দ্বিতীয় নবাবের অভিলাষ—- রফিকুর রশীদ

আমাদের নবাব চাচা যে একেবারে শেষবেলায়, নাটক মঞ্চায়নেরও শেষ প্রান্তে এসে এরকম নাটকীয় একটা ঘটনা ঘটিয়ে বসতে পারে, সে কথা আমরা আগে কেউ ভাবতেই পারিনি। নিয়মিত রিহার্সেলে এলে হয়তো তার আচার-আচরণের মধ্যে কোনো রকম অসঙ্গতি কারও না কারও নজরে পড়ত, সময় থাকতে সাবধান হওয়া যেত অথবা বিকল্প একটা কিছু ভাবা যেত। কিন্তু না, সে সুযোগ আমরা পাইনি। আগে নবাব চাচার অভিনয় আমরা দেখিনি বললেই চলে, তবে তার নাট্যপ্রতিভার বিস্তর প্রশংসা শুনেছি এলাকার বহু মানুষের কাছে। সিনেমার পর্দায় আনোয়ার হোসেনের অভিনয় যারা দেখার সুযোগ পেয়েছে, তাদের মধ্যেও অনেকেই অকুণ্ঠভাবে ঘোষণা করে- সিরাজুদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয়ের প্রশ্নে আমাদের নবাব হচ্ছে আনোয়ার হোসেনের কার্বনকপি। সেই অগ্নিগোলক দুই চোখ, প্রশস্ত ললাট, সেই ব্যাকব্রাশ চুল- মিলিয়ে নিতে চাইলে একে একে সবকিছুতেই মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। মঞ্চে নবাব চাচার অভিনয় যারা দেখেছে তাদের চোখে নবাব সিরাজুদ্দৌলা, আনোয়ার হোসেন এবং এই পলাশপাড়া হাইস্কুলের নৈশপ্রহরী নবাব আলী মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আমরা এ প্রজন্মে তরুণেরা প্রায় বার্ধক্যে উপনীত নবাব চাচার মধ্যে এতসব সাদৃশ্য যথাযথভাবে দেখতে পাইনি বলে সিনিয়রদের কাছে তিরস্কৃত হয়েছি- দ্যাখার জন্য অন্তরের দৃষ্টি লাগে, তোরা কোথায় পাবি এসব! নবাব হচ্ছে জিনিয়াস।

তা আমরা কেমন করে জানব নবাব চাচার নাট্যপ্রতিভার খবর। আমাদের এই পলাশপাড়ায় স্কুল-কলেজ সবই হয়েছে, লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। নাটক-যাত্রার মঞ্চায়ন তো হতে দেখিনি। অথচ গল্প শোনা যায়- এই গ্রামের জমিদার বাড়িতে নাকি নাটমন্দির ছিল, যাত্রা নাটকের সঙ্গে শাস্ত্রীয় নৃত্যেরও আয়োজন হতো, নদীতে বজরা ভাসিয়ে লক্ষ্ণৌ থেকে বাঈজিও আনা হতো! এসব সেই কবেকার কথা। জমিদারবাড়ির ভগ্নাবশেষ এখনও দাঁড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু কোথায় নাটমন্দির। স্বাধীনতার পর হেডমাস্টার ইন্দুভূষণ বাবুর নেতৃত্বে এবং আগ্রহে পলাশপাড়া নবনাট্য সংঘ
নামে একটি প্রতিষ্ঠান বেশ কবছর চলেছিল মহাসমারোহে। নবাব আলী সেই নাট্যচর্চারই সুবর্ণ ফসল। লোকে বলে- ইন্দুবাবুর হাতে গড়া পুতুল।

 
ইন্দুবাবুর সাক্ষাৎ শিষ্য নবাব আলীকে নাটকের রিহার্সেলে নিয়মিত আসার কথাটা বলবে কে? সে থাকে তার আপন জগতে। বাড়িতে একটা দুধেল গাইগরু আছে। সেই গরুর গলায় দড়ি ধরে স্কুল-কম্পাউন্ডের চতুর্দিকে সারা বিকেলে চরানোর পর একেবারে সন্ধ্যায় মুখে তাকে খোঁয়াড়ে তুলে রেখে সে স্কুলে চলে আসে নাইট ডিউটিতে। ইন্দুবাবুর হেডমাস্টারি-জীবনের শেষবেলায় নবাব আলীকে এই নাইট গার্ডের চাকরি দিয়ে যান। নাটক-যাত্রার নেশায় পড়ে ততদিনে পৈতৃক সামান্য জমিজিরেত হারিয়ে তার পথে বসার দশা। গলার রগ কাঁপিয়ে যাত্রার ডায়ালগ টানটান করে উচ্চারণ করা ছাড়া সংসার-রাজ্যের আর কোনো কাজই ঠিকমতো শেখা হয়নি। কী করবে সে। কোলে বাচ্চাসহ বউটাকে হেডমাস্টারের বাড়িতে গছিয়ে দিয়ে মাঝে মধ্যেই পলাশপাড়া ছেড়ে উধাও হয়ে যায়। ফিরে আসে তিন-চার মাস পর। কোথায় যায় কী করে- কারও কাছে মুখ খোলে না। ইন্দুবাবু বহু তত্ত্বতালাশ করে আবিষ্কার করেন, নবাব আলী ফরিদপুরের এক যাত্রাদলে মৌসুমি চাকরি নিয়েছে। নবাব সিরাজুদ্দৌলা ছাড়াও টিপু সুলতান, শাহজাহান প্রভৃতি ঐতিহাসিক পালায় সে অভিনয় করে। এটাই চাকরি। কিন্তু তার মেয়াদ ওই মাস তিনেকের বেশি নয়। বছরের বাকি সময় সে কী করবে, সংসার চলবে কেমন করে? হেডস্যারের চোখের সামনে ফ্যা ফ্যা করে ঘোরে, বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরাজকণ্ঠে মা ডেকে গিন্নিমাকে পটায়, টুকিটাকি ফাইফরমাশ খাটে। এসব কাণ্ডকীর্তি দেখে বউটা তখন অভিমান করে বাপের বাড়ি চলে যায়। নবাব আলী নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে হাসে আর বলে- ক্যানে, উডা কি তুমার বাপের বাড়ি না?
সবকিছু দেখেশুনে হেডমাস্টার ইন্দুভূষণ বাবু নবাব আলীকে তার স্কুলের নাইট গার্ডের চাকরি দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাপের কাজই করেন। সেই থেকে সে পায়ের তলে মাটি খুঁজে পায়, নিজের পায়ে থিতু হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। নবাব তার প্রকৃত নাম নয়, এ কথা গ্রামের সবাই এক প্রকার ভুলেই গেছে। নবাব সিরাজুদ্দৌলার চরিত্রে অভিনয়-কুশলতার স্বীকৃতি হিসেবে পিতৃদত্ত নাম ছাপিয়ে নবাব পরিচয়টা ততদিনে বেশ দাঁড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আছে নবাবি স্বভাব। হেডস্যারও চাকরি দেয়ার সময় তার অর্জিত পরিচয়কে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করেন। কাগজে-কলমে নির্দিষ্ট হয়ে যায় নবাব আলীর নাম। স্কুলের খাতায়, ভোটার লিস্টে সর্বত্রই নবাব আলী।
বহু দিন পর নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাবে নবাব আলী প্রথমে চমকে ওঠে। চোখ গোল গোল করে তাকায় সবার মুখে মুখে। চিনতে চেষ্টা করে, এরা কারা? এরা কি এই জনপদেরই সন্তান! এদের মাথায় কে ঢোকালো নাটকের পোকা! ছেলেরা কোনো রাখঢাক না করে সোজাসুজি জানায়- কলেজপড়ুয়া কয়েকজন বন্ধু মিলে এবারের স্বাধীনতা দিবসে নাটক মঞ্চায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারপর ক্লাসে নাটক পড়ান যে আতাহার স্যার, তার কাছে গিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা বলতেই তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন এবং ছেলেদের ঠেলে পাঠান নবাব আলীর কাছে। তারা দাবি জানায়, নবাবের রোলটা আপনাকেই করতে হবে চাচা।

 
নবাব আলীর চোখে মুখে বিস্ময়,
তার মানে তোমরা বই নামাবা সিরাজুদ্দৌলা?
দু-তিনজন একসঙ্গে বলে ওঠে,
হ্যাঁ চাচা, সেই জন্যই তো আপনাকে…
না না আমার বয়স হয়েছে। আর কতদিন নবাব চরিত্রে অভিনয় করব? আতাহার স্যার যে আপনার কথা বললেন। আপনাকে আমরা… শেষে ছেলেদের দাবি মানতেই হয়। নবাব আলীর বুকের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা বাংলার শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলা আড়ামোড়া ভেঙে জেগে ওঠে, সম্মতি জানায়। এভাবেই দীর্ঘদিনের ব্যবধানে আবারও তার নাটকে জড়িয়ে পড়া। কিন্তু রিহার্সেলে অংশগ্রহণ নিয়ে দেখা দেয় সংকট। রিহার্সেল হবে কলেজের কমনরুমে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর। নবাব আলী তখন স্কুল ফেলে যাবে কেমন করে। তার ডিউটিও শুরু সন্ধ্যা থেকেই। তাহলে উপায়! আতাহার স্যার এ সংকটের কথা শুনে হাঁ হাঁ করে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উড়িয়ে দেন। আঙুলের ডগায় তুড়ি বাজিয়ে আমাদের ধমকে ওঠেন- তোমরা চেনো নবাব আলীকে? কতটুকু জানো?
আমাদের মুখে কথা নেই। স্যারের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। হাসির লাগাম টেনে স্যার আমাদের অবাক করা তথ্য জানান- গোটা সিরাজুদ্দৌলা বইটাই নাকি নবাব আলীর মুখস্থ। সিরাজ, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, মোহনলাল, মীর মদন, ঘসেটি বেগম, লুৎফা, লর্ড ক্লাইভ- সবার সংলাপ সে একক কণ্ঠে গড়গড় করে বলে যেতে পারে। নতুন করে কি রিহার্সেলের দরকার আছে তার? আমরা সবাই একযোগে ঘাড়-মাথা দোলাই। স্যার কী ভেবে নিজে থেকেই ঘোষণা দেন- হ্যাঁ, তাকে আমরা ধরে আনব স্টেজ রিহার্সেলের দিন। তখন দেখো সিরাজুদ্দৌলা কাকে বলে।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে নবাব আলীর রিহার্সেল না লাগলেও অন্যান্য চরিত্রের অভিনয় ফুটিয়ে তোলার জন্য রিহার্সেলের সময় সিরাজুদ্দৌলা চরিত্রে একজনের প্রক্সি দেয়া জরুরি প্রয়োজন হয়ে ওঠে। সেখানেও এগিয়ে আসেন আতাহার স্যার, প্রতিটি রিহার্সেলে তিনি নির্বিকার চিত্তে নবাবের ভূমিকায় প্রক্সি দিয়ে যান, প্রতিটি চরিত্রের ডায়ালগ থ্রোয়িং, ক্যাচিং, মঞ্চে কার কোথায় অবস্থান- সবকিছু ধীরে ধীরে শিখিয়ে দেন। এই পলাশপাড়ায় কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দশ-বারো বছর ধরে ক্লাসরুমের মধ্যে নাটক পড়িয়ে এসেছেন সিলেবাস শেষ করার তাগিদে, কিন্তু আতাহার স্যার নিজে থেকে কলেজে কিংবা কলেজের বাইরে নাটক মঞ্চায়নের কোনো উদ্যোগ কখনও নেননি। আমাদের আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর সেই মানুষটাই যেন আমূল বদলে গেলেন। দিন যত ঘনিয়ে আসে, উৎসাহ তার ততই বৃদ্ধি পায়। মঞ্চসজ্জা, লাইট, সাউন্ড, মেকআপ, ড্রেসআপ- সবদিকে তার টনটনে খেয়াল। নিজে কোনো চরিত্রে অভিনয় করবেন না, অথচ সবার সঙ্গেই আছেন। একেবারে স্টেজ, রিহার্সেলের দিন নিজে গিয়ে নবাব আলীকে রিকশায় উঠিয়ে নিয়ে আসেন। শিল্পীর সম্মান বলে কথা।
সত্যি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই- নবাব চাচার অভিনয় আমরা আগে তো কখনও দেখিনি। নানান জনের কাছে নানা গালগল্প শুনেছি। এদিকে আমাদের আতাহার স্যার তো আছেনই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাব্বা, জীবিত থাকতেই মানুষ যে এমন কিংবদন্তি নায়কে পরিণত হতে পারে একথা আমাদের জানা ছিল না। তার গমগমে কণ্ঠে যখন বাতাস কেঁপে কেঁপে উচ্চারিত হয় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খাঁ, দাদু, আমায় বলেছিলেন ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজদের তুমি আশ্রয় দিয়ো না… তখন সারা গায়ের লোম কাঁটা না দিয়ে পারে! পাতানো যুদ্ধের প্রহসনে সিরাজের পরাজয়ে কার না বুক ভেঙে যায়। আতাহার স্যার তো বলেই বসেন- এই মানুষটি একসময় আমাদের এ তল্লাটের মুকুটবিহীন নবাব ছিলেন, হ্যাঁ!
শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়ে আসে। এত কাছে থেকেও এতদিনে এই পাহাড় সমান উচ্চতার মানুষটিকে চিনতে পারিনি বলে ভেতরে ভেতরে আমরা খুব লজ্জিত হই। বিস্ময়েরও অবধি থাকে না- এত বড় নাটকের পুরোটাই তার মুখস্থ। বিস্ময়ের সলতে আরও খানিক উসকে দেয়ার জন্য আতাহার স্যার বলেন, শাহজাহান নাটকের ডায়ালগ শুনবে নাকি তোমরা?
আমরা হ্যাঁ বলতে না বলতেই অতিশয় সরল অন্তঃকরণের নবাব চাচা শাহজাহান নাটক থেকে পিতৃহƒদয়ের হাহাকার ছড়ানো লম্বা এক সংলাপ উচ্চারণ করতে শুরু করে। কিন্তু জাহানারা শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রগাঢ় মমতামাখানো সংলাপ। কী আশ্চর্য, ওই জাহানারাতেই আটকে যায়। একবার নয়, ভাঙা রেকর্ডের মতো বারবার ঘুরে ঘুরে ওইখানে এসে থেমে পড়ে। শেষেরবারে তো কান্নায় ভিজে আসে গলা। মুখে আর কথা সরে না। আতাহার স্যার অতি দ্রুত বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রিকশায় তুলে বিদায় দেন নবাব চাচাকে। তারপর আমাদের সামনে ব্যাখ্যা দেন- বয়স হয়েছে তো, আবেগ সামলাতে পারেননি।

 
স্যারের এই ব্যাখ্যা আমরা সহজে মেনেই নিই। আমাদের মধ্যে একমাত্র রিন্টু বাধা দেয়। তার বাড়ি নবাব চাচাদের পাড়াতেই। রিন্টুর মনের ভেতরে কী আছে কে জানে। সহসা সে প্রশ্ন করে বসে,
এই জাহানারাটা কে স্যার?
এমন প্রশ্ন শুনে অনেকেই হেসে ওঠে। স্যার কিন্তু রিন্টুর প্রশ্নের ঠিকই উত্তর দেন, জাহানারা সম্রাট শাহজাহানের কন্যা।
রিন্টু বলে, নবাব চাচারও একটা মেয়ে আছে জাহানারা নামে।
তাই নাকি!
জি স্যার। জাহানারাবুর স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে। গতকাল সে বাপের বাড়ি চলে এসেছে।
এ খবর শুনে আতাহার স্যারের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। মুখে দুবার চুক চুক করে অনুশোচনা করেন নবাব চাচার জন্য। ঘরে তার স্ত্রী দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ। একমাত্র ছেলে জব্বার হয়েছে অমানুষ। আবার মেয়েটার হল এই দুরবস্থা। তবু নাটকের কথা বললেই হল, আর তাকে পায় কে! স্যার আমাদের আশ্বস্ত করেন- ভয়ের কিছু নেই, ঠিক সময়মতো গ্রিনরুমে এসে হাজির হবে দেখো। একেবারে জাতশিল্পী যে, তার পথ আগলাবে কে!
হ্যাঁ, বাস্তবেও দেখা গেল তাই। নাটক মঞ্চায়নের দিন সবার আগে না হোক নবাব আলী যথাসময়ে হাজির সাজঘরে। চোখেমুখে মোটেই ব্যক্তিগত দুঃখ-দৈন্যের ছাপ নেই। বরং বহুদিন পর নাটকের মঞ্চে ওঠার সুযোগ পেয়েছে বলে সে যেন আনন্দে আটখানা। অকারণেই হো হো করে হেসে ওঠে। ঘনঘন চায়ের অর্ডার দেয়। মেকআপ সারা হলে আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে বারবার নিজেকে দ্যাখে। আয়নার মধ্যে মুচকি হেসে নিজের সঙ্গে রসিকতা করে- কী হে নবাব, নাটক জমবে তো!
পলাশপাড়ার নবাব আলী স্বয়ং সিরাজুদ্দৌলার চরিত্রে অভিনয় করবে, আর সেই নাটক জমবে না তা কিছুতে হয়! বয়স হয়েছে কিংবা দীর্ঘদিন অভিনয়ের অভ্যাস নেই- এসব অজুহাতের জবাবে আতাহার স্যার পরিষ্কার জানিয়ে দেন- পুরনো চাল যে ভাতে বাড়ে, দেখে নিয়ো সবাই। ওর নাম নবাব আলী, ইন্দুবাবুর রাখা নাম, হ্যাঁ!
নবাব আলী সত্যিই তার নামের মান রেখেছে। দীর্ঘ সংলাপ টানটান করে উচ্চারণের সময় তার শ্বাসকষ্ট খানিকটা ধরা পড়ে যায় ঠিকই তবু তার বুকভরা আবেগ আর চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা ছোটখাটো ত্র“টি-বিচ্যুতি পরম মমতায় ঢেকে দেয়। মঞ্চে সে ঠিকই দোর্দণ্ড দাপুটে নবাব, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ জয়ের স্মৃতি তাকে আত্মপ্রত্যয়ী করে, ঘরে বাইরে ষড়যন্ত্রের প্রাকার ভেঙে সবার মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে এবং পলাশীর প্রান্তরে নতুন করে সৈন্যসমাবেশে আগ্রহী করে, আবার আলেয়ার সামনে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে প্রেমবিহ্বল অন্য এক নবাবের ছবি। সব মিলিয়ে বেশ চলছিল আমাদের নাটক। দর্শকের চোখেমুখে মুগ্ধ আবেশ। নাটকের উত্থান-পতনের সঙ্গে তারাও একাকার। শুধু নবাব আলী বলে তো কথা নয়, তার সঙ্গে অভিনয় করতে নেমে আমাদের মতো আনাড়ি অভিনেতাদেরও সব জড়তা কেটে যায়। ফলে বহুদিন পরে হলেও পলাশপাড়ার দর্শকেরা একটি ভালো নাটক উপভোগের সুযোগ পায়। একেবারে শেষের দিকের এক দৃশ্যে আমাদের নবাব আলী সহসা বিগড়ে যায়। বেগম লুৎফাকে নিয়ে সিরাজুদ্দৌলা রাতের আঁধারে যাত্রা করবেন ভগবানগোলার পথে। এদিকে নবাব আলী কিছুতেই সিংহাসন থেকে নামতে রাজি নয়, বসে আছে অনড় হয়ে; লুৎফার আহ্বানেও যখন কাজ হচ্ছে না, তখন একান্ত বাধ্য হয়ে আমাদের আতাহার স্যারকে মঞ্চে অবতীর্ণ হতে হয়। মঞ্চে এসে নাটকীয় আবহ রক্ষা করেই তিনি ডেকে ওঠেন।
জাহাপনা!
কী আশ্চর্য, এই ডাকে নবাব যেন একটুখানি কেঁপে ওঠে। চোখের পাতা নেচে ওঠে।

 
নৌকা প্রস্তুত জাহাপনা। চলুন, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি।
সিরাজুদ্দৌলা সিংহাসনের হাতলে দুহাতে মুঠি পাকান। অব্যক্ত কী যেন বলতে চান, বলা হয় না। সিংহাসনের হাতলে ঘুষি মারেন। দুচোখে অগ্নিগোলক বিস্ফোরিত করে তাকিয়ে থাকেন। আতাহার স্যার বলেন,
আর বিলম্ব নয় জাহাপনা। চারিদিকে ওঁৎ পেতে আছে শত্রু।
কী ভেবে সিরাজুদ্দৌলা উঠে দাঁড়ান। সিংহাসনের চতুর্দিকে মৃদু পায়চারি করেন। থমকে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলে ওঠেন,
বাংলার মসনদ তাহলে অরক্ষিত পড়ে থাকবে গোলাম হোসেন?
এ নিয়ে আপনি ভাববেন না জাহাপনা! আতাহার স্যার নিজেই সংলাপ রচনা করেন, এ বড় দুঃসময়। আগে নিজেকে বাঁচান।
নিজেকে বাঁচাব! এমনই স্বার্থপর! হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন সিরাজুদ্দৌলা। সে হাসি রাতের নিস্তব্ধ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। হাসি যেন থামতেই চায় না। আতাহার স্যার সেই হাসির মধ্যেই জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে যান।
গোস্তাকি মাফ করবেন জাহাপনা। এখন এভাবে হাসারও সময় নয়। চলুন আমার সঙ্গে।
তবে কি এটা কাঁদার সময় গোলাম হোসেন?
এটা মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করার সময় জাহাপনা। আপনি আসুন আমার সঙ্গে।
ভয়ানক অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিংহাসন ত্যাগ করেন সিরাজুদ্দৌলা। মঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার আগে অশ্র“সজল চোখে চারদিকে একবার দেখে নেন, দর্শকের কৌতূহলোদ্দীপক দৃষ্টির সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন মিনিট, কী যেন বলতে চেয়েও বলা হয় না, ঠোঁটের ফাঁকে বিড়বিড় করতে করতে অবশেষে কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ধীর পায়ে নেমে আসেন মঞ্চ থেকে। অভিনয় শেষে মঞ্চ ত্যাগের সময় শিল্পীদের পায়ে যে গতি থাকে, আমাদের নবাব আলী সেই গতি যেন সবার অলক্ষে কখন হারিয়ে ফেলেছে। বিধ্বস্ত শরীরে টলতে টলতে গ্রিনরুমে এসে হাতলভাঙা পুরনো চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়ে। আতাহার স্যার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন।
কী হয়েছে নবাবভাই, আপনার শরীর খারাপ করছে?
নবাব আলী নিরুত্তর।
ক্ষিধে পেয়েছে? খাবেন কিছু?
ঘাড়ের ওপরে নবাব আলীর মাথা সামান্য দুলে ওঠে। এর অর্থ হ্যাঁ এবং না দুই-ই হতে পারে। আতাহার স্যার হ্যাঁ ধরে নিয়ে কাকে যেন চায়ের অর্ডার দেন। কাচের গ্লাসে টলটলে লাল লিকার আসে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই নবাব আলীর। ড্রেসআপ মেকআপ খসিয়ে ফেলার জন্য এগিয়ে আসে মেকআপম্যান। সে হাত তুলে নিরস্ত করে তাকে। তারপর সটান উঠে দাঁড়ায়। জরির কাজ করা মখমলের শেরোয়ানির বুক থেকে একটা সোনালি বোতাম কখন খসে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। সেই বোতামশূন্য ফাঁকে হাত রেখে নবাব আলী জানতে চায়,
এই পোশাকে আমাকে কেমন মানিয়েছে বলো দেখি!
এ আবার একটা প্রশ্ন হলো! অনেকেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। আতাহার স্যার কাঁধে হাত রেখে বলে,
ফার্স্ট ক্লাস মানিয়েছে নবাব ভাই। একেবারে অরিজিনাল সিরাজুদ্দৌলা। বাংলার শেষ নবাব।
হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে নবাব আলী,
সত্যি বলছ তোমরা?
সত্যি বলতে সত্যি! আর অভিনয়ও হয়েছে তেমনি। একেবারে যাকে বলে বাদশার বাদশা, নবাবের নবাব!
কী কথায় যে কী কথা এসে গেল। এই শেষবেলায় নবাব আলী সহসা এক অভিলাষ ব্যক্ত করে,
না, অভিনয় আর নয়। এখন আমি এই সাজ পোশাকেই থাকতে চাই। সিংহাসন তো ছেড়েই এসেছি, এখন এই সাজ পোশাক যদি না ছাড়ি…!
এমন এক প্রস্তাব শুনে আমরা বাক্যহারা হয়ে অভিনেতা নবাব সিরাজুদ্দৌলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!