নবী মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর মোজেযাসমূহ

কুরআনকেই নবুয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে

“হে নবী! তুমি তাদের সামনে কোনো নিদর্শন (মোজেযা)পেশ না করলে তারা বলেঃ তুমি নিজের জন্যে একটা নিদর্শন বেছে নিলে না কেন? তুমি তাদেরকে বলঃ আমি তো শুধু সেই অহীর অনুসরণ করি যা আমার রব আমার কাছে পাঠান। এ হলো তোমাদের রবের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞার আলো, হেদায়াত ও রহমত তাদের জন্যে যারা একে গ্রহণ করে”।–(সূরা আল আরাফঃ ২০৩)

কাফেরদের এ প্রশ্ন ছিল স্পটত বিদ্রূপাত্মক। অর্থাৎ তাদের কথার অর্থ ছিল এইঃ ‘তুমি বাপু যেমন নবী হয়ে পড়েছ তেমনি নিজের জন্যে কখনো মোজেযাও বাছাই করে নিয়ে এলে পারতে’। কিন্তু এ বিদ্রূপের কেমন মনোজ্ঞ জবাব দেয়া হয়েছে, তা লক্ষণীয়।

এ জবাবের মর্ম হলোঃ তোমরা দাবী করলেই বা আমি নিজে প্রয়োজন বোধ করলেই একটা কিছু আবিস্কার করে অথবা বানিয়ে দেব এমন ক্ষমতা আমার নেই। আমি একজন রসূল মাত্র। আমার দায়িত্ব শুধু এই যে, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর নির্দেশ মত কাজ করব। আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন তিনি আমাকে মোজেযার পরিবর্তে কুরআন দিয়েছেন। এ দূরদৃষ্টিকারী আলোকে পরিপূর্ণ। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, একে যারা মেনে নেয় তারা জীবনের সঠিক সরল পথের সন্ধান পায় এবং তাদের সুন্দর চরিত্রে আল্লাহর রহমদের চিহ্ন পরিস্ফুট হয়।

নবী মুহাম্মদ (সা) আপন উদ্যোগে মোজেযা দেখাতে সক্ষম ছিলেন না

“তথাপি (হে নবী) যদি তাদের উপেক্ষা তুমি সহ্য করতে না পার তাহলে ক্ষমতা থাকরে মাটির তলায় কোন সূড়ঙ্গ খুঁজে বের কর অথবা আকাশে একটা সিঁড়ি লাগাও এবং তাদের জন্যে একটা নিদর্শন নিয়ে আসার চেষ্টা কর”।–(সূরা আল আনআমঃ ৩৫)

নবী (সা) যখন দেখলেন যে, জাতিকে বুঝাতে বুঝাতে দীর্ঘ দিন কেটে গেল, তবু তারা পথে এলো না, তখন সময় সশয় তার মনে এ আকাঙ্খা জাগতঃ “আহা যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কোনো নিদর্শন প্রকাশ পেত যার দ্বারা তাদের কুফরী ঘুচে যেতো এবং তারা আমার নবুয়াতের সত্যতা মেনে নিত”। এ আয়াতে নবীর এ আকাঙ্খারই জবাব দেয়া হয়েছে। তার মর্ম এইঃ অধৈর্য হয়ো না। যে নিয়মে এবং যে ধারা প্রক্রিয়ায় আমি এ কাজ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, ধৈর্য্যের সাথে তার অনুসরণ কর। মোজেযা দিয়েই যদি কাজ নিতে হতো তাহলে তা কি আমি নিজে নিতে পারতাম না? কিন্তু আমি জানি যে, মানসিক ও নৈতিক বিপ্লব এবং যে নিষ্কলুষ তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে তোমাকে নিয়োজিত করা হয়েছে সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছাবার সঠিক পথ এটা নয়। তথাপি মানুষের বর্তমান স্থবিরতা এবং তাদের কঠোর অস্বীকার-অবিশ্বাস যদি তোমার সহ্য না হয়, আর তুমি যদি মনে কর যে, এ স্থবিরতা দূর করার জন্যে কোনো স্থূল ও ইন্দ্রিয় গাহ্য নিদর্শন দেখানেই দরকার তাহলে নিজেই উদ্যোগ নাও এবং ক্ষমতা থাকলে যমীনের মধ্যে প্রবেশ করে অথবা আকাশে উঠে এমন কোনো মোজেযা নিয়ে আসার চেষ্টা কর যা অবিশ্বাসকে বিশ্বাসে পরিণত করার জন্যে তুমি যথেষ্ট মনে কর। তবে তুমি এ আশা কর না যে, আমি তোমার এ আকাঙ্খা পূরণ করব। কেননা আমার পরিকল্পনায় এ ধরনের কোনো চেষ্টা-তদবিরের স্থান নেই।

