগ নেই। তাকে জেগে উঠার বিষয়টা প্রমাণ করতে হবে বিছানা ছেড়ে। কেউ যদি জেগে ওঠার পরও বিছানায় শুয়ে থাকে, তবে তাকে জেগে উঠা বলা যাবে না। বলা যাবে অর্ধ জাগ্রত। অর্ধ জাগ্রত মানুষকে দিয়ে পৃথিবীতে কোন কাজ হয় না। অর্ধ জাগ্রত মানুষটি বিছানাও ছেড়ে দেয় না, আবার নিজেও বিছানা গুটাতে পারে না। দ্বিতীয়ত, বীজটি মাটি ভেদ করে উঠার পর ঝড়-বৃষ্টি, তাপ-শীত, বন্যা-খরা প্রভৃতির মোকাবেলা করে বড় হতে থাকে। যে সব বৃক্ষরাজি এই প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারে না, তারা হারিয়ে যায়, মাটির সাথে মিশে যায়। প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে থাকা বৃক্ষটি বড় হতে হতে এক সময় বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়। এত বড় হয়, কিন্তু কখনো মাটির সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করে না। মাটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে মৃত্যু ওটাকে আলিঙ্গন করে। তার এ চরিত্রের মধ্যে আমরা যে শিক্ষাটি পাই তা হলো, বড় হতে হলে তোমাকে প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হবে। যারা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে হারিয়ে যায়, তারা বড় হতে পারে না। তাদের চাওয়া পাওয়া খড়কুটোর মত ভেসে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি শিক্ষা হলো, যে যত বড় হোক না কেন, নাড়ি ও মাটির সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করা চলবে না। নাড়ি ও মাটির সাথে যে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তার একমাত্র পরিণতি ধ্বংস। তোমরা দরিদ্র তহবিল গঠন করার যে উদ্যোগ নিয়েছ, তা খুব মহৎ উদ্যোগ। সে জন্য তোমাদেরকে অভিনন্দন। কিন্তু সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, কোন মহৎ কাজ বিনা বাধায় কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। সমাজের স্তরে স্তরে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত মানুষেরা সব সময় মহৎ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। এই ধারাবাহিকতায় তোমাদের উদ্যোগেরও বিরোধিতা হবে। এসব প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করার জন্য যে ধৈর্য্য ও সাহস প্রয়োজন, তা তোমাদেরকে অর্জন করতে হবে। আর এই উদ্যোগটা যত প্রসার লাভ করুক না কেন, তোমাদেরকে বিনয়ী হতে হবে। মনের মধ্যে অহঙ্কার দানা বাঁধলে তোমাদের পতন ত্বরান্বিত হবে।’

থানা শিক্ষা কর্মকর্তা বারী বললেন, ‘আমাদের সমাজটা বড্ড অগোছালো। এদেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার বড় অভাব। আপনাদের মতো আমিও বলতে চাই, আমাদের জাতি ঘুমন্ত। এই ঘুমন্ত জাতির মধ্য হতে কয়েকজন জেগে উঠার স্বপ্ন দেখছে, এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমরা ঘুমন্ত, কারণ আমাদের বিবেক জাগ্রত নয়। বিবেক জাগ্রত নয় বলে, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। আমরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি, থুথু নিক্ষেপ করি। আমাদের ঘুমন্ত বিবেক আমাদেরকে বলতে পারে না যে, এটা অন্যায়। তোমরা সে বিবেককে জাগিয়ে তুলছ। সে জন্য তোমাদেরকে আবারো অভিনন্দন। তোমরা মানুষের কাছে পৌছার উদ্যোগ নিচ্ছ। তোমরা জেগে উঠছ। এইভাবে প্রত্যেক মহৎ কাজ বাস্তবায়ন করার জন্য দশ নয়, শুধু একজনকে জেগে উঠতে হয়। তোমরা অনেকে জেগে উঠার চেষ্টা করছ, তাই তোমাদেরকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। যদি তোমাদের কোন কিছু দরকার হয়, আমার সাহায্য পাবে।’

অনুষ্ঠান শেষে বারী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে টিনের কৌটাগুলো বিতরণ করলেন। কৌটার উপরে সাদা কাগজে মার্কার কলম দিয়ে লেখা আছে, ‘দরিদ্র ছাত্র কল্যাণ তহবিল।’’

মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। প্রথমবারের মতো দরিদ্র ছাত্র কল্যাণ তহবিলের জন্য ছাত্রদের মাঝে বিলিকৃত কৌটা ব্যাংকগুলো একত্রিত করা হল। কে কত টাকা জমা করার জন্য সব ছাত্র-ছাত্রী এক কক্ষে ভীড় করেছে। ওখানে শিক্ষকরাও উপস্থিত হলেন। প্রধান শিক্ষক আহমদ রেযা সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন, ‘তোমরা জাতির ভবিষ্যৎ। তোমাদের মাঝে লুকিয়ে আছে আগামী দিনের বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রি, সচিব, কবি, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ সমাজের নানান স্তরের দায়িত্বশীল সম্প্রদায়। তোমাদের অবদানে এগিয়ে যাবে এদেশ।

দারিদ্র্যতা যে কোন সমাজের জন্য অভিশাপ। দারিদ্র্যতা মানুষকে নানা পাপাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। এই দারিদ্র্যতা হতে মুক্তির একমাত্র সোপান হল শিক্ষা। এদেশের জনগোষ্ঠির বিশাল একটা অংশ দারিদ্র্যতার কারণে শিক্ষা হতে বঞ্চিত। আবার দারিদ্র্যতার কারণে অনেকে অকালে শিক্ষা হতে ঝরে পড়ছে। শুধুমাত্র সামান্য সাহায্য পাচ্ছে না বলে তারা এগিয়ে যেতে পারছে না। এ রকম নিঃস্ব ছাত্রদের প্রতি হাত বাড়ানোর তোমরা যে উদ্যোগ নিয়েছ তা অসাধারণ।

দানের কথা প্রকাশ করা অনুচিত। সে জন্য কার কৌটায় কত টাকা জমা হয়েছে তা প্রকাশ করা হবে না। যাদের কৌটায় দশ টাকার কম তাদের নামও প্রকাশ করা হবে না। কারণ, সবাই এক অবস্থা সম্পন্ন নয়। তবে যাদের ব্যাপারে সন্দেহ হবে তাদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে আমি কৈফিয়ত চাইব।’’

শিক্ষক মিলনায়তনে ছাত্র ছাত্রীদের শ্রেণি প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কৌটাগুলো উন্মুক্ত করা হলো। বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দু’শ’ জন। টাকা পাওয়া গেল ২,৫১২ টাকা। টাকা গণনা শেষ হলে প্রধান শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে মোট টাকার পরিমাণ ঘোষণা করলেন। প্রথম মাসের সাফল্যে না ঘুমানোর দলের সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এই বৈঠকে স্যার জানিয়ে দিলেন অতি শীঘ্রই তিনি আরেকটি অভিভাবক সম্মেলনের আয়োজন করবেন।

সায়িদ বিদ্যালয় হতে এস বাড়িতে ঢুকতে দেখতে পেল শিবলু খাঁচার মধ্যে চটপট করছে। খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে লড়াই করছে। শিবলুর এমন আচরণ দেখে সায়িদ অবাক হয়ে গেল। এই সময় তার কানে ভেসে আসল সাপ সাপ চিৎকার। আতঙ্কে চমকে উঠল সায়িদ। সে প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটি কী? বাড়ির সামনে কেউ নেই। বাড়ির পিছন দিক হতে অনেক মানুষের গুঞ্জন ভেসে আসছে। সায়িদ সেখানে গিয়ে জানতে পারল, তাদের বাড়িতে একটা বিষাক্ত সাপ ঢুকে উমে বসা মুরগীটি হত্যা করে সব ডিম খেয়ে ফেলেছে। তার মা সাপের লেজটি দেখতে পেয়েছে। মানুষ দেখে সাপটি কোথায় পালিয়ে গেছে। শুনে সায়িদ আবার দৌড়ে ঘরে ঢুকল। সে খাঁচা হতে তাড়াতাড়ি শিবলুকে মুক্ত করে দিল। ছাড়া পেয়েই শিবলু উড়াল দিল দূর অজানায়।

খবর পেয়ে না ঘুমানোর দলের সব সদস্য সেখানে জড়ো হলো। তারা নানা যুক্তি তর্ক করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, দলের সব সদস্যরা বাড়ির চারিদিকে অবস্থান গ্রহণ করবে। একজন সদস্য ঘরের ভিতর ঢুকে মাটির হলকায় মরিচ পোড়াতে দিবে। মরিচ পোড়ানোর গন্ধ সাপ সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে আসলে তারা ওটাকে মেরে ফেলবে। তাদের সাপ নিধনের কথা শুনে দ্বিমত পোষণ করলেন ফুরকান। স্পষ্ট করে তাদের জানিয়ে দিলেন, সাপ তাড়ানো যাবে কিন্তু মারা যাবে না। কারণ, সাপ প্রকৃতির একটা অংশ। প্রকৃতির মধ্যে মানুষের হস্তক্ষেপ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। সুন্দর আগামী প্রজন্মের জন্য সাপ রক্ষা করা সবার কর্তব্য। প্রথমে তোমরা সাপ বের করে দাও, পরে সালফিউরিক এসিড এনে তা ছিটিয়ে দিব। যাতে এই এলাকা ছেড়ে সাপটি পালিয়ে যায়।’

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সায়িদ ঘরের মধ্যে ঢুকে মাটির হলকায় কয়লার আগুন দিয়ে তার উপর শুকনো মরিচ ছিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসল। কিছুক্ষণের মধ্যে সবখানে পোড়া মরিচের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। সে গন্ধের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো একটা কেউটে সাপ।

সাপটিকে দেখে উত্তেজনায় সবাই ফুরকানের বিধিনিষেধের কথা ভুলে গেল। লাঠি নিয়ে ছুটল ধাবমান সাপটির দিকে। বিপদের গন্ধ পেয়ে সাপটি হঠাৎ ইউটার্ন দিল। তখন দেখা দিল নতুন বিপদটা। মিন্টু একেবারে সাপের কাছে চলে গিয়েছিল। সাপটির আকস্মাৎ উল্টো ঘুরাতে সে খুব ভড়কে গেল। তাল সহ্য করতে না পেরে ধপাস করে সে মাটিতে পড়ে গেল। সাপটি তাকে কামড় মেরে পালিয়ে গেল।

উৎসব মুখর পরিবেশে হঠাৎ নেমে এলো শোকের অশ্রু। ফুরকান ছুটে গিয়ে মিন্টুর রানে শক্ত করে তিন জায়গায় বেঁধে দিল। যাতে এদিকের রক্ত উপরের দিকে চলাচল করতে না পারে। খবর পেয়ে ছুটে আসল মিন্টুর বাবা আকরাম। সবাই বিভিন্ন ওঝার খোঁজ খবর দিতে লাগল। হস্তক্ষেপ করলেন ফুরকান। তিনি বললেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে সাপে কাটা রোগীর ভালো চিকিৎসা আছে। আগের সে টুকটাক ওঝা-বৈদ্যের চিকিৎসা বাদ দিয়ে আমাদেরকে এ চিকিৎসার দিকে যেতে হবে। আকরাম ওঝার নিকট নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ফুরকানের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে নিয়ে গেল ছেলেকে।

 

চম্পার বিয়েতে এক টাকাও খরচ করতে হয়নি আবদুল গফুরকে। এটা আকরামের মনে হিংসার উদয় করেছিল। করার কথাও। মেয়েকে তিনি অনেক টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছেন। উপহার হিসেবে অনেক আসবাবপত্র দিতে হয়েছে। তারপরও অনেক আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে। বলা যায়, উপযুক্ত মূল্য দিয়ে একটা পশু ক্রয় করে নিয়েছেন। সে পশুর হাতে মরিয়মকে সঁপে দিয়েছেন। মরিয়ম এখনো এই সেই জিনিস দাবি করে বাবার কাছে। মরিয়মের বিয়ের ক্ষত না শুকাতেই মিন্টুর উপর সাপে কাটার বিপদ হানা দিল। মিন্টুর চিকিৎসায় ফুরকান সাহায্য করতে চাইলেও রাজি হয়নি আকরাম। তিনি বললেন, ‘এটা আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কঞ্জুসের মতো টাকা আটকে রাখার পরিণতি। আমি আমার অকৃতজ্ঞতার শাস্তি ভোগ করছি। আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।’

‘তোমার অকৃতজ্ঞতা মানে আমি বুঝতে পারলাম না?’ -ফুরকান বললেন।

‘ধন সম্পদে গরীবদের অধিকার আছে, এ কথাটা আমি বিলকুল ভুলে গিয়েছিলাম। তাই তাই আমার উপর দিয়ে বিপদের ঝড় যাচ্ছে। আমি আমার ধন সম্পদ ভাল কাজে ব্যয় করতে চাই। গরীব দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করতে চাই।’

আকরাম ফুরকানের কোন সাহায্য নেয়নি। যদিও তাদের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে মিন্টুর এই মরণ দশা।

গ্রামের হাসপাতালে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় মিন্টুকে শহরে নিয়ে যাওয়া হলো। কয়েকদিন পর তাকে দেখতে ‘না ঘুমানোর দলের’ সদস্যবৃন্দ শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সবাই বেরিয়েছে যাওয়ার জন্য, কিন্তু অসুস্থতার জন্য মাহবুব যেতে পারল না। দেখে তাকে কারো অসুস্থ মনে হয়নি, অসন্তুষ্ট মনে হয়েছে। তাকে রেখে সবাই চলে গেল শহরে। ভবগঞ্জ বাস টার্মিনাল হতে শহর পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া ত্রিশ টাকা কিন্তু গাড়ির সহকারী ভাড়া নিচ্ছিল চল্লিশ টাকা করে। সবাই বিনা প্রতিবাদে ভাড়া দিচ্ছিল কিন্তু সায়িদ স্পষ্ট জানিয়ে দিল ‘আমরা একটাকাও বেশি ভাড়া দিব না।’

‘কেন দিবে না? সবাই দিচ্ছে।’ -সহকারী বলল।

‘ওরা অন্যায়কে পশ্রয় দিচ্ছে। আমি দিতে পারব না।’

‘বাচ্চারা, এখন তোমাদের রক্ত গরম। পৃথিবীর বাস্তবতা বুঝ না। বুঝার বয়সও তোমাদের হয়নি।’ -একজন যাত্রী বলল।

‘এত ঝামেলায় যাওয়ার দরকার কি?’ -আরেক যাত্রী বলল।

সায়িদ বলল, ‘দরকার আছে। আমরা যদি আজ দশ টাকা বেশি দিই, আগামীকাল হতে তারা বলবে ভবগঞ্জ বাস স্টেশন হতে শহরের গাড়ি ভাড়া চল্লিশ টাকা। তখন যে গরীব লোকটি সারাদিনে পঞ্চাশ টাকা আয় করে, তাকেও কোন কারণে শহরে আসতে হলে চল্লিশ টাকা গাড়ি ভাড়া দিতে হবে। আপনার কাছে দশ টাকা কিছুই না। কিন্তু ওর কাছে তো দশ টাকা একটা পাহাড়।’

সায়িদের বক্তব্য শোনার পর অনেকে তার পক্ষে দাuঁড়য়ে গেল। এক যাত্রী বলল, ‘আমরা ঘুমিয়ে আছি, তুমি ছোট হলেও ঠিকই জেগে আছ। আসলে তোমার মত করে বিষয়টি আমরা চিন্তা করিনি।’

