শাহজাদা নারঙ্গি কন্যার জন্য রাজকীয় পোশাক নিয়ে এসে দেখে অপূর্ব সুন্দরী কন্যা বিশ্রীরকম কালো হয়ে গেছে এবং তার লম্বা সুন্দর চুলগুলোও নেই। আসলে নারঙ্গি কন্যাকে মেরে প্রতিবেশীর দাসী নারঙ্গি কন্যার ভান করছিল। কন্যার রক্ত থেকে জন্ম নিয়েছে একটা কমলা গাছ। শাহজাদা বুঝে উঠতে পারছিল না। কালো দাসী বলছিল সূর্যতাপে তার রং কালো হয়ে গেছে আর ঝড়ে উড়ে গেছে লম্বা চুল। শাহজাদা এখন রাজকীয় পোশাক হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
কন্যার রক্ত থেকে জন্ম নেয়া কমলা গাছটি রাজপ্রাসাদের বাগিচায় লাগালো। শাহজাদা রাজকীয় পোশাকটা এখন এই কৃষ্ণ নারীকে দেবে কি দেবে না-ভাবছিল। মনে মনে রাগই হচ্ছিল তার। এতো কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্বাভাবিক অভিযান চালিয়ে নারঙ্গি বনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এই কৃষ্ণ সুন্দরী…! এই ছিল তার ভাগ্যে! বাবা মা তাকে কত্তো করে নিষেধ করেছিল, এখন তাঁদেরকে কী বলবে সে! নির্ঘাৎ বিদ্রূপ করবে তাকে। নারঙ্গি কন্যা জয়ী বীর এখন উপহাসের পাত্রে পরিণত হবে সবার। তবে মনে মনে সূক্ষ্ম একটা আশা হলো এই যে রোদ থেকে ছায়ায় কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো আগের মতোই নারঙ্গি কন্যার স্বরূপ ফিরে পাবে। উপায়ন্তর না দেখে তাকে নিয়েই এলো প্রাসাদে।
এদিকে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল নারঙ্গি কন্যার রক্তে সবুজ হয়ে ওঠা কমলা গাছটি বেশ বড়োসড়ো হয়ে গেছে। একটু জোরে বাতাস এলেই তার কান্নার সুর উঁচু হয়ে উঠতো। কৃষ্ণ দাসী ভাবলো এই গাছটি আবার কন্যায় রূপ নিয়ে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেয় নাকি! এই চিন্তা করে কৃষ্ণদাসী শাহজাদার দিকে তাকিয়ে বললো: একজন মিস্ত্রিকে খবর দাও! আমার জন্য একটা খাট তৈরি করতে হবে। শাহজাদা বুঝে উঠতে পারলো না কৃষ্ণদাসীর মাথায় কোন দুর্বুদ্ধি কাজ করছে। মিস্ত্রিকে ঠিকই খবর দিলো এবং দেখতে চাইলো কৃষ্ণদাসী তাকে কী ফরমায়েশ করে।
মিস্ত্রিকে দাসী বললো: শাহজাদা রুমের দরোজার পাশে যে কমলা গাছটি আছে ওই গাছটি সমূলে কেটে একটা খাট যেন বানায় তার জন্য। মিস্ত্রি গাছটা শেকড়সুদ্ধ তুলে নিয়ে চললো তার দোকানে। কিন্তু যখনই ফালি করতে যাবে তখনই গাছের ভেতর থেকে কান্নাধ্বনি উঠলো। মিস্ত্রি থ হয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে শাহজাদাকে নারঙ্গি কন্যার যন্ত্রণার শাপ দেওয়া বুড়ি এসে হাজির হলো এবং কমলা গাছের একটা শিস চেয়ে নিয়ে তা দিয়ে একটা মাকু বানালো। উদ্দেশ্য হলো তার মাকু অকেজো হয়ে গেলে এই মাকু সে ব্যবহার করবে। মাকুটা বানিয়ে বুড়ি তার ঘরের ভেতর একটা তাকে রেখে দিলো।
এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। এরিমাঝে বুড়ি একদিন বাজারে গিয়েছিল কিছু পশমি সূতা কেনার জন্য। সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বুড়ি বাজারেই ছিল। এরপর যখন সে বাসায় ফিরে এলো তার চোখ তো ছানাবড়া হয়ে গেল। এলোমেলো রেখে যাওয়া ঘর কীরকম পরিপাটি করে সাজানো। ঘরদোর, থালা-বাসন তকতকে ঝকঝকে সব। ঘর যেন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে ঝাড়ু দেওয়া হয়েছে। বিন্দুমাত্র বালিও নজরে পড়ছে না। ঘরের মেঝে এবং বারান্দায় পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা। কী আশ্চর্য ব্যাপার! বুড়ি তো আঙুল কামড়ে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। ভাবছে কে এলো তার ঘরে আর কে-ই বা এতো সুন্দর করে তার ঘর সাজালো। কার হাত পড়েছে তার ঘরে। যতই ভাবলো কিছুই আঁচ করতে পারলো না।
দুদিন পর আবারও বুড়ি গেল বাজারে। আবারও বাজার থেকে ফিরে এসে দেখে একই অবস্থা। ঘরদোর সুনসান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কিন্তু কে আসে তার ঘরে? কে সবকিছু পরিষ্কার করে রেখে যায়? বুড়ির মাথায় কিচ্ছু ধরে না। মনে মনে ভাবে কোনো পরীটরি তার অনুপস্থিতিতে এসে এ কাজ করে যায় না তো আবার? বুড়ি সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক এই রহস্যের জাল তাকে উন্মুক্ত করতেই হবে। এরপর কয়েক দিন কেটে গেল। বুড়ি একদিন তার শাল আর মাথার হ্যাট পরলো বাইরে বের হবার জন্য। ঘরের দরোজো জোর শব্দ করে আটকালো। উদ্দেশ্যটা হলো সে যে ঘরের দরোজা লাগিয়ে চলে গেছে সেটা যাতে আশেপাশে কেউ থাকলে বুঝতে পারে। দরোজা লাগানোর পর বাইরে চলে গেল বুড়ি।
বুড়ি চালাকি করে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে চাইলো কে আসে তার ঘরে। আর কে এতো সুন্দর করে তার ঘর দোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখে যায়। চোখ কান সজাগ রেখে কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর বুড়ি তার ঘরের দরোজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো। বুড়ি কৌতূহলী হয়ে উঠলো। সতর্কতার সাথে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল দরোজার কাছে। খানিক থেমে হঠাৎ করে দরোজা খুলেই ঢুকে গেল ঘরের ভেতরে। ঘরের ভেতরে গিয়েই বুড়ি তো হতবাক। মানুষ কতোটা সুন্দর হতে পারে? কল্পনার তুলিতে এঁকেও যতোটা সুন্দর মানুষের ছবি দাঁড় করানো যায় তারচেয়েও সুন্দর একটা মেয়ে বুড়ির ঘর পরিষ্কার করছে। ওই সুন্দরী কন্যার শরীর থেকে যেন বেরুচ্ছে সূর্যের কিরণ। এতো সুন্দর মানুষ হতে পারে! বুড়ির মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছিল না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল মেয়েটির অপরূপ সৌন্দর্য। এদিকে বুড়ি হতবাক। অপরদিকে মেয়েটিও বুড়িকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কী বলবে বা কী যে করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।
বুড়ি মেয়েটার এই বেহাল অবস্থা দেখে তারদিকে এগিয়ে গেল এবং মেয়ের মাহ হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো: তুমি কে মা! কেন তুমি আমার ঘরদের পরিষ্কার করছো?
মেয়েটা এবার তার জীবনের সকল ঘটনা বুড়ির কাছে খুলে বললো। সে কে, কোত্থেকে এসেছে, কীভাবে এসেছে ইত্যাদি। নারঙ্গি কন্যার কথা শেষ হবার পর তাকের ওপর রাখা সূতোর মাকুটা ফেটে গেল। বুড়ি বললো যে নারঙ্গি কন্যাকে তার খুব ভালো লেগেছে। তাকে সে তার মেয়ে বানাতে চায় এবং মেয়ের সব সমস্যা যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করে দেবে সে।
সেইদিন থেকে বুড়ি যেন এই পৃথিবীতেই নতুন জীবন ফিরে পেলো। বুড়ি তো ঘর থেকে বেরুতেই চায় না এখন। সারাদিন মেয়ের পাশেপাশে থাকে। এমনকি রাতেও চেরাগ জ্বালিয়ে মেয়ের কাছে বসে থাকে। এই গল্প সেই গল্প বলে বলে সময় কাটায়।
এদিকে শাহজাদা আর কৃষ্ণ দাসীর দিনকাল নষ্ট ঘড়ির কাঁটার মতো আটকে ছিল। শাহজাদা নারঙ্গি কন্যার চিন্তায় বিভোর। কীভাবে তাকে ফিরে পাওয়া যায় সেই পন্থা নিয়ে ভেবে ভেবেই কাটিয়ে দিচ্ছে দিনরাত। কোত্থাও যায় না সে, প্রাসাদেই থাকে। এভাবে প্রাসাদে বসে থাকতে থাকতে সময় কাটছিল না শাহজাদার। নিজের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি কেমন যেন একটা নিঃস্পৃহ ভাব এসে গেল তার মনে। বিরক্ত হয়ে উঠলো সে। তার বাবা মাও বুঝতে পারছিল না ছেলের কী হয়েছে। কোন দু:খে শাহজাদা মনমরা হয়ে আছে কে জানে। সুতরাং বাদশাহ এবং তাঁর স্ত্রী বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী করবেন, না করবেন। তারা ঠিক করলেন হেকিমকে ডেকে আনবেন ছেলের চিকিৎসার জন্য। #
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।