তানজিনা চা নিয়ে এল। চায়ের কাপ নিতে নিতে শওকত জিগ্যেস করে, কী হয়েছে বলো তো?
রাইসা আজ একটা মেয়েকে দেখেছে। তানজিনা বলল।
শওকত চায়ের কাপটা ঠোঁটের কাছে তুলে এনেছিল, হাত থমকে গেল। বলল, রাইসা আজ একটা মেয়েকে দেখেছে মানে?
আমি রান্না করছিলাম। রাইসাকে বললাম জলপাই ছাদ শুকোতে দিয়ে আসতে। ও গেল। একটু পর ফিরে এসে বলল, ছাদে জলপাই রেখে ফেরার সময় সিঁড়িঘরের ঠিক সামনে একটা মেয়েকে দেখেছে। মেয়েটার গায়ের রং কালো হলেও দারুণ সুন্দরী। আকাশি রঙের শাড়ি পরা ছিল। রাইসা বলল, তুমি কে ? মেয়েটি বলল, আমি অর্চনা। রাইসা বলল, তুমি কোথায় থাক? মেয়েটি বলল, বলল, আমি এই বাড়িতে থাকি। রাইসা বলল, দেখি নাকেন? মেয়েটি বলল, আমাকে তো দেখা যায় না। বলে মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
তারপর? শওকত কেমন বিমূঢ় বোধ করছিল।
তারপর রাইসা টিভি দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে গেল। আমি ওকে অবশ্য তুলে একবার খাইয়ে দিয়েছি।
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরালো শওকত। কপালে ভাঁজপড়েছে। বলল, রাইসার ভুল দেখেনি তো? অন্য কেউ ছাদে ওঠেনি তো?
অমাঃ ও ভুল দেখবে কীভাবে? ছাদের চাবি তো আমাদের কাছেই থাকে।
ওহ্ ।
এই বাড়িটা ভালো না শওকত। আমার আরভাল্ লাগছে না। কয়েক দিন আগে জুয়েলের মাও বলল এই বাড়িতে নাকি জিনের আছর আছে। ভাড়াটিয়ারা থাকতে চায় না। কী সব নাকি দেখে। এই কারণে ভাড়া নাকি কম। কাল তোমার ফিরতে দেরি হল। রাইসাকে নিয়ে পড়তে বসিয়েছি। তখন ঘরে হালকা ধূপের গন্ধ পেয়েছি।
শওকত বলল, আমি আজ সিঁড়িতে ওঠার সময় ধূপের গন্ধ পেয়েছি।
একতলার হোমিও ডাক্তার ধূপ জ্বালান নি তো?
মনে হয় না। ভদ্রলোক তো কিছু দিন ধরে আসছেন না। বলে শওকত এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ে। ঠিক তখনই তারা মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আছে। অন্ধকার ঘনিয়ে উঠছে। বারান্দায় শীত মাখানো বাতাস ছড়ায় । ওরা ধূপের গন্ধ পায়।তানজিনা চমকে উঠে। বলে, ধূপের গন্ধ পাচ্ছ?
হু। বলে শওকত উঠে দাঁড়ায়। তারপর দ্রুত ঘরের ভিতরে চলে এল। তানজিনা সুইচ অন করে বাতি জ্বালায়। ঘরের বাতাসে তীব্র ধূপের গন্ধ । রাইসা বিছানার ওপর গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে।
কে ধূপ জ্বালালো? ফিসফিস করে বলল তানজিনা।
শওকত কাঁধ ঝাঁকায়। তাকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে।
কলিংবেল বাজাল।
কে এল? তানজিনা প্রায় আর্ত চিৎকার করে উঠল।
ওরা প্রায় দৌড়ে ড্রইংরুমে এল। সুইচ অন করে শওকত বাতি জ্বালালো। দরজা খুলে তীব্র আতরের গন্ধ পেল তানজিনা । চাদরমুড়ি দিয়ে সোলাইমান মিঞা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কাগজ দিয়ে ঢাকা একটি প্লাস্টিকের গামলা। তার ওপর মিষ্টির একটা প্যাকেট। বলল, সেলাম ম্যাডাম।
সালাম। কী ব্যাপার সোলাইমান?
সোলাইমান মিঞা হেসে বলল, আইজ চাইনপীরের মাজারে মায়ফিল বইসিলে ম্যাডাম। আপনাগো জইন্য তবারক নিয়া আরসি । আইজ গুলজারে সবজি খিচুড়ি পাকায়ছিলে।
ওহ। এসো, ভিতরে এস।
সোলাইমান মিঞা ভিতরে ঢোকে।তানজিনা জিগ্যেস করে, মিষ্টি কিসের?
মিষ্টির প্যাকেট আর খিচুড়ির গামলা ড্রাইনিং টেবিলের ওপর রেখে সোলাইমান মিঞা বলল,
আমাগো বাড়িওলায় আশীষ খোনকার আইজনানা হইছেন, বোঝলেন। এই আনন্দে হে নাকি নবীগঞ্জবাসীরে দাওয়াত করিয়া খাওয়াইবেন কইলেন। আপনাগোও দাওয়াত করিবেন কইলেন । আইজ তিনি আমারে ফোন করিয়া আপনাগোরে মিষ্টি কিন্না খাওয়াইয়া দেতে কইলেন।
আচ্ছা, তুমি এখন বস, একটু চা খাও।বলে তানজিনা রান্নাঘরে চলে যায়।
শওকত একটা চেয়ার টেনে বসল। ধূপের গন্ধটা তখনও বাতাসে ভাসছিল। মোবাইলের রিংটোন শুনতে পেল। মোবাইলটা বেডরুমে। সে দ্র্রুত বেডরুমে চলে আসে। মোবাইল টেবিলের ওপর থেকে তুলে নেয়। রওশন আপা। হ্যাঁ, আপা বলেন।
একটু আগে ছোটনের সঙ্গে কথা হল। ভাইরা আমাদের জমির ভাগ দেবে বলল।
আচ্ছা। সে তো ভালো কথা।
তারপরও আমরা কাল আসছি, বুঝলি?
ঠিক আছে। আসুন না।
বেশি ঝামেলা করতে যাস না আবার। কাল বিকেলেই ফিরে আসব। লোপার আবার পরীক্ষা।
না, না ঝামেলার কি আছে।
ফোন অফ করে ড্রইংরুমে এসে চেয়ারে বসল শওকত । সোলাইমান মিঞা আরষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে। শওকত বলল, সোলাইমান মিঞা?
কন ছার।
তুমি এই বাড়িতে কত দিন ধরে আছ?
পুরানবাড়িত আমি দেখতে আছি জন্মের পরের থন। দূর্গাপাড়ায় আমার মায়ে কাম করতে। আমি তখন ছুড। দ্যাশ স্বাধীন হইলে পর আমার মায়ে মরল।আমি অথই গাঙে পড়লাম। পুরানবাড়ির মালি আছিল সালামত আলী। বিহারী হইয়াও আমার লালনপালনের ভার লইলেন। তখন মমতাজ ছিনেমা হলের মালিক গুলাম দস্তগীর ছাহেব পুরানবাড়ি কিন্না লইলেন। তারপর তিনি বিলাতচইলা গেলেন। এইবার পুরানবাড়ি কিন্না লইলেন চকখোলা হাজী কেরামত । তিনি মারা গেলে পর এইবার সুনতানগঞ্জের আশীষ খোনকারে কেনলেন পুরানবাড়ি। পুরানবাড়ি অনেকবার হাত বদল হইছেছার। তয় তামারে কেউ খেদায় নাই।
শওকত বলল, লোকে বলে পুরানবাড়িতে জিনভূত না কী সব নাকি আছে। তুমি দেখেছ কখনও?
লোকে তো হেইয়া কয়। আমি হইলাম চাইনপীরের মুরিদ। জিনপরি আমার কাছে ঘেঁষবে কন সাহসে কন? তয়-
তয় কী? শওকতের চোখ সরু হয়ে ওঠে।
মিছা কমুনা ছার।
আহা বল না
কার্তিক মাস আইলে না ছার … একডা কালা কইরা সুন্দরী মাইয়ায় …
কথা শেষ হল না। তানজিনা চা নিয়ে এল। তারপর বসতে বসতে বলল, সোলাইমান মিঞা?
সোলাইমান মিঞা গরম চা সুরুত করে শব্দ বলল, কন ম্যাডাম।
রাইসার স্কুলের আশেপাশে ভাড়াবাড়ি পাওয়া যাবে? সস্তায়?
যাইব ম্যাডাম। তয় কার জইন্ন ম্যাডাম?
আমাদের জন্য।
আয় হায়। কন কী! আপনারা পুরান বাড়ি ছাইড়া চইল্যা যাইবেন ম্যাডাম?
হ্যাঁ।
কী বলতে যাবে- বেডরুমের দরজায় শব্দ হল। রাইসা দাঁড়িয়ে। রাইসা তখনও চোখ কচলাচ্ছে। ঘুমের ঘোর কাটেনি। ও আদুরে গলায় বলল, মা। আমাকে খিচুড়ি দাও না। আর শোন মিষ্টিও দিও।
তানজিনা ঝট করে তাকালো শওকতের মুখের দিকে।
খিচুড়ি খাইবা মা? আইয়ো। তোমারে খিচুড়ি দেই। সোলাইমান মিঞা বলল।
সারারাত শওকতের ঘুম হল না। একবার ঘুম হল ঠিকই। আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখল। ভোরে বিছানায় শুয়েফজরের আজান শুনল। ভোরে হাঁটাহাঁটি না করলে সারাদিন গা ম্যাজম্যাজ করে। মেয়েকে জড়িয়ে তানজিনা ঘুমিয়ে।ও কালই বলেছিল মেয়েকে ফেলে আজ আর হাঁটতে যাবে না।
শওকত চাদর জড়িয়ে মাঙ্কি ক্যাপ পরে নীচে নেমে এল। নীচতলার বাগানে কুয়াশা। ফটকের কাছে সোলাইমান মিঞা। মসজিদে যাচ্ছে হয়তো।