নবী মুহাম্মদ (সা)-এর সবচেয়ে বড় মোজেযা কুরআন

“তারা বলে যে, মুহাম্মদ তাঁর প্রতিপারকের কাছ থেকে একটু নিদর্শন (মোজেযা) নিয়ে আসে না কেন? তাদের কাছে কি পূর্বতন গ্রন্থসমূহের সকল শিক্ষা সুস্পষ্ট হয়ে আসেনি”।–(সূরা ত্বাহাঃ ১৩৩)

অর্থাৎ এটা কি একটা ছোট-খাট মোজেযা যে, তাদেরই একজন নিরক্ষর লোক এমন একখানা কিতাব পেশ করেছেন যাতে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত আসমানী কিতাবের বিষয়বস্তু ও শিক্ষার নির্যাস সন্নিবেশিত রয়েছে? মানুষকে সৎপথে চালিত করার জন্যে ওসব কিতাবে যা কিছু ছিল তা যে এ কিতাবে শুধু সন্নিবেশিত হয়েছে, তা-ই নয়, বরং তা এত সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় বিবৃত হয়েছে যে, একজন মরুচারী বেদুঈনও তা বুঝতে পারে ও তা দ্বারা উপকৃত হতে পারে।

“(হে নবী!) তুমি ইতিপূর্বে না কোনো বই পড়তে আর না আপন হাত দিয়ে লিখতে পড়তে লিখতে পাররে বাতিলপন্থী লোক সন্দেহে পড়তো। আসলে যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের মনে এ উজ্জ্বল নিদর্শনগুলো রয়েছে। যালেমরা ছাড়া আর কেউ আমার নিদর্শন অবিশ্বাস করে না। তারা বলেঃ এ লোকটার ওপর তার প্রভুর পক্ষ থেকে নিদর্শনসমূহ (মোজেযা) অবতীর্ণ করা হয়নি কেন? তুমি বল! নিদর্শনসমূহ আল্লাহর কাছেই রয়েছে। আমি শুধু পরিস্কার ভাসায় সাবধানকারী। তাদের জন্যে এ নিদর্শন কি যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার ওপর কিতাব নাযিল করেছি যা পড়ে পড়ে তাদেরকে শোনানো হচ্ছে? বস্তুত আসলে এতে রয়েছে করুণা ও উপদেশ তাদের জন্যে যারা ঈমান আনে”।–(সূরা আল আনকাবুতঃ ৪৮-৫১)

