সারাটা পথ হেঁটে এসে কেন সেখানে আব্বা দাঁড়িয়ে যেতেন বুঝতে পারতাম না। প্রায়ই আব্বা দুই হাঁটুর উপর হাত রেখে ঝুঁকে পড়তেন। আমি ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করতাম, জোঁকে ধরছে আব্বা? আব্বা তখন নিরুত্তর থাকতেন। আবার হাঁটা শুরু করতেন। প্রতি বৈশাখ মাসে ধানের আঁটি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে এসে থেমে যেতেন! অথচ ক্ষেত থেকে ধানের বোঝা নিয়ে কী এক ছন্দময় দৌড়েই না চলে আসতেন সেটুকু পথ। আমি প্রতিবারই চেষ্টা করতাম আব্বার সাথে পাল্লা দিতে। কিন্তু পেরে উঠতাম না। তবে সেই জায়গার কথা মনে করে খুশিই হতাম, অন্তত সেই জায়গায়তে গেলেই আব্বার গায়ের জোর কমে আসবে। সেখানে দুজন একত্র হতাম। যখন ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়তাম, তখন আব্বাই আমাকে বলতেন সে কথা- ব্রিটিশ সরকার নাকি গোপনে এক ধরনের বোতল পুতে রেখেছিল। যেসব স্থানে এই বিশেষ ধরনের বোতল থাকত সেখানে নাকি বজ্রপাত হত না। এসব স্থান নির্ধারণের একমাত্র উপায় ছিল রেডিও সেট নিয়ে পরীক্ষা করা। যে জায়গার কথা বলছি সেটি আমাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। আমরা বাড়িঘেঁষা জমিতে বীজতলা তৈরি করতাম তাকে “জালাপাট” বলা হত। সেই “জালাপাট” পেরিয়ে স্থানীয় হিসেব মতে দুই চার কানি জমি পেরুলেই সেই জায়গাটি। তো একদিন আব্বার রেডিও সেট নিয়ে সেই জায়গাতে উপস্থিত হলাম। আব্বার ভাষ্যমতে, যেখানে ব্রিটিশ বোতল পুঁতে রাখা হতো, সেখানে রেডিও ট্রানজিস্টর বাজবে না। সেদিন চাচাতো ভাই রফিককে নিয়ে সঙ্গে নিয়ে গেলাম সেই বোতল পরীক্ষা করার জন্যে। কই কি! ফুল ভলিউমে ট্রানজিস্টর বাজছিলই। বুঝতে পারলাম, সেখানে এই বিশেষ কোন বোতল নেই। এই পরীক্ষার পর আরেক নতুন মানসিক যন্ত্রণা শুরু হল। আগে ভাবতাম, এই ব্রিটিশ বোতলের কথা শুধু আব্বা একা নিজেই জানতেন। তাই তিনি সেখানে থমকে যেতেন। কিন্তু এখনতো দেখছি অন্য ব্যাপার! সেই ব্যাপারটি নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হল।
ক্লাস এইটে উঠার পর আর আব্বার সাথে তেমন মাঠে যাওয়া হতো না। বৃত্তি পেতে হবে, স্যার বলে দিয়েছেন। সেজন্য আব্বার সাথে মাঠে গিয়ে কাজ করার তাগদা পেতাম না। আমাদের খুব বেশি জমিজমা নেই। যেটুক ছিল তা আব্বা নিজেই চাষাবাদ করতেন। উপরন্তু অন্যের জমি কিছু বর্গা নিতেন। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক বলতে যা বোঝায় আর কি, আব্বা সেরকম মাপের কৃষক ছিলেন। তাই আব্বাকে সারাদিন মাঠেই পড়ে থাকতে হতো। আমাদের ভাগে- মানে আমার দাদা যেটুকু রেখে গিয়েছিলেন সেটুকুর উপর দুহাত ছড়িয়ে চাষাবাদ করতেন। প্রতি বাংলা বছরের চৈত্র মাস আসার আগেই মা আব্বাকে বলতেন, সামনের মাসেই ‘কিনা’ লাগবো। অর্থ্যাৎ আমাদের ঘরের ধান ফুরিয়ে আসছে। আব্বার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারতাম, এই ‘কিনা’ লাগার সংকেত টা আব্বার কাছে অশনি সংকেত। আসলে আমাদের চাষের জমিগুলোতে অগ্রহায়ন- পৌষ মাস পর্যন্ত বর্ষার পানি লেগে থাকতো। শুধু বোরো মৌসুমেই চাষাবাদ করা যেত। চার কানি জমি তাও এক ফসলি, সংসারে ছয়- সাতটি মুখ- তাতে চইত মাস পর্যন্ত যে খোরাক চলে, এরকম সাংসারিক হিসাব নিকাশ হারহামেশাই চলত বলে গা করতাম না। নিম্নবিত্তের জীবন বুঝি এ রকমই হয়।
আব্বার চলে যাওয়ার অনেকদিন পর বুঝতে পারি, কেন আব্বা সে জায়গায় এলেই থেমে যেতেন। আমার দাদা মহাজনী সুদের উপর টাকা ধার করতেন। এলাকার শাহজাহান মেম্বার সেই মহাজনী সুদের ব্যবসা করতেন। সেবার আমার ফুফুর বিয়ে দেওয়ার সময় দাদা কুড়ি হাজার টাকা ধার করতে গিয়েছিলেন। মহাজন মেম্বার বিরাট অংকের টাকার কথা শুনে আঁতকে ওঠলেন, এত্তো ট্যাকা? শেষমেশ রাজি হয়েছিলেন। এক শর্তে, জমির দলিল বন্ধক দিতে হবে। শাহজাহান মেম্বার এবং আমার দাদার রসায়ন আদৌ খারাপ ছিল না। দাদা এসে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলেন, শমসের তুই কি কস? মেম্বর আমারে ক্ষেতের দলিল বান্ধা দিতে কয়! আব্বা তখনও বিয়ে শাদি করে নি, তাছাড়া তখনও তিনি সাংসারিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান নি। আব্বা দাদাকে বললেন, তুমি যা ভালা মনে করো তাই করো বাজান।
দাদার পক্ষে আর ঋণ শোধ করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এমনকি আব্বাও… এখন এই জমির দলিল কার কাছে আছে কে জানে। তবে মেম্বারের ছেলের দখলে সেই জমি। পেশায় আইনজীবী, সদরুল সাহেব বছরেও পা মাড়ান না মাঠে। তাঁর বাড়ি ঘর দেখাশোনা করে মঞ্জিল মিয়া। আমার সামনেই আব্বা বেশ কয়েকবার মঞ্জিল মিয়াকে ধর্ণা দিতে দেখেছি, উকিল সাবের নম্বরটা যদি দিতা মঞ্জিল মিয়া… শেষ পর্যন্ত আর উকিল সাহেব পর্যন্ত পৌঁছে নি শমসের মিয়ার আকুতি। এইচ.এস.সি পাশ করার পর পরই আব্বা মারা যান। সংসারের যাবতীয় দায় দায়িত্ব এসে আমার কাঁধে এসে বর্তায়। দুটো বোনের বিয়ে দেওয়া, ভাই দুটিকে পড়াশুনা করানো- আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। শেষ পর্যন্ত দুই ভাই আমার কষ্ট বুঝতে পারল, ওষুধ কোম্পানির সাধারণ রিপ্রেজেন্টেটিভ, অল্প বেতন দিয়ে নিজের জীবনই বিপন্ন হবার উপক্রম! তখন কেমন করে সম্ভব দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালানো?
দুই ভাই শহরে জুতার কারখানায় কাজ জুটিয়ে নিয়েছে বেশ আগেই। আর বোন দুটোকে বিয়ে দিতে গিয়ে আমি নিজেই বিক্রি করে দিয়েছি বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বলটুকু। দলিল রেজিস্ট্রিতে শেষবারের মতো সিগনেচার করতে গিয়ে মা মূর্ছা গেলেন, আমার ছেরাইনতের বুঝি আর বন্দ পাও ফেলানোর জায়গা থাকল না! একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পর আর কীসের পিছুটান? মা’কে নিয়ে এলাম আমার কাছে। পুরান এক বিল্ডিংয়ে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি। তিন ভাই মিলে থাকি। মায়ের চাপাচাপির উপর আরও ভাইবোনদের আবদার বাড়ছে, ঘরে এইবার একটা বউ চাই। আমি অবশ্য এখনই সে ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছি না। তিন ভাইয়ের রোজগারে ভালো একটা অংকের টাকা জমেছে। আব্বা প্রায়ই বলতেন, শিক্ষিত হইয়া চাকরি- বাকরি করবা, দেইখো ট্যাকা ব্যাংকে রাইখ্যো না। জমিনে ফেলাইয়ো।
অনেকদিন ঈদে বাড়িতে আসা হয় না। এইবার কোরবানি বাড়িতে এলাম। কুরবানি দেই না প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। গত রোজার ঈদেই ছোট ভাইয়েরা বলছিল, আসছে কোরবানিতে কুরবানি দেব। সেজন্যই বাড়িতে আসা। বাড়িতে এসেই ঘর ঠিক করতে হল। টিনের চালে কিছু নতুন টিন, ইকড়ের বেড়ার বদলে টিনের বেড়া- কোন রকম সংস্কার করা আর কি! টয়লেট, কলপাড় পাকা করেছিলাম, গত রোজার ঈদেই। ভাই দুটিকে নিয়ে মা আব্বার কবর জিয়ারত করবেন বলে গ্রামেই ঈদ করেছিলেন। আমি শহর ছেড়ে আসি নি ছুটি নেই- এই অজুহাতে।
অনেকদিন পর শৈশবের মাঠে পা ফেললাম। সব জমি বিক্রি করে দিয়েছি তো কী হয়েছে? জমির মালিক বদলেছে বটে জমিতো আর বদলায় নি। ব্রাশের ডাঁট হাতের মুঠোতে পুরে পা ভেজাচ্ছি আশ্বিণের শিশির ভেজা আলপথের ঘাসে। মনে পড়ল আবার সেই, স্মৃতি, সেই জায়গা- সেই দুই কানি জমি। ব্রিটিশ বোতলের শংকায় নয় পূর্ব পুরুষদের গ্লানির জায়গাটিতে এসে বুকের নিদারুণ, শুন্যতা আর হাহাকারে স্থবির হল পা। ঝাপসা চোখের উপর বাঁ হাতের পিঠ ঘসে হালকা হতে চাই। আবার হাঁটা ধরেছি সেই বিকিয়ে দেওয়া এক ফসলি জমির দিকে। এখন আর বর্ষার পানি সেই জমিগুলোকে নিজের মত আগলে রাখে না। গত বছর সরকারি ব্যবস্থায় খাল খনন করা হয়েছে। আমনের চারা গুলো মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, চারাগুলো আমাকে নিয়ে এক ধরনের বিদ্রুপই করছে।
পাশের খেত থেকে ছুটে এলো মালিক, যার কাছে বিক্রি করেছি জমি। মাথায় গামছা, হাতে কাস্তে- আমায় দেখেই ছুটে এলো রহমত চাচা। আইছো ভাতিজা, খেত দেখতা আইছো, মাডির টান ভুলন যা নারে ভাতিজা, ভুলন যা না, আমি রহমত চাচার চোখে চোখ রাখতে পারি নি, মাথা নুইয়ে আসে। বাড়ির দিকে হাঁটা ধরতেই রহমত চাচা ডেকে বলল, শোন ভাইস্তা, তুমার বাপের খুব শখ আছিন একটা দুই ফসলি জমির। আল্লাহর কী কুদরত দেহো, তোমরাও জমি বেচলা আর খালও কাডা অইলো। গলায় আটকে থাকা কফটুকু নাক দিয়ে উপরে টেনে শেষবারের মত বলল, সবই মেম্বরের পুতের কাম বুঝলা। সদরুল উকিল না থাকলে আমডার কী যে অইত বুঝলা!
বাড়ি ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে মাথার ভেতর রহমত চাচার কথা গুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো, তুমার বাপের শখ আছিন একটা দুই ফসলি জমির…. ভাবতে লাগলাম “দুই ফসলি জমি” শব্দটা আমায় ধাক্কা দিচ্ছে কেন! মুহুর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো আব্বার চলে যাওয়ার শেষ দৃশ্য। আব্বার নিস্তেজ ঠোঁট চকিতেই নড়ে ওঠলো। বিড়বিড় করে বলছিলেন, আমার দুই ফসলি… কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই মহিউদ্দি ভাই, আব্বার শিথান থেকে বালিশটা সরাতে সরাতে উচ্চস্বরে পড়তে লাগল, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহামাদুর রাসুলুল্লহা…”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।