নপুংসক বাদশার সন্তানের গল্প (শেষ পর্ব)

ভাইদের যাবার পথে খানিকটা গিয়ে দেখলো আলুথালু হয়ে জীর্ণ আর ছিন্ন পোশাক পরা এক যুবক আসছে। শাহজাদা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো তারই এক ভাই সে। তাড়াতাড়ি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো: ‘কী হয়েছে তোমার’! ভাই বললো: ‘আমি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছি। চোর আমাদের সব কেড়ে নিয়ে গেছে। এখন কী করবো জানি না। ভাবছি কাঁটাগাছ তোলার কাজ করবো। সেগুলো তুলে বিক্রি করে খরচের ভার বহন করবো’। এই বলে দু’ভাই একসাথে যাত্রা করলো এবং শহর-নগর ব্যাপক ঘুরলো। অন্য ভাইকেও তারা খুঁজে পেলো।

 

খুঁজে পাওয়া ভাইও যাঁতাকলের মালিকের শাগরেদ হিসেবে কাজ করছিল। তার চুলও অপর ভাইয়ের মতো মাথা থেকে একেবারে কোমর পর্যন্ত লম্বা হয়ে গেল। নখগুলো তাদের কাস্তের মতো বড়ো বড়ো। যে ছোট ভাইটা পরীদের রানীর মাদি ঘোড়া নিয়ে এসেছিল সে অন্য ভাইদের চুল নখগুলো কেটে দিলো। মোটামুটি তাদেরকে মানব সন্তানের মতো মনে হয় এরকম একটা অবস্থায় নিয়ে এলো। তবে ভাইদের কাটা চুল আর নখগুলো তাদের অগোচরে রুমালে বেঁধে ঘোড়ার জিনের ভেতর রেখে দিলো। এবার তিন ভাই একসাথে রওনা হলো নিজেদের শহরের দিকে।

 

হ্যাঁ! তিন ভাই নিজেদের শহরের দিকে রওনা দিলো। যেতে যেতে পথে প্রথম ভাই দ্বিতীয় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো: ‘আমরা কোন্‌ মুখে শহরে ফিরবো? আমরা যাকে মানুষ বলেই গণ্য করি নি সে ঠিকঠাক মতো মাদি ঘোড়াও নিয়ে এসেছে আবার আমাদেরকেও আমাদের দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি দিয়েছে। মানুষ যদি এটা জানতে পারে আমাদের মান-সম্মান তো আর থাকবে না। এদিকে বাবার চোখেও সে আদরের দুলালী হয়ে উঠবে। কে জানে হয়তো বাবা তার সিংহাসন তাকেই দিয়ে বসতে পারে’। দ্বিতীয় ভাই এ কথা শুনে বললো: ‘তাকে মেরে ফেললে ভালো হয় না! তাহলে সবকিছুই হবে আমাদের’। প্রথম ভাই বললো: ‘না, তাকে মারবো না। মারলে হত্যার দায়-দায়িত্ব পড়বে আমাদের ঘাড়ে। তারচে ভালো তার কাছ থেকে মাদি ঘোড়াটা নিয়ে নেবো, ফলে সে যাবে তার পথে’। এরকম কথাবার্তার পর ঘনিয়ে এলো রাত।

 

রাতের বেলা তিন ভাই ঘুমিয়ে পড়লো। মাঝরাতে দু’ভাই ‘চোর’ ‘চোর’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। ছোট ভাই মাদি ঘোড়ার দিকে দৌড়ে যেতে চাইলো কিন্তু তার অপর দু’ভাইয়ের একজন তার পায়ে তলোয়ার দিয়ে জোরে আঘাত করলো। কাপুরুষের মতো দু’ভাই ছোট ভাইকে ফেলে রেখে ঘোড়ায় চড়ে রওনা দিলো নিজেদের শহরের দিকে। কয়েকদিন পর গিয়ে পৌঁছলো তারা শহরে। বাবার কাছে মাদি ঘোড়া নিয়ে গেল এবং তার দুধ দুইয়ে নিয়ে বাদশার চোখে মেখে দিতেই বাদশার চোখ ভালো হয়ে গেল। দুই ছেলেকে দেখতে পেয়ে বাদশাহ ভীষণ খুশি হলো। পুরো শহরে আলোকসজ্জা করে উৎসবমুখর করা হলো।

 

এদিকে পা কাটা ছোটো ভাই সকাল পর্যন্ত কষ্টে কাটালো। ভোর হতেই চারদিক যখন ফর্সা হলো দেখলো দুটি ইঁদুর ঝগড়া করছে। একটার পায়ে আঘাত লেগেছে। কাছেই একটা জায়গায় সাদা মাটি ছিল। আহত ইঁদুর সেই মাটিতে গিয়ে তার পায়ে মাখালো আর অমনি ইঁদুরের পা ভালো হয়ে গেল। শাহজাদা এই কাণ্ড দেখে ইঁদুরের মতো নিজেও একই কাজ করলো এবং সুস্থ হয়ে গেল, একটু ব্যথাও আর রইলো না তার পায়ে। দেরি না করে শাহজাদা এবার পাড়ি জমালো শহরের দিকে। শহরে গিয়েই দেখলো উৎসবমুখর সাজ সাজ অবস্থা চারদিকে। বুঝতে বাকি রইলো না যে তার ভাইয়েরা কী করেছে। মনে মনে বললো: এখন যদি বলি সব আমি করেছি, কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই সে এক কোণে সাধারণ মানুষের সাথে বসে নীরবে উৎসব দেখতে লাগলো।

 

এদিকে চল্লিশ দিন শেষ হবার পর পরীদের রানী জেগে উঠেই বুঝতে পারলো যে কোনো মানুষ তার প্রাসাদে এসেছে। যেভাবেই হোক এখন ওই মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে কেননা পরীদের মাঝে আর সে বাস করতে পারবে না। তার মাদি ঘোড়ার খোঁজে গিয়ে বুঝলো ঘোড়াটাকেও নিয়ে গেছে। দ্রুত সে তার বাহিনী জড়ো করলো এবং যেখানে তার মাদি ঘোড়া রয়েছে সেই শহরে গিয়ে পৌঁছলো। বাদশার কাছে পাঠালো একজনকে। সে বাদশাকে বললো: হয় মাদি ঘোড়া এবং যে তাকে এনেছে তাকেও দিতে হবে না হয় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই ঘটনা সারা শহর হয়ে গেল। বাদশার কাছে এসে হাজির হলো সবাই। বাদশাকে বললো: পরীদের সাথে যুদ্ধ করে পারবে না কেউ। তারচেয়ে ভালো ঘোড়া আর যে তাকে এনেছে উভয়কে ফেরত দেওয়া।

 

বাদশা এবার ভড়কে গেল। সে এক বার্তায় জানালো যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা তার নেই। তার দুই ছেলে কেন একাজ করেছে তাও বললো। এই বলে দুই ছেলেকে মাদি ঘোড়াসহ পাঠালো পরীদের রানীর কাছে। দুই ছেলে তো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। তারা বুঝতে পারলো চরম ভুল করেছে তারা। এখন তো বলতেও পারবে না যে তারা এ কাজ করে নি বরং তাদের ছোট ভাই কাজটি করেছে। রাণী তাদের দেখে বললো: এরা আমার মাদি ঘোড়া চুরি করে নি। মূল কাজটি যে করেছে তাকে পাঠাতে বললো। এবার তো সমস্যা দেখা দিলো। কে করেছে তাহলে কাজটি।

 

এক সপ্তা সময় দিল পরীদের রানী। এর মধ্যে না পাঠালে পুরো শহর চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে। বাদশা তো হতবাক। সে বলতে লাগলো এ অবস্থা দেখার চেয়ে অন্ধ থাকাটাই তো ভালো ছিল। এভাবে ছয় দিন কেটে গেল। সবাই থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নাজানিকী হয়। শেষ পর্যন্ত শাহজাদা বাদশার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললো সে-ই কাজটা করেছে। এরপর যা হয়েছিল সবই বাদশাকে বললো। বাদশা তাড়াতাড়ি তাকে পরীদের রানীর সামনে পাঠালো। পরী তাকে দেখেই বুঝলো কাজটা এ-ই করেছে। রানী এবার শাহজাদার দিকে ফিরে বললো: তুই যেহেতু আমার ঘোড়া এনেছিস এখন আমি আর পরীদের মাঝে ফিরে যেতে পারবো না। সুতরাং আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে এবং আমরা একসাথে জীবন যাপন করবো। শাহজাদা মনে মনে বললো: খোদা আমার মনোবাসনা পূর্ণ করেছে।

 

এরপর যা হবার তাই হলো। সাত দিন সাত রাত ধরে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে বিয়ের আয়োজন হলো। যে দু’ভাই বাদশাকে মিথ্যে বলেছিল তাদেরকে শাস্তি দিতে চাইলো বাদশা। কিন্তু শাহজাদা বললো: তারা যে অপমানিত হলো সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। তাদেরকে আর শাস্তি দেওয়ার দরকার নেই।#

দুঃখিত!