এ আয়াতগুলোতে যে যুক্তির অবতারণা করা হয়েচে তার মূল কথা এই যে, হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন নিরক্ষর। তাঁর প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও গোত্রীয় লোকজন তাঁকে জন্ম থেকে যৌবন পর্যণ্ত দেখেছে এবং তারা এ কথা ভাল করেই জানত যে, তিনি সারা জীবনে না কোনো বই পড়েছেন আর না কখনো কলম হাতে নিয়েছেন। এ বাস্তব অবস্থার উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, এ নিরক্ষর মানুষটির মুখ দিয়ে পূর্বতন আসমানী গ্রন্থসমূহের শিক্ষা, পূর্বতন নবীদের জীবন বৃত্তান্ত, সাবেক ধর্মসমূহের আকীদা ও বিশ্বাস, আদিম জাতিসমূহের ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও চারিত্রিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের ওপর যে ব্যাপক ও গভীর তত্ত্বজ্ঞানের অভিব্যক্তি ঘটচে তা তিনি অহী ছাড়া আর কোনো পুস্তক পড়তে ও জ্ঞান-গবেষণা করতে দেখতো তাহলে হয়তো অবিশ্বাসীদের সন্দেহের কিছুটা অবকাশ থাকত। তাঁরা ভাবতে পারতো যে, তাঁর এ জ্ঞানসম্ভার অহীর পরিবর্তে নিজস্ব চেষ্টা-সাধনা দ্বারা অর্জিত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর নিরক্ষরতা লেশমাত্র সন্দেহের অবকাশ রাখেনি। এরপর নিরেট হঠকারিতা ছাড়া নবুয়াতের অস্বীকার করার পেছনে আর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

উম্মী হওয়া সত্ত্বেও কুরআনের মত গ্রন্থ নবী মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর নাযিল হওয়াটাই এত বড় মোজেযা যে, তাঁর রসূল হওয়ার ওপর বিশ্বাসস্থাপন করার জন্যে তা যথেষ্ট। এরপর আর কোনো মোজেযা যারা তা দেখেছিল। কিন্তু কুরআন এমন কালজয়ী ও চিরন্তন মোজেযা, যা সবসময় মানুষের সামনে রয়েছে, তাদের কাছে পড়ে শুনানো হয় এবং সবসময় তারা তা দেখতেও পারে।

নবী মুহাম্মদ (সা)-কে বস্তুগত মোজেযার পরিবর্তে জ্ঞানগত মোজেযা দেয়ার কারণ

“এমন কোনো কুরআন যদি নাযিল করা হতো যার জোরে পাহাড় চলতে আরম্ভ করে দিন, পৃথিবী বিদীর্ণ হয়ে যেত অথবা মৃত ব্যক্তি কবর থেকে বেরিয়ে কথা বলা শুরু করে দিত, তাহলেই বা কি লাভ হত?”-(সূরা আর রা’আদঃ ৩১)

এ আয়াত বুঝবার জন্যে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এতে কাফেরদের সাথে নয় মুসলমানদের সাতে কথা বলা হয়েছে। মুসলমানরা কাফেরদের পক্ষ থেকে বারংবার মোজেযার দাবী শুনে অস্থির হয়ে উঠতেন এবং মনে মনে বলতেন, ওদের বিশ্বাস জন্মানোর মতো কিছু মোজেযা দেখিয়ে দেয়া হলে কতই না ভাল হতো। এ ধরনের কোনো নিদর্শন না আসার কারণে কাফেরগণ সাধারণ মানুষের মনে নবীর নবুয়াত সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে এটা যখন তাঁরা অনুভব করতেন তখন তাঁদের অস্থিরতা ও উদ্বেগ আরো বেড়ে যেত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের বলা হচ্ছে যে, কুরআনের কোনো সূরার সাথে সাথে হঠাৎ করে এ জাতীয় কোনো নিদর্শনও যদি দেখান হতো, তাহরে কি সত্যিই তারা ঈমান আনত বলে তোমরা মনে কর? তোমরা কি তাদের সম্পর্কে এতই আশাবাদী যে, তারা সত্যদ্বীন গ্রহণ করার জন্যে একেবারে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে শুধু একটা প্রকাশই বাকী রয়েছেঃ কুরআনের শিক্ষায় বিশ্ব প্রকৃতির নিদর্শনাবলীতে নবীর নিষ্কলুষ জীবনে এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনের বিপ্লবী পরিবর্তনে যারা সত্যের আলোর দর্শন পেল না, তোমরা কি ভেবেছ যে তারা পাহাড় চালিত হওয়া, পৃথিবী বিদীর্ণ হওয়া এবং মৃত ব্যক্তিদের কবর থেকে বেরিয়ে আসার মধ্যে কোনো আলোকরশ্মির সন্ধান পাবে।–[এ আলোচনার অর্থ এ নয় যে, নবী মুহাম্মদ (সা)-এর পক্ষ থেকে কোনো মোজেযা প্রকাশ পায়নি। সময়ে সময়ে অনেক মোজেযাই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এগুলো বিরোধীদের ঈমান আনার জন্যে নবুয়াতের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি।–(সংকলকবৃন্দ)]