সবাই হৈ চৈ করে উঠল। ফলে সহকারী ত্রিশ টাকা করে ভাড়া নিতে বাধ্য হলো।

শহরে টার্মিনালে নামামাত্র দুটি রিকশা তাদের দিকে ছুটে আসল। একজন বয়স্ক ও আরেকজন কিশোর। কিশোরটিকে দেখে তাদের মন হাহাকার করে উঠল। যে বয়সে ছেলেটির বই নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, সে বয়সে ছেলেটি সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়েছে। সায়িদ ও তাহসিন তার রিকশায় উঠল। বাকীরা অন্য দুটি রিকশায়। যেতে যেতে সায়িদ ছেলেটির সাথে কথা বলল। ছেলেটির নাম রিংকু। তার বাবা অসুস্থ। সে ভাই বোনদের সবার বড়। ফলে তাকে পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে। সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা পায়, তা দিয়ে বাবার ওষুধ ও পরিবারের সবার জন্য খাবার কিনে নিয়ে যায়। রিংকু আরো জানাল, তার লেখাপড়া করার ইচ্ছা আছে, কিন্তু পরিবারের অভাবের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। তারা মেডিক্যাল কলেজের সামনে নেমে রিকশাওয়ালা ছেলেটিকে একশ টাকা দিল, যদিও তার সাথে ত্রিশ টাকা দিয়ে দরদাম হয়েছিল। এত টাকা একসাথে পেয়ে ছেলেটি খুব খুশী হল।

হাসপাতালের গেইটে যখন তাদের রিকশা থামল, তারা দেখল দুটো ছোট শিশু ময়লাগারে কাগজ কুড়াচ্ছে। কিশোর রিকশা চালকটিকে দেখে তারা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার? তাদের দেখে তাহসিন কেঁদে দিল। জীবন যে এভাবে শিশুদেরকেও ছোবল মারে তা তার জানা ছিল না। আজ নতুন বাস্তবতা তাদের সামনে উদয় হয়েছে। তাহসিনের অশ্রুসজল কান্না দেখে শিশু দুটি খিলখিল করে হেসে দিল। সায়িদ ছেলে দুটিকে ইশারায় ডাকল। তাদেরকে দশ টাকা করে দিল। টাকাগুলো পেয়ে ছেলে দুটি খুব খুশী। তাদের কাছে প্রশ্ন করল, তারা কুড়ানির কাজ করছে কেন? ছেলে দুটি উত্তরে জানাল, ওরা তাদের ঘরবাড়ি কোথায় তা জানে না। যেখানে রাত হয়, সেখানে ঘুমায়। তাহসিন ওদেরকে লেখাপড়া করে কিনা জানতে চাইলে, ওটা কি জিনিস তারা বুঝতেও পারল না। সায়িদের মনে পড়ল সেই বৃদ্ধা মহিলাটির কথা, যাকে তার মা সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবার কারণে করতে পারেনি। বেড়ে উঠার সাথে সাথে জীবনের অন্ধকার দিকগুলো দেখে দেখে কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সায়িদ।

মিন্টু সিটের উপর বসা ছিল। সম্পূর্ণ সুস্থ। তার দলের কয়েকজন সদস্য তাকে দেখতে এসেছে তাই সে খুশি। সবার সাথে কোলাকুলি করল। তারাও তাকে অভিনন্দিত করল নতুন জীবন ফিরে পাওয়ায়। ঐ দিনটি ছিল মিন্টুর ফিরে আসার দিন। তার বাবা সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। শুধু একটা কাজ বাকী। কতকগুলো ওষুধ আছে, যেগুলো গ্রামে পাওয়া যাবে না, এখান হতে কিনতে হবে। এই কাজটা করে তারা বেরিয়ে পড়বে। এই শেষ মুহূর্তে তারা গিয়ে পৌঁছেছে। আকরাম সায়িদ ও আরমানকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ওষুধগুলো কেনার জন্য। বেরিয়ে যাবার সময় অন্যদের বললেন, ‘তোমরা সব গুছিয়ে নাও, আমরা ওষুধ নিয়ে এসে হাসপাতাল ছাড়ব।’ আকরাম সায়িদদের নিয়ে একটা বড় বিপণি বিতানে গেলেন। প্রবেশ পথে একটা বড় দানবাক্স তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ক্যান্সার আক্রান্ত একজন শিশুর চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়ে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে দান বাক্সটির পাশে। মানুষ দান বাক্সটা অতিক্রম করে আসছে আর যাচ্ছে, পোস্টারটাও পড়ছে। কিন্তু কেউ টাকা দিচ্ছে না। বিষয়টা সায়িদকে নাড়া দিল। তিনি আকরামকে বললেন, ‘চাচ্চু অত বড় একটা সাহায্যের আবেদন করা হয়েছে, অথচ কেউ কিছুই দিচ্ছে না। তাদের কোন প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে না।’

‘আসলে এভাবে তো সাহায্য পাওয়া যায় না।’ -বলল আকরাম ‘এই রকম কত হাজার দানবাক্স দেখেছি। পশ্চিমারা বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা গড়ে তুলে সারা বৎসর অর্থ সংগ্রহ করে , আর বিপদ আক্রান্ত মানুষ দেখলে দান করে। তারা এই অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। বিভিন্ন জিনিসপত্র নিলামে দেয়। আমাদের এখানে কেউ অসুস্থ হলে তার পরিবারের যদি সামর্থ্য না থাকে, তবে সাহায্যের জন্য আবেদন করা হয়, এইভাবে দানবাক্স বসানো হয়, কিন্তু কয়জনেই সাড়া দেয়? এর চেয়ে রাস্তার ভিক্ষুকরা আরো বেশী ভিক্ষা পায়। আসলে মানুষকে পোস্টার লিফলেটের মৌন ভাষায় অনেক কষ্টের কথা বুঝানো যায় না। মানুষের কাছে যদি ধরণা দেওয়া হয়, তবে অধিক ভাল ফল পাওয়া যায়।’

তারা এগিয়ে যতে লাগল। সিঁড়ি বেয়ে বিপণি বিতানের তৃতীয় তলায় উঠে গেল। উঠতে উঠতে আরমান আকরামকে জিজ্ঞাসা করল, ‘চাচ্চু, এখানে কয়টা দোকান হতে পারে?’

‘দু’শ হতে দু’শ বিশ এ রকম হবে। কেন?’

‘প্রত্যেক দোকান হতে যদি পাঁচ টাকা করে নেওয়া হয়, তবে দৈনিক এক হাজার টাকা পাওয়া যাবে। ঐ টাকা দিয়ে তো একটা বিদ্যালয় পরিচালনা করা যাবে, যেখানে আশেপাশের টোকাইরা লেখাপড়া করতে পারবে।’

‘শুধু তা কেন? দানবাক্সের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে যদি মানুষের দৃষ্টি আকষর্ণ করার চেষ্টা করতো বা সাহায্য চেয়ে এক টাকা পাঁচ টাকা মূল্যের টিকেট বিক্রি করতো, তাহলেও তো দৈনিক অনেক টাকা পাওয়া যেত, যা দিয়ে ছেলেটার দ্রুত চিকিৎসা করানো যেত। কিছুদিন আগে রাকিব স্যার তো এভাবে অনেক টাকা তুলেছিলেন।’ -সায়িদ বলল।

‘আসলে সমাজের জন্য কিছু করতে গেলে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্য দিয়ে করতে হয়। সবাই তো আর হাজী মুহাম্মদ মুহসিন বা হাতেমতাঈ হয়ে জন্ম নেয় না। এই যে যাকাত ২.৫% হারে দেওয়ার বিধান করা হয়েছে, এটাও সে রকম একটা মানবিক কাঠামো। যাকাত আছে বলে অনেকে বৎসরে একবার হলেও কিছু টাকা খরচ করছে। না হলে তাও হতো না।’ -আকরাম তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

