নটভৈরব —- বর্ণালী সাহা

“ভালোই”, উত্তরে বলল আবেদা তদ্গত শুকনো গলায়।
আবেদার কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন ও কেমন আছে। প্রশ্নটা সরাসরি উদ্ধৃত করলে: “তুমি আজকে কেমন আছ?”।
শক্ত চেয়ারে পিঠ রেখে আবেদা কেন যেন চাইলেও আরাম করে বসতে পারছে না। গত দুইদিনের সন্ধ্যা সাতটার সিটিং-এর অভিজ্ঞতায় ওর অবশ্য আস্তে আস্তে অভ্যাসটা হয়ে আসছে। ওর সামনে রাখা মজবুত টিক-উডের টেবিল, যার উপর দুটো পেপারওয়েট, একটা পানির গ্লাসসহ পিরিচ, আর একটা ওষুধ-কোম্পানীর ছাপ্পা মারা কলমদানী ছাড়া আর কিছু নেই। সেই টেবিলের পিছনে বসা বিশেষজ্ঞ তিনি, তাঁর পিছনে বুকশেলফে সার করে দাঁড় করিয়ে রাখা সাইকায়াট্রির ইংরেজি বই। তটস্থ বইগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শাস্তি পেয়েছে।
ভদ্রমহিলা এর পরের প্রশ্নের অবতারণা করার জন্য গলা-খাঁকারি দেন। আবেদা নড়েচড়ে বসে।
“গতদিন তো বলেছিলে একই দুঃস্বপ্ন প্রতিরাতে দেখছ। তো, গতরাতে কী দেখলে?”
“মনে নেই।”
“ওইরকম রেকারিং ড্রিমস আগে আর কখনো তুমি কিছু নিয়ে দেখেছ?”
আবেদা উত্তর দেয় না। নিজেকে সত্যি সত্যি রোগী মনে না করলে রোগ-নির্ণয়ে সহযোগিতা করা প্রায় অসম্ভব।
দীর্ঘ বিরতির পর ধৈর্যশীল মানুষের মত মাথাটাকে একটু নিচে ঝুঁকিয়ে কিন্তু মুখে কিছু না বলে নীরবে প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলেন ভদ্রমহিলা।
আরো দুই সেকেন্ড। মহিলার চোয়াল একটু কাঁপে। আবেদা তাও নিশ্চুপ।
খেলাটা আবেদার ভালো লাগে। ওর টনটনে জেদ আর পরিমিত আত্মবিশ্বাস কি করে মহিলা টের পায় না? আরিফ কি করে সত্যিই ওকে অসুস্থ ভেবে এখানে নিয়ে আসে? অবাধ বীর্যপাতে বাধা পেলে কি উদ্যোগী পুরুষের ভালবাসার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত ভর করে বউয়ের অসুস্থতা? আবেদার অভিমান হওয়া উচিত।
ভদ্রমহিলা দৃষ্টি সরান না। নীরব জিজ্ঞাসা জারি থাকে। সপ্রশ্ন দৃষ্টি দীর্ঘক্ষণ বিছিয়ে রাখার ট্রেনিংও পেয়েছেন নাকি মহিলা মেডিক্যাল স্কুলে?
আবেদা তারপরও কিছু বলে না। এমন একটা চেহারা বানিয়ে বসে থাকে যা দেখে যে কেউ নিশ্চিত হবে যে সে স্মৃতি হাতড়ে উত্তর খুঁজে বের করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না।
ধৈর্য আর সহানুভূতিতে মাখামাখি গুরুপাক দৃষ্টিকে এইভাবে শায়েস্তা করতে হয়। আবেদা জানে। অফিসের ইন্টারভিউ বোর্ডে এরকম মাইন্ড গেইমের অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। (প্রার্থী হিসেবে নয়; ইন্টারভিউয়ার হিসেবে। হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের কাজই এমন।)
নির্মোহ চোখে-চোখে চেয়ে থাকার স্ট্র্যাটেজিতে কাজ হয়।
ভদ্রমহিলা শায়েস্তা হন। শায়েস্তা হওয়ার প্রথম লক্ষণ হল সূক্ষ্ম অসহিষ্ণুতার প্রকাশ।
“আবেদা, দেখো…আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি।”
“তুমি ছাড়া ‘তোমরা’ কারা?”, বলল আবেদা মনে মনে।
“আবেদা, তুমি সেদিন বলেছিলে প্রায়ই তুমি দেখ একটা হসপিটালের বেডে শুয়ে তুমি একে একে কয়েকশ বাচ্চা জন্ম দিচ্ছ। এই ব্যাপারে ডিটেইলস আলাপও আমাদের হয়েছে। আমি যা জানতে চাইছি, তা হল– অতীতে এমন কিছু স্বপ্ন রিপিটেডলি দেখার কথা তোমার মনে পড়ে কিনা।”
আবেদা খুব বেশি মনোযোগ দিতে পারে না মহিলার প্রশ্নে।
আবেদা কেন যেন গোড়া থেকেই এই ভদ্রমহিলার অফিসঘরে একটা গন্ধ পেত। আজ ও বুঝতে পারছে কিসের গন্ধ। ছোটবয়েসে রিমন’দের ভোজ্য তেলকলের উল্টোদিকের বাড়ির বাইরের ঘরে আলমারি ঠাসা সস্তা নিউজপ্রিন্টের পেপারব্যাক অনুবাদের বই রাখা থাকত। বাইন্ডিংএর সুতা প্রায়-আলগা হয়ে আসা ওয়েস্টার্ন কিংবা রোমান্টিক অনুবাদের বই। কেমন একটা সোঁদা ঘাসপচা গন্ধ আসত ঐ আলমারি থেকে। সার সার অনুবাদের বইগুলো অমায়িকভাবে হাতে হাত ধরে থাকত। বহুদূরের অন্য এক দুনিয়ার গল্প বুকে নিয়েও ওরা কেমন মেকি বন্ধুসুলভ রপ্ত হাসি নিয়ে কাছে আসার ভান করত; বলতে চাইত নরম সুরে, “দেখ দেখ, আমরা ভিনদেশী হয়েও কেমন তোমার নিজের ভাষায় গল্প ফেঁদেছি! তোমার ভাল লাগছে না? আচ্ছা ঐ স্পাই থ্রিলারটাকে ডেকে নামিয়ে দিই, কেমন? ওকে নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগবে! ও একটু চটুল হলে কি হবে? দিলটা দরাজ। আচ্ছা প্রাপ্তবয়স্ক ওয়েস্টার্নটা এখনি খুলো না কিন্তু। একটু বড় হলেই দেখবে কেমন অদ্ভূত পেট চিনচিন সারপ্রাইজ দিচ্ছে ও তোমাকে!”। কত কথাই না বলত ওরা। ওদের এত কথার ভিড়ে ওদেরকে খুলে পড়ার ইচ্ছে কোথায় যেন হারিয়ে যেত। শুধু ঐ বিনবিনানি কথার চিরুনির দাঁড়া আঁকড়ে জটপড়া ঝরা-চুলের মত অবাধ্য পেঁচিয়ে থাকত ওদের গায়ের ঘাসপচা সোঁদা গন্ধ।
সেই গন্ধ আর এই ঘরের গন্ধ হুবহু এক! হুবহু একই অনুবাদের বইয়ের গন্ধ। এই গন্ধটা যেন ভদ্রমহিলার হাত-পায়ের ভাপ থেকেই আসছে।
ভদ্রমহিলার প্রতিটি বাক্যেই এমন একটা কিছু আছে যা সম্ভবত ঘরের কোনায় ডাঁই করে রাখা পুরনো অনুবাদের বই ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। খুব বেশি খুঁজলে বাংলায় ডাব করা এখনকার ডিসকভারি চ্যানেলের ঘ্যানানি ধারাভাষ্যের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। তা না হলে কে কবে বাংলায় জিজ্ঞেস করে “তুমি আজকে কেমন আছ?” কিংবা বলে “আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি!”?
এই যে প্রাণঢালা সহমর্মিতা নিয়ে মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে আছে, এই সহমর্মিতাটাও মনে হচ্ছে ইংরেজি থেকে বাংলায় আক্ষরিক অনুবাদ করা। যে অসীম ধৈর্য নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি মনোরোগের গতিপ্রকৃতি ধরার চেষ্টা করেন, সেটাও নিছক অনুবাদ করা ধৈর্য। যে অনুসন্ধিৎসা নিয়ে উনি সওয়াল-জবাব চালান, সেটাও নিরেট কাঁচা অনুবাদ। মহিলার পরনের আসমানি নীল শাড়িটাও একটা অনুবাদ করা শাড়ি। ডানহাতের সোনার চিকন চুড়িজোড়া দেখতেও লাগছে যেন বার বার ঘষে-মেজে অনুবাদ করা। যে পাট-পাট শৃংখলায় উনি রোগীদের ফাইল সাজিয়ে রাখেন, তাতে ডটপেন দিয়ে সযত্নে সাইডনোট লেখেন গোটা গোটা অক্ষরে, ‘টুক’ শব্দ করে পিরিচে আধখালি গ্লাস রাখেন, নতুন করে প্রশ্ন সাজিয়ে নরম কাশি কেশে গলা পরিষ্কার করেন—সব, সব অনুবাদ করা। ছুটির দিনে বাড়িতে বসে তিনি কি কুরুশ কাঁটার কাজ করেন? কিংবা বুয়ার বানানো হালুয়া দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন? করলে সেগুলোও টুকটাক অনুবাদ করা।
উনি যে কায়দায় আবেদার আবেগিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন, রোগ-নির্ণয় করবেন, বিশ্লেষণ করবেন, ঘুমের ওষুধ দেবেন, আবেদার হাজব্যান্ড আরিফকে ওয়েটিং রুম থেকে ডেকে এনে পাশে বসিয়ে শলাপরামর্শ দেবেন—ওগুলোও সব অনুবাদ করা নিদান।
মনোবিজ্ঞানের অনুবাদ লাগে। গার্হস্থ্য বিজ্ঞানেরও লাগে। কিংবা মনে হয় সব বিজ্ঞানের। অথবা সম্ভবত সব জ্ঞানের। ঈশপের গল্পের লাগে। ধর্মগ্রন্থেরও তো লাগে!
এই সব ভাবনার মাঝে মহিলা আরো একটা নতুন প্রশ্ন ফেঁদে ফেলেছেন। জানতে চাইছেন আবেদার জীবনে বা অফিসে ইদানিং কোনো ট্রমাটিক বা স্ট্রেসফুল এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে কিনা।
উত্তর না পেয়েও ভদ্রমহিলার বাঁকাচাঁদের দেখনহাসিতে কোনো কমতি ঘটে না। নতুন প্রশ্ন রেডি হয়।
“স্বপ্নে কি তুমি কখনো তোমার মা’কে দেখতে পাও? কিংবা চেনা অন্য কাউকে?”। এই প্রথম ভদ্রমহিলার করা কোনো প্রশ্ন আবেদার কাছে অনুবাদের মত লাগল না।
“হুঁ…মা’কে দেখি মনে হয়…মাঝে মাঝে”, মিথ্যা কথা। তাও আবেদা এই প্রশ্নটার উত্তর দিল।
হ্যাঁ…একরাতে দেখেছিল নানাভাইকে। বারান্দার বেড়ার সামনে বসে মুড়িভর্তি একটা বিশাল অ্যালুমিয়ামের বাটিতে রগ-ফোলা হাতটা চুবিয়ে লাগাতার খিস্তি করছেন কাকে যেন। উঠানে কে যেন পানি ছিটিয়ে ঝাড়ু মারছিল গাছকোমরে। স্বপ্নটা আর কোনোদিন ফিরে আসে নি; ঐ একবারই। ঐ একবারের স্বপ্নটা এত স্পষ্ট দগদগে, জীবনের কয়েকশ রেকারিং ড্রিম মিলেও ঐ স্বপ্নের চেয়ে বেশি স্মরণীয় হতে পারবে না কোনোদিন। নানাভাই ওর ছয় বছর বয়সে দেহান্তরিত হন।
নানাভাইকে দেখার কথা মনে হতেই ঘাসপচা অনুবাদ বইয়ের ছ্যাঁতলা-পড়া গন্ধ ছাপিয়ে টাটকা তামাকপোড়া গন্ধ টের পেল আবেদা। সেদিনের স্বপ্নেও নানাভাইয়ের সঙ্গে এসেছিল ক্যাপস্টান সিগারেটের উগ্র গন্ধ। নানাভাইয়ের বুকের ঘন কাঁচাপাকা চুলে লেগে থাকত যে সিগারেটের গন্ধ, নানীর মাথার সুগন্ধী জবাকুসুম তেলের চেয়েও ভাল ছিল সেটা।
নানাভাই মরেছিলেন লাং ক্যান্সারে। “সিগারেটের নেশাই কাল হল”। মা বলেছিল। হয়তো অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে সবে পঞ্চাশ পার হওয়া মানুষটার মৃত্যুর পিছনে। কে জানে? অনেক কেঁদেছিল মা। অনেক।
নানাভাই মরার বছর বিশেক পর মায়ের শিথিল মুখে শিশুর নিটোল হাসি দেখেছিল আবেদা। সেদিন আবেদার পীড়াপীড়িতে ওরা মিলে দামী রেস্টোরান্টে খেয়েছিল। সেদিন খেতে গিয়ে খলবল করে আবেদা সবার কাছে আরিফের কথা পেড়েছিল। কারণ সেদিন আবেদা’দের বাড়ির ঠিকানায় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছিল। আবেদার নামে। ইংরেজিতে। আন্তরিকভাবে লেখা ছিল চিঠিতে—“কনগ্রাচুলেশনস”।
এইসব চিঠির অনুবাদ লাগে না।
এ-বি-সি-ডি’র গণ্ডি সামান্যই পেরোনো আবেদার মা অনুবাদ ছাড়াই খুশি। কয়েকটা ফটোকপি বানিয়েছিলেন ঐ চিঠির, আর অরিজিন্যালটা সম্ভবত বাঁধিয়ে রাখবেন বলে মনস্থির করেছিলেন।
বহুজাতিক (আসলে ব্রিটিশ বা আমেরিকান) টোব্যাকো কোম্পানির সেই চাকরি করছে আবেদা আজ বছর চারেক ধরে। সবাই জানে জীবনে আর বড় কোনো পরীক্ষায় ওকে বসতে হবে না।
সময়ে সে পরীক্ষার্থী থেকে হয়ে যাবে পরীক্ষা-নিয়ন্তা। সবাই জানে।
সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রমহিলা কি কখনো ওর সঙ্গে অনুবাদঘরের বাইরে যাবেন? না গেলে উনি কীভাবে বুঝবেন আবেদাকে?

দুঃখিত!