“আমি ইচ্ছা করলে আসমান থেকে এমন নিদর্শন নামিয়ে দিতে পারি যার সামনে তাদের মাথা নুয়ে পড়বে”।–(সূরা শুয়ারাঃ ৪)

অর্থাৎ সকল কাফেরকে ঈমান আনতে ও আল্লাহর আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য করে এমন কোনো নিদর্শন নাযিল করে দেয়া আল্লাহর পক্ষে মোটেই কঠিন কাজ নয়। তিনি যে এমন করছেন না তার কারণ এ নয় যে, এ কাজ তাঁর ক্ষমতার বহির্ভূত। আসলে লোকদের এ ধরনের বাধ্যতামূলক ঈমান তাঁর বাঞ্ছিত নয়। তিনি চান লোকেরা নিজ নিজ জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে আল্লাহর কিতাবে, বিশ্বপ্রকৃতির সর্বত্র এবং স্বয়ং তাদের মধ্যে যেসব নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে তার সাহায্যে সত্যকে উপলব্ধি করুক। তারপর যখন তাদের মন সাক্ষ্য দেবে যে, নবীগণ যা বলেছেন আসলে সেটাই সত্য আর তার বিপরীত যতসব আকীদা-বিশ্বাস ও রীতি-পদ্ধতি চালু রয়েছে তা সবই বাতিল ও অসত্য, তখণ তারা জেনে-বুঝে বাতিলকে ত্যাগ করে সত্যকে অনুসরণ করাই এমন কাজ যা আল্লাহ তায়ালা মানুষের কাছে দাবী করেন। এ কারণেই তিনি মানুষকে ইচ্ছা ও এখতিয়ারের স্বাধীনতা দান করেছেন। এ কারণেই তিনি মানুষকে এ স্বাধীনতা দিয়েছেন যে, সে ইচ্ছা করলে সঠিক অথবা ভ্রান্ত যে কোনো একটা পথ গ্রহণ করতে পারে। এ কারণেই তিনি মানুষের মধ্যে ভাল ও মন্দ এ উভয় প্রবণতাই দান করেছেন। পাপ ও পুণ্য উভয়ের পথই তার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। শয়তানকে ধোঁকা দেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সঠিক পথ-প্রদর্শনের জন্যে নবুয়াত, অহী এবং মঙ্গলের দিকে দাওয়াতের ধারাবাহিকতা কায়েম করেছেন। মানুষকে মত ও পথ বেছে নেয়ার যাবতীয় সময়োপযোগী যোগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়ে পরীক্ষা ক্ষেত্রে দাঁড় করিয়েছেন এটা দেখার জন্যে যে, সে কুফরী ও অবাধ্যতার পথ অবলম্বন করে, না ঈমান ও আনুগত্যের পথ। মানুষকে ঈমান ও আনুগত্যে বাধ্য করে এমন কোনো ব্যবস্থা যদি আল্লাহ গ্রহণ করতেন তাহলে এ পরীক্ষার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যেত। ঈমান আনতে মানুষকে বাধ্য করাই যদি তাঁর ইচ্ছা হত তাহলে মোজেযা দেখিয়ে বাধ্য করার কি দরকার ছিল? আল্লাহ মানুষকে এমন স্বভাব-প্রকৃতি ও এমন গঠন দিয়ে সৃষ্টি করতে পারতেন যে, কুফরী, নাফরমানী ও পাপাচারের কোনো ক্ষমতাই তার থাকত না। ফেরেমতাদের মত মানুষও ফরমাবরদার ও অনুগত হয়েই জন্ম নিত। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এ সত্যটাই তুলে ধরেছেন। যেমনঃ

