শাহজাদা নারঙ্গি কন্যাকে হারিয়ে মনমরা হয়ে ছিল। কোনোকিছুতেই তার মন বসছিল না। বাদশাহ এবং তাঁর স্ত্রীও বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী করবেন, না করবেন। তারা ঠিক করলেন হেকিমকে ডেকে আনবেন ছেলের চিকিৎসার জন্য এবং তাই করলেন। হেকিম এসেই শাহজাদাকে দেখেশুনে বাদশাকে গিয়ে বললো: শাহজাদার চিকিৎসার জন্য স্বচ্ছ কাঁচের একটা চেইন তৈরি করতে হবে এবং সেই চেইনটা শাহজাদার গলায় পরিয়ে দিতে হবে। চেইনটা গলায় পরিয়ে দিলেই তার সকল বিষণ্ণতা কেটে যাবে, ফ্রেশ হয়ে উঠবে শাহজাদা। বাদশা তাঁর আশপাশের মন্ত্রীদেরসহ সবাইকে ডেকে পাঠালেন। সবার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন শহর জুড়ে ঢোল পিটিয়ে এলান করে দেবেন যাতে এ কাজে পারদর্শীরা প্রাসাদে এসে যোগাযোগ করে।
বাদশার আদেশে এলানকারী দল ঢোল পিটিয়ে শহরের বাজারে রাস্তাঘাটে অলিতে গলিতে ঘোষণা করে দিল: কাঁচের স্বচ্ছ চেইন যে বানাতে পারবে সে যেন চেইন বানিয়ে প্রাসাদে নিয়ে আসে এবং শাহজাদাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। নারঙ্গি কন্যা এবং বুড়িও এই ঘোষণা শুনলো। নারঙ্গি কন্যা বুড়ির দিকে তাকিয়ে বললো: ‘তুমি গিয়ে বলো যে আমি বানাতে জানি। তবে শর্ত হলো আমাকে একটা নিরিবিলি জায়গা আর একটা পিওর আয়না দিতে হবে’।
বুড়ি প্রাসাদে গিয়ে তাই বললো। শাহজাদার রুমের পাশেই একটা খালি জায়গা ছিল। খাঁটি আয়না একটা আনা হলো এবং বুড়িকে দেওয়া হলো। বুড়ি ওই আয়না আর নারঙ্গি কন্যাকে উন্মুক্ত উঠোনে নিয়ে গেল।
অপরদিকে শাহজাদাকে খবর দেওয়া হলো যে হেকিম বলেছে, তার চিকিৎসা হলো কাঁচের চেইন বানিয়ে গলায় দেওয়া। এখন ওই চেইন উঠোনে বানানো হবে। শাহজাদা একথা শুনেই সবকিছু ফেলে রেখে দৌড়ে উঠে গেল প্রাসাদের ছাদে। ছাদের এক কোণে লুকিয়ে দেখতে চাইলো বুড়ি কী বানায় তার জন্য। কিছুক্ষণ পরই বুড়ি আর এক মেয়ে এলো উঠোনে। বুড়িকে দেখে সে চিনতে পারলো। সেইসাথে মেয়েটাকেও তার যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। মেয়ে তার সামনে আয়নাটা ধরে বিগত জীবনের ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলো। শাহজাদা মনোযোগের সাথে ওই ঘটনা শুনতে লাগলো। শুনতে শুনতে এ সময় দেখলো মেয়ে তো শাহজাদারই জীবন কাহিনী বলছে। কী করে নারঙ্গি বনে গেছে ইত্যাদি।
শাহজাদা সবকিছু ফেলে রেখে মেয়ের কথায় পরিপূর্ণ মনোযোগ দিলো। মেয়ে বলতে বলতে একসময় কৃষ্ণদাসীর গাছে ওঠা এবং তার মাথা কেটে নদীতে ফেলে দেয়ার কথা বললো। আরও বললো তার কাটা মাথা থেকে ঝরে পড়া রক্ত থেকে সবুজ কমলা গাছ জন্ম নিলো। ধূর্ত কৃষ্ণদাসী সবকিছু বুঝতে পেরে নিজেকে নারঙ্গি কন্যা বলে মিথ্যা দাবি করলো। শাহজাদা যখন ওই কমলা গাছ নিয়ে এলো নিজের প্রাসাদে কৃষ্ণদাসী তার দ্রুত বৃদ্ধি দেখে আদেশ দিলো গাছটি কেটে তার জন্য খাট বানাতে। গাছ ফার্নিচারের দোকানে নেওয়ার পর বুড়ি ওই গাছের একটা অংশ তার বাসায় নিয়ে যায় এবং সেই অংশ থেকেই তার পুনর্জন্ম হয়।
শাহজাদা ওই মেয়ের পুরো কাহিনী শুনে কী করে তাকে এখন প্রাসাদে নিয়ে যাবে সেই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়লো। দেরি সহ্য হচ্ছিল না তার। ছাদ থেকে দ্রুত নেমে এক গোলামকে বললো তার বাবা মাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে। বাদশা তার স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে এলো। ওই মেয়েকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেল তারা, এতো সুন্দরী মেয়ে তারা এর আগে আর কোনোদিন দেখে নি। শাহজাদা সবকিছু তার বাবা-মাকে খুলে বললো। নারঙ্গি কন্যা এবং তার রূপের কথা যখন প্রাসাদে পৌঁছলো, হেরেমের সকল নারী বেরিয়ে এসে ওই নারঙ্গি কন্যাকে দেখে হতবাক হয়ে গেল। এতো সুন্দর মানুষ হতে পারে! এতো রূপবতী! যে-ই দেখে সে-ই আর চোখ ফেরাতে পারে না।
এদিকে বাদশা দেখলো তাদের ছেলে অর্থাৎ শাহজাদা বেশ খুশি। তার সকল বিষণ্ণতা কেটে গেছে এবং আনন্দে সে যেন আত্মহারা। বাদশা এবং তার স্ত্রী ছেলের আনন্দ দেখে ভীষণ খুশি হয়ে গেল। সাথেসাথে আদেশ দিলো সমস্ত শহরকে যেন আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। সারা শহরজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। ঝিকিমিকি বিচিত্র রঙের আলোকসজ্জা যেন মানুষের মনেও আনন্দের রঙ মেখে দিলো। চারদিকে শুধুই আনন্দ আর আনন্দ। সাতদিন সাতরাত ধরে আনন্দ উৎসবে মজে থাকলো শহরবাসী। উৎসবের আমেজ আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল যখন সপ্তম দিনের মাথায় নারঙ্গি কন্যার সাথে শাহজাদার বিয়ের আয়োজন হলো। বিয়ের উৎসব আর আনন্দের ভরা আমেজের ভেতর শাহজাদা আরেকটি কাজ করলো।
সবকিছুর আগে শাহজাদা কৃষ্ণদাসীকে ডেকে পাঠালো। তাকে বললো: “দ্রুতগামী ঘোড়া চাও নাকি তীক্ষ্ণধার তলোয়ার”। কৃষ্ণদাসী বললো: “তীক্ষ্ণধার তলোয়ার থাক আমার জানের শত্রুর জন্য, আমি দ্রুতগামী ঘোড়াটাই চাই”। শাহজাদা আদেশ দিলো: অবিলম্বে এমন একটা দ্রুতগামী ঘোড়া নিয়ে আসো যাকে নিয়ন্ত্রণ করা দায়! শাহজাদার আদেশে দ্রুতগামী একটা ঘোড়া নিয়ে আসা হলো। কৃষ্ণদাসীর চুলের সাথে ওই ঘোড়ার লেজ বেঁধে দেওয়া হলো। তারপর ঘোড়াটাকে ছেড়ে দেওয়া হলো বিয়াবান বা জনমানবশূন্য উষর মরুতে।
অপরদিকে বৃদ্ধা মহিলাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে প্রাসাদে নিয়ে গেল। প্রাসাদে যত নারী ছিল সবাই শ্বেতকেশী বৃদ্ধাকে যথাযোগ্য সম্মান দিলো। আর শাহজাদা এবং নারঙ্গি কন্যা শুরু করলো তাদের সুখ ও শান্তিময় দাম্পত্য জীবন।#
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।