জাফর ইবন সুলায়মান (রহ.) বলেন—একদিন আমি এবং মালেক ইবন দিনার (রহ.) একসঙ্গে বসরা শহরে গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে আমরা একটি আলিশান প্রাসাদের কাছে পৌঁছালাম। এর ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম, মিস্ত্রী ও অন্যান্য শ্রমিকরা কাজ করছে। প্রাসাদটির একপাশে বসে আছে অত্যন্ত সুন্দর ও সুদর্শন এক যুবক। এত সুন্দর পুরুষ আমরা আগে কখনও দেখিনি। যুবকটি প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সে মিস্ত্রী ও শ্রমিকদের নানা কাজে নির্দেশ দিচ্ছিল।
এই অবস্থা দেখে মালেক ইবন দিনার (রহ.) আমাকে বললেন, “দেখেছ লোকটিকে? কত সুন্দর চেহারা তার, আর প্রাসাদ নির্মাণে তার কী গভীর আগ্রহ! তাকে দেখে আমার খুব করুণা হচ্ছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে, তার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করি যেন আল্লাহ তাআলা তাকে নেককার বানিয়ে দেন এবং সে জান্নাতের যুবকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।”
আলাপ শেষে আমরা যুবকের কাছে গিয়ে সালাম করলাম। সে সালামের জবাব দিল বটে, কিন্তু শুরুতে মালেক (রহ.)-কে চিনতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর চিনতে পেরে তাকে যথাযোগ্য সম্মান করল এবং বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “জনাব, কী উদ্দেশ্যে আগমন?”
হযরত মালেক (রহ.) বললেন, “আমি তোমাকে এক প্রশ্ন করতে চাই। বলো তো, তুমি এই প্রাসাদ নির্মাণে কত টাকা-পয়সা ব্যয় করার ইচ্ছা করেছ?”
যুবক উত্তর দিল, “এক লাখ দিরহাম।”
তখন হযরত মালেক (রহ.) বললেন, “যদি এই সমস্ত মালামাল তুমি আমাকে দাও, আমি এগুলো এমন স্থানে ব্যয় করব, যার বিনিময়ে তুমি এর চেয়ে বহু গুণ উন্নত একটি প্রাসাদ পাবে—যার জামিন আমি নিজে হবো। শুধু প্রাসাদই নয়, এর সকল আসবাবপত্র, খাট, পালঙ্ক এবং দাস-দাসীর ব্যবস্থাও আমার জিম্মায় থাকবে। ঐ প্রাসাদে থাকবে লাল ইয়াকুতের গম্বুজ, থাকবে সুন্দর তাবু; মাটিও হবে মেশক ও জাফরানের তৈরি। সেই প্রাসাদ তোমার এই প্রাসাদ থেকে হাজার গুণে প্রশস্ত হবে। আর সেটি হবে চিরস্থায়ী, কখনও নষ্ট হবে না। সেই প্রাসাদে কোনো শ্রমিকের হাত লাগবে না; বরং আল্লাহর ‘কুন’ (হও) শব্দের মাধ্যমেই তা সৃষ্টি হবে।”
তখন যুবক বলল, “জনাব, আমাকে শুধু আজকের রাতটি সময় দিন। আগামীকাল সকালেই আপনি আবার আসবেন।”
হযরত মালেক ইবন দিনার (রহ.) বললেন, “ঠিক আছে।”
জাফর (রহ.) বলেন—মালেক ইবন দিনার (রহ.) সারা রাত সেই যুবকের কথাই ভেবে কাটিয়ে দিলেন। রাতের শেষ প্রহরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, অজু করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করলেন এবং যুবকের জন্য দো‘আ করলেন। এরপর সকাল হতেই আমরা দু’জন আবার যুবকের কাছে গেলাম।
যুবককে দেখলাম, সে প্রাসাদের দরজার সামনে বসে আছে। মালেক (রহ.)-কে দেখেই সে খুশি হয়ে বলল, “জনাব, গতকালের প্রতিশ্রুতি স্মরণ আছে তো?”
মালেক (রহ.) বললেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে। তাহলে বলো, তুমি কি আমার কথায় রাজি হয়েছ?”
যুবক বলল, “অবশ্যই রাজি হয়েছি।”
এ কথা বলেই সে শ্রমিকদের ডাক দিল, যেন তারা সমস্ত ধন-সম্পদ একত্র করে আনে। শ্রমিকরা এসে সব মালামাল এনে তার সামনে রাখল। এরপর যুবক কলম ও কাগজ আনিয়ে চুক্তিনামা লিখল, যা ছিল এভাবে—
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
এই চুক্তিনামাটি এই উদ্দেশ্যে লেখা হলো যে, মালেক ইবন দিনার অমুকের পুত্র অমুকের জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে এমন এক প্রাসাদের জামিন হয়েছেন, যা তিনি আল্লাহর জন্য দান করেছেন। আর যদি ঐ প্রাসাদ থেকে অতিরিক্ত কোনো অনুগ্রহ হয়, তা হবে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। এই ধনসম্পদের বিনিময়ে জান্নাতে একটি প্রাসাদ ক্রয় করা হলো, যা হবে এর চেয়ে অনেক প্রশস্ত, চিরস্থায়ী, এবং আল্লাহর নিকট মর্যাদাপূর্ণ।
চুক্তিনামা লেখা শেষ হলে তা যুবকের হাতে প্রদান করা হলো, এবং সব মালামাল মালেক (রহ.)-এর নিকট হস্তান্তর করা হলো। মালেক ইবন দিনার (রহ.) সারা দিন সেই সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করলেন — দরিদ্র, মিসকিন ও অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিলি-বণ্টন করলেন। সন্ধ্যা নাগাদ তার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না, শুধু সেই রাতটুকু ছিল তার বিশ্রামের জন্য।
চল্লিশ দিনও পার হয়নি, একদিন মালেক ইবন দিনার (রহ.) ফজরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলেন। তিনি যখন মিহরাবের দিকে তাকালেন, তখন দেখলেন — যুবকের সাথে করা সেই চুক্তিনামাটি পড়ে আছে। কৌতূহলবশত তিনি সেটি উল্টে দেখলেন, এবং অবাক হয়ে দেখলেন অপর পাশে লেখা আছে—
“এটি মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মালেক ইবন দিনারের জন্য ফরমান ও পাপমোচনের সনদ।
তুমি যে প্রাসাদের জামিন আমার উপর রেখেছিলে, আমি তা ঐ যুবককে প্রদান করেছি। আমি তাকে এর সত্তর ভাগেরও বেশি অংশ দান করেছি।”
এই লেখা দেখে মালেক ইবন দিনার (রহ.) বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি সেই চুক্তিনামাটি হাতে নিয়ে যুবকের বাসায় গেলেন। সেখানে পৌঁছে কান্নার শব্দ শুনলেন। বুঝতে পারলেন, যুবক ইন্তেকাল করেছে।
তিনি গোসলদাতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি তাকে গোসল দিয়েছ?”
গোসলদাতা উত্তর দিল, “হ্যাঁ, দিয়েছি।”
মালেক (রহ.) বললেন, “তার মৃত্যু কিভাবে হলো, আমাকে বলো।”
গোসলদাতা বলল, “মৃত্যুর পূর্বে সে আমাকে বলেছিল—‘আমার মৃত্যুর পর তুমি আমাকে গোসল দিবে। এরপর এই লেখা কাগজটি আমার কাফনের ভেতরে রেখে আমাকে দাফন করবে।’”
তখন মালেক (রহ.) সেই কাগজটি বের করে দেখালেন। গোসলদাতা একে দেখেই বলল, “আল্লাহর কসম! এটাই সেই কাগজ, যা আমি তার কাফনের ভিতর রেখেছিলাম।”
এরপর মালেক ইবন দিনার (রহ.) আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাই করেন। সব কিছুই তাঁর কুদরতের মধ্যে।”
এরপর থেকে যখনই তিনি সেই যুবকের কথা স্মরণ করতেন, তখন অশ্রুসিক্ত হতেন এবং তার জন্য দো‘আ করতেন।
জীবিত থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদ
কোন এক ব্যক্তি বললেন, “একজন বুযুর্গ আমাকে বলেছিলেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম—এক ব্যক্তি আমাকে বলছে, ‘আমি তোমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেছি, যা দেখলে তোমার নয়ন শীতল হবে।’ এক সপ্তাহ পরপর আমি সেই ঘরটি পরিষ্কার করার নির্দেশ পেলাম। ঘরটির নাম দেওয়া হয়েছে দারুসসুরুর, যার অর্থ—‘শান্তির ঘর’। তাই তুমি খুশি হয়ে যাও, কারণ এটি তোমার জান্নাতের ঘর।”
বর্ণনাকারী বলেন, সপ্তম দিন যখন এলো, দিনটি ছিল জুমআ বার। লোকটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঝর্ণায় গেল ওযু করার জন্য। সেখান থেকে সে পা ফসকে ঝর্ণায় পড়ে মারা গেল। নামাযান্তে আমি তাকে ঝর্ণা থেকে বের করে দাফন-কাফন সম্পন্ন করলাম।
তিন দিন পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখলাম, সে সবুজ রেশমি পোশাক পরিহিত অবস্থায় আছে। আমি তার অবস্থা জানতে চাইলাম। সে বলল, “আল্লাহ তাআলা আমাকে দারুসসুরুরে স্থান দিয়েছেন, যা আমার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।”
আমি তাকে বললাম, “স্থানটি কেমন? কিছু বলো।”
সে বলল, “আফসোস! এর সৌন্দর্য ও প্রশান্তির বর্ণনা আমি দিতে পারব না। সম্ভবত আমার পরিবার-পরিজনের জন্যও এর নিকটে আরেকটি প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছে। এখানে সকল রকম আরাম-আয়েশের উপকরণ বিদ্যমান। আমার ভাইদের জন্যও একইরকম হবে। তুমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত।”
এমন একটি স্থান যা বিরান হবে না এবং যার মালিকও মরবে না
প্রাচীনকালে এক বাদশাহ একটি শহর আবাদ করেন। শহরটি অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত করে নির্মাণ করেন এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। এরপর বাদশাহ প্রজাদের জন্য ভোজের আয়োজন করলেন। দরজায় কিছু প্রহরী বসিয়ে দিলেন যেন যারা ভোজ শেষে বের হয়, তাদের জিজ্ঞেস করা হয়— “এই স্থানে কোনো ত্রুটি দেখলে বলো।”
সবাই একবাক্যে বলল, “না, কোনো ত্রুটি নেই।”
শেষে কিছু দরবেশ লোক কম্বল জড়িয়ে এলো। তাদের কাছেও একই প্রশ্ন করা হলো। তারা বলল, “এর মধ্যে দুটি ত্রুটি আছে।”
প্রহরীরা বিষয়টি বাদশাহকে জানালে তিনি বললেন, “আমি একটি ত্রুটিও বরদাশত করি না; তাদের সামনে আনো।”
যখন তাদের আনা হলো, বাদশাহ জিজ্ঞেস করলেন, “ত্রুটি দুটি কী?”
তারা বলল, “এ স্থানটি একদিন বিরানভূমিতে পরিণত হবে এবং এর মালিক মারা যাবে।”
বাদশাহ জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি এমন কোনো জায়গার কথা জানো যা কখনও বিরান হবে না এবং যার মালিক মারা যাবে না?”
তারা বলল, “হ্যাঁ, আছে — জান্নাত।”
তারা জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা এবং জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির কথা বর্ণনা করল। বাদশাহ চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি রাজ্য ও বাদশাহি ত্যাগ করে জঙ্গলে চলে গেলেন এবং আল্লাহর কাছে তওবা করলেন।
এক হুর এবং তার অতি সুন্দর দাসী
শায়খ আব্দুল ওয়াহিদ ইবন যায়েদ (রহঃ) বলেন—
একদিন আমি জিহাদের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিলাম। আমি আমার সাথীদের বললাম, “জিহাদের ফজিলত বর্ণনার জন্য প্রত্যেকে দুটি করে আয়াত পাঠ করবে।”
তখন একজন পাঠ করল—
“আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জান ও মালের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করেছেন।”
— (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ১১১)
এই আয়াত শ্রবণ করল এক কিশোর, বয়স চৌদ্দ বা পনের বছর, যার পিতা বিপুল ধনসম্পদ রেখে মারা গিয়েছিলেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“হে আব্দুল ওয়াহিদ, আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জান ও মালের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করেছেন। আমি আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আমার জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দিলাম।”
আমি বললাম, “বাছা, ভালো করে ভেবে কথা বলো। তরবারির ধার খুবই ভয়ঙ্কর। তুমি হয়তো ধৈর্য রাখতে পারবে না, দুর্বল হয়ে পড়বে।”
বালকটি বলল, “হে শায়খ! আমি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করব, আর দুর্বল হয়ে যাবো— তা কি হয়? আমি আল্লাহ তাআলাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আমার সমস্ত সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দিলাম।”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।