আরিফ জানালার কাছে বসে একটা বইতে বৃথা মনযোগ দেবার চেষ্টা করছে। সামনে এইচ,এসসি পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষাটা শেষ পর্যন্ত দেয়া হবে কিনা সে জানেনা। চারিদিকে শুধু মিছিল আর দাবি আদায়ের কোলাহল। বাঙ্গালী জাতি বায়ান্নতে সশব্দে সমস্ত রাজপথ রাঙ্গিয়ে তুলেছিল নিজেদের আত্মপরিচয়ে পরিচিত হবার জন্য। সেই আন্দোলনে শুধু বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিই ছিলনা, সেই সঙ্গে ছিল শ্রমের ন্যায্য পাওনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে উপেক্ষা না করার দাবি। আর এর জন্য অগ্নিঝরা বাক্যে, বিবৃতিতে, স্লোগানে আর মিছিলে মিছিলে মুখরিত হয়ে উঠে বাংলার পথঘাট। সেই আন্দোলন থেকে ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সাহস সঞ্চয় করে দেশ মুক্ত হয় হানাদার বাহিনী থেকে। কিন্তু আজ এই ৫৬বছর পরেও আরিফ ভেবে পায়না, যে দেশ ও জাতি আজ মুক্ত স্বাধীন , যে অনাধিকার ও শোষিত জীবন থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য ৩০লক্ষ শহীদ আর ২লক্ষ মা , বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের এই বাংলাদেশ পাওয়া। যে দেশে এখন আর নেই কোন বাইরের শাষন। সে দেশে কেন এখন মানুষের এত কষ্ট? কেন এত দাবি, এত আন্দোলন? আসলে আরিফ মানতে চায়না কেন এত ভাইবোনের আত্মত্যাগের পরেও দেশের এই করুণ পরিণতি। ওর বাবা মায়ের অনেক স্বপ্ন ওকে নিয়ে। সে ডাক্তার হবে, বিদেশে যাবে ডিগ্রি নিতে। কিন্তু সে যেতে চায়না। আরিফ এই দেশে থাকতে চায়, মায়ের কোলে প্রিয় দেশটার মাটি আকড়ে বেঁচে থাকতে চায়। ওর বড় আপু দেশের বাইরে থাকে। সে বলে-
“আরিফ শোন ভাল করি পড়াশুনা করিস, যেন স্টূডেন্ট ভিসা পাইতে সুবিধা হয় ,যত টাকা লাগে আমি দেব। টাকার চিন্তা করবি না বুঝলি…পড়াশুনা এই দেশে হবে না আর এদেশের যে অবস্থা। মানুষের জন্য মানুষের কোন দয়া মায়া নেই, তুই যেভাবে হোক আমার এখানে চলে আসবি বুঝলি “।
আরিফ-কি যে বল না আপু ! এ দেশে কি মানুষ নেই? দু একজনের জন্য সবাইকে এক কাতারে দাড় করানো ঠিক না।
আপু-“শোন আমি এতো কিছু বুঝি না ! আমি যেহেতু বিদেশে আছি, তোর একটা সুযোগ আছে বাইরে এসে পড়াশুনা করবার। মুখে মুখে তর্ক করিস না। যা বলি তাই করিস”
আরিফ মনে মনে হাসে। ওর আপুটা অনেক বোকা, আরে এখন আমাদের দেশেই বিদেশ থেকে মানুষ আসে পড়তে আর আমি দেশ ছেড়ে, মাকে ছেড়ে যাব বিদেশ ! কি আজব চিন্তা। আরিফ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে রেজাল্ট যাই হোক সে কোথাও যাবে না মাকে ছেড়ে। মাকে রেখে সে একদিনও কোথাও থাকতে পারবে না। কথাটা মনে হতেই চোখ ভিজে আসে আরিফের।
বাইরে থেকে মিছিলের শব্দ আসছে।”আমাদের দাবি আমাদের দাবি মানতে হবে মানতে হবে…স্বৈরাচার নিপাত যাক গনতন্ত্র মুক্তি পাক” ও উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাড়াল। মিছিলটা দেখতে ভালই লাগছে। মিছিল না করলে আন্দোলন না হলে কেউ দাবি মানে না। সে জানে নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হয় কিন্তু এর শেষ কোথায়? এর জন্য কত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। এটাই আরিফের ভাললাগে না। সেই ৭১ এর পর থেকে শুধু আন্দোলন হচ্ছে কিন্তু দেশের তো তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। পরের দিন সংবাদ পত্রে বড়বড় করে খবর বের হল “গতকাল একটি মিছিলে পুলিশ লাঠি চালিয়ে ও কাঁদানে গ্যাস ছেড়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এতে শিশুসহ ৩জন নিহত এবং শতাধিক আহত” আরিফ বোঝেনা কেন এমন হয়। কেন এই শিশুটি মারা গেল? সেকি মিছিলে কোন দাবি নিয়ে গিয়েছিল? ওর মনটা হু হু করে কেঁদে উঠে এক অজানা শিশুর জন্য। কাগজের পিছনের পাতায় চোঁখ পড়তেই মেজাজ বিগড়ে গেল –ধ্যাৎ শেষ পর্যন্ত পরিক্ষাটা পিছিয়ে দিল। পরবর্তি তারিখ পরে জানানো হবে। কেউ ছাত্রদের কথা ভাবে না কেন? কেন বুঝে না এই বিলম্বের জন্য পড়াশুনার কতটা ক্ষতি হল এক একজন ছাত্রের, আরিফের কান্না পাচ্ছে। সারা বছর কি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে সে , ভাল রেজাল্ট করবার জন্য। ওর কত আশা ওর মায়ের আশা পুরন করবে।এই দেশের মাটিতে মাথা উচুঁকরে ওর আপুকে, সারা দেশের মানুষকে দেখিয়ে দেবে, মানুষ চেষ্টা করলে, ইচ্ছা করলে সব অসাধ্য সাধন করতে পারে। মানুষের পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব যদি সে নিষ্ঠা দিয়ে, শ্রম দিয়ে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে থাকে। কিন্তু তা আর বোধ হয় সম্ভব হবে না, দেশের এমন নাজুক পরিস্হিতির জন্য। মানুষ মারা যেন এখন কোন ব্যাপার না। একটা ছোট্ট বাচ্চা………।আরিফ আর ভাবতে পারছে না।
১৫ দিন হয়ে গেছে আরিফ বইয়ের সামনে বসে থাকে কিন্তু পড়ায় মন বসছে না। এই কারফিউ, এই হরতাল, এই ভাংচুর , জ্বালাও ,পুড়াও। কার সম্পদ এরা এভাবে ধ্বংস করছে? আরিফ বাইরে যেতেও ভয় পায়। যদি কোন বোমা এসে পড়ে অথবা ………না এভাবে বেঁচে থাকা যায়না।সে বাইরে যেতে চায়। মন খুলে হাসতে চায়। মুক্ত পাখির মত ঘুরে বেড়াতে চায়। বাবা মা একরকম বন্দি করে রেখেছে ঘরে। তাদের ভয় বাইরে গেলে বোধহয় কিছু একটা হয়ে যাবে। বাবা যতক্ষন বাইরে থেকে না আসে মা শুধু দোয়া পড়তে থাকেন। একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ চারিদিকে।
আরিফ ছাঁদে দাঁড়িয়ে সামনের বস্তির দিকে তাকাল। হরতাল তাই রাস্তায় মানুষ জন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। রিক্সা দোকানপাট সব বন্ধ। সামনের বস্তিতে সে দেখে একজন মহিলাকে একজন পুরুষ লোক মারছে আর বলছে-
—“ঐ মাতারী তোর এত বারবারছে কেন ! তুই জানস্ না ! রিস্কা না চালালি টাকা পামু কই ! বাজার করুম কি দিয়া, বান্দির বাচ্চা”
—“হের আমি কি জানি ! পোলামাইয়া তো খাওন আমার কাছে চায়, তর কাছে কি চায় ?”কথা শেষ হতে পারেনা লোকটা আবার মহিলাকে মারতে থাকে। যেন হরতালের জন্য মহিলা দায়ী। আরিফ চেয়ে দেখে ছোট দুটো বাচ্চা ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে। ওর ভাল লাগে না। ও ভাবে যখন বড় হবে তখন এসব গরীবদের জন্য নিজে কিছু করবে। সব কষ্ট দূর করে দিবে আর তা করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের জনগনকে জনশক্তিতে পরিনত করা। প্রতিটা ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌছে দিতে হবে। অনেক কিছু করতে হবে কিন্ত কিভাবে সে জানে না। নিজেই আবার আপন মনে বলে সে বড় হলে নিশ্চয় একটা পথ বের করতে পারবে। আজ এত বছর পরেও আরিফ যেন সেই বাহান্ন এর আন্দোলনের আস্বাদ পেয়ে যাচ্ছে, তবে নিজেদের দেশের সম্পদ ভাংচুর , পোড়ান এই রকম ক্ষতি ওর ভাল লাগে না মেনে নিতে কষ্ট হয়।
একটা মিছিল, এটাই যেন দেশের শেষ মিছিল মানুষের অধিকার আদায়ের।
আরিফের সাথে সাথে হাত উচুঁ করে জোর গলাতে সবাই বলতে লাগল “আমাদের অধিকার দিতে হবে দিতে হবে,শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না দেবনা ! সোনার বাংলা গড়ে তুলব, মায়ের হাসি ফিরিয়ে আনব আর কোন ভাইবোনের রক্তে রাঙ্গাবনা মায়ের কোল।সব কষ্টের অবসান হবে আজকের পরথেকে আমি হব সেই নির্দেশক, আরিফের সাথে সারা দেশের মানুষ , সবার মুখে একই স্লোগান”। ঘুম ভাংতেই এক নতুন আরিফের জন্ম হয়। সে প্রতিজ্ঞা করে যে কারনে আজ আমরা হারিয়েছি জাতীর জনক সহ আরো গর্বিত চার নেতা। তাদের ও সব ভাইবোনের রক্তের ঋন শোধ করবার এটাই সময়। তাদের স্বপ্ন আমি আরিফ বাস্তবায়ন করবই, কথাগুলো ভাবতেই এক অজানা শক্তি সে সঞ্চয় করে আর তাই পড়ার টেবিলে বসে একাগ্রচিত্তে বইয়ের মাঝে ডুবে যায়-নতুন এক সুর্যের আশায় !!!!
আশাবাদি আমি………………।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।