“সকাল বেলা সূর্য যখন পূর্ব দিকে প্রথম উঁকি মারে তখন কি একবারের জন্য-ও ভাবে আগের দিন অস্ত যাওয়ার আগে যাদের দেখেছিল তাদের অনেকেই আজ আর তাকে দেখল না” আগের দিন রাতেই শোয়ার সময় শ্রী বলেছিল – “দাদান আমরা কাল চলে যাব। তুমি আজকেই তসমা শাহ্-র গল্পটা শেষ করে দেবে।” গল্প শেষ করেছিলেন শেখর। ততক্ষনে নাতনি ঘুমিয়ে কাদা। সকালে উঠেই আবার বলেছিল – “পরের বার কিন্তু ওই ঠাকুমার ঝুলি পুরোটা বলবে, আগে থেকে ভাল করে পড়ে রাখবে। বলতে বলতে বলবে না দেখতে হবে।”
হেসে ফেলেছিলেন শেখর-“আসলে বুড়ো হয়েছি তো, মনে থাকতে চায় না, সে জন্য দেখতে হয়।” শেখরের ভাল লাগে নাতনি বাংলা রূপকথা শুনতে চায়। শ্রী-র হয়ত আর-ও কিছু বলার ছিল, কিন্তু জলখাবারের ডাক এসে পড়ায় আর বলা হল না। রিনি এই বাড়িতে এলে তবেই যা একটু হইচই হয়, সঙ্গে শ্রী-ও থাকে। তবে যাওয়ার দিন সবচেয়ে বেশি হইচই হয়, আর সেদিনই শ্রী সবচেয়ে বেশি শান্ত হয়ে থাকে। কারন জানে মাকে কোনো রকম বিরক্ত করা চলবে না। সেদিন রিনির প্রচুর কাজ, সমস্ত ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রাখতে হবে।
এই বাড়িতে যত জিনিস আছে, সেগুলি-র বেশিরভাগ হয় তার নয়ত মেয়ের কাজের। শেখরের কাজের বলতে বিবিধ গান শোনার যন্ত্র এবং আনুষঙ্গিক, কিছু বই আর লেখার সাজসরঞ্জাম। সামান্য কিছু পোশাক-আসাক অবশ্য আছে, যেটাকে শেখর নিজে খুব কাজের জিনিস বলে মনে করেন না। আর সেই কারনেই এই বিষয়গুলি বিশেষ করে টুনি-কে বুঝিয়ে যেতে হয়। কতবার নিজের কাছে নিয়ে রাখার কথা বলেছে, কিন্তু কে কার কথা শোনে। সম্পর্ক নাকি দূরে থাকলেই ভাল থাকে। কাজেই টুনিকেই দেখিয়ে দিতে কোথাও বাইরে যাওয়ার থাকলে শেখর কি পরবেন। শেখর ব্যাপারটিকে অবশ্য মেয়ের ছেলেমানুষি বলেই উড়িয়ে দেন। বলেন-“জানা ছিল না মানুষ জন্মাবার সময় জামাকাপড় পরে জন্মায়।” “তাহলে আর কি উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াও, ঘরেও বা দরকার কি?” গোছাতে গোছাতে জবাব দেয় রিনি
শেখর অবশ্য খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর প্রতি মেয়ের কারনে অকারনে রাগ বা অভিমান দুটোই খুব উপভোগ করেন। কাজেই এই ধরনের কথাবার্তা-র পরেই রিনি যখন বেশ উত্তেজিত ভাবে –“শোন মাথা গরম করে দেবে না তো যেটা বলছি সেটা করবে” বলেই টুনিকে ডেকে নিজে নির্দেশ দিয়ে দেয় বাবা কখন কোথায় কোন পাঞ্জাবি-পাজামা পরে যাবে, শেখর তখন চুপ করে অপরাধীর মত মুখ করে একবার জিজ্ঞেস বলেন “সব ভাল করে বুঝে নিয়েছিস তো টুনিদিদি? নাহলে এই বুড়োটার জন্যে তোর চাকরি নিয়ে আবার টানাটানি পড়বে।”
বলে “মা মা বলে আর ডাকব না, দিয়েছ দিতেছ কতই যাতনা” গান করতে করতে বেরিয়ে যান। প্রতিবার রিনি যাওয়ার দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। গানটাই যা পালটে যায়। তবে গর্ব করার মতই মেয়ে রিনি। নিজের মেয়ে বলে নয়, রিনির মত ছাত্রী তিনি কম পেয়েছেন বললেও কম বলা হয়। তাঁর নেশা সবই পেয়েছে সে। গান শোনা, করা, বইয়ের নেশা কোনটাই বাদ নেই। সঙ্গে আছে তার নাটক। বেশ কয়েকবার দেখেওছেন। খুব বেশি না বুঝলেও বেশ ভাল লেগেছে। শেখর অবশ্য নিজেকে বার কয়েক প্রশ্ন করেছেন যে ভাল লাগার কারন কি শুধু রিনি। উত্তর পাননি। রিনি বা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস-ও হয়নি। এটা তাঁর কাছে খুব লজ্জার যে শুধুমাত্র রিনি-র সৃষ্টি বলেই সেটা খুব ভাল বা বেশ ভাল বা হয়ত শুধুই ভাল। পাছে কেউ কিছু অন্য রকম ভাবে, ইউনিভার্সিটিতে যে কদিন পড়েছে রিনি, অফিসিয়াল সব ব্যাপার থেকে দূরে ছিলেন। তা সত্বেও কথা যে ওঠেনি তা নয়, নীতাকে বলেছিলেন-“দিনের শেষে আমি নিজের কাছে সৎ থাকতে চেয়েছিলাম, থেকেছি। সবাইকে তো খুশি করা যায় না।
” তবু একটা খুঁতখুঁতানি আছে শেখরের মনে। রিনি আরও পড়তে পারত। নীতা জিজ্ঞাসা করেছিলেন-“তুমি বললে না কেন?” -কি দরকার? মানুষ করে দেওয়া কর্তব্য ছিল সেটা তুমি আর আমি মিলে করেছি। এখন ওদের একটা নিজস্ব জীবন তৈরী হয়েছে, সেটা ওদের মত কাটাতে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর ও তো ওরটা করে নিয়েছে, শুনেছি ভালই তো নাটক করে -তবু একটা মেয়ে নাটক করবে… -শোন, আমার বাবারও ইচ্ছে ছিল না ছেলে আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করে। বংশে তো কেউ সেটা করেনি। মা একবার বলেছিলেন, তবে কোন চাপাচাপি করেনি কেউ। চাকরিটা পাওয়ার পর অবশ্য সবাই বিশেষ করে বাবা তো খুব খুশি হয়েছিলেন। সেই জন্যেই আর আমিও রিনিকে কিছু বলিনি। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেখলাম উৎসাহ নেই, কাজেই… -না তুমিই তো বল যে রিনি খুব ভাল ছাত্রী -সেটা তো ঠিক। তা বলে আমি ওর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করব কেন -জানি না বাপু, তোমাদের এই বাপ-মেয়ের মধ্যে এই ব্যক্তিগত সম্পর্কের গল্প, মেয়ের যেটায় ভাল হবে সেটা বাপ-মা না বললে কে বলবে শুনি, গুজুর গুজুর দেখলে তো মনে হবে দুই বন্ধু কথা বলছে, তা প্রাণের বন্ধুকে কথাটা বলতে বাধা কোথায় হেসে ফেলতেন শেখর। নীতার সারা জীবনে শেখরের সম্বন্ধে যদি একটিমাত্র কোন অভিযোগ থেকে থাকে তা হল মেয়েকে আদর দিয়ে মাথায় তোলার। তবু তিনি একবার ঝুঁকি নিয়েছিলেন রিনি-র বিয়ের আগে।
শেখরের মতামত অগ্রাহ্য করেই বলেছিলেন-“রিনি বিয়ের পর তোকে তোর ওই নাটক-ফাটক ছাড়তে হবে।” -কেন? হঠাৎ নাটক ছাড়তে হবে কেন? -না একবার ভেবে দেখ, তোর শ্বশুর-শ্বাশুরি কি ভাববেন কিন্তু না। নীতার সেই আশাতেও জল ঢেলেছিলেন, না শেখর নন, পারিজাতের বাবা-মা, প্রথম দিনের মুখোমুখি আলাপেই-“সে কি বলছেন? অরূপরতন নাটকেই তো আমরা রিনিকে প্রথম দেখলাম। শ্রেয়া আলাপ করিয়ে দিল। তখন তো আর এত জানি না, শেষ কালে দিন কয়েক বাদে অপু আমাদের বোঝাল যে সে মেয়েটিকে ভালবাসে সে সেদিনের সুদর্শনা। আমাদের দেখানোর জন্যেই নাকি তিনটে টিকিট কেটেছিল। সেটা অবশ্য আমাকে নয়, ওর মাকে বলেছে। যাকগে, রিনিমা-কে সুদর্শনা বলে ডাকলে আপনাদের আপত্তি নেই তো?” এরপর আর কোনো কথা চলে না। নীতা-ও একটু আমতা আমতা করে চুপ করে গিয়েছিলেন। এরপর একটানা প্রায় দিন সাতেক শেখরকে সহ্য করতে হয়েছিল স্ত্রী’র গজগজানি। একে তো মেয়ের প্রেমে পড়ার ঘটনা জানতে পেরেছেন তাঁর স্বামীর জানার প্রায় দু-মাস পরে তার ওপর মেয়ের হবু শ্বশুর-শ্বাশুরি-ও…। শেখর কিছু বলেননি। যেন জানতেন পুরো ব্যাপারটাই আসলে কালবৈশাখী-র ঝড়। রোজই উঠতে পারে। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। শেষ পর্যন্ত নীতাকে শান্তি দিয়েছিল রিনি-র সিঁদুর পরা চেহারা। “যাক আপনার মেয়ের মধ্যে তাহলে আপনার কিছুটা অন্তত অবশিষ্ট আছে। আমার পাল্লায় পড়ে পুরো উচ্ছন্নে যায়নি। কি বলেন নীতাদেবী?” উত্তরের প্রত্যাশা শেখর করলেও, তাঁকে বিস্মিত করে নীতা চুপ করেই ছিলেন।
(২) সুখে দুঃখে সমান নিরুদ্বিগ্ন থাকার যে কথা ধর্মগ্রন্থের পাতায় লেখা আছে, সেটা আসলে সম্ভব নয়। অন্তত সাংসারিক ক্ষেত্রে শেখরের পক্ষে অসম্ভব। নাহলে আজ শেখরের, যাঁর জীবনের প্রতি নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি সকলের কাছে ঈর্ষণীয়, তাঁর এত কথা মনে পড়ার তো কারন নেই। এমন তো নয়, রিনি বিয়ের পর এই প্রথম এল, তার বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় দশ বছর, এই সময়ে অনেক উত্থান পতন হয়েছে, কখনও শেখর এত কিছু ভাবেননি। বুঝতে পারলেন কোনো ঘটনাই এমনকি নীতার মৃত্যুও তাঁকে এত বিচলিত করেনি যতটা আজকের রিনি করেছে। গত প্রায় চার মাস ধরে রিনি আর শ্রী-কে না দেখলেও শেখর দেখার তাগিদও অনুভব করেননি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার পরামর্শ উপেক্ষা করে না নিজে গেছেন রিনি-র কাছে, না তাকে আসতে দিয়েছেন। জীবনে খুব সম্ভবত প্রথম বার রিনি-র সাথে তিনি অভিনয় করে চলেছিলেন। বার বার বলেছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রিনি-র কাছে যাবেন অতএব সমস্ত কাজকর্ম ফেলে রিনি-র এখন আসার দরকার নেই বা কখনও অন্য কোন অজুহাত। নিজেকে ঢেকে রাখতে বাইরের কাজের পরিমান-ও বাড়িয়ে তুলে ছিলেন। তবু বোধহয় রিনি বুঝেছিল আসল ব্যাপারটা। কাজেই সে যখন ফোন করে বেশ জোরের সঙ্গে জানায় যে সে আসছে, মন থেকে না চাইলেও আর বারন করতে পারেননি। নানাবিধ ব্যর্থ অজুহাতের পর শেখরেরও মনে হয়েছিল তিনি কে তাকে বাধা দেওয়ার? শুধুমাত্র আজকের রিনিকে তিনি দেখতে চান না বলেই সে তার বাবার কাছ থেকে দূরে থাকবে সেটাও হয় না। যা অনিবার্য, যা ঘটবেই, শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা, প্রায়শ মিথ্যে দিয়ে তাকে আটকানোর চেষ্টা-ও অর্থহীন মনে হল শেখরের কাছে। ফলতঃ রিনি এবার বহুদিন বাদেই এল।
থাকল সাত দিন। শ্রী-র স্কুল খুলে না গেলে হয়ত আর কিছুদিন থাকত। শেখর লক্ষ্য করলেন রিনি অনেক পালটে গেছে। কাজের মধ্যে একটা অদ্ভুত গিন্নিপনা। সেই হই হল্লা নেই এবং অনেক বেশি পরিপাটি। শেষদিনটা অন্যান্য বারের মতই হল। মেয়ের আর নিজের ব্যবহার্য জিনিস গুছিয়ে রাখা, টুনিকে বোঝান, সব আগের মতই। শুধুমাত্র শেখর সুযোগ পেলেন না মেয়ের সাথে খুনসুটি করার কিংবা মেয়েকে রাগিয়ে দেওয়ার। একবার মনে হল বলেন শেখর রাজি আছেন রিনি-র কাছে গিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে, কিন্তু সেটা যদি রিনি তার প্রতি বাবার করুণা হিসেবে দেখে। বলতে গিয়েও নাতনির মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন-“পরশু থেকে স্কুল খুলে যাচ্ছে তো, মন দিয়ে পড়াশোনা করো, মা-বাবার স্বপ্ন সফল করতে হবে, মনে রেখো। আমি হয়ত থাকব না, তবু ঠিক দেখতে পাব।” শ্রী পাছে আর কিছু জানতে চায়, সেইজন্যে শেখর দ্রুত সরে গেলেন। রিনি ট্যাক্সি ডাকতে বেরিয়ে গেল। নীতা-র ছবিটার সামনে চুপ করে বসেছিলেন শেখর। চমক ভাঙল রিনি-র ডাকে। -বাবা -কিছু বলবি মা -এইটা -কি -তুমি চেয়েছিলে -ওঃ শেখর কাগজের মোড়ক-টা খুললেন। দুটি ছবি। বাগানে একরাশ চন্দ্রমল্লিকার সামনে পারিজাত।
শেখরের তোলা। আরেকটা পরিবারের সবাইকে নিয়ে স্টুডিওতে তোলা গ্রুপ ছবি। -বাবা এলাম। সাবধানে থেকো কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন শেখর। “কিছু বলবে?” রিনি জিজ্ঞাসা করল। “না, সাবধানে থাকবে। মেয়েটা বড় হচ্ছে। যা শুনি দিন কাল তো আসলে খুব খারাপ হয়ে গেছে। চিন্তা হয়। ধানবাদ পৌঁছে একটা ফোন করো।” -চিন্তা করো না। সব ঠিক আছে। কিছুই বদলায়নি -সব ঠিক আছে ? বলছ কিছু বদলায়নি অস্ফুটে একবার জিজ্ঞাসা করলেন। “ভাল, না বদলালেই ভাল” রিনি শ্রী-কে নিয়ে গাড়িতে উঠল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শেখর হাত নাড়তে থাকেন। আস্তে আস্তে গলির মোড়ে ট্যাক্সিটা অদৃশ্য হয়ে যায়। ঘরে আসেন শেখর। শীতের বেলা তাড়াতাড়ি পড়ে আসে।
টুনি রান্নাঘরে তার কাজে ব্যস্ত। রোজকার অভ্যেস মত ডায়েরি বের করেন শেখর – নীতা আমি তোমাকে ঈর্ষা করি। তোমাকে আজকের দিনটা দেখতে হয়নি। তুমি যে কথায় কথায় তোমার মন্দ ভাগ্যের কথা বলতে, সেটা আসলে সম্পূর্ন ভুল। তুমি আসলে অনেক বেশি ভাগ্যবতী। তোমাকে দীর্ঘজীবনের অভিশাপ অন্তত বইতে হয়নি।