“তোমাদের প্রভু যদি চাইতেন তাহলে দুনিয়ার সমস্ত অধিবাসী মুমিন হয়ে যেত। তুমি কি এখন মানুষকে ঈমান আনতে বাধ্য করতে চাও?”-(সূরা ইউনুসঃ ৯৯)

“তোমার প্রভু যদি চাইতেন তাহলে সকল মানুষকেই একই উম্মতভুক্ত করে দিতে পারতেন। তারা তো বিভিন্ন পথেই চলতে থাকবে। (বিভ্রান্তি থেকে) বেঁচে যাবে শুধু তাঁরাই যাদের ওপর তোমার প্রভুর অনুগ্রহ রয়েছে। তাদেরকে তিনি এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন”।

“তারা কি কখনও পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখেনি যে, কত বেশী পরিমাণে সব রকমের উৎকৃষ্ট উদ্ভিদ সেখানে পয়দা করেছি?”-(সূরা আশ শুয়ারাঃ ৭-৮)

অর্থাৎ সত্যকে খুঁজে পেতে কারো যদি নিদর্শনের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকে বেশী দূরে যেতে হবে না। এ দুনিয়ার রূপ-বৈচিত্র্যকে একটু চোখ মেলে দেখে নিলেই সে বুঝতে পারবে বিশ্ব-প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যে তত্ত্ব (আল্লাহর একত্ব) নবীগণ পেশ করেছেন সেটাই সত্য, না সত্য সেসব মতবাদ যা মুশরিক ও নাস্তিকরা প্রচার করছে। পৃথিবীতে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজির এত অধিক ও বিচিত্র সমাবেশ, এগুলোর গুণাগুণে ও অসংখ্য সৃষ্টির অসংখ্য চাহিদায় যে সুস্পষ্ট মিল ও সামঞ্জস্য বিদ্যমান তা দেখে একজন নির্বোধই এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, কোনো নিপুণ কুশলীর তীক্ষ্ণ কর্মকুশলতা, কোনো মহাজ্ঞানীর প্রজ্ঞা, কোনো মহাশক্তিদরের অজেয় শক্তি এবং কোনো দক্ষ স্রষ্টার সুচিন্তিত সৃষ্টি পরিকল্পনা ছাড়াই এসব আপনা আপনিই হচ্ছে। অথবা এ সমস্ত পরিকল্পনা রচনা ও বাস্তবায়নকারী কোনো এক খোদা নয় বরং বহুসংখ্যক খোদার ব্যবস্থাপনায় পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, বাতাস ও পানির মধ্যে এমন সুষ্ঠু সমন্বয় স্থাপিত হতে পেরেছে এবং এসব উপকরণে তৈরী উদ্ভিদরাজি ও সীমা সংখ্যাহীন রকমারি জীব-জানোয়ারের চাহিদা ও  প্রয়োজনের মধ্যে এমন সামঞ্জস্য গড়ে তুলেছে। একজন বিবেকবান মানুষ হঠকারিতা ও আগে থেকে কোনো বদ্ধমূল ধারণায় যদি লিপ্ত না হয়, তাহলে এ দৃশ্য অবলম্বন করে স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠবে যে, এগুলো নিশ্চয়ই খোদার অস্তিত্ব এবং একই খোদার অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ। এসব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আর কোনো মোজেযার প্রয়োজন থাকতে পারে কি, যা না দেখলে তাওহীদের সত্যতার প্রতি মানুষ বিশ্বাসী হতে পারে না?

এটা বড় রকমের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মোজেযা

[গ্রন্থের ‘এ’ অংশটি আমাদের কাঠামো মাফিক মোজেযার দর্শন তত্ত্ব নীতিগত আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট, এতে ঘটনাবলীর দিক দিয়ে নবী করীম (সা)-এর মোজেযাসমূহ সন্নিবেশিত করা হয়নি, বরং তা গ্রন্থের ঘটনাবলীর আলোচনায় স্ব-স্ব স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। এখানে শুধু চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করার বিরাট মোজেযাটিকে উদাহরণস্বরূপ আলোচনায় শামিল করা হয়েছে।

“কেয়ামতের মুহুর্ত ঘনিয়ে এসেছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে। তাদের স্বভাব এমনই যে, যে নিদর্শনই তারা দেখুক না কেন মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে এটা চিরাচরিত জাদু। তারা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে আর প্রত্যেক ব্যাপারকে শেষ পর্যন্ত একটি পরিণতিতে অবশ্যই পৌঁছতে হবে”।–(সূরা আল কামারঃ ১-৩)

চাঁদ বিদীর্ণ হওয়া সংক্রান্ত বর্ণনাবলী

চাঁদ বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা কুরআনের অকাট্য বর্ণনা থেকে প্রমাণিত। হাদীসের বর্ণনাসমূহের ওপর এটা র্নিভরশীল নয়। তবে হাদীসের বর্ণনা থেকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরন জানা যায় এবং এটা কবে ও কিভাবে ঘটেছিল তার সন্ধান মেলে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আহমদ, আবু উয়ানা, আবু দাউদ তায়ালেসী, আবদুর রাজ্জাক, ইবনে জারীর, বায়হাকী, তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া ও আবু নঈম ইসফাহানী বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে হযরত আলী, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর, হযরত হোযায়ফা, হযরত আনাস ইবনে মালেক ও হযরত যুবাইর ইবনে মোতয়েম থেকে ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে তিনজন মনীষী এ ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হতে পারেননি। কেননা তাঁদের একজন (হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস) জন্মের আগে এ ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয়জন (হযরত আনাস ইবনে মালেক) এ ঘটনার সময় শিশু ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তাঁরা উভয়ে সাহাবী, তাই এ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী বয়স্ক সাহাবীদের নিকট থেকে শুনেই যে তাঁরা বর্ণনা করে থাকবেন সেটা নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া যায়।

বর্ণনাসমূহের সারসংক্ষেপ

এ বর্ণনাগুলোর সবক’টি একত্র করলে যে মর্ম অনুধাবন করা যায় তা নিম্নরূপঃ হিজরতের প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনা। চান্দ্রমাসের চতুর্দশীর রাত। চাঁদ সবেমাত্র উঠেছে। হঠাৎ চাঁদ দু’টুকরো হযে গেল। তার এক টুকরো সামনের পর্বতের একপাশে এবং অপর টুকরো অপর পার্শ্বে দেখা গেল। এক মুহুর্ত এ অবস্থায় থাকার পর আবার উভয় টুকরো একত্র হলো। নবী মুহাম্মদ (সা) তখন মিনায় অবস্থান করছিলেন। তিনি উপস্থিত লোকদের বললেন, ব্যাপারটা তোমরা দেখে নাও এবং সাক্ষী থাক। কাফেররা বলল, মুহাম্মদ আমাদের জাদু করেছে। সে জন্যে আমাদের দৃষ্টি প্রতারিত হয়েছে। যাদু করতে পারেন না। বাইরের লোক আসুক। তাদেরকে জিজ্ঞেস করব ঘটনাটা তারাও দেখেছে কিনা। বাইরে থেকে যখন কিছু লোক এলো তখন তারাও জানাল যে, তারাও এ দৃশ্য দেখেছে।

হযরত আনাস কোনো কোনো বর্ণনা থেকে এ ভ্রান্ত ধারণা জন্মে যে, চাঁদ দু’টুকরো হওয়ার ঘটনা দু’বার ঘটেছিল। কিন্তু প্রথমতঃ অন্য কোনো সাহাবী এ কথা বলেননি, দ্বিতীয়তঃ খোদ হযরত আনাসেরই কোনো কোনো বর্ণনায় ‘মাররাতাইন’ (দু’বার) এবং কোনো কোনো বর্ণনায় ‘ফিরকাতাইন’ ও ‘শিরকাতাইন’ শব্দ দুটি রয়েছে। এর অর্থ হল দু’টুকরো। তৃতীয়তঃ পবিত্র কুরআনে শুধু একবার চাঁদ দু’টুকরো হওয়ার উল্লেখ রয়েছে। কাজেই ঘটনাটা একবার ঘটেছে এ কথাই ঠিক। অবশ্য রসূলুল্লাহ (সা) চাঁদকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা মাত্র দু’টুকরো হওয়া এবং চাঁদের এক টুকরো তাঁর জামার ভেতর ঢুকে আস্তিন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত কিংবদন্তীগুলা একেবারেই ভিত্তিহীন।

ঘটনাটির আসল ধরন

এখানে প্রশ্ন উঠে যে, এ ঘটনাটা আসলে কি ধরনের ছিল। কি কাফেরদের দাবীর প্রেক্ষিতে নবী মুহাম্মদ (সা)-এর নবুয়্যাতের সত্যতা প্রমাণের জন্যে একটা মোজেযা ছিল? না এটা আল্লাহর ইচ্ছায় চাঁদের বুকে সংঘটিত নিছক একটা দুর্ঘটনা মাত্র? আর নবী মুহাম্মদ (সা) কি একে কেয়ামতের সম্ভাব্যতা ও আসন্নতার নিদর্শন মনে করে লোকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন? মুসলিম মনীষীগণের একটি দল একে নবীর একটি অন্যতন মোজেযা বলে গণ্য করেন। তাঁদের ধারণা কাফেরদের দাবীর জবাবেই এ মোজেযা দেখান হয়েছিল। কিন্তু এ অভিমতের ভিত্তি হল হযরত আনাস থেকে বর্ণিত কতিপয় হাদীস। তিনি ছাড়া আর কোনো সাহাবী এ বক্তব্য পেশ করেননি। ফাতহুল বারীতে ইবনে হাজার বলেন, “চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা যতগুলো সূত্রের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে তার মধ্যে একমাত্র হযরত আনাসের হাদীস ছাড়া আর কোন হাদীসে আমি এ কথা পাইনি যে, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনাটা মুশরিকদের দাবী অনুসারেই ঘটেছে”। (চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়া সংক্রান্ত অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। অবশ্য আবু নঈম ইসফাহানী ‘দালাইলুন্নবুয়াত’ নামক গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত এক হাদীসে ঠিক এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তবে তার সূত্র খুবই দুর্বল। বিশ্বস্ত সূত্রে ইবনে আব্বাস থেকে যতগুলো বর্ণনা হাদীস গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে তার কোনোটাতেই এ বক্তব্য আসেনি। তাছাড়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও হযতর আনাস উভয়েই এ ঘটনার সময় অনুপস্থিত ছিলেন। সে সময়ে যেসব সাহাবী উপস্থিত ছিরেন যথা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত হুযায়ফা, হযরত যোবাইর ইবনে মোতয়েম, হযরত আলী ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর এদের কেউই বলেননি যে, মক্কার মুশরিকরা নবী মুহাম্মদের নবুয়াতের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে একটা কিছু নিদর্শন দেখানো আবদার ধরেছিল এবং সে জন্যেই তাদেরকে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মোজেযা দেখান হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, পবিত্র কুরআন নিজেও এ ঘটনাকে রেসালাতে মুহাম্মদীর নিদর্শন নয়, বরং কেয়ামত আসন্ন হওয়ার নিদর্শণ বলে অভিহিত করেছে। অবশ্য নবী (সা) কেয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার যে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন এ ঘটনা তার সত্যতা প্রমাণ করেছিল সে হিসেবে এ ঘটনা যে নবী মুহাম্মদ (সা)-এর নবুয়াতের সত্যতারও একটা জ্বলন্ত নিদর্শন তাতে সন্দেহ নেই।

কিছু প্রতিবাদ ও তার জবাব

এ মোজেযা নিয়ে দু’ধরনের প্রতিবাদ করা হয়েছে। প্রথমত চাঁদের মত অত বড় একটা উপগ্রহের বিদীর্ণ হয়ে দু’টুকরো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং একটি অপরটি থেকে শত শত মাইর দূরে চলে যাওয়ার পর পুনরায় একত্র হওয়া তাদের মতে কিছুতেই সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ঃ এমন ঘটনা যদি ঘটে থাকত তাহলে এ ঘটনা সারা দুনিয়ায় প্রদিদ্ধি লাভ করত, ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে তার উল্লেখ থাকত এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রের বই পুস্তকে এর বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু এ দু’টো প্রতিবাদই মূলত ভিত্তিহীন। এর সম্ভাব্যথা নিয়ে যে বিতর্ক সেটা প্রাচীন যুগে চলতে পারত কিন্তু এ যুগে গ্রহ-উপগ্রহের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষ যেসব তথ্য জানতে পেরেছে তার ভিত্তিতে এটা সম্ভব যে একটি গ্রহের ভেতরে যে আগ্নেয়গিরি রয়েছে তার আগুন উদগীরণের ফলে সেটা ফেটে যাওয়া এবং প্রচণ্ড বিস্ঠোরণে তার এক এক টুকরো এক এক দিকে ছিটকে বহুদূর পর্যন্ত চলে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তারপর কেন্দ্রেরচুম্বক শক্তির দরুন টুকরোগুলো আবার পরস্পরের সাথে মিলিত হওয়াও অসম্ভব নয়। এরপর দ্বিতীয় আপত্তিটার কথঅ ধরা যাক। এটাও এ জন্যে গুরুত্বহীন যে, এ ঘটনা আকস্মিকভাবে এক মুহুর্তের জন্যে ঘটেছিল। সে বিশেষ মুহুর্তটায় সারা দুনিয়ার মানুষ চাঁদের দিকেই চেয়ে থাকবে এমন কোনো কথা ছিল না। ঘটনাটার সাথে কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি যে লোকের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হবে। আগে থেকে কোনো বিজ্ঞপ্তিও ছিল না যে, লোক তার প্রতীক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তাছাড়া সারা দুনিয়ায় তা দেখাও সম্ভবপর ছিল না। শুধুমাত্র আরব ও তার পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুরোতেই তখন চাঁদ উঠেছিল। আর ইতিহাস লেখার আগ্রহ ও কলাকৌশল তখনও এতটা উৎকর্ষ লাভ করেনি যে, প্রাচ্য দেশে যারা সে ঘটনা দেখেছে তারা তা লিপিবদ্ধ করে ফেলবে এবং এসব সাক্ষ্য প্রমাণ কোনো ঐতিহাসিকের হস্তগত হলে সে তা ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ কবে। তথাপি মালাবারের ইতিহাসে এ কথার উল্লেখ পাওয়া যায় যে, সেই রাতে সেখানকার এক রাজা এ দৃশ্য দেখেছিল। জ্যোতিষ শাস্ত্রের বইতে এবং পঞ্জিকায় এর উল্লেখ পাওয়া যায় না কেন, সে প্রশ্নের জবাবে বলা যায় যে, এর প্রয়োজন শুধু তখনই হত যদি চাঁদের গতিতে তার কক্ষপথে এবং উদয়াস্তের সময়ে যদি কোনো তারতম্য দেখা দিত। সেটা হয়নি বলেই প্রাচীন যুগের জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদদের দৃষ্টি সেদৃকি আকৃস্ট হয়নি। সে যুগে মহাশূন্য পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলোও এতটা উন্নতি লাভ করেনি যে মহাশূন্যে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার প্রতি তারা লক্ষ্য রাখবে এবং সেগুলোকে প্রমাণচিত্রে সংরক্ষিত করবে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!