সায়িদ অনুভব করতে পারল যে, আকরামের মধ্যে বিশাল পরিবর্তন এসে যাচ্ছে।

শহুরে সভ্যতার প্রতিটি পরতে পরতে অন্ধকারের আবরণ। এখানে অন্ধকার সভ্যতাকে কালো দাঁত দেখিয়ে বেঁচে আছে। ফুরকান বলেছিলেন, শহরের মানুষ লাশের বেচাকেনা করে। অনেকে মরা মানুষ দেখলে আনন্দে লাফালাফি করে। কারণ, তাদের কাছে লাশ মানে টাকা। আরো বলেছিলেন, পুরো শহরটায় একটা বিশাল লাশ। এখানে মানুষ আর পশুর মধ্যে ব্যবধান খুব সীমিত। তারা আরেকটু এগিয়ে যেতেই সায়িদ তার বাবার কথাগুলোর প্রমাণ দেখতে পেল। তারা দেখল, একটা লোক কান্নাকাটি করে এম্বুলেন্স চালকদের সাথে কথা বলছে। আর ওরা হাসাহাসি করছে। সায়িদ ও তাহসিন সেখানে ছুটে গেল। সেখানে গিয়ে জানতে পারল, লোকটির বাড়িও ভবগঞ্জ। গতরাতে তার বাবা মারা গিয়েছে। তিনি বাবার লাশ নেওয়ার জন্য এম্বুলেন্স ভাড়া করতে এসেছেন। এম্বুলেন্স চালকরা কেউ পাঁচ হাজার টাকার নিচে রাজি হচ্ছে না। এমনে গাড়ি ভাড়া করতে গেলে ১০০০/১১০০ টাকা চায়, যে মাত্র শুনে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে, তখন তারা ৪০০০/৫০০০ টাকায় চলে যায়। মানুষের মৃত্যুতে মানুষের আনন্দ। পৃথিবীর মধ্যে এর চেয়ে নিষ্ঠুরতা আর কিছুই হতে পারে না। পুরো কাহিনী শুনে তারা খুব ব্যথিত হলো।

মিন্টুর বাবার হঠাৎ মনে পড়ল তার মুঠোফোনে আনজুমানে মুফিদুল ইসলামের একটা ফোন নম্বর আছে। এটা একটা মানব কল্যাণমূলক সংগঠন। তিনি সে নম্বরে ফোন দিলেন। কিছুক্ষণ পর তাদের গাড়ি এসে হাজির হলো। সে এম্বুলেন্সটা দেখে উপস্থিত সব এম্বুলেন্স চালক খুব ক্ষুব্ধ। ওদের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে, তারা এই এম্বুলেন্স চালককে পিটিয়ে মারবে। এম্বুলেন্সটাকে ভেঙ্গে চুরমার করবে। অবস্থা বেগতিক দেখে সায়িদরাও তৎপর হয়ে উঠল। তাদের বহুমুখি তৎপরতা দেখে লাশ পরিবহন ব্যবসায়ী চক্র আর কিছু করল না। সায়িদরা ঐ এম্বুলেন্সে ভবগঞ্জে ফিরে আসল।

 

কথাটা শুনেই হতভম্ব হয়ে গেল সায়িদ। তা কীভাবে সম্ভব? তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ গ্রামের আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এমনকি ডা. মুনতাসিরের চেম্বারে ময়লা নিক্ষেপের ঘটনাও সবার মুখে মুখে। তাদের অভিযোগ হচ্ছে, দারিদ্র তহবিলের নাম দিয়ে টাকা আত্মসাৎ। সেই টাকা দিয়ে নিজেদের জামা পোশাক কেনার। প্রথমে এক কান দু কান শুনে বিশ্বাস হয়নি সায়িদের। যখন আরো কয়েকজনের মুখে কথাগুলো শুনল, তখন সায়িদ বিশ্বাস করল যে, তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হয়েছে। একটা অভিযোগ ছাড়া বাকী সবগুলোই মিথ্যা। কে এই কুৎসাগুলো রটালো এবং কেন? বিষয়টা ভাবিয়ে তুলে ‘না ঘুমানোর দলের’ সদস্যদের। এই নিয়ে তারা বৈঠকে বসে। বৈঠকে মাহবুব বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, এটা রাকিব স্যারের কাজ। তিনি আমাদের বিরুদ্ধে রটনা রটিয়ে টাকা গুলো আত্মসাৎ করতে চায়।’

‘স্যার কুৎসা রটাবে কেন?’ -সায়িদ মাহবুবকে প্রশ্ন করল।

‘ঐ যে বললাম, টাকা আত্মসাৎ।’

‘এখানে কত টাকা যে, উনি আত্মস্যাৎ করতে চাইবেন?’ -আরমান মাহবুবের কাছে জানতে চাইল।

‘তুই কীভাবে বুঝলি যে, এটা স্যারের কাজ।’ -সায়িদ মাহবুবের কাছে প্রশ্ন করল।

‘আমাদের দেশের পুলিশ একটা পান পর্যন্ত ঘুষ খায়। দুই হাজার টাকাতো অনেক বেশী।’ -বলল মাহবুব।

‘মানুষ সর্ম্পকে আজে বাজে ধারণা করবি না। এটা মারাত্মক পাপের কাজ।’ -আরমান মাহবুবকে ধমক দিল।

‘আমি তার পরিচয় বের করবই।’ -প্রতিজ্ঞা করল সায়িদ। ‘এখন তো আমার কোন কাজ করতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে সব ছেড়ে দিই। আমরা কি এখানে চুরি করতে এসেছি।’

‘আরে এত অল্পে হাঁপিয়ে উঠলে চলবে। খারাপ লোকেরা অবশ্যই খারাপ কথা বলবে। এতে ভাল লোকদের ঘাবড়ানোর কিছুই নেই।’ -আরমান সায়িদকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল।

‘এটা ভালো কাজ করতে চাইছি, এটা নিয়েও এত নোংরামী! ইশ।’ -দুঃখ প্রকাশ করল মাহবুব।

মাহবুব পরে বলল, আলী হাকিমও তো এই কাজ করতে পারে। আমার শুরু হতে মনে হয়েছে ওই ব্যাটা ধান্ধাবাজ।’

সবাই বুঝে গেল মাহবুব আন্দাজের উপর ঢিল ছুড়ে মারছে।

সবাই সিদ্ধান্ত নিল, এক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টা উদ্ঘাটন করবে। এবং অভিভাবক সম্মেলনও চালিয়ে যাবে। ভাল কাজ করতে গেলে দু একটা বাধা আসবেই, তাই তারা প্রতিহত করবে।

অভিভাবক সম্মেলন আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। তারা এ ব্যাপারে রাকিব স্যারের সাথে পরামর্শ করলেন। আলী হাকিমও যথেষ্ট সহযোগিতা করলেন তাদেরকে। ‘দরিদ্র ছাত্র কল্যাণ তহবিল’ হতে কিছু টাকা খরচ করে আমন্ত্রণ পত্র ছাপানো হল। আমন্ত্রণ পত্রের খসড়াটিও রাকিব স্যারের করা। এই সম্মেলনে বিভিন্ন জন বক্তব্য রাখলেও সবচেয়ে হৃদয় বিদারক বক্তব্য ছিল তাহসিনের বক্তব্যটা। যে অনেকের দৃষ্টি আকষর্ণ করতে সক্ষম হয়ে। তাই তার বক্তব্যের চুম্বক অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো।

