দুর্যোগের রাত –শেষ পর্ব-ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

“আর বলিস না ভাই। গিয়েছিলুম একটু মেয়ের বাড়ি। তা সে কী বিপদ— যাক সে কথা। আমি যখন এসে গেছি তখন তোর আর কোনও চিন্তা নেই। কিন্তু এইখানে এক মুহূর্তও থাকিস না আর।”       “কেন জগাইদা ? এই অন্ধকারে যাব কোথায় আমি ?”

“চল, তোকে আমার পরিচিত একজনদের বাড়িতে রেখে আসি। এই পরিস্থিতিতে মাঠের মাঝখানে কি পড়ে থাকা যায়? তা ছাড়া আকাশের যা অবস্থা তাতে ঝড় এখনই উঠল বলে! একটু পরে তাঁবু টাবু কোথায় থাকবে তা কে জানে?”

বলার সঙ্গে-সঙ্গেই দারুণ একটা ঘূর্ণিঝড় হঠাৎই ধুলোবালি উড়িয়ে চারদিকে ঘুরপাক খেতে লাগল। তারপরই দেখি বাঁধের ওপর আমরা দু’জন। কিন্তু তাঁবু উধাও।

এরপর নামল বৃষ্টি। জগাইদা ভিজে-ভিজেই আমাকে নিয়ে এলেন এক গোয়ালার বাড়িতে। এসে হাঁকড়াক করতেই বাড়ির লোকজন বেরিয়ে এল। জগাইদার বিশেষ পরিচিত এঁরা। জগাইদা বললেন, “আজ রাতটুকুর মতো এই ছেলেটাকে তোমাদের বাড়িতে একটু আশ্রয় দাও দিকিনি। ভদ্রলোকের ছেলে। ওইরকম ফাঁকা জায়গায় এই দুর্যোগে থাকতে পারে কখনও?”

আমি তো আশ্রয় পেলাম। কিন্তু জগাইদা ?

বললাম, “জগাইদা, তুমি কোথায় যাবে? তাঁবুর তো চিহ্ন নেই। তার ওপর এইরকম ঘন ঘন বাজ পড়ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে। শিলাবৃষ্টিও হতে পারে।”

জগাইদা বললেন, “হোক। আমি যে চৌকিদার। এইটাই তো আমার ডিউটি ভায়া। না হলে রেলের অত দামি দামি যন্ত্রপাতি, একটু চোখের আড়াল হলে ওর একটিও অবশিষ্ট থাকবে না আর।”

“সে তো বুঝলাম। কিন্তু ওই দুর্যোগে তুমি থাকবে কী করে?”

“আমার জন্য চিন্তা করিস না। আমরা হচ্ছি জল-কাদার মানুষ। এসব আমাদের গা সওয়া।”

আমি সে রাতে ওই গোয়ালার বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে সত্যিই বেঁচে গেলাম। ওদের বাড়িতে পোস্তর তরকারি, মৌরলা মাছের টক আর পেটভরে ভাত খেয়ে আরামে শুলাম বটে কিন্তু জগাইদার চিন্তায় আমার ঘুম হল না। কেননা জগাইদা চলে যাওয়ার পর দুর্যোগ আরও প্রবল রূপ ধারণ করল। ঘন ঘন বাজ পড়ার শব্দে বুকের ভেতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল আমার।

ভোরবেলা সবে একটু ঘুমিয়ে পড়েছি এমন সময় গুণধর ও গোষ্ঠদার ডাকে ঘুম ভাঙল। দুৰ্যোগ কাটলেও অন্ধকার তখনও কাটেনি। একেবারেই নিশিভোর যাকে বলে। গুণধর বলল, “শোন, আমরা স্টেশন ধারে যাচ্ছি জগাইদাকে দেখতে। তুই সকাল না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাক। বেলায় একবারে শ্মশানে চলে যাবি।”

চমকে উঠলাম আমি, “সে কী ! কেন ?”

“মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে জগাইদা সাপের কামড়ে মারা গেছে। একেবারে জাত কেউটেয় কেটেছে জগাইদাকে। বুঝলি, দারুণ বিষ তীর।”

আমার সারা গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। ওদের কথা যদি সত্যিই হয় তা হলে কাল সন্ধেবেলা কে আমাকে এই বাড়িতে পৌছে দিয়ে গেল ?

আমি সকাল হতেই গোয়ালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে আমাদের সেই কর্মস্থলে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন সেখানে অনেক লোকজন। আমাদের কুলি-খালাসিরাও আছে।

সবাই বলল, “আমরা তোমার কথাই ভাবছিলাম গো। কী দুর্যোগই না গেল কাল। তিন-তিনজন সহকর্মীকে হারালাম। জগাইদা তো মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সাপের কামড়ে মরল। গুণধর আর গোষ্ঠ মরল ফাঁকা মাঠে বজ্রাঘাতে।”

“কখন ?”

“কাল সন্ধেবেলা, নেশা করতে গিয়ে।”

আমার তো হাত-পা তখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এমনও নাকি হয়? আমি আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে স্টেশনের পথ ধরলাম।

সেই শেষ।

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!