ধর্মের খাবার

ক্ষুধার্ত ছেলেটি একলা রাস্তায় হাঁটছে । খিদের জ্বালায় চোখের সামনে মাঝে মাঝে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে , ভিড়ের পিছনে চলতে চলতে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল ,জায়গা টা সে চেনে না , কেউ তাড়িয়ে দেবার আগের সময়টুকু যদি জিড়িয়ে নেওয়া যায় ।
হঠাৎ একজন তার সামনে একটা শালপাতা রেখে দিয়ে গেল , কিছু বোঝার আগেই আরেকজন ভদ্রলোক সামনে রাখা শালপাতায় ভাতের হাতা কাত করার চেষ্টা করতেই ছেলেটি অস্ফুটে বাঁধা দিয়ে বলল , “আমাকে দেবেন না ! ধর্মের খাবারে আমার অধিকার নেই , মিথ্যাচারের বিনিময়ে লাথি সহ্যের ক্ষমতাও এই মুহুর্তে আমার শরীর হারিয়েছে । “
ভদ্রলোক হেসে বললেন : তোমার বুঝি খিদে নেই ?
ছেলেটি : আমি জানি না আমার জাত কি , ধর্মের নাম ও অজানা , কোনো অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব আছে বলেও কখনো মালুম হয়নি , তাই বিশ্বাসের প্রশ্ন অবান্তর ।
ভদ্রলোক : আমার প্রশ্নটা বোধহয় তুমি ঠিক করে শুনতে পাওনি , বলছি এত বেলাতেও তোমার খিদে পায়নি ?
ছেলেটি : আর কিছুক্ষণ না খেলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাব কিন্তু …
ভদ্রলোক : তাহলে আর দেরী না করে চটপট খেয়ে নাও । আর একটা কথা , এখানে খাবার জন্যে খিদে থাকাই যথেষ্ঠ ।
খাবারের প্রথম গ্রাস মুখে দিয়ে ছেলেটির কানে স্মৃ তির কথাগুলো আবার বেজে উঠলো ….”তোর নাম কি রে ছোকড়া ? দেখে তো মনে হচ্ছে মুসলিমের বাচ্চা ! ….এই সোমনাথ ! কয়েকটা লাথি ঘুষি মেরে ব্যাটাকে ছেড়ে দে এবার ,আবার কোনদিন মন্দিরে চত্তরে ঘুরঘুর করতে দেখলে হাত পা ভেঙ্গে দিবি ! “
” সালাম আলাইকুম বলতে জানে না শুধু গান্ডে পিন্ডে গেলার জন্য মুসলিম সাজার সখ ! পেদিয়ে ধুনে দে ওটাকে , আলহার বান্দারা ধর্মের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার সহ্য করে না , এই সত্যি যেন ও কোনদিন ভুলতে না পারে !”
“আরে এখানে খাবার দাবার পাওয়া যায় না তবে এই গেটের বাইরে আমার মোমবাতির ব্যবসা দারুন চলে ,ওই হাড়ি কাঠে ঝোলা লোকটার কাছে গিয়ে মোমবাতি কেন দাবানল জ্বালালেও কিছু হবার নয় , আরে যে নিজেই হাড়ি কাঠে …সে যাই হোক , এই সব কথা বলিয়ে আমার রোজের কাস্টমার না তাড়ালে তোর শান্তি নেই দেখছি ! যা ভাগ এখান থেকে !”
“শোন রে ছেলে ! কৃষ্ণ , মহম্মদ , যীশুর কথা ছাড় দেখিনি , সবাইকে দলে পাওয়ার একটাই উপায় , ‘অদৃশ্য শক্তি’ শব্দ টার প্রয়োগ , হ্যাঁ হ্যাঁ ! খাবারের প্যাকেট পাবি , আগে আমাদের নতুন ধর্মের ব্যবসার খরিদ্দার ধরে দে কটা !অফিস টাইমে শিয়ালদহ স্টেশনে দাড়িয়ে লোকের হাতে এই প্যাম্ফ্লেট গুলো ধরাবি , সে যতই ব্যস্ত থাকুক অথবা রেগে যাক ,ফ্রি তে লাড্ডু খাওয়ার মতই গালাগালি -চড় চাপড় খাওয়ার অভ্যাস নিশ্চই হয়ে গেছে এতদিনে।”
খিদের জ্বালা মেটায় ছেলেটার অবসন্ন শরীর খানিক চাঙ্গা হল । সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল , কোনো অজানা কারণে তার আশেপাশের বেশীরভাগ মানুষগুলোর মাথা কাপড়ে ঢাকা , কেউ রুমালে ঢেকেছে , কেউ শাড়িতে , কেউ বা গায়ের ওরনা দিয়ে । কিছু ছাড়া ছাড়া কথা ছেলেটির কানে ভেসে এলো , ‘রাত্রের লাঙ্গারের সময়টা জানিস তো !’ , “সত শ্রী অকাল !’ , ‘ওয়াহে গুরু ‘ , এসবের মানে বুঝতে না পেরে শালপাতার বাকি খাবারে মনোনিবেশ করলো সে । ধর্মের নাম না জেনেই পেট তার গুনগান গাইছে , প্রথমবার কেউ স্মৃতির চোখ ঢেকে বলছে , ‘ধর্ম মানে খুনখারাপি বা ধান্ধাবাজি নয় ,ধর্ম মানে ক্ষুধার্ত পেটে বিনা কৈফিয়তে ডাল ভাতের শান্তি মিছিল ।’

দুঃখিত!