‘না উটের দুধ, না আরবের সাক্ষাত’

বন্ধুরা! আশা করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। আজও আমরা তেমনি একটি প্রবাদের গল্প শোনাব। প্রবাদটি হলো: ‘না উটের দুধ, না আরবের সাক্ষাত’। এ ধরনের প্রবাদগুলো আসলে কথার কথা। কথা মানে সত্য কিংবা বাস্তব কিনা; বলা কঠিন। তবে লোকমুখে বলাবলি হতে হতে এক রকম কথা প্রচলিত সত্যে পরিণত হয়েছে। আজকের শুরুতেই থাকবে আমরা এ সম্পর্কে একটি গল্প শুনব। আর গল্প শেষে থাকবে উটের দুধের উপকারিতা ও উট সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য। ‘না উটের দুধ, না আরবের সাক্ষাত’।

অনেক অনেক দিন আগের মরুর অধিবাসী এক আরবের কথা। বাংলাদেশের নাগরিক যারা তারা যেমন বাংলাদেশী তেমনি যারা কোনো আরব দেশের অধিবাসী কিংবা আরবী ভাষাভাষী অঞ্চলের লোক তারা হলো আরব। আর কে না জানে প্রাচীন কালের আরবেরা ছিল তাঁবুবাসী। মানে মরুভূমিতে তাঁবু গেড়ে বসবাস করত তারা। বসবাসযোগ্য আবহাওয়ার খোঁজে মরুভূমির এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তারা তাঁবু স্থানান্তর করে বাস করত। এ জন্য তাদেরকে বেদুঈনও বলা হয়। তাঁবুবাসী বেদুঈনরা শহরে খুব একটা যেত না। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে তারা মরুভূমিতেই কাজকর্ম করে জীবন যাপন করত।

এ রকম একজন আরব মাঝে মাঝে শহরে যেত তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য। সাধারণ তাঁবুবাসীদের মতো মরুবাসী ওই আরবেরও পেশা ছিল উট প্রতিপালন করা। প্রাচীন কাল থেকেই আরবদের জীবন ও জীবিকার সাথে মিশে আছে উট। ভীষণ কষ্ট সহিষ্ণু এ প্রাণীটিকে দীর্ঘ ও উত্তপ্ত মরু অঞ্চলে টিকে থাকার অকল্পনীয় ক্ষমতা দিয়েই মহান স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন।

তো, উটের রাখাল ওই আরব শহরে যেতে যেতে পরিচিত হয়েছিল এক শহুরে লোকের সাথে। তার বাসায় যাওয়া আসা করতে করতে শহুরে লোকটির সাথে আরব লোকটির বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাই যতবারই উট পালনকারী শহরে তার কাজে যেত ততবারই তার বন্ধুর সাথে দেখা করত। পারস্পরিক কুশল বিনিময় করত। বন্ধুর জন্য আরব লোকটি কখনই খালি হাতে যেত না, সবসময়ই উটপালক অন্তত উটের খাঁটি দুধ মাটির কলসি ভর্তি করে নিয়ে যেত।

উটের খাঁটি দুধ খেতে খেতে শহুরে বন্ধুর ভালো লেগে গেল। বলা যায় একরকম অপেক্ষায় থাকত কখন তার মরুবাসী বন্ধু শহরে আসবে, উটের দুধ নিয়ে আসবে তার জন্য। মরুবাসী উটপালক কিন্তু খুব বেশি আসত না শহরে, বড়জোর মাসে একবার, তার বেশি নয়। তারপরও একরকম রুটিন হয়ে গিয়েছিল। শহুরে বন্ধু বুঝতে পারত কখন তার মরুবাসী বন্ধু আসবে। অন্তত তার আসার আনুমানিক সময়টা আঁচ করতে পারত।

কিন্তু হঠাৎ একটা সমস্যা দেখা দিল। আনুমানিক সময় পার হয়ে গেল অথচ উটপালক বন্ধু তার এল না। অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগল শহরবাসী বন্ধু। তবু প্রহর যেন ফুরায় না। এক মাসের জায়গায় আরেক সপ্তা, আরো এক সপ্তা, আরো এক মাস, তারপরও আসে না তার বন্ধু। নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছে, কিংবা কোনো অসুখ বিসুখে পড়ে আসতে পারছে না। তবু অপেক্ষা বন্ধুর জন্য। হয়ত এসে যাবে। কিন্তু না বন্ধু এল না, আরো এক মাস পরেও না। তিন তিনটি মাস বন্ধু শহরে এল না। আর তো অপেক্ষা করাটা ঠিক হবে না। কতকাল দেখা হয় না। শহরের বন্ধুটা এবার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল মরুবাসী friend’s খোঁজে বেরুবে।

এদিকে, মরুবাসী উটপালকের জীবনে এসেছে বহু ঘটনা দুর্ঘটনা। কিছুতেই তার পক্ষে আর শহরে যাওয়া হয়ে উঠল না। তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো এনে দেওয়ার জন্য তার প্রতিবেশী তাঁবুবাসীদের অনুরোধ করত। তাদেরাও না বলত না, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শহর থেকে এনে দিত তাকে।

মরুবাসী উটপালকের দেখা না পেয়ে শহরের বন্ধু ঠিকঠাকমতো তার নৈতিক দায়িত্বে অংশ হিসেবে পা বাড়ালো মরুর দিকে। বহুদিন পর বন্ধুকে দেখতে পাবে সেই আনন্দ বুকে তার। আর মনের ভেতর উটের তাজা দুধ খাবার বাসনাটাও আছে। দুটোই পূর্ণ হবে- এই আকাঙ্ক্ষায় পথ চলছিল সে। চমৎকার একটি ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলো সে। সাথে নিয়েছে বন্ধুর জন্যে চমৎকার উপহার।

ঘোড়া নিয়ে মরুপথে দৌড়ে বেড়ানোর মধ্যে একটা মজা আছে। সেই মজার একটা অভিজ্ঞতাও হবে- এরকম একটা চিন্তা মনে মনে ছিল ঘোড় সওয়ারির। ঘোড়া নিয়ে যখন শহর ছেড়ে বেরুচ্ছিল সে তখনই আবহাওয়াটা একটু কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছিলো তার। তবু এগিয়ে গেল সে। সামনে যেতেই হালকা বাতাস অনুভব করল সে। মন্দ লাগেনি তার। আরো সামনে যাবার পর বাতাসের গতি বেড়ে গেল। খোলা মরুভূমি, একেবারে দিগন্ত বিস্তৃত। বাতাস তো লাগতেই পারে। ঘোড়ায় চড়ে শহুরে বন্ধু এগিয়ে যেতে লাগল মরুবাসী বন্ধুর সাক্ষাতে, আহা! কতকাল দেখা হয় না।

এখনো অনেক পথ বাকি। কিন্তু হঠাৎ করে শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড বাতাস, দমকা বাতাস। শহুরে বন্ধুটা ভাবল কী আর হবে… এগিয়ে যেতে লাগল। মনে মনে ভাবছিল হয়ত বেশি আর বাকি নেই বন্ধুর তাঁবু। তাঁবুতে পৌঁছে একবারে বিশ্রাম নেওয়া যাবে। উটের তাজা দুধ খেতে খেতে বন্ধুর সাথে গল্প করতে করতেই বিশ্রাম নেওয়া হয়ে যাবে। ঘোড়াকে আরো দ্রুত চালাতে লাগল সে। কিন্তু না, শহুরে বন্ধু তো মরুঝড়ের ব্যাপার স্যাপার কিছুই জানত না। ঝড় এবার সাইমুম রূপ ধারণ করল। মরুভূমির সাদা বালির কুণ্ডলি যেন সমস্ত মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়ল। সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে এমনকি উর্ধ্ব আকাশেও বালির মেঘ কুয়াশার মতো ছেয়ে গেছে। ঝড়ের প্রচণ্ড গতিতে টিকে থাকাই দায়। এখন তো পথঘাটও দেখা যাচ্ছে না- কোথায় যাবে এখন বেচারা মরুবাসীর বন্ধু! অগত্যা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে গেল।

ঘোড়ার পেটের নীচে আশ্রয় নিল সে। ঝড়ে বয়ে আনা বালি তার চোখে মুখে অনবরত এসে পড়ছিল, ভীষণ বিরক্ত লাগছিল তার। বালিময় মরুঝড়ের সাথে তখনও সে লড়ে যাচ্ছিল।

হঠাৎ আবছা আবছা তার নজরে পড়ল কালো কালো দুর্বোধ্য কিছু। বুঝে ওঠার আগেই ওই কালো আঁধার তার সামনে এসে গেল। সেই অন্ধকার ছিন্ন ভিন্ন হয়ে তার এবং তার ঘোড়ার চারপাশ ঘিরে ধরল। বন্ধুর জন্যে আনা মূল্যবান উপহার, পাথেয়, টাকাপয়সা যা কিছুই ছিল, অন্ধকারেরা লুটপাট করে নিয়ে গেল। ওই অন্ধকার আসলে ছিল মরুডাকাতের দল। ডাকাতেরা সবকিছু তো নিলই, পথ চলার একমাত্র বাহন ঘোড়াটাকেও নিয়ে গেল। আহা বেচারা শহুরে বন্ধু! এখন কী করে তার বন্ধুর তাঁবুতে যাবে, উটের তাজা দুধ খাবে! কোনো উপায়ই ছিল না।

বেচারা সবকিছু হারিয়ে নিরুপায় হয়ে মরুঝড়ের ভেতর পায়ে হাঁটতে শুরু করল। তবে এবার আর বন্ধুর তাঁবুর উদ্দেশ্যে নয়। কেননা সে তো জানে না ওই তাঁবু কোথায় আছে আর থাকলেও যাবে কী করে। তাই সে এবার ফিরে যেতে পা বাড়াল নিজ শহরের দিকে। এ সময় নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে নিজে নিজেই বলে উঠল: ‘না উটের দুধ চেয়েছি না আরব বন্ধুর সাক্ষাৎ। কিছুই চাইনি।’ এরপর থেকে কেউ যখন তার লক্ষ্যে পৌঁছানোকে কঠিন দেখে মাঝপথ থেকে ফিরে যায়, তখনই তার সম্পর্কে বলা হয়: ‘না উটের দুধ, না আরবের সাক্ষাত’।

ভাবুক দরবেশ

রুটির চিন্তা কর, তরমুজ তো পানি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *