
নুরু খুব পিঠা খেতে পছন্দ করে। নুরুর মা ওকে মাঝেমধ্যে যতটা সম্ভব পিঠা তৈরি করে খাওয়ায়। কিন্তু এর পরিমাণ এতই কম যে নুরুর মন ভরে না। নুরু তাই বারবার মাকে পিঠা বানাতে বলে। কিন্তু নুরুকে প্রতিদিন পিঠা তৈরি করে দেওয়ার সাধ্য ছিল না ওর মায়ের। পিঠা তৈরি করতে কত কী লাগে! চালের গুঁড়ো, গুড়, নারকেল, তেল ইত্যাদি। এসব জোগাড় করার সাধ্য নুরুর মায়ের নেই। কিন্তু চেষ্টা করে।
নুরুরা খুব গরিব। তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না ওরা। খুব কষ্টে দিন কাটে। নুরুর মা বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে। আর তাতে কেউ সামান্য টাকা, কেউ সামান্য চাল, কেউ-বা ভাত খাইয়ে বিদায় করে। নুরুর মা ভাত না খেয়ে বাটি ভরে নুরুর জন্য নিয়ে আসে। নুরু সারাদিন অপেক্ষা করে ওর মা কখন খাবার নিয়ে আসে! নুরুর খুব খিদে পায়। কিন্তু কিছুই করার থাকে না। ওদের ভাঙাচোরা ঘরটা বড় রাস্তার পাশে। রাস্তা ধরে হেঁটে কিছুদূর গেলেই ছোট্ট একটা খাল। নুরু খালের পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। আর কত কী দেখে সময় কাটে ওর! খালে কচুরিপানা ভেসে যায়। কচুরি ফুলে ফুলে খালটা কেমন ভরে উঠেছে। সেই ফুলের উপর প্রজাপতি, ফড়িং ওড়াউড়ি করে। আরও দেখে, অনেক উঁচুতে ঠিক যেন আকাশ ছুঁয়ে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। কত্ত রংয়ের পাখি! কখনও কখনও ঘাসের উপর ওড়াউড়ি করা ফড়িং ধরে নুরু। ফড়িংয়ের লেজে সুতো বেঁধে উড়িয়ে দেয়। আর এসব যখন ভালো লাগে না তখন উত্তর পাড়ার মাজেদ, আবুলদের সঙ্গে ঘুড়ি উড়াতে যায়। লাল-নীল-সবুজ-হলুদ নানান রংয়ের ঘুড়ি ওড়ে। দেখতে পাখির মতো মনে হয়। এখন শুকনো মৌসুম, উত্তরের বিলে পানি নেই। সেখানে নুরুর বয়সী অনেকে ঘুড়ি উড়াতে আসে। কেউ আসে গরু-ছাগল চড়াতে। ওরাও সবাই ঘুড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু নুরুর নাটাই-ঘুড়ি কিছুই নেই। ও একপাশে বসে ওদের ঘুড়ি ওড়ানো দেখে। ঘুড়ির কাটাকাটি খেলা দেখে, কারও ঘুড়ি সুতো ছিঁড়ে গেলে এক সঙ্গে সবাই দৌড়ে যায় সেই ঘুড়ি ধরতে। নুরুও দৌড়ে যায়। মাঝে মাঝে মাজেদ, আবুল ওদের ঘুড়ি নুরুকে ওড়াতে দেয়। ঘুড়ি-টুড়ি উড়িয়ে যখন বেলা পড়ে আসে, সবাই তখন খালের দিকে ছোটে। সাঁতার কাটে, হৈ-হুল্লোড় করে। পানির মধ্যেও কত খেলা! ডুব সাঁতারে কে কত দূর যেতে পারে, পানির মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ি। কখনও আলম ওর প্লাস্টিকের বলটা নিয়ে আসে। সেটা নিয়ে পানির মধ্যে খেলায় মাতে সবাই। এসব শেষে বাড়ি ফেরে নুরু। তখনও ওর মা ফেরে না। মা যখন ফেরে তখন বেলা পড়ে আসে। মা এলে তারপর নুরু খেতে পায়। খেতে খেতে নুরু বলে, মা তুমি খাইছ? তুই খাইয়া ল, আমি তার বাদে খামুনে। খলসে মাছের তরকারি দিয়ে খেতে ভালোই লাগে নুরুর। খুব তৃপ্তি নিয়ে খায় ও। এক সময় বলে, মা আইজ আমারে পিডা বানাইয়া দিবা না? পরতিদিন কি পিডা বানাইয়া দেওন যায়? তুই যে ক্যান পরতিদিন খালি পিডা পিডা করচ! পিডা বানাইতে কত কী লাগে! এইসব আমি কইত্তুন পামু? নুরু কিছু বলে না। ওর মন খারাপ হয়ে যায়। ম্লানমুখে সে মায়ের দিকে তাকায়। নুরুকে ম্লান মুখে দেখতে খুব কষ্ট হয় ওর মায়ের। কাছে এসে নুরুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। দিমুনে বাজান। তরে পিডা বানাইয়া দিমুনে। মন খারাপ করিস না। তুই বুজস না, আমরা গরিব মানুষ? পিডা বানাইবার জিনিসপত্তর আমরা কই পামু? নুরুকে অল্প কিছু পিঠা তৈরি করে দেয় ওর মা। আর বলে, এই খাও বাজান। তোমারে একদিন বেশি কইরা পিডা বানাইয়া দিমু। নুরু, পিঠা নিয়ে ঘরের দক্ষিণ দিকের দরজায় বসে খায়। ওদের ঘরের দক্ষিণ দিকে চৌধুরীদের সুপুরি বাগান। লম্বা লম্বা সুপুরি গাছে ভরে গেছে বাগানটা। একটার গা ঘেঁষে আরেকটা দাঁড়িয়ে। রাত হলে বাগানটায় ঘন অন্ধকার নামে! নুরুর শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রাতে বাগানের দিকে তাকালে ওর ভয় লাগে। দিনের বেলায়ও বাগানটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার, নীরব। মা নুরুকে ভূত, পরি, দ্যাও-দানবের গল্প শোনায়। বাগানের দিকে তাকিয়ে সেসব গল্পের কথা মনে পড়ে নুরুর। তখন ভয় লাগে।

মাজেদদের সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়ে আজ অনেক মাছ পেয়েছে ওরা। ট্যাংরা, পুঁটি, খলশে, কৈ, শোল ধরা পড়েছে। ভাগ করে নিয়েছে সবাই। সবার ভাগে ভালোই মাছ পড়েছে। মোটামুটি বড় একটা শোল পড়েছে নুরুর ভাগে।মা ফিরলে নুরু বলে, মা আইজকা ম্যালা মাছ পাইছি। ভাগে বড় একটা শৈল পড়ছে। তুমি ভালো কইরা ভাইজো। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর নুরু বলে, মা আইজ পিডা বানাবা না? আইজকা না বাবা। আইজকা শরীরডা ভালো লাগতাচে না। নুরুকে মিথ্যে বলে সান্ত্বনা দিল ওর মা। আসলে পিঠা বানানোর কিছু নেই। কী দিয়ে বানাবে? দুদিন পিঠার কথা মনেও করল না নুরু। তারপরের দিন বাড়ি ফিরলে ওর মা-ই বলে, নুরু আইজ তরে ম্যালা পিডা বানাইয়া দিমু। মায়ের কথা শুনে নুরুর খুব ভালো লাগে। ও জিজ্ঞেস করে। এত পিডা বানানের জিনিসপত্তর পাইলা কই মা? পাইছি রে! তুই ক, কী পিডা খাবি! যেইডা চাইবি, হেইডাই বানাইয়া দিমু। নুরু বলে, তোমার যা ইচ্ছা বানাইয়া দ্যাও। নুরু দেখে ওর মা চালের গুঁড়ো, নারকেল, গুড়, তেল- পিঠা বানানোর সবকিছু নিয়ে এসেছে। আনন্দে মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নুরুর। যাক, আজকে অনেক পিঠা খেতে পারবে ও। পিঠা বানাতে বানাতে রাত হয়ে গেল নুরুর মায়ের। এক সময় শেষ হয় পিঠা বানানো। বাটিতে নুরুকে এক বাটি পিঠা দিয়ে ওর মা বলে, নুরু তুই খা বাজান, আমার খুব ঘুম পাইছে। নুরু বলে, তুমি ঘুমাইয়া পড় মা। আমি পিডা খাই। দক্ষিণ দিকের দরজার কাছে পাটি পেতে বসে পিঠা খাচ্ছে নুরু। সুপুরি বাগানটা চোখে পড়ে। কী ঘুটঘুটে অন্ধকার! নুরুর একটু ভয় ভয় করে। বাগানের অন্ধকারের দিকে তাকালেই নুরুর মায়ের কাছে শোনা গল্পগুলো একে একে মনে পড়তে থাকে। ভূতের গল্প, পরির গল্প আর কত কী! নুরু একমনে খাচ্ছিল। হঠাৎ বাগানের দিকে চোখ পড়তে চমকে ওঠে ও। বাগানে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। কীসের আলো? এত রাতে কারা এল ওখানে? নুরুর ভয় ভয় করে! মাকে ডাকবে কি না ভাবে। হঠাৎ দেখে দরজার কাছেই কিসের একটা ছায়া আস্তে আস্তে ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। নুরু পিঠা খাওয়া থামিয়ে সেদিকে তাকায়। এক সময় দেখে ছায়া নয়, বিশাল একটা কিছু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নুরু ভয় পেয়ে সেটার দিকে তাকায়। ইস্, কী কালো, মোটা শরীর! নাকটা ইয়া বড় লম্বা, কান দুটোও। নুরুর মনে পড়ে– মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্পে এ রকম প্রাণীর কথা ও শুনেছে। ও মা, এইডা দেহি দৈত্য! নুরু ভয়ে পেছনে সরে আসে। আবার উঠে দরজাটা লাগাতে যায়। অমনি দৈত্য ওকে ধরে ফেলে। কী বিশাল শরীর দৈত্যের! নুরু দৈত্যের পায়ের কাছে পড়ে থাকল। দৈত্য বিকট শব্দে কথা বলে। বলে, তুই খুব পিঠা খেতে পছন্দ করিস, তাই না? হ। নুরু ভয়ে ভয়ে বলে। আমারও পিঠা পছন্দ। তোর পিঠাগুলো আমাকে দিয়ে দে। নুরু বলে, সবগুলান দিমু না। চাইরটা লও। এই ছুঁচো বলে কিনা, সবগুলো দেবে না! দে, সব দিয়ে দে। দিমু না। তোমারে দিলে আমি কী খামু? তোর খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেব। তুমি ক্যামনে করবা? তুমি তো দৈত্য। তুমি পিডা বানাইতে পারনি? যাও। আবার পিডা খাওয়ার শখ! নুরু বলে। দৈত্য নুরুর কথায় অবাক হয়। বলে, তোর তো দেখছি ছুঁচো অনেক সাহস। আমি কে জানিস? তোকে আমি যা ইচ্ছা তা-ই বানিয়ে ফেলতে পারি। তাইলে তুমি নিজেই পিডা বানাইয়া খাও। অত সময় নেই আমার। তোর পিঠাগুলোই খাব। দে, পিঠা দিয়ে দে। নুরু কয়েকটা পিঠা দৈত্যকে দিল। পিঠা পেয়ে দৈত্য মহাখুশি। চার-পাঁচটা পিঠা একবারে মুখে পোরে সে। খেয়ে মজা পেয়ে আরও পিঠা চায়। নুরু বলে, তোমারে সব দিয়া দিলে আমি কী খামু? শোন্, তোকে আমি পিঠার বাগান করে দেব। সেই বাগানে অনেক পিঠা গাছ থাকবে। তোর যখন ইচ্ছে, যত ইচ্ছে পিঠা খেতে পারবি। তোর ঘরের পাশেই পিঠার বাগান করে দেব। নুরু এই কথা শুনে দৈত্যকে ওর সবগুলো পিঠা দিয়ে দেয়। দৈত্য মজা করে পিঠা খায়। তারপর নুরুকে ছেড়ে দিয়ে বলে, যা, তুই একটা পিঠা বাগান পাবি। ইচ্ছে করলেই নানান রকম পিঠা খেতে পারবি। নুরু বলে, তুমি খুব ভালো দৈত্য। পরদিন ঘুম থেকে জেগে নুরু দেখে সত্যি সত্যি একটা বাগান। সেই বাগানে নানা রকম পিঠা গাছ। গাছগুলোতে হরেক রকম পিঠা। তেলের পিঠা, চিতৈ পিঠা, পাটিসাপটা, আরও কত কী!