দেনাপাওনা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-২য় অংশ

রায়বাহাদুর ঘরে নাই , কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে । মনের উচ্ছ্বাস সংবরণ করিতে না পারিয়া রামসুন্দর কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন । আনন্দে দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল । বাপও কাঁদে, মেয়েও কাঁদে ; দুইজনে কেহ আর কথা কহিতে পারে না । এমন করিয়া কিছুক্ষণ গেল । তার পরে রামসুন্দর কহিলেন , “ এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি মা । আর কোনো গোল নাই । ”

এমন সময়ে রামসুন্দরের জ্যেষ্ঠপুত্র হরমোহন তাঁহার দুটি ছোটো ছেলে সঙ্গে লইয়া সহসা ঘরে প্রবেশ করিলেন । পিতাকে বলিলেন , “ বাবা , আমাদের তবে এবার পথে ভাসালে ? ”

রামসুন্দর সহসা অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন , “ তোদের জন্য কি আমি নরকগামী হব । আমাকে তোরা আমার সত্য পালন করতে দিবি নে ? ” রামসুন্দর বাড়ি বিক্রয় করিয়া বসিয়া আছেন ; ছেলেরা কিছুতে না জানিতে পায় , তাহার অনেক ব্যবস্থা করিয়াছিলেন , কিন্তু তবু তাহারা জানিয়াছে দেখিয়া তাহাদের প্রতি হঠাৎ অত্যন্ত রুষ্ট ও বিরক্ত হইয়া উঠিলেন ।

তাঁহার নাতি তাঁহার দুই হাঁটু সবলে জড়াইয়া ধরিয়া মুখ তুলিয়া কহিল , “ দাদা আমাকে গাড়ি কিনে দিলে না ? ”

নতশির রামসুন্দরের কাছে বালক কোনো উত্তর না পাইয়া নিরুর কাছে গিয়া কহিল , “ পিসিমা , আমাকে একখানা গাড়ি কিনে দেবে ? ”

নিরুপমা সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কহিল , “ বাবা , তুমি যদি আর এক পয়সা আমার শ্বশুরকে দাও তা হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না , এই তোমার গা ছুঁয়ে বললুম । ”

রামসুন্দর বলিলেন , “ ছি মা , অমন কথা বলতে নেই । আর, এ টাকাটা যদি আমি না দিতে পারি তা হলে তোর বাপের অপমান, আর তোরও অপমান । ”

নিরু কহিল , “ টাকা যদি দাও তবেই অপমান । তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই । আমি কি কেবল একটা টাকার থলি , যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা , এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না । তা ছাড়া আমার স্বামী তো এ টাকা চান না । ”

রামসুন্দর কহিলেন , “ তা হলে তোমাকে যেতে দেবে না , মা । ”

নিরুপমা কহিল , “ না দেয় তো কী করবে বলো । তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ো না । ”

রামসুন্দর কম্পিত হস্তে নোটবাঁধা চাদরটি কাঁধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন ।

কিন্তু রামসুন্দর এই-যে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন , সে কথা গোপন রহিল না । কোনো স্বভাবকৌতূহলী দ্বারলগ্নকর্ণ দাসী নিরুর শাশুড়িকে এই খবর দিল । শুনিয়া তাঁহার আর আক্রোশের সীমা রহিল না ।

নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল । এ দিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া দেশান্তরে চলিয়া গিয়াছে; এবং পাছে সংসর্গদোষে হীনতা শিক্ষা হয় এই ওজরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নিরুর সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে ।

এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর পীড়া হইল । কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়িকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না । শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত । কার্তিক মাসের হিমের সময় সমস্ত রাত মাথার দরজা খোলা , শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই । আহারের নিয়ম নাই । দাসীরা যখন মাঝে মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত তখন যে তাহাদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া , তাহাও সে করিত না । সে-যে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে , এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল । কিন্তু এরূপ ভাবটাও শাশুড়ির সহ্য হইত না । যদি আহারের প্রতি বধূর কোনো অবহেলা দেখিতেন তবে শাশুড়ি বলিতেন , “ নবাবের বাড়ির মেয়ে কিনা। গরিবের ঘরের অন্ন ওঁর মুখে রোচে না । ” কখনো-বা বলিতেন , “ দেখো-না একবার , ছিরি হচ্ছে দেখো-না , দিনে দিনে যেন পোড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে । ”

রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন শাশুড়ি বলিলেন , “ ওঁর সমস্ত ন্যাকামি । ” অবশেষে একদিন নিরু সবিনয়ে শাশুড়িকে বলিল , “ বাবাকে আর আমার ভাইদের একবার দেখব , মা । ”

শাশুড়ি বলিলেন , “ কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছল । ”

কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না — যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল , সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল এবং সেইদিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল ।

বাড়ির বড়োবউ মরিয়াছে , খুব ধুম করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল । প্রতিমা-বিসর্জনের সমারোহ সম্বন্ধে জেলার মধ্যে রায়চৌধুরিদের যেমন লোকবিখ্যাত প্রতিপত্তি আছে , বড়োবউয়ের সৎকার সম্বন্ধে রায়বাহাদুরদের তেমনি একটা খ্যাতি রটিয়া গেল — এমন চন্দনকাষ্ঠের চিতা এ মুলুকে কেহ কখনো দেখে নাই । এমন ঘটা করিয়া শ্রাদ্ধও কেবল রায়বাহাদুরদের বাড়িতেই সম্ভব এবং শুনা যায় , ইহাতে তাঁহাদের কিঞ্চিৎ ঋণ হইয়াছিল ।

রামসুন্দরকে সান্ত্বনা দিবার সময় তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে , সকলেই তাহার বহুল বর্ণনা করিল ।

এ দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসিল , “ আমি এখানে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছি , অতএব অবিলম্বে আমার স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবে । ” রায়বাহাদুরের মহিষী লিখিলেন , “ বাবা, তোমার জন্যে আর-একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি , অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে । ”

এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায় ।

গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!