তাহসিন তার বক্তব্যে বললেন, ‘দারিদ্রে্যর যন্ত্রণা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। জানার কথাও না। যে পেটকে পরিতৃপ্ত করে ঘুমিয়ে পড়ে সে কখনো এই অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে পারবে না। জীবনে কত বেলা যে না খেয়ে থেকেছি তা কেউ জানে না। আপনারা সকালে কত কিছুই না খান। আর আমার সকালের একমাত্র নাস্তা হয় পোড়া মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত। আপনাদের মনে হতে পারে এটা তেমন কিছু না। কিন্তু আপনাদেরকে অত্যন্ত বেদনার সাথে বলতে চাই, প্রচন্ড শীতে আপনারা যখন উষ্ণতার জন্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্ত হচ্ছেন, তখন এই শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমাকে পান্তাভাত গিলতে হয়। আমার সর্দি জ্বর যায় থাকুক না কেন, পান্তাভাত আমাকে খেতেই হবে। কারণ এর বিকল্প আয়োজন করার মতো সামর্থ্য বাবার নাই। আমি যদি সকালে পান্তা ভাত খেয়ে বিদ্যালয়ে যাই, তবে দুপুরে অনাহারে থাকি, আর যদি সকালে অনাহারে থাকি, তবে দুপুরে খাই। কখনো কখনো রাত্রে উপোস থাকি। এভাবে খেয়ে না খেয়ে আমাদের জীবন চলে। অথচ আমাদের অনেক ভাইয়েরা সকালে আহার করার পর ১১/১২টার দিকে খাবার জন্য নাস্তা নিয়ে চলে আসে। দুপুরে বাড়ি গিয়ে খায়, বিকেলে বাড়িতে গিয়ে নাস্তা করে, এরপর আবার রাত্রেও খায়। এরপর তার মা হাজির হয় নানান পদের ফলমূল নিয়ে। হাজির হয় দুধ বা দই নিয়ে। সন্তানেরা খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়ান। সন্তান খায় না বলে মা বাবার কতো উদ্বেগ। এই যে বৈষম্য, একজন খেতে পাচ্ছে না, আর একজন খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে, ছেলেটা বিরক্ত হচ্ছে, মা-বাবাকে বকাঝকা করছে, এর কি জবাব? সমাজের লোকগুলো যদি ঘুমিয়ে না থাকত, আমাদের তো এই অবস্থা হতো না। রাষ্ট্রও তো আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। অভাব আমাদের ঘরের চারপাশে অক্টোপাশের মতো ঘিরে আছে। আমার নিজের পরিধান করার কাপড় নেই, বিদ্যালয়ের ড্রেস কেনার চিন্তা করাটা পাপ। এবার রাকিব স্যার কিনে দিলেন বলে, আমার এই বিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাবার সুযোগ হচ্ছে। না হলে, হয়তো আমাকে আর বিদ্যালয়ে যেতে হতো না, শুধুমাত্র একটি পোশাকের অভাবে। বাংলাদেশে আমার মতো হাজারো তাহসিন আছে, যারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে, আমার বয়সে সংসারের হাল ধরেছে। সেদিন শহরে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখলাম। এদেরকে যদি আমরা মানুষ রূপে গড়ে তুলতে না পারি, তবে জাতি চিরকাল অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে। এদের জন্য কিছু করতে সমাজের স্বচ্ছল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।’’ -তার বক্তব্যের সময় অনেককে চোখ মুছতে দেখা গেল।

সভায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহিত হলো। সিদ্ধান্তগুলো হলো-

০১. প্রতি বৎসরের শুরুতে দরিদ্র ছাত্র কল্যাণ তহবিলের জন্য বিশেষ তহবিল সংগ্রহ করা হবে। তা আদায় করা হবে অভিভাবকদের নিকট হতে।

০২. বিভিন্ন পরীক্ষার সময়ও অভিভাবকদের কাছ থেকে বিশেষ তহবিলের অর্থ সংগ্রহ করা হবে।

০৩. ফুরকান প্রতিমাসে তার আয়ের ২% তহবিলের জন্য প্রদান করবেন।

০৪. রাকিব স্যার তহবিলের সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করবেন। এই জন্য তিনি সম্পূর্ণ আলাদা একটি হিসাব পরিচালনা করবেন।

০৫. কিছু সংখ্যক অভিভাবক প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমান চাঁদা প্রদান করবেন।

০৬. এলাকার চরম দরিদ্র ছাত্রদের খোঁজে বের করার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে। না ঘুমানোর দলের সদস্যরা অভিভাবকদের সহায়তায় এ কাজ করবেন।

এ সভায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় সিদ্ধান্তটি ছিল আকরামের। আকরামের এই সিদ্ধান্তটি দারুণভাবে প্রশংসিত হলো। অনেকেই বললেন, সমাজের সচ্ছল লোকগুলো যদি অন্তত দু/তিন জনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়, এদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব সাধিত হবে। কৃপণ বলে খ্যাত আকরাম তিনজন ছাত্রের দায়িত্ব নিলেন। প্রমাণ দিলেন ইচ্ছা করলে নিজের স্বভাবকে অতিক্রম করা যায়।

সম্মেলনের পর দিন বিদ্যালয়ে যাওয়ার সায়িদ দেখল পাড়ার পুকুর পাড়ে বসে মাহবুব কারো সাথে কথা বলছে। সায়িদ চুপি চুপি তার নিকট যাচ্ছিল তাকে চমকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। এ কি বলছে মাহবুব! মাহবুব বশরকে বুঝাচ্ছে যে, সম্মেলনের নামে অনেক টাকা পকেটে ভরেছে সায়িদ। শুনে তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, তাদের বিরুদ্ধে যত কুৎসা রটাচ্ছে, এর পিছনে কাজ করছে মাহবুব। সেখান হতে আবার নিঃশব্দে বিদ্যালয়ের পথ ধরল সায়িদ। কয়েকদিন পর বিকেলে না ঘুমানোর দলের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হলো। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাহবুবকে দল থেকে বাদ দেওয়া হলো। এতে সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আলী হাকিম তাদেরকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। আলী হাকিমের বক্তব্য হলো, শরীরের কোথাও যদি গ্যাংরিং হয়, তবে ঐ অংশ কেটে ফেলতে হয় রোগীকে বাঁচানোর জন্য। তোমাদেরকে তাই করতে হবে। না হলে সারা শরীরে রোগটা ছড়িয়ে পড়বে। আগুন হালকা হলেও নিভিয়ে ফেলতে হবে, না হলে যে কোন সময় তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। আসলে প্রত্যেক ভালো কাজের কিছু বিরোধিতাকারী থাকে। কেন তারা বিরোধিতা করছে তাও তারা জানেনা। এদেরকে দমন করতে না পারলে পুরো সমাজটাই অন্ধকার হয়ে যায়।

 

এলাকার চরম দরিদ্র ছাত্রদের খুঁজে বের হয়েছে না ঘুমানোর দল। দলের সাত সদস্য এক সাথে বের হয়েছে। মাহবুবকে বাদ দেওয়ায় তারা সাতজনে চলে এসেছে। যারা তাদের নতুন তৎপরতা সম্পর্কে জানত না, তারা এ দলের সবাইকে একসাথে দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল। কারণ, সবাই এক সাথে থাকা মানে নতুন কোন দুরভিসন্ধি। তাই অনেকে তাদের চলার পথে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল। যেতে যেতে তারা উঠল জ্বিন বুড়ির ভিটায়। বুড়ির কোন আত্মীয়-স্বজন নাই, বুড়ি এ ভিটায় সম্পূর্ণ একলা থাকে, তাই তাকে জ্বিন বুড়ি বলা হয়। ওখানে গিয়ে তারা বুড়ির টিনে মাটির ঢেলা ছুড়ে মারল। বুড়ি বেরিয়ে এসে দেখে তাদেরকে। তিনি তাদেরকে কিছু বললেন না। রাকিব স্যার বিকেলে যাওয়ার সময় এ পথ দিয়ে যায়। বুড়ি বিকেলে তাকে সব কথা খুলে বললেন। পরদিন তিনি দলের সদস্যদের ডাকালেন। বললেন, ‘তোমাদের নতুন নতুন মানবতাবাদী উদ্যোগ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এখন দেখি, যে লাউ সে কদু। তোমরা যদি মানুষকে এক হাতে আদর কর, অন্য হাতে থাপ্পড় মার, তোমাদের ভাল উদ্যোগগুলো মন্দ কর্মের কারণে ভেস্তে যায়। এই ধারা আর কত দিন চলবে। আমি তোমাদের মধ্যে এই দুই ধারা দেখতে চাই না। এই দুই ধারার যে কোন এক ধারার অবসান ঘটুক। হয় তোমরা ভাল হয়ে যাও, নয় তো খারাপ হয়ে যাও। কোন লোক দশটি ভালো কাজ করে একটি খারাপ কাজ করলে সবাই তাকে খারাপ বলে। ভালো বলে না। কারণ মানুষ খারাপ কাজটা আগে দেখে। আমি সত্যি তোমাদের ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত। আমার মনে হয়, তোমাদের এ ধরণের উগ্রতা, তোমাদের ধ্বংসের কারণ হবে। আমি তোমাদের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে গেলাম। কারণ তোমাদের ব্যাপারে আমাকে প্রতিদিন অভিযোগ শুনতে হয়।’

স্যারের কথাগুলো শুনে তারা অনুতপ্ত হলো। স্যারের কাছে ওয়াদা করল তারা আর কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না। স্যার খুশি হলেন।

কয়েকদিন পর দ্বিতীয় দফা অভিযানে বের হয়েছে না ঘুমানোর দল। তারা গ্রামের কয়েকটা হতদরিদ্র পরিবারে গিয়ে তাদের সন্তানদের খোঁজ খবর নিল। এই খোঁজ নিতে গিয়ে অভাবের তাড়না কি তারা বুঝতে সক্ষম হল। তাহসিনের অভাব দেখে তারা ভালো পথে চলার জন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। এবার যা দেখতে পেল তাতে তাদের মর্মবেদনা আরো বহুগুণ বেড়ে গেল।

হায় অভাব! তুমি মানুষকে কিনা করতে পার? অভাবের তাড়নায় জগতের অনেক পাপ সংঘটিত হয়। তা মানুষের নৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়, তাকে অসৎ পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করে। গ্রামের তজু চোর হিসেবে খ্যাত। তজুর বাড়িতে গিয়ে তারা দেখতে পেল পুরো পরিবারের সবাই শুয়ে আছে। সবার চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, তিনদিন যাবৎ কোন দানা পানি পড়েনি তাদের পেটে। শুনে অনেকের চোখে পানি টলমল করে উঠল। সায়িদ, শাকিল, মিন্টু, আরমানের হাত চলে গেল নিজ নিজ পকেটে। সবাই পকেট হাতড়ে যা পেল তা বের করে আনল। সবার টাকা একত্রিত করে তাহসিন ছুটল বাজারে। বাজারে গিয়ে কিছু চাল, ডাল, আলু ও বিস্কুট নিয়ে দ্রুত ফিরে আসল সে। বিস্কুট খেয়ে একটু চাঙ্গা হওয়ার পর তজুর বউ গেল রান্না করতে।

তজু চোর। গ্রামে কিছু চুরি হলে দোষ এসে পড়ে তজুর উপর। কিন্তু তজু কেন চুরি করে তা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। তজু মূলত অলস প্রকৃতির মানুষ। যতদিন হাতে টাকা থাকে, ততদিন কোন কাজ করে না। অভাব দেখা দিলে আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করে সে। তার এ স্বভাবের কারণে তার পরিবার হতে অভাব বিদায় নিচ্ছে না। চোর বদনাম আছে বলে তাকে কেউ কাজ দিতে চায় না। আর কেউ বাধ্য হয়ে কাজ দিলেও সে তা ঠিকমতো করে না। সব মিলে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তার একমাত্র ছেলেটার বয়স আট বছর। তজু সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে কোন কাজে দিয়ে ফেলবে। তারা তজুর ছেলেকে তালিকা ভুক্ত করল। এরপর গেল মাক্কুর বাড়িতে। মাক্কু অভাবী মানুষ। কিন্তু তার স্বভাব তজুর মতো নয়। অলসতার সুখ শয্যা তাকে গ্রাস করতে পারে না। কিন্তু কপাল বলে একটা কথা আছে। মাক্কু সে কপালের খপ্পরে পড়ে আছে। সে সংসারের অভাব মোচনের জন্য রাতদিন কাজ করে। পরিবার অনাহারে না থাকলেও তার নুন আনতে পানতা পুরোয় অবস্থা। তার দু’মেয়ে পাড়ার দু’বাড়িতে কাজ করে। ওরা লেখাপড়ার আশেপাশেও কখনো যায়নি। এভাবে আরো কয়েকটি পরিবারের খোঁজ খবর নিয়ে তাদেরকেও তালিকাভুক্ত করল না ঘুমানোর দল।

তারা সকালে বের হয়েছিল এই অনুসন্ধান কার্যে। যখন তাদের কাজ গুটিয়ে ফিরে আসছিল তখন তপ্ত দুপুর। খাল-বিল-মাঠ জনশূন্য। দুপুরের তিক্ষ্ণ রোদ প্রচন্ড উত্তাপ ছড়িয়ে পুরো পৃথিবীকে ছাই করে দিচ্ছে। এই রোদের অত্যাচার হতে বাঁচার জন্য পাখিরাও বৃক্ষের ছায়ায় বসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। তারা বিলের আইল বেয়ে আসতে আসতে এক বট বৃক্ষের নিকট আসল। সবাই ক্লান্ত বলে সে বৃক্ষের নিচে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসল। তাদের দৃষ্টি গেল পাশের এক তরমুজ ক্ষেতে। পুরো মাঠ জনশূন্য। এই সুযোগটা হাতছাড়া করার মতো নয়। সুযোগ পেয়ে ক্ষেতের তিনটি তরমুজ ছিড়ে এনে বট গাছের সাথে আঘাত করে তা ভেঙে ফেলল। তাহসিন একটু বাধা দিতে চাইলেও তাকে কেউ গ্রাহ্য করল না। সবাই মিলে সে তরমুজ খেয়ে বাড়ির পথ ধরল।

তরমুজ ক্ষেতের মালিক রইচ দূর হতে এ দৃশ্য দেখলেও বাধা দেয়নি। বাধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ছেলেদের প্রকৃতি সর্ম্পকে তার ভালো করেই জানা। ইতোপূর্বে যারা তাদের এ কাজ হতে বাধা দিয়েছে সবাই বিপদে পড়েছে। কয়েকদিন পর দেখা গেছে তাদের পুরো ফসলের মাঠ ছারখার হয়ে গেছে। রইচ জানে তাদের হাতে তিনটি তরমুজ নষ্ট হলেও তিনশ তরমুজ রক্ষা পাবে ওদের বাধা না দিলে। তাদেরকে বাধা না দিলেও এ ঘটনা অবহিত করল রাকিব স্যার ও প্রধান শিক্ষককে। তারা রইচকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, ‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

কোন জিনিসটা সহজ?

প্রধান শিক্ষক আহমদ রেযা না ঘুমানোর দলকে একটা কাজ দিয়েছেন। বিদ্যালয়ের সামনে কিছু ইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তিনি সবাইকে বললেন, সব ইট ভাঁজ করে রাখার জন্য। তারা তাই করল। তারা যখন কাজ শেষ করল, তখন আহমদ রেযা গিয়ে লাথি মারতে মারতে সব এলোমেলো করে দিলেন। তিনি তাদেরকে পরবর্তি কাজ দিলেন, মাটির বিভিন্ন রকম ফুল বানাতে। ছাত্ররা তিনদিন ধরে শিউলী, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জবা বানিয়ে প্রধান শিক্ষককে দিলেন। তারা যখন সব শিল্পকর্ম স্যারের সামনে রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছিল, তখন আহমদ রেযা সবগুলো দু’পায়ে দলে নষ্ট করে দিলেন। এরপর তিনি বাঁশ দিয়ে নৌকা, জাহাজ, সাপ, বানিয়ে এনে দেখাতে বললেন। স্যারের এবারের নির্দেশ পাবার পর তাদের মনে প্রশ্ন জাগলো, স্যার আমাদের সাথে এমন ব্যবহার করছে কেন?

বিভিন্ন জায়গায় জরিপ করে না ঘুমানোর দল বিশজন হতদরিদ্র ছাত্রকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছে। এই বিশজনকে বিদ্যালয়মুখি করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাদের। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার প্রয়োজন হয়েছে তা হলো উদ্বুদ্ধকরণ। দেখা গেছে, যারা সমাজের নিম্ন শ্রেণিতে বসবাস করে, তাদের চিন্তা-ভাবনা কখনো উন্নত পর্যায়ের হয় না। তজু তার ছেলেকে কাজে দেওয়ার জন্য সব ঠিক করে রেখেছে। তার বক্তব্য হলো, ছেলে যদি দৈনিক ত্রিশ টাকা আয় করে, তাদের পরিবারের অভাব দূর হবে। তাদেরকে অনেক কষ্টে বুঝাতে হয়েছে, যে ছেলেটাকে তুমি ত্রিশ টাকা আয়ের জন্য কাজে দিচ্ছ, তার আয় সারা জীবন ত্রিশ টাকায় থাকবে। তার আয়কৃত অর্থ নানানভাবে হাওয়ায় মিশে যাবে। সে বুঝতে পারবে না, সে কোথায় স্বাক্ষর দিচ্ছে, তার মৃত্যুদন্ডে নাকি উন্নতিপত্রে। তার জীবনের বাঁকে বাঁকে আত্মগোপন করে থাকবে বিপদ। বিপদের গন্ধ তার নাকে সুড়সুড়ি দিবে, কিন্তু অনুভব করতে পারবে না। শিক্ষা হচ্ছে একটি আশ্চর্য প্রদীপ, যার স্পর্শে জীবন উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। এভাবে আদর, স্নেহ, যুক্তি, তর্ক দিয়ে তাদের অভিভাবকদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে হয়েছে। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হয়েছে।

বিশজন তৃণমূল ছাত্র বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করেছে। তাদেরকে বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য মধ্যাহ্নে হাল্কা নাস্তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের এই উপস্থিতি দেখে না ঘুমানোর দলের সদস্যদের মন ভরে উঠার কথা। কিন্তু কারো মনে শান্তি নেই। শান্তি থাকবে কেন? তাদের সাথে প্রধান শিক্ষক কয়েকদিন যাবত রহস্যজনক আচরণ করছে। কেন করছে তারা কেউ তা বলতে পারে না।

এই নিয়েই জরুরী সভায় বসল দলের সব সদস্যরা। সায়িদ সবার কাছে প্রশ্ন রাখল, ‘প্রধান শিক্ষকের আমাদের সাথে এ বিরূপ আচরণের কারণ কি? আমাদের এই সভা হলো সে উত্তর খুঁজে বের করার জন্য।’

তারা অনেক আলোচনা পর্যালোচনা করে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। নানা জন নানা মত দিয়েছে। কিন্তু ফলাফল অশ্বডিম্ব। তারা হতাশ মন নিয়ে বিষয়টা নিয়ে রাকিব স্যারের সাথে আলোচনা করার জন্য তার বাসায় গেল। সব শুনে রাকিব স্যার হেসে বললেন, ‘আমি তো সব দেখেছি। আমাকে বলার দরকারটা কি?’

‘স্যার আপনাকে বলেছি যাতে আপনি স্যারের সাথে কথা বলে এর কারণটা বের করতে পারেন।’ -আরমান বলল।

রাকিব স্যার হাসলেন।

‘স্যার, আমরা কি অনেক ভালো উদ্যোগ নেয়নি। স্যার আমাদের উপর এত ক্ষিপ্ত হবেন কেন?’ -জানতে চাইল সায়িদ।

‘আমিও তাই ভাবছি।’ -জবাব দিলেন রাকিব স্যার।

‘স্যার, আপনি কি স্যারের সাথে কথা বলে ব্যাপারটার একটা সুরাহা করবেন?’ -অনুনয় করল মিন্টু।

তার কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন রাকিব স্যার। তার হাসি দেখে সায়িদ বুঝতে পারল, প্রধান শিক্ষক তাদের সাথে কি কারণে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে, তার রহস্য রাকিব স্যারের কাছে জানা আছে। কিন্তু প্রকাশ করছে না।

কয়েকদিন পর তারা প্রধান শিক্ষকের নির্দেশ অনুযায়ী বাঁশের নৌকা, জাহাজ, সাপ, বানিয়ে জমা দিলেন। প্রধান শিক্ষক জিনিসগুলো হাতে নিয়ে টুকরো টুকরো করতে করতে বললেন, ‘এবার তোমাদের কাজ হবে মোম দিয়ে।’

‘স্যার,’ অনেকটা চিৎকার করে সায়িদ বলল, ‘আপনার কাছে একটা প্রশ্ন করতে পারব?’

‘হ্যাঁ, একটা কেন, একশটাই করতে পারবে।’ বললেন আহমদ রেযা।

‘স্যার, আপনি আমাদের দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানিয়ে নিচ্ছেন, আবার সেগুলো দেখামাত্র ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছেন। এর রহস্যটা আমরা জানতে চাই আপনার কাছে।’

‘এটা তো কোন রহস্য না। এর উত্তরটা তোমাদের কাছেও আছে। আমি শুধু সে উত্তরটা তোমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি ।’

‘উত্তর আমাদের জানা আছে!’ -বিস্মিত হয়ে গেল না ঘুমানোর দলের সদস্যরা।

‘কিন্তু আমরা তো সে উত্তরটা খুঁজে বের করতে পারছি না।’ বলল মিন্টু।

‘যতদিন পর্যন্ত এই উত্তরটা তোমরা বের করতে পারবে না, ততদিন পর্যন্ত তোমাদেরকে এভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।’ -বললেন আহমদ রেযা।

তিনি তার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদেরকে মোমের বিভিন্ন রকমের জিনিস বানিয়ে আনার নির্দেশ দিয়ে সেখান হতে চলে গেলেন। তাদেরকে তিনি তিনদিন সময় দিলেন। স্যারের নির্দেশ পাবার পর না ঘুমানোর দল বিদ্যালয় হতে বের হয়ে বাড়ির পথ ধরল।

প্রধান শিক্ষকের রহস্যময় কথা, রাকিব স্যারের রহস্যময় হাসি, গড়া ও ভাঙ্গা সব নিয়ে খুব বেকায়দায় পড়ল না ঘুমানোর দল। তারা সিদ্ধান্ত নিল তিন দিনের আগে প্রধান শিক্ষকের এই আচরণের রহস্য উদঘাটন করবে। প্রয়োজনে তিন দিনে সাতটি বৈঠক করে তার সমাধান তারা বের করে আনবে।

কি কারণ থাকতে পারে আহমদ রেযার অদ্ভুত আচরণের পিছনে! এ নিয়ে পরপর তিনদিন বৈঠকে বসল তারা। নানান জন নানান মত দেয় কিন্তু সমাধান আসে না। মনোচাপের কারণে স্যারের দেওয়া কাজটিতেও তারা হাত দিতে পারল না। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করে চারদিন সময় বাড়ানোর আবেদন করল। তাদের আবেদন পত্র পেয়ে প্রধান শিক্ষক যেন চমকে উঠলেন।

‘তোমরা কেন সময় বাড়ানোর আবেদন করছ?’ -জানতে চাইলেন আহমদ রেযা।

‘আমরা স্যার একটা রহস্যের সমাধান বের করার জন্য আপ্রাণ লড়াই করছি, সে দিকে মনোযোগ দেওয়াতে আমরা আপনার কাজে হাতও দিতে পারিনি।’ -জবাব দিল সায়িদ।

‘কি সে রহস্য?’

‘স্যার, পরে বললে কি আপনি বেয়াদবী ধরবেন!’

‘যদি তোমাদের অসুবিধা থাকে পরে বলিও। আমি তোমাদের আবেদন মঞ্জুর করলাম।’

স্যারের দরখাস্ত মঞ্জুরী দেখে না ঘুমানোর দলের সদস্যরা খুব খুশী হল।

 

বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলছিল সায়িদরা। একটু দূরে মনু চাষীর মরিচ ক্ষেত। বলের গায়ে সজোরে লাথি মেরেছিল আশফাক। বলটা সরাসরি গিয়ে পড়ল মরিচ ক্ষেতে। ক্ষেতে পানি দিচ্ছিল মনু। সে গিয়ে বলটা কুড়িয়ে নিল। সবাই বুঝতে পারল, বলটা ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা মনুর নেই। সব খেলোওয়াড় ছুটল মনুর নিকট হতে বলটা উদ্ধারের জন্য।

‘বল দেওয়া হবে না। আমি কি তোমাদেরকে এখানে ফুটবল খেলতে মানা করিনি!’ -মনু স্পষ্ট জানিয়ে দিল।

‘চাচা, শেষ বারের মতো বলটা দিয়ে দেন। আমরা আর কখনো আশেপাশেও ফুটবল খেলবো না।’ -আরমান মনুর কাছে অনুনয় করল।

‘খেলবে না বললেই হলো, এই দেখ তোমরা আমার কী ক্ষতি করেছ?’ মনু কয়েকটা ভাঙ্গা চারা গাছ তাদেরকে দিকে তুলে ধরল। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এগুলো বড় করেছি। আর তোমাদের বলের এক আঘাতে সব নষ্ট হয়ে গেল। বাবারা কোন জিনিস গড়া কঠিন, ভাঙ্গা সহজ। সারা বৎসরের সাধনা একটা আঘাতে বরবাদ হয়ে যায়।’

মনু তার কথা শেষ করতে না করতেই ‘পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি’ বলে চিৎকার করে দৌড়তে শুরু করল সায়িদ। সে বাড়ির দিকে না গিয়ে পূর্ব দিকে দৌড়াচ্ছে। সায়িদ কি পেয়েছে? এই পাওয়ার পর দৌড়াচ্ছে কেন? বাড়ির দিকে না গিয়ে পূর্ব দিকে যাচ্ছে কেন? তার এই অদ্ভুত আচরণ দেখে মনু ভাবল, সায়িদ মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। তাই মনু দ্রুত বলটা বাইরে ছুড়ে মারল। বলটা কুড়িয়ে নিয়ে সবাই মাঠে ফিরে আসল।

কি পেয়েছে সায়িদ? হঠাৎ সে পূর্ব দিকে ছুটল কেন? সে কি পাগল হয়ে গেল নাকি! অনেক প্রশ্ন শুধু মনু নয়, জড়ো হয়েছে সবার মনে। সায়িদকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য সবাই ছুটল পূর্ব দিকে। অজানা আশঙ্কায় কেঁদে দিল শাকিল। সে ছুটল বাড়ির দিকে মা বাবাকে খবর দেওয়ার জন্য। সবার চোখে মুখে উদ্বেগের চাপ। শাকিলের কথা শুনে মা বাবাও ছুটল পূর্ব দিকে। সবাই যখন অর্ধেক পথ গিয়েছে তখন তারা দেখল সায়িদ ফিরে আসছে। তার চেহারায় আনন্দ বা বেদনার কোন চাপ নেই।

‘সায়িদ, তুই কী পেয়েছিস? হঠাৎ এমন দৌড় দিয়ে কোথায় গেলি? কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।’ -মিন্টু তার কাছে প্রশ্ন রাখল।

‘কী পেয়েছি, বুঝতে পারিসনি? আমি সমাধানটা পেয়ে গেছি।’

‘কী সমাধান?’

সায়িদ দেখল তার মা বাবা উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসছে। সায়িদ এতক্ষণে অনুভব করল এইভাবে দৌড়া ঠিক হয়নি। বাবা এক দৌড়ে এসে সায়িদকে জড়িয়ে ধরল।

‘বাবা কী হয়েছে?’ -মায়ের প্রশ্নের মধ্যে প্রচন্ড উদ্বেগের চাপ।

সায়িদ তাদেরকে জানাল প্রধান শিক্ষক আহমদ রেযা স্যার তাদের সাথে যে রহস্যময় আচরণ করছে, তার সমাধান সে পেয়েছে মনু চাচার কথায়।’

সে তার অবস্থান তাদের কাছে ব্যাখ্যা করল। শেষে বলল, স্যার এই আচরণের মাধ্যমে আমাদেরকে বুঝাতে চায়, কোন জিনিস গড়া কঠিন, কিন্তু ভাঙা সহজ। আমরা যে বিভিন্ন দুষ্টুমি করে বদনাম কুড়াই, তা আমাদের সব অর্জনকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়।

‘এদিকে দৌড়ে কোথায় গেলেন, ভাইয়া?’ -শাকিল বড় সহোদরের কাছে জানতে চাইল।

‘বিষয়টা স্যারকে অবহিত করার জন্য। বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখি কেউ নেই। আমার মনেও ছিল না যে, আজ বৃহস্পতিবার, অর্ধছুটি।’

স্যারের রহস্যময় আচরণের সমাধান পেয়ে গেছে তারা। সুতরাং তাদের আর কোন মনোচাপ নেই। তারা মোমের কাজে হাত দিল। দুটি ফুলের গাছ ও একটি বাড়ি, একটি আপেল ও দুটি কলা বানিয়ে ফেলল। তারা চার দিন সময় বাড়িয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সে বাড়তি সময়টা দরকার হলো না। শনিবারে সব শিল্পকর্মগুলো আহমদ রেযার কাছে নিয়ে গেল তারা।

সেগুলো জমা দিতে দিতে সায়িদ বলল, স্যার, দয়া করে এগুলো নষ্ট করবেন না।’

স্যার বললেন, ‘তোমরা তো চারদিন সময় চেয়েছিলে।’

‘তার দরকার হয়নি, স্যার।’ -বলল সায়িদ।

‘কেন?’ স্যার একটি কলা ভাঙতে লাগলেন।

‘স্যার, আমরা আপনার আচরণের রহস্য ভেদ করতে পেরেছি।’ -বলল তাহসিন।

‘তাই নাকি।’ -স্যার মৃদু হাসলেন। ‘কীভাবে?’

‘স্যার, আপনি আমাদের হাতে কলমে বুঝাতে চাচ্ছেন, কর্মে সাফল্য পাওয়ার পথটা খুব কঠিন, কিন্তু তা এক লাথিতে ভেঙে যায়। তাই আমাদের এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যা আমাদের অর্জিত সুনামকে মুহূর্তের মধ্যে হাওয়ায় মিশিয়ে দেয়।’

আহমদ রেযা মাথা নাড়লেন। তিনি মোমের শিল্পকর্ম গুলোর ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করে সেগুলো নেড়ে ছেড়ে দেখতে লাগলেন।

‘স্যার,’ সায়িদ বলতে লাগলেন, ‘আমরা আপনার নিকট ওয়াদা করছি, আমরা জীবনে আর কারো কোন ধরনের ক্ষতি করবো না। সর্বদা মানুষের ভালো করবো। আমরা জেনে গেছি, আমাদের দুষ্টুমির কারণে আমাদের সব অর্জনগুলো ধুলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের অর্জনগুলোকে আর ধুলোমলিন হতে দেব না।’

সায়িদের কথা শেষ না হতেই সবাই একযোগে চিৎকার করে উঠল, আমরা আর মানুষের ক্ষতি করবো না।’

তাদের কথায় প্রধান শিক্ষক খুব খুশি হলেন। তাদের বানানো শিল্পকর্মের একটি কলা স্যার ভেঙে ফেলেছেন। বাকীগুলো তার হাতে আছে। তিনি সবগুলো আলমারীর উপর সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলেন। তিনি সব শিক্ষকদের ডেকে পাঠালেন। সব কথা শুনে তারাও খুব খুশি হলেন।

রাকিব স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘সত্যিই তোমরা অসাধারণ। একজন কৃষকের কথার মাঝে সমাধান পাওয়া, মানে তোমাদের অন্তরদৃষ্টি খুলে যাচ্ছে।’

আহমদ রেযা কেদারায় বসতে বসতে বললেন, ‘তোমরা সত্যিই জেগে উঠছ। এবার তোমাদের দায়িত্ব হবে সবাইকে জাগিয়ে তোলা। তোমাদেরকে সূর্যের মতো হতে হবে। সূর্য উঠলে কেউ কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে! পারে না। আমি চেষ্টা করেছি, তোমাদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করতে। তাতে আমি সফলতা পেয়েছি। তোমাদের বিবেক জেগে উঠেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এখন তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অপবাদ উত্থিত হলে আমি তা প্রতিরোধ করতে পারব। মাহবুবের মতো দুষ্ট ছেলেরা আর অপবাদ দিয়ে সুবিধা ভোগ করতে পারবে না। কোন মানুষের যখন বিবেকবোধ জাগ্রত হয়, তখন তার জেগে উঠা আর রোধ করা যায় না। আমি আজ নিশ্চিত হয়েছি, তোমরা আর অন্যায় কর্মে লিপ্ত হবে না। আমার সাথে কৃত ওয়াদা রক্ষা করবে।’ -স্যারের কথায় তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। এই সময় রাকিব স্যার বলে উঠলেন, ‘আজ হতে তোমরা সত্যিই না ঘুমানোর দল।’

সবাই যখন আনন্দে হাসছে ঐ সময় সায়িদ দেখল একটি তোতা পাখি উড়ে এদিকে আসছে। তোতা পাখিটি এসে সায়িদের কাঁধে বসল। সবাই বুঝতে পারল, এটা শিবলু। সায়িদের প্রিয় তোতা পাখি।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!