দুঃখীরামের এই সাজার হুকুম হইল যে, তাহাকে থলের ভিতর পুরিয়া পাথর বাঁধিয়া সমুদ্রে ফেলিয়া দেওয়া হইবে। রাজামশায়ের সামনেই থলে আর পাথর আনিয়া সব বাঁধিয়া ঠিক করা হইল,তারপর রাজা চারিটা জল্লাদকে যে, ‘একে সমুদ্রে ফেলিয়া দিয়া আয়।’
দুঃখীরামকে সকলেই ভালবাসিত। সুতরাং তাহার এই সাজার কথা শুনিয়া সকলেরই ভারি ক্লেশ হইল। পথে যাইতে যাইতে জল্লাদেরা চুপিচুপি পরামর্শ করিল যে, এমন ভাবে লোককে কখনই সমুদ্রে ফেলিয়া মারা হইবে না। এইরূপ স্থির করিয়া তাহারা সমুদ্রের ধারে একটা বনের ভিতরে দুঃখীরামকে রাখিয়া থলের মুখ খুলিয়া দিয়া আসিল। আসিবার সময় তাহাকে একখানি কুড়াল আর এক টুকরো নেকড়া দিয়া বলিয়া আসিল, ‘ছোট মন্ত্রীমশাই, আমরা আর তোমাকে কি দিতে পারি, এই নেকড়া ও কুড়াল নাও, কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে খেও। তোমার দোহাই ছোট মন্ত্রীমশাই, আমাদের রাজার দেশে যেও না। সেখানে তোমাকে দেখতে পেলে রাজা তোমাকেও রাখবে না, আমাদেরও রাখবে না।
দুঃখীরাম এখন কাঠুরে হইয়াছে, লম্বা লম্বা চূল দাড়ি গোঁফ রাখিয়াছে আর নিজের পোষাকটা ফেলিয়া দিয়া সেই জল্লাদের দেওয়া নেকড়াখানা পরে। ভাল করিয়া স্নান না করাতে তাহার গায়ের রং ময়লা হইয়া গিয়াছে। পেট ভরিয়া খাইতে না পাওয়াতে ঢের রোগা হইয়া গিয়াছে। এখন তাহাকে দেখিলে আর চট করিয়া চেনা যায় না। এইরূপ অবস্থায় কষ্টে দুঃখীরামের দিন কাটিতে লাগিল।
একদিন কাঠ কাটিতে বাহির হইয়া দুঃখীরাম দেখিল যে, ঝরনার ধারে গাছতলায় এক বুড়ি ঘুমাইতেছে। সে এতই বুড়া হইয়াছে যে, তেমন বুড়ামানুষ আর দুঃখীরাম কখনো দেখে নাই। বুড়িকে দেখিয়া সে চলিয়া যাইতেছে, এমন সময় দেখিল যে, একটা বিষাক্ত সাপ চুপিচুপি সেই বুড়ির দিকে যাইতেছে। দুঃখীরাম তখনই কুড়াল দিয়া সাপটাকে টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিল আর সেই টুকরাগুলি ঝরনার জলে ফেলিয়া দিল। কি আশ্চর্য! সেই টুকরাগুলি জলে পড়িবামাত্র জলটা টগবগ করিয়া ফুটিতে লাগিল। তাহার শব্দ শুনিয়া বুড়ি ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বসিল।
বুড়ি খানিক অবাক হইয়া ঝরনার দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর দঃখীরামকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি কে বাবা?’ দুঃখীরাম বলিল, ‘আমি দুঃখীরাম”’ বুড়ি বলