সোনালি কুকুরের নিজের পিঠে চড়ার গল্পটা দিয়ার অবশ্য ভালই লেগেছিল। পরে দিয়ার পিসি, দীপঙ্করের বৌ দীপঙ্করকে বলেছিল, দিয়া বলেছে, কুকুরের, দীপঙ্করের ওই কুক-কুকুরের গল্পটা বেশ ভাল। ঠিক তোতলা নয়, কিন্তু একটা বাড়তি মনোযোগ এসে যায় দিয়ার প্রথম অক্ষরটা বলতে গিয়ে। তাই ‘ক’-এ চাপ দিয়ে ও ঠিক কী ভাবে বলেছে সেটা মাথায় আওয়াজ আকারেই বেজেছিল দীপঙ্করের। রাতে শোয়ার সময়, ঘরের বড় আলো অফ করে, টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে, একটা বই নিয়ে দিয়ার পাশেই শুল দীপঙ্কর। ওকে পাহারা দেওয়াও হবে, আর ঘুমিয়ে পড়লে নিজেও পাশে শুয়ে পড়তে পারবে। দিয়া সবসময়ই কিছু না কিছু করছে।
তখন সে ইশকুলে কার্সিভ টানা হাতের অক্ষরে এ বি সি ডি কী করে লেখে সেগুলো দেখাতে চাইছিল দীপঙ্করকে। তার মধ্যে একটা লড়াইও ছিল। দীপঙ্করের পৌরাণিক ছেলেবেলায় প্যারী চাঁদ সরকারের, সরকারই বোধহয়, বা প্রায় ওই রকমই নামের কোনো লেখকের একটা পাতলা বই ছিল। তার গায়ে ব্রাউন পেপারের মলাট দেওয়া, তখন যার নাম ছিল বাঁশ কাগজ। তার গাঢ় সবুজ রংটা ময়লা হয়ে প্রায় কালচে একটা সবুজ হয়ে গেছিল। সেই বইয়ের পিছন দিককার পাতাগুলোয় ছিল টানা হাতের ইংরিজি অক্ষর, সেখান থেকে অভ্যেশ করতে হয়েছিল। তা থেকে যা শিখেছিল তাতে দীপঙ্করের নিজের সময়েও ইশকুলের দিদিমণিরা বেশ বিরক্ত হত। যা হয়, ইশকুলের দিদিমণিরা, তাদের লেখাপড়াটা সবই খুব উপর উপর, অত খোঁজ রাখেন না, অত কুলীন ব্রিটিশ রকমের টানা হাতের লেখার অনেক অক্ষরই তারা চিনতে পারতেন না, বিশেষ করে এস অক্ষরটা। একবার এক দিদিমণি কেটেও দিয়েছিলেন, এতটাই অন্য রকম সেগুলো, পরিচিত অক্ষরের থেকে। আজ বহু বহু বছর, বছর চল্লিশেক বাদে, আবার সেই আপত্তি ফেরত আসতে দেখল দীপঙ্কর দিয়ার কাছ থেকে। এবং আবার মূল আপত্তি সেই এস।
এইসব কী উল্টোপাল্টা লিখছ, এটা একটা এস হল, ম্যাম এরকম বলেনি। তোর ম্যাম কিছু জানে না। এই বার রীতিমত ক্ষেপে গেছিল দিয়া, এবং সত্যিই একটু তোতলামি এসেছিল ওর কথায়। ত-তুমি কিছু জানো না, ম্যাম জানে। এতে কী যে বলবে, ঠিক খুঁজে পাচ্ছিল না দীপঙ্কর। শেষে বলেছিল, তুই জানিস, তোর ম্যাম যেমন পড়ায়, আমিও পড়াই, বড়দের ইশকুলে। এতে একটু মজা পেয়েছিল দিয়া। তোমাকে ম্যাম বলে — ম্যাম না ম্যাম না, স্যার বলে ডাকে তোমায়? এই প্রসঙ্গটা একটু অপরিচিত লেগেছিল দীপঙ্করের। দিয়ার মা কি কখনো ওকে নিজের ইশকুল কলেজের গল্প করেছে, সেখানের স্যারদের? নয়তো ওর মাথায় এটা কী করে এল? কিন্তু অন্য প্রসঙ্গ এসে যাওয়ায় একটু স্বস্তি পেয়েছিল দীপঙ্কর। তাড়াতাড়ি কাগজ আর পেনটা কিছু না বলেই সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, ঘুমোতে যাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দিয়ার। না, দাঁড়াও, তোমায় দেখাচ্ছি, কী করে লিখতে হয়। লড়াইটা সাঙ্গ না করে কী করে ঘুমোতে যায়, অনেক বেগ পেতে হয়েছিল দীপঙ্করকে ওই কাগজ পেন আর কার্সিভ মাথা থেকে সরাতে। তাই, দিয়াকে গল্প শোনানোর প্রস্তাবটা নিজেই দিল। আজ কিসের গল্প শুনবি? বাঘের। উঃ, তোর এই বাঘ, পৃথিবীতে অত বাঘ নেই রে।
বাঘরা সব হারিয়ে যাচ্ছে, সেই বাঘের ছানাটা যেমন হারিয়ে গেছিল, পাহাড় পেরিয়ে, ঝর্ণা পেরিয়ে, অচেনা বনে। আমরা যেমন রাস্তা চিনি, বাড়ি চিনি, বাঘেরা চেনে জঙ্গল। ওদের তো বাড়িও জঙ্গল, রাস্তাও জঙ্গল, দোকানও জঙ্গল, জঙ্গলেই থাকে, জঙ্গলেই ঘোরে, জঙ্গল থেকেই খাবার নিয়ে আসে। তাই এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে গেলে ওরা আর কিছু চিনতে পারে না। আর, শুধু একটা জঙ্গল না, সব জঙ্গল থেকেই বাঘ হারিয়ে যাচ্ছে। দীপঙ্করের নিজের মাথার গম্ভীর অন্য ভাবনার বোধহয় ছায়া পড়েছিল, সেটা এড়াতে, বা হয়তো নিজে থেকেই, দিয়া বলল, তাহলে, তাহলে, অ্যালিসের। অ্যালিসের গল্প আবার শুনবি কি? ওটা তো নিজেই দেখলি সেদিন। দেখবি নাকি আবার, সেইরকম? অ্যালিস দেখার প্রসঙ্গটা তোলাতেই একটু ভিতু চোখে তাকাল দিয়া, তার মানে, ওরও বেশ তাজাতাজা মনে আছে সেদিনের কেলেঙ্কারি। দীপঙ্করের লেখার কাজ বন্ধ করে ল্যাপটপে অ্যালিস দেখাতে বলেছিল দিয়া। ও জানত অ্যালিসটা ওখানে তোলা আছে। যখন ডিভিডিটা এনকোড করছিল দীপঙ্কর, বারবার এসে জিগেশ করছিল এটা কী হচ্ছে, সিনেমাটা চলছে না, তাহলে কম্পিউটারের এই আলোটা জ্বলছে কেন। ডিভিডি ড্রাইভের আলোটা ও চেনে। দীপঙ্কর বলেছিল, এনকোড করছি সিনেমাটা। তাতে খুব বোদ্ধার মত বলেছিল দিয়া, ওঃ। তার একটু পরেই বলেছিল, কই দেখি কী হচ্ছে? সে আর দেখে ও কী বুঝবে, সারি সারি সংখ্যা উঠে যাচ্ছে মেনকোডারের। তখন দীপঙ্করই ওকে বুঝিয়েছিল, এতদিন পর্যন্ত সিনেমাটা শুধু ওই ডিভিডিটায় ছিল, এখন অনেক ছোট হয়ে এই কম্পিউটারের মধ্যে চলে এল, এরপরে ওটা একটা সিডিতেও নেওয়া যাবে। এটাও যে ও তেমন কিছু বুঝছিল, তা না, তাও, নিশ্চয়ই কিছু একটা বুঝে নিল। কারণ, তার পরেই বলেছিল, কই দেখাও সিনেমাটা। দীপঙ্কর একটু বাড়তি গম্ভীর গলায় কাজের কথা বলায় চলে গেছিল। চলে গেছিল কী করতে সেটা একটু বাদেই বোঝা গেছিল, ওর মায়ের চীৎকারে। গোটা টেবিল ক্লথের গায়ে মার্কারের হিজিবিজি। ও নাকি সাজাচ্ছিল। পাছে খুব মার খায়, ততক্ষণে এনকোডিংটাও শেষ হয়ে গেছিল, নিজের কাজ বন্ধ করে ওকে এনে অ্যালিস দেখতে বসিয়েছিল দীপঙ্কর। তুই দেখতে চাস? হ্যাঁ, চাই, চাইছি তো। দেখাতে পারি তোকে, একটা শর্তে, গোটা সময়টা একটাও কথা বলবি না। ঠিক আছে? বলব না। ভেবে নে আগে থেকে, যতক্ষণ না সিনেমা শেষ হয়, বা আমি নিজে থেকে কথা বলি, তুই একটাও কথা বলতে পারবি না।
যদি বলিস তাহলে কী করব জানিস? কী করবে দীপঙ্কর, মারবে? একটু ভিতু একটু তেল দেওয়া গলায় ঘাড় তুলে মাথা বেঁকিয়ে বলেছিল দিয়া। মারব মানে, গদাম করে মারব, সারাদিন আর পিঠ বেঁকাতে পারবি না। দিয়া জানে এটা ফাঁকা ভয় দেখানো নয়, দীপঙ্কর পিসির মত মারে না, মারলে সত্যিই লাগে, কিন্তু জেদও তো করতে হবে। বলল, দেখবই, বলব না কথা। একটা কথাও বলব না, দীপঙ্কর। চালিয়ে দাও এবার। দীপঙ্কর জানত, এটা চাইলেও করা প্রায় অসম্ভব ওর পক্ষে, ওর কথা বলার কারণ লাগে না, প্রায় কথা বলা টিয়াপাখির মত, বিনা কারণেই বলে। শেষে সত্যিই মারতে হয়, আগে থেকেই তাই সাবধানতা নিয়েছিল অনেক। ওর কানে কথা এলে ও কথা বলে উঠবেই, তাই হেডফোন লাগিয়ে দিয়েছিল ওর কানে। আর, নিজে নিজে বসে থাকলে কিছু না কিছু করতে উঠে যাবেই, তাই নিজেরই কোলে বসিয়ে সামনে চালিয়ে দিয়েছিল। এটা দীপঙ্করের নিজেরও শাস্তি হয়েছিল। হেডফোনটা দিয়ার কানে, তাই ও কিছু শুনতে পাচ্ছে না। খুব ভালো দেখতেও পাচ্ছে না, এলসিডি স্ক্রিনে যা হয়, বেঁকিয়ে দেখা যায় না। আর পুরো সময়টা নিজের বুড়ো আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে থাকার মত, খেয়াল করে চলতে হচ্ছে দিয়াকে। প্রতি মুহূর্তে ও দেখতে দেখতে কিছু না কিছু একটা বলে উঠতে যাচ্ছে, পিছন দিকে উপরে ঘাড় বেঁকিয়ে, আর প্রতি বারই দীপঙ্করকে আঙুল তুলে ঠোঁটে এনে দেখাতে হচ্ছে, চুপ। একবার শুধু বলল, দীপঙ্কর, আমি একটু জল খাব। এটা যে ঘটতে পারে তা আগে থেকেই হিশেবে ছিল দীপঙ্করের। জানলার বাতায় জলের বোতল আর দিয়ার টুপির মত দেখতে গেলাশটা আগেই এনে রেখেছিল। মুখে আঙুল দেখিয়ে সেটায় জল ঢেলে দিয়াকে দিয়েছিল। কিন্তু সত্যিই দিয়াকে পেটাতে হয়নি, পুরো সিনেমাটাই ও ওই ভাবে কোলে বসে দেখেছিল, একটাও কথা না-বলে। অসম্ভব অবাক হয়ে গেছিল দীপঙ্কর নিজেই। মজাও পেয়েছিল বেশ।
দেখলি, তুই বেশ পারিস কথা না-বলে। আজকে অ্যালিস দেখার কথায় বোধহয় সেদিনের কথা মাথায় এসে গেল দিয়ার, বিন্দুমাত্রও আর উৎসাহ দেখাল না। বলল, দীপঙ্কর, দীপঙ্কর, ঘোড়ার গল্প বলো। কী বলবে সেটা খুঁজছিল দিয়া, এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। তাকের উপর ডোকরার ঘোড়াগুলোর গায়ে চিকচিক করছে টেবিলল্যাম্পের এই আবছা আলো। সেগুলো দেখেই বোধহয় ওর ঘোড়ার কথা মনে হল। অন্তত বাঘের হাত থেকে তো বাঁচল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘোড়ার গল্প ভাবতে শুরু করল। ঘোড়ার গল্প যখন, শুরু হবে নিশ্চয়ই একটা ঘোড়া দিয়ে। একটা ঘোড়া ছিল, খুব ঘুরে বেড়াত চারদিকে। অত ঘোরে বলেই তো ওদের নাম ঘোড়া। খুব ফূর্তিতেই ছিল। সব ঘোড়ার মতই ওর ঘাড় ভর্তি ছিল কেশরে। ফোলানো, ঝাঁকড়া ঢেউ খেলানো কেশর। কোনও দিন শ্যাম্পু করেনি, তাও। ঘোড়ারা আর শ্যাম্পু করবে কী করে, বাথরুম-ই নেই ওদের যে মা ঘাড় ধরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে শ্যাম্পু করাবে, আর সেই শ্যাম্পুর ফেনা চোখে গিয়ে কেঁউ কেঁউ করে নাকে কাঁদবে। এইখানটায় যে ওর প্রতি একটা কটাক্ষ করা হল এটা বুঝল দিয়া, এবং খিঁখিঁ করে একটু উপরচালাকির হাসি হাসল। আর শুধু তো কেশর না, অন্য ঘোড়াদের মত এই ঘোড়াটারও ছিল চারটে পা, এবং তাতে চারটে খটখটে খুর। ফূর্তি হলে যেমন একঘাড় কেশর রৈ রৈ করে ঝাঁকাত, চটে গেলে আবার খুর ঠুকত।
খুরে মাটিতে শব্দ উঠত খটাখট খটাখট খটাখট। তবে শুধু যে রেগে গেলেই ঠুকত তা নয়। পাথুরে চাটানে কী শক্ত রুক্ষ মাটিতে চলার সময়ও আওয়াজ উঠত। ঘোড়ার বেশ ভালই লাগত। আরো যখন একা একা হাঁটত, মনে হত সে একা না, আরো কে একটা জানি আছে তার সঙ্গে। ক্রমে ক্রমে ঘোড়ার বেশ নেশা চেপে গেল এই আওয়াজের। রাতে ঘুমোচ্ছে, আরো ঘোড়ারা তো দাঁড়িয়েই ঘুমোয়, একটু যেই ঘুম পাতলা হল, বেশ ক-বার পা ঠুকে নিল। আবার কখনো হয়ত কোনো তাড়া নেই, দুলকি চালে হাঁটলেই চলে, চলতে শুরু করল একদম পল্টনি দৌড়, ওতে তো খুরের আওয়াজ অনেক বেশি হয়। ক্রমে দেখা গেল, ঘোড়া বেশির ভাগ সময়ই দৌড়চ্ছে। কিন্তু অত দৌড় কি ঘোড়ার সয়? কত আর দৌড়বে? একটাই তো ঘোড়া। তখন সে দেখল, দৌড়ের চেয়ে অনেক ভালো হল নাচ। দৌড় মানে তো একই তালে খটখট খটখট খটখট। কিন্তু নাচ মানে কত তাতে তাল, কত লয়, কত আলাদা আলাদা ছন্দ। এক এক নাচ মানে এক এক আলাদা রকমের খটাখট। ক্রমে নাচিয়ে হিশেবে বেশ নাম হয়ে গেল ঘোড়ার। অন্য নাচিয়ে ঘোড়ারা যেমন নাচবে বলে নাচে, এই ঘোড়া তো নাচে তার নিজের আনন্দে। নেচেই চলে, নেচেই চলে। দুবার তিনবার চারবার ‘অবিরত নৃত্য প্রতিযোগিতা’-য় ফার্স্ট হল ঘোড়া, মানে যেখানে নেচেই চলতে হয়, নেচেই চলতে হয়, থামা চলে না। থামলেই আউট। আর সবাই আউট হয়ে গেলে যে রয়ে গেল সে হল ফার্স্ট। ফার্স্ট হলেই সব জায়গায় ফ্লাস্ক দেয়, ইস্তিরি দেয়। একা একটা ঘোড়া কত ফ্লাস্ক আর চা খাবে, আর ইস্তিরি করবে যে তার তো কোনো জামা প্যান্ট কোটই নেই, ঘোড়ার পাড়ার কাউকে আর ফ্লাস্ক বা ইস্তিরি কিনতে হয়নি বেশ কয়েক বছর। এক জায়গায় সে ফার্স্ট হয়ে একটা সঞ্চয়িতাও পেল। সেটা পেয়ে বেশ ফূর্তি হয়েছিল ঘোড়ার, এখন বেশ ছড়া কেটে কেটে নাচতে পারে।
আজকাল আর কেন যে কেউ প্রাইজে বই দেয় না, ভাবে ঘোড়া। এরকম করে নেচে নেচে, ছড়া কেটে কেটে, হেঁটে দৌড়ে বেশ অনেকটা জীবন কেটে গেল ঘোড়ার। একটা সময় খেয়াল হল ঘোড়ার, বয়স হচ্ছে। আজকাল বেশি নাচলে কি বেশিক্ষণ দৌড়লে বেশ হাঁফিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাতের দিকে হাঁটুতে ব্যথা করে, দু-চারটে করে সোনালি-সাদা কেশর পেকে কালো হয়ে যাচ্ছে। খারাপ লাগে না ঘোড়ার, ভালোই লাগে, কমবয়েসি কচি ঘোড়ারা অনেকেই আজকাল তাকে দেখলে পথ ছেড়ে দেয়, সমস্যায় পড়লে পরামর্শ নিতে আসে, ভালোই লাগে ঘোড়ার। কিন্তু নাচ ক্রমে ক্রমে তাকে ছেড়ে দিতে হল। ডাক্তারও বলল, আর নাচলে ভেলোরে গিয়ে অপারেশন করে আসতে হবে। একটা ঘোড়ার পক্ষে সে কি কম ঝক্কি। এমনি ট্রেনে তো ঘোড়াদের উঠতেও দেয় না। অন্য ঘোড়াদের নাচতে দেখলে, লেজে কেশরে কোমরে একটু যে দোলা লাগে না এখনও, তা নয়। কিন্তু আর নাচে না ঘোড়া। কিন্তু এই নাচ ছেড়ে দিয়ে মহা মুশকিলে পড়ল ঘোড়া। শুধু তার না, তার শরীরেরও তো অভ্যেশ হয়ে গেছে নাচ, অত বছর অত অত সে নেচেই গেছে। শরীর সামলে রাখা, হাত পা পেট সব নিজের নিজের নিজের মত নাচতে চাইলে তাদের আটকানো, এটাই এখন কাজ ঘোড়ার। কিন্তু সব সামলালেও একটা দাঁতকে সে কিছুতেই সামলাতে পারে না। ঘোড়ার সেই দাঁতটার নাম রসময়, মহা অবাধ্য সে, দিনরাত সে শুধু নেচেই চলে। একসময় ঘোড়া যেমন নাচত। ঘোড়া খুব একটা শাসনও যে করতে পারে, তাও নয়। সে তো নিজেও একসময় ওরকমই ছিল। কোথাও একটা মায়া হয় তার। মাঝে মাঝে রসময়ের নাচের চোটে খুব ব্যথা হয় তার। কিন্তু বারণ করলেও শোনে না রসময়। আজকাল মাঝে মাঝেই দাঁতের ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয় ঘোড়ার। ক্রমে ক্রমে সবাই জেনে গেল রসময়ের এই নাচের কথা। তার সেই তাথৈ তাথৈ নাচ দেখতে সবাই ভিড়ও করতে শুরু করল খুব। একসময় যেমন ঘোড়ার নাচ দেখতে করত। লোকের এই আসা, ভিড় করা, মজা পাওয়া — এগুলোয় খারাপ লাগেনি ঘোড়ার, তার খারাপ লাগল অন্য একটা জায়গায়। ঘোড়ার নিজের কোনও নাম ছিল না, কখনও নামের কথা মাথায়ই আসেনি তার। নাম ছাড়াই বেশ তো ছিল। কখনও মনেই হয়নি নামের কথা। কিন্তু এখন তার পরিচয় হতে শুরু করল রসময়ের নামে। লোকে তাকে ডাকতে শুরু করল ‘রসময়ের মাড়ি’ বলে, কারণ, তার মাড়িতেই থাকে রসময়। এইটা মনে খুব লাগল ঘোড়ার। সে একটা ঘোড়া, একটা আস্ত ঘোড়া, পা লেজ কেশর সহ একটা আস্ত জ্যান্ত ঘোড়া। আর লোকে তাকে জানবে ‘মাড়ি’ বলে, ‘রসময়ের মাড়ি’ বলে, এটা কিছুতেই মানতে পারছিল না ঘোড়া। মনে খুব কষ্ট হতে শুরু করল ঘোড়ার। মন খারাপ আর দাঁত ব্যথা, এই নিয়েই বাঁচতে শুরু করল ঘোড়া।
কে তাকে দেখলে বলবে, এই ঘোড়াই এক সময় এমন নাচত যে কেশরগুলোকে আর আলাদা করে দেখাই যেত না, মনে হত যেন উঁচু পাহাড়ের গায়ে দমকা হাওয়ায় মেঘের ঝাপট। দাঁতের ব্যথা সারাতে কত কিছুই তো করল ঘোড়া। মাড়ির গোড়ায় মলম, কুলকুচি। দাঁতের মধ্যে লবঙ্গ চেপে ঘুমোতে যাওয়া, কত কিছু। শেষ অব্দি দেখল একটা জিনিসেই কাজ হচ্ছে, যে কোনো কিছু খাওয়ার পরে, ভালো করে কুলকুচি করে একটু পেয়ারা পাতা চিবোনো। কিন্তু সেই বা কী কম ঝামেলা। ঘোড়ারা মোটেই গোরু নয় যে সারাদিন সারারাত জাবর কাটবে, কিন্তু ঘোড়ারা বার বার খায়। বার বার খাওয়া মানে বার বার পেয়ারা পাতা। কাছাকাছি সব পেয়ারা গাছের নিচের দিকের সব পাতা গেল শেষ হয়ে। সেই কোথায় উপরের ডালে উঠে পাতা পাড়তে হয়। বয়সও হয়েছে। শেষে অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বার করল ঘোড়া। সে পেয়ারা গাছের উপরের দিকের ডালেই থাকতে শুরু করল। শুধু পেয়ারা পাতাই খায়, তাই আলাদা করে আর পেয়ারা পাতা চিবোতে হয়না তাকে। মজার কথা এই যে, ঘোড়া আগে থেকে যা বুঝতে পারেনি, তার সব কষ্টেরও শেষ হল এতে। গল্পের ঘোড়া গাছে থাকছে বলে রাজ্য শুদ্ধ সবাই আজকাল তাকে দেখতে ভিড় করে।
হয়তো দিনরাত ওই পেয়ারা পাতা খাওয়ার কারণেই তার দাঁত ব্যথাও কমে গেল। আর, অত নিচ থেকে, মাটি থেকে গাছের ডালে ঘোড়াকেই বুঝে নিতে হয় বেশ ঠাহর করে, তার মাড়ি বা দাঁত তো অনেক দূরের কথা। তাই রসময়ের নাচ দেখতেও কেউ আসে না, আসবে কি, দেখতেই তো পায় না। উত্সাহের অভাবে রসময়ের নাচও গেল কমে। রসময়ের কথা সবাই ক্রমে ভুলেই গেল। ধীরে ধীরে ঘোড়ার একটা নামও জুটে গেল, ‘গাছে চড়া ঘোড়া’। এত কিছুর পরে, এত বয়সে এসে শেষ অব্দি একটা নাম জুটল তার। তাকে আর কেউ ‘রসময়ের মাড়ি’ বলে ডাকেনা। ঘোড়া বেশ ভালোই আছে, সব দিক দিয়েই শান্তিতে।