দুষ্টু এক পুঁচকে পুঁটির গল্প—তানজিল রিমন

বেশ নিরিবিলি। সাগরের একপাশে বেড়ে উঠেছে গ্রামটি। ছোট একটা নদী এসে যেখানে সাগরে মিশেছে, তার পাশেই। এখানে নেই কোনো বিশাল ঢেউ। নেই ঢেউয়ের গর্জন। তবে মাঝে মাঝে কিন্তু সাগরের গর্জন কিছুটা হলেও ভেসে আসে। পানির নিচের কত শত যে প্রাণী এই গ্রামে বাস করে, তার হিসেব নেই। গ্রামে সবাই মিলেমিশে থাকে। কারো কোনো ভয় নেই। কেউ কারো ক্ষতি করে না। নানা ধরনের ছোট মাছদের রাজতব বলা যায়। এছাড়াও হাজার রকমের পোকামাকড় রয়েছে। রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট পাথর। এখানে যারা বাস করে, তাদের জায়গাও নির্ধারিত। নিজেদের হাতে তৈরি করেছে ঘরবাড়ি। বাড়ির চারপাশে কত গাছপালা! কোনো পরিচর্যা ছাড়াই বেড়ে উঠে। কোনোটা সবুজ, কোনোটা গাঢ় সবুজ, কোনোটা ধুসর। আবার লালচে গাছও রয়েছে। ছোট বড় গাছের যেন শেষ নেই। গাছগুলোকে ঘিরে সারাদিন খেলে বেড়ায় ছোট মাছদের বাচ্চা-কাচ্চাগুলো। মা আর বাবা মাছরা ব্যস্ত থাকে খাবার সংগ্রহে। ছোট ছোট এই মাছের এলাকাটায় থাকত একটা পুঁচকে পুঁটি। না, একা থাকত না। বাবা-মার সাথেই থাকত। কিন্তু কী যে দুষ্টু তার কোনো সীমা নেই! সারাদিন এটা করবে, ওটা করবে। ঘরের জিনিসগুলো এলোমেলো করবে। ওর দুষ্টুমিতে বাবা-মাও বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পারে না। যেমন গাছের ডালে বসে খেলছে সবাই, হঠাৎ ও ভয় দেখাবে। ভয় পেয়ে অন্য কোনো পুঁচকে হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আবার কেউ দুই তিন জ্বরে পড়ে থাকে। বাবা-মা বাইরে থেকে এলেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় নালিশের পর নালিশ আসতে থাকে। কিন্তু কোনো কথাই শুনতে চায় না পুঁচকে পুঁটিটা। আবার নিজেদের এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে চায়। এই খুব ভয় বাবা-মার। কখন আবার একা একা কোথায় যায়! বাইরে যে কত বিপদ-আপদ আছে। তা কোনোভাবেই বুঝাতে পারে না পুঁচকেটাকে। একদিন জেদ ধরলে দূরে ঘুরতে যাবেই যাবে। তার নাকি নিজের এলাকায় আর ভালো লাগছে না। এখানে এত কম পানি। সে সাগরে ঘুরতে যাবে। যেখানে অনেক অনেক পানি। বাবা-মা অনেক বুঝাল পুঁচকেটাকে। সাগরে শত্রুর অভাব নেই। সব রাক্ষুসে প্রাণীরা বাস করে সেখানে। একবার হাতের কাছে পেলে একদম গিলে ফেলবে। ভয় পেয়ে এবার কিছুটা শান্ত হলো পুঁচকেটা।

প্রতিদিনের মতো আজও মা পুঁটি ও বাবা পুঁটি পুঁচকেটাকে বুঝিয়ে বাইরে গেল কাজে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। একটু পরেই সে নাচতে নাচতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পিছু নিয়েছে এক দল পুঁচকে মাছ। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। জাদুর বাঁশি বাজিয়ে পুঁচকেগুলোকে নিয়ে এলাকা ছাড়ছে। কিন্তু না বেশিদূর যেতে পারল না দলটাকে নিয়ে। যেখানে গ্রামের শেষ গাছটা, সেখানে দলটা থেমে গেল। এরপরই পানির গভীরতা বেশি। সাগরের শুরুটাও এখান থেকেই। সেদিকে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক, এটা সবাই জানে। কিন্তু পুঁচকে পুঁটিটা যাচ্ছেই তো যাচ্ছে। দলের সবাই মানা করল ওদিকে যেতে। কিন্তু সে কারো কথাই শুনল না। বরং ভেংচি কেটে সামনে এগিয়ে গেল।

পুঁচকে পুঁটি মাছটার মনটা খুব ভালো আজ। সে সব ঘুরে দেখে তবেই না বাড়ি ফিরবে। মনে মনে ভাবতে থাকে।

‘ইস! কী সুন্দর।’ একটা বিশাল পাথর দেখে বলল। পাথরের গায়ে নানা ধরনের নকশা দেখে সে মুগ্ধ হয়। সে আনন্দে নাচতে থাকে। গান গাইতে গাইতে এগুতে থাকে। তবে সে এখানে তার মতো ছোট কাউকে দেখছে না কেন? চিন্তায় পড়ে যায় সে। ‘এত সুন্দর জায়গা রেখে কেউ একটা অজপাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকে। আমি আর বাসায়ই যাব না।’ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় সে। এখানকার পানিও কি সুন্দর। স্বচ্ছ, একটু একটু নীল, পরিষ্কার। সে চোখ বন্ধ করে বেশ জোরে একটা নিঃশ্বাস নেয়। চোখ খুলেই সে সামনে ঘোলাটে, লালচে কী যেন দেখতে পায়। উৎসুক দৃষ্টিতে সে আরেকটু কাছে এগিয়ে যায়। চারপাশে লাল রঙে ভরে আছে। হঠাৎ সে একটা বিশাল পাথরের সাথে ধাক্কা খায়। সে একটু ভয় পেয়ে যায়- ‘কী রে এত বড় পাথর, আমার ধাক্কাতে নড়ে উঠল।’ সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে আসলে কী হয়েছে। একটু পর পাথরটি যেন দেŠড়াতে শুরু করল। চারপাশে লাল রঙে সব ঘোলাটে হয়ে গেছে। স্পষ্ট কিছু বুঝাও যাচ্ছে না। সে পাথরের পিছু পিছু যেতে লাগল। পাথরের গায়ে আবার লতানো গাছও জড়ানো। এগুলোও লাল রঙের। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছে না, পাথরটি দেŠড়াচ্ছে কীভাবে? কিংবা পাথরটি শূন্যের উপর ভেসে আছেই বা কীভাবে? এক জায়গায় এসে পাথরটি থেমে যায়। এখানে কিছুটা ঘোলাটে কমেছে। সে এবার দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট। এটি পাথর নয়। অন্য কোনো ভয়ঙ্কর প্রাণী। বড় একটা মাছকে ধরে আছে খাওয়ার জন্য।

পুঁচকে পুঁটি ভাবতে থাকে তার দাদার কথা। দাদার কাছে শুনেছিল- ভয়ঙ্কর এক প্রাণী একবার ওদের গ্রামে হামলা করেছিল। অক্টোপাস না কী যেন নাম। যার কাছে একটি থলে থাকে। এই থলের ভেতরে লাল রঙ থাকে। শিকার করতে গেলে লাল রঙ পানিতে ছেড়ে দিয়ে চারপাশ ঘোলাটে করে। তারপর সহজেই সে শিকার করে ফেলে। ‘এটাই তাহলে অক্টোপাস। যে আমাদের পূর্বপুরুষদের হজম করেছে।’ ভাবতেই গা শিউরে উঠে পুঁচকে পুঁটিটার। ভয়ে সে অন্যদিকে ছুটে যায়। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পরও সে স্বাভাবিক হতে পারল না। ‘একটুর জন্য আজ জীবনটা যায়নি’ -ভাবল সে। পুঁচকে পুঁটিটা আবার সাঁতরাতে থাকে স্বচ্ছ পানিতে। মন থেকে তখনও ভয় দূর হয়নি। ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল বিশাল একটা প্রাণীকে। সে ভাবল- এটা বুঝি আমাদের দেশি মাগুরের ভাইটাই হবে। কিন্তু না, কী বিশাল তার দাঁত। ‘ওরে বাবা, এটা কী মাছ না উড়োজাহাজ! আমাকে গিলতে তো এক মুহূর্তও লাগবে না।’

একটা হাঙরকে দেখে এবারও চুপসে গেল পুঁটির পুঁচকে ছানাটা। সে এবার উল্টো দিকে পথ ধরল। বাড়ির দিকে। ভয়ে তার দেহ থেকে যেন প্রাণটাই বের হয়ে গেছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে সে শুধু সামনের দিকে ছুটছে। এবার সে এক রাক্ষুসে মাছের খপ্পরে পড়ল। কিছু বুঝে উঠার আগেই সে তার সামনে গিয়ে পড়ল। ‘এবার বুঝি আর রক্ষা নেই।’ মনে মনে সে বলল। বাবা-মার কথা মনে পড়ল। কত বারণ করা সত্ত্বেও সে চলে এসেছে। সবার কথা না শোনার জন্যই আজ সে রাক্ষুসেটার পেটে যাচ্ছে!

পুঁচকেটা আবার দেŠড়াতে শুরু করল। সে দেখল, তার পেছনে অন্য একটা পোকা ছিল। একটু বড়, বেশ নাদুশ-নুদুস। এটাকেই ধরতে এগিয়ে গেল রাক্ষুসে মাছটা। পুঁচকেটা কী আরো দাঁড়িয়ে থাকে। ছুটতে থাকে। সাঁতরাতে থাকে। ভালোভাবে সে নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। সে কেবল ছুটছে। একসময় সে পৌঁছে যায় নিজের গ্রামে। যেখানে পানি কম কিন্তু নিরাপদ।

সে ভাবে- ‘আমার গ্রামই ভালো। এখানে সবাই কত মিলেমিশে থাকে। সবাই কত আপন।’

পুঁচকে পুঁটিটা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়- ‘আর কোনোদিন বড়দের কথা অমান্য করব না। বড়দের কথা মেনে চলব।’

 

 

 

 

 

 

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!