দেওঘরে অদ্ভুত ঘটনা– প্রথম অংশ

 

বাড়ীর চারিদিকে যে কম্পাউণ্ড আছে তাহা পনের বিঘা জমী। কম্পাউণ্ডের চারিদিকে কেয়া গাছের বেড়া দিয়া ঘেরা। এই বাড়ী এক্ষণে বাবু প্রেমচাঁদ বড়ালের। এই বাড়ীর বারাণ্ডা ব্যতীত আর সবই পাকা ছাতওয়ালা।

১২৮৯ সালের ১০ই বৈশাখ। সন্ধ্যাকাল। সমস্ত দিন গরম বাতাস বহিয়া এখন থামিয়াছে। উত্তর বারাণ্ডার ট চিহ্ণিত স্থানে আমরা সকলে বসিয়া আছি, এমন সময়ে আমার এক ছোট ভগিনী আসিয়া বলিল যে পশ্চিমের ঘরে ( খ চিহ্ণিত ঘর ) একটা বিকট শব্দ হইল এবং ঝুর ঝুর করিয়া কি পড়িল – যেন কে খিল খিল করিয়া হাসিয়া কতকগুলা ঢিল ছড়াইয়া ফেলিল। কি একটা শব্দ শুনিয়া সে ভূত মনে করিয়াছে ইহা ভাবিয়া আমরা বলিলাম কিছুই নহে এবং সে কথায় মনোযোগ দিলাম না। কিয়ত্‍‌ক্ষণ পরে মেঘ উঠিয়া ঝড় আরম্ভ হইল। আমরা সকলে ঘরে চলিলাম। ধূলা উড়িতে লাগিল, সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করা হইল। কিছুকাল ঝড় হইবার পর একজন আসিয়া বলিল যে পশ্চিমের ঘরে ( খ চিহ্ণিত ঘর ) কে ঢিল ফেলিতেছে। আমরা সকলে সেই ঘরে গিয়া জুটিলাম। দেখিলাম ঢিল নহে, ঘ চিহ্ণিত ঘরের খ চিহ্ণিত স্থানে একটি মাটির পাত্রে অনেকদিন হইতে যে কাঁচা আমলকী রাখা হইয়াছিল তাহাই টুপ টুপ করিয়া এক একটি উপর হইতে পড়িতেছে। আমার সর্ব্ব কনিষ্ঠ ভাই তখন বড় mischievous ছিল। আমরা ভাবিলাম ভয় দেখাইয়া আমোদ করিবার জন্য সে ঐরূপ করিতেছে সুতরাং তাহার হাত ও কাপড় তল্লাস করিয়া দেখা গেল, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। তথাপি আমরা তাহার উপর নজর রাখিলাম। আবার একটি আমলকী টুপ করিয়া পড়িল – আমার ছোট ভাইয়ের উপর নজর ছিল – তাহাকে নড়িতে চড়িতে দেখিলাম না অথচ ফল পড়িল কোথা হইতে? ঘরের পশ্চিমের জানালার দুটি খড়খড়ি খোলা ছিল। সন্দেহ হইল বাহির হইতে হয়ত কেউ ফলগুলি ফেলিতেছে। সব খড়খড়ি ও সার্সি বন্ধ করা হইল। কিয়ত্‍‌ক্ষণ পরে আবার একটি আমলকী পড়িল, ফলের গতি ঠিক উপর হইতে। উপরে চাহিয়া রহিলাম। আবার একটি পড়িল – সেটি যখন ঠিক মাথার উপরে তখন দেখিতে পাইলাম। ফল যে ঠিক উপর হইতেই আসিতেছিল, এবং পার্শ্বস্থ কোন ব্যক্তি ছুড়িয়া ফেলিতেছিল না তাহা তাহার গতি দেখিয়া বেশ বুঝা যাইতেছিল। ঘরের চারিদিক বন্ধ, ঘরে যে কয়জন আছেন সকলেই নিস্পন্দ হইয়া দণ্ডায়মান, তথাপি ফল পড়ে কোথা হইতে ইহার কিছুই ঠিকানা করিতে না পারিয়া ক্রমে আমাদের মনে ভূতের ভয় আস্তে আস্তে জাগিয়া উঠিতেছিল। আবার সন্দেহ হইল হযত ছদের উপর চোর উঠিয়াছে, ছাদের কোন স্থানে হয়ত ছিদ্র আছে, সেই ছিদ্রের মধ্য দিয়া ঐ ফলগুলি ফেলিয়া আমাদিগকে ভয় দেখাইতেছে, ভয় পাইলে কেহ আজ রাত্রে এ ঘরে থাকিবে না, তাহা হইলে ঐ ঘরে যাহা কিছু আছে চোরেরা তাহা নির্বিঘ্নে লইয়া যাইবে। এই সন্দেহ সকলেরই সঙ্গত বলিয়া বোধ হইল, কেননা এ দেশে চোরদিগের নিয়ম যে তাহারা প্রথমে গৃহস্থকে নানাপ্রকারে ভয় দেখাইতে চেষ্টা করে, পরে সুবিধা বুঝিয়া যথাসর্ব্বস্ব চুরি করে। ইহার কিছুকাল পূর্ব্বে আমাদের বাটীতে চুরি হয়। যে দিন চুরি হয় সেদিন চোরেরা ইট ফেলিয়া ও বিকট শব্দ করিয়া ভয় দেখাইয়াছিল। ছাদে নিশ্চয়ই চোর উঠিয়াছে ভাবিয়া আমরা দুইজন চাকরকে ছাতে পাঠাইলাম। তাহারা লাণ্ঠান লইয়া গিয়া দেখিল কেহ কোথায়ও নাই এবং ছাতের উপর কোথায়ও ফল প্রবেশ করান যায় এরূপ ছিদ্র নাই। এইবার আমাদিগের মনে ভূত বলিয়া অনেকটা বিশ্বাস হইল। আমরা “গ” চিহ্ণিত ঘরে আসিয়া বলিলাম, “আচ্ছা, যদি ভূত হয়, তবে এই ঘরে একটা ফল পড়ুক, তাহা হইলে আমরা ভূত বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারিব।” এই কথা বলিবার ৮।১০ সেকেণ্ড পরেই ঠিক আমাদের সম্মুখে সজোরে একটা ফল পড়িল। এই ফলটী আমলকি নহে, বাদামের ন্যায় একপ্রকার অপরিচিত ফল। এ দেশীয় লোককে পরে ঐ ফল দেখান হইলে তাহারা বলিয়াছিল যে উহা কি ফল তাহারাও জানে না, তবে পাহাড়ে কখন কখন তাহারা ঐরূপ ফল দেখিয়াছে। পুনরায় আমাদের সকলে খ চিহ্ণিত ঘরে গেলাম। সকলে দাঁড়াইয়া এই ব্যাপারের আলোচনা করিতেছি, এমন সময়ে চ চিহ্ণিত ঘরের ঝ চিহ্ণিত জানালার একটা খড়খড়ি সজোরে উঠিল, ৩।৪ সেকেণ্ড খোলা থাকিয়া আবার সজোরে বন্ধ হইল – যতটুকু সময় খোলা ছিল তাহার মধ্যে বাহিরে একবার বিদ্যুত্‍‌ হইয়াছিল, তাহার আলোক স্পষ্ট দেখা গিয়াছিল।

খড়খড়ে বন্ধ হইবার পরেই আমরা লাণ্ঠান লইয়া দক্ষিণের বারাণ্ডায় আসিলাম এবং চাকরদ্বয়কে লাণ্ঠান লইয়া কম্পাউণ্ডের সকল স্থান অনুসন্ধান করিতে বলিলাম। হয়ত ত কোন লোক ( চোর ) জানালা খুলিয়া আবার বন্ধ করিয়া তখনই পলাইয়াছে, আমাদের এই সন্দেহ হইয়াছিল। কিন্তু বাড়ীর বারাণ্ডা হইতে কম্পাউণ্ডের বেড়া যতদূর ততদূর খুব দৌড়িয়া যাইতে যত সময় লাগিতে পারে তাহার মধ্যেই আমরা বাহির হইয়াছিলাম। চাকরেরা তন্ন তন্ন করিয়া ঝোপ ঝাপ সকল খুঁজিয়া আসিল, কোথাও কাহাকে দেখিতে পাইল না। পুনরায় আমারা খ চিহ্ণিত ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। তখনও ফল পড়িতেছে – তখন আর আমলকি নহে – দুই তিন প্রকার অপরিচিত আকৃতির ফল। ইতিপূর্ব্বে যতক্ষণ অন্তর ফল পড়িতেছিল এখন হইতে তাহা অপেক্ষা কিছু অধিককাল অন্তর পড়িতে লাগিল। এই সময়ে আমরা মাতাঠাকুরাণী ‘ক’ চিহ্ণিত ছোট ঘরে কোন কার্য্যানুরোধে গমন করেন, সঙ্গে আমার ছোট ভগিনী যায়। ঐ ঘরে তাহারা কিয়ত্‍‌ক্ষণ থাকিলে পর ঐ ঘরের ড চিহ্ণিত স্থানে থপ করিয়া একটা কি পদার্থ পড়িল। তখন ঐ ঘরের স চিহ্নিত দ্বার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল, তাহার একটিও খড়খড়ি খোলা ছিল না এবং ঐ ঘরের সম্মুখের চ চিহ্ণিত ঘরে দুইটি আলোক উজ্জ্বলরূপে জলিতেছিল। চ চিহ্ণিত ঘরের ঝ চিহ্ণিত জানালাটিও সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। সুতরাং স চিহ্ণিত দ্বার হইতে কিম্বা চ চিহ্ণিত ঘরের ঝ চিহ্ণিত জানালা হইতে কেহ যে ঐ পদার্থটি ফেলিয়া দিয়াছিল, তাহা হইতে পারে না। যে পদার্থটা পড়িয়াছিল মা তাহা দেখিয়াছিলেন, কিন্তু আমার ছোট ভগিনী ঐ দিকে পশ্চাত্‍‌ করিয়া বসিয়া থাকাতে তাহা দেখিতে পায় নাই। চতুর্দ্দিক বন্ধ অথচ ঐ পদার্থটা পড়িল এবং যেরূপ শব্দ করিয়া ও যেভাবে পড়িল উপর হইতে পড়িলে যেরূপ শব্দ হওয়া উচিত ও যেরূপ ভাবে পড়া উচিত সেইরূপ হইল দেখিয়া মা অত্যন্ত ভয় পাইয়া আমার ছোট ভগিনীকে লইয়া সে ঘর হইতে চলিয়া আসিলেন। আমরা খ চিহ্ণিত ঘরে ছিলাম। তিনি আমাদিগকে ঐ ঘটনার কথা বলিলেন। আমরা ক চিহ্ণিত ঘরে গেলাম। ড চিহ্ণিত স্থানের প্রতি চাহিয়া সেখানে কিছুই নাই দেখিয়া স্তম্ভিতা হইয়া মা বলিলেন, “এ কি হল। আমি এইমাত্র এখানে একটা কালবর্ণের জিনিস পড়তে দেখে গিযেছি।

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!