ধুপ [১ম অংশ]

আজ বিকেলে ব্যাঙ্ক থেকে বেরুতেই দারোয়ান রশিদ মিঞা সালাম দিয়ে বলল, ছার, আপনারে একখান কথা কই। আপনে পরিবার পরিজন লইয়া যেই বাড়িত উঠছেন, সেই বাড়িটা ভালো নাছার, বাড়িতে জিনের আছর আছে। এট্টু দেইখা শুইনা থাইকেন সার।
কথাটা শুনে শওকতের ভ্রুঁ কুঁচকেযায়। কুসংস্কার বেশ মজার ব্যাপার। আর কুসংস্কার জিনিসটা মানসিকভাবে লালন করারও একটা ব্যাপার আছে। দারোয়ান, কাজের ঝি-এই শ্রেণির লোকজন কুসংস্কার জিনিসটা লালন করে। সযত্নে। নতুনকাজের মেয়েটিও নাকি তানজিনাকে বলেছে বাড়িটা নাকি ভালো না। শওকত খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। তারপর হাঁটতে থাকে। তখনও ঝরঝরে রোদ ছিল। দূর্গাপাড়ার বাড়িটা কাছেই। এখানকার লোকে বলে পুরানবাড়ি । রেললাইন পেরিয়ে, বাসষ্ট্যান্ড, তারপর আসফ আলী মিলনায়তন, চাঁদপিরের গলি। সেই গলির শেষ মাথায় বেশ নিরিবিলি গাছপালায় ঘেরা পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। একতলায় গ্রিন হোমিওহল। মোছলেম উদ্দীন নামে একজন বৃদ্ধ ডাক্তার সকাল-সন্ধ্যা বসেন। বৃদ্ধ কানে কম শোনেন বলেই হয়তো পসার তেমন ভালো না। শওকতরা থাকে দোতলায় । পুরনো আমলের বাড়ি বলেই ছাদে কড়িবর্গা, বেশ বড় বড় রুম, বড় বড় বাথরুম আর বড় বড় জানালা। পানির সমস্যা নেই। সোলাইমান মিঞা নামে একজন দারোয়ান আছে । মুসল্লী টাইপের লোকটাকে মধ্যবয়েসিই বলা চলে। সোলাইমান মিঞা থাকে একতলায় । মাঝেমধ্যে বাজার- টাজার করে দেয়। চাঁদপিরের মাজার থেকে সিন্নী এনে দেয়। বাড়িওলা আশীষ খোন্দকার সুলতানগঞ্জের বড় ব্যবসায়ী। নবীগঞ্জ থাকেন। ভাড়ার টাকা সোলাইমান মিঞাই নবীগঞ্জে পৌছে দেয়।
সুলতানগঞ্জ ব্রাঞ্চে সদ্য বদলী হয়ে এসেছে শওকত। নির্জন ছিমছাম শহর সুলতানগঞ্জ । এই শীত আসি-আসি সময়ে ভালো লাগছে। অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় বেডরুম-লাগোয়া দোতলার বড় বারান্দায় বসে শওকত । তখন রাইসাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে; গল্প বলে, যে গল্প মায়ের মুখে ছেলেবেলায় শুনেছিল, সেই গল্প । তখন নীচের বাগানের গাছপালা, দূরের আবছা গাছপালা, শিবমন্দির, সীতার দিঘী কেমন স্তব্দ হয়ে থাকে । দূর থেকে ভেসে আসে শেয়ায়ের ডাক । দূরে কুয়াশা ঢাকা নিঝঝুম গ্রাম। খুব ভোরে উঠে যে গ্রামের মেঠেপথে তানজিনার সঙ্গে চলে যায় শওকত। শিশির-ঝরা নির্জন গ্রাম্য পথে হাঁটে। কুয়াশার ভিতরে তখন একটি-দুটি কাকা উড়ে যায়।
তানজিনার সঙ্গে শওকতের স্কুল জীবন থেকে প্রেম ( সর্ম্পকে তানজিনা শওকতের খালাতো বোন)। সেপ্রেম এত বছর পর এখনও অটটু। … কখনও ওরা হাতে হাত রেখে বসে প্রাচীন শিব মন্দিরের সিতার দিঘীর ঘাটে । শিব মন্দিরের পুরোহিত নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তার সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। সৌম্য বৃদ্ধটি বেশ অমায়িক আর স্বশিক্ষিত। চমৎকার জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বরে কথা বলেন।তানজিনার আবার পুত্রসন্তানের ভীষণ শখ। বৃদ্ধ পুরোহিত তানজিনার হাত দেখে গর্ভধারণের দিনক্ষণ বলে দিয়েছেন। পুত্র সন্তান নাকি কুম্ভ রাশির জাতক হবে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে কুম্ভ রাশির জাতক অত্যন্ত মেধাবী হয়। … রোদ উঠি-উঠি ওরা সময়ে ফিরে আসে। রাইসা তখনও ঘুমে কাদা। “স্কুলে যেতে হবে মা।” বলে মেয়ে কে ডেকে তুলে রান্নাঘরে যায় তানজিনা । শওকতের বদলীর চাকরি। মেয়ের স্কুল নিয়ে সমস্যা হয়। তবে এবার ভাগ্য প্রসন্ন বলতেই হয়। রাইসারস্কুল পুরানবাড়ির একেবারে কাছেই, আসফ আলী মিলনায়তনের পাশে। তানজিনাই মেয়েকে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। রাইসা এবার ক্লাসফাইভে উঠল।
রাইসার জন্য কী যেন কিনতে হবে। ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ল না। তানজিনাকে ফোন করবে কিনা ভাবল।মোবাইলটা প্যান্টের পকেটেছিল। ভাইব্রেশন মোডে ছিল। ওটা বিজবিজ করে উঠল। ফোন বের করে দেখল-ওশন আপা। তানজিনার বড় বোন।মাগুরা থাকেন। তানজিনা সর্ম্পকে শওকতের খালাতো বোন বলেই বিয়েতে সাংঘাতিক ঝামেলা হয়েছিল। তখন রওশন আপাই নানা ঝক্কি সামলিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন।
হ্যালো । স্লামালাইকুম আপা।
অলায়কুমআস সালাম। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল রওশন আপার কন্ঠস্ব।
কেমন আছেন আপা?
ভালো থাকি কি করে বল? রায়পুরায় আমাদের দাদারবাড়ির জমিজমা সব ভাগভাঁটোয়ারা হচ্ছে। ছোটন বিদেশ থেকে এসেছে। ভাইরা আমাদেরঠাকাচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। এখন আমরা চুপ করে থাকলে ঠকে যাব না? তুই কি বলিস?
শওকত বলল, এসব আপনাদের ব্যাপার আপা। আমার কিছু বলা কি ঠিক হবে?
তোরা বাপেরবাড়ির সম্পত্তি থেকে পরীকে ভাগ দিলি না?
শওকতদের দেশের বাড়ি যশোর। পৈত্রিক জমিজমা বিক্রি করে গত মাসে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েছে। শওকতরা এক বোন, দুই ভাই। ছোট বোন পরীকে কিছু টাকা দিয়েছে। সে বলল,একটাই বোন। আদরের …
আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? আমরা নেকস্ট উইকে রায়পুরা যাচ্ছি। তুই তানজিনা কে ছাড়বি তো?
ওর ইচ্ছে হলে যাবে। শওকত বলল। তারও ইচ্ছে তানজিনা ওর ভাগের টাকা পাক।
তুই যাবি রায়পুরা?
আমি বরং না যাই।
ঠিক আছে। কাল শুক্রবার। আমি আর তোর দুলাভাই কাল সুলতানগঞ্জ আসছি।
ঠিক আছে। আসুন।
এখন রাখছি তাহলে।
ঠিক আছে।
চাঁদপিরের গলির মুখে মধু ঘোষের মিষ্টির দোকান। রাইসার জন্য আধ কে জি বুন্দিয়া কিনল শওকত। মেয়েটা বুন্দিয়া খেতে ভালোবাসে। তানজিনারও এই জিনিসটা পছন্দ। গলির মুখে অস্থায়ী বাজার বসেছে। টমাটো, লেবু, ধনেপাতা, আর একটা মাঝারি সাইজের লাউ কিনল শওকত। তারপর বাজার নিয়ে বাড়ির সামনে চলে আসে। ট্রেনের হুইশেলের শব্দ শুনল। স্টেশন কাছেই।
দোতলার সিঁড়িতে ওঠার সময় ধূপের গন্ধ পেল। কে ধূপ জ্বালিয়েছে? তানজিনা?
দরজা তানজিনাই খুলল। ওর মুখ কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছে।
কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে? তরিতরকারি ভর্তি প্লাস্টিকের ব্যাগটা দিতে দিতে জিগ্যেস করল শওকত।
বলছি। তুমি বারান্দায় গিয়ে বসো।আমি চা নিয়ে আসছি।
টেবিলের ওপর বুন্দিয়ার প্যাকেট রেখে শওকত জিগ্যেস করল, রাইসা কোথায়?
ও ঘুমাচ্ছে।
ঘুমাচ্ছে? এখন?
এসে সব বলছি। বলে তানজিনা রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
শওকত কাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে গায়ে বারান্দায় বসে। শেষবেলার রোদ মিলিয়ে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ফুটে উঠছে। বাগানের গালপালায় অল্প রোদ লেগে আছে। কাকপাখিরা তারস্বরে চিৎকার করছিল। অক্টোবরের শেষ। এই সময়ে মফস্বলেবেশ কুয়াশা পড়ে। সন্ধ্যার পরপরইদূরের গ্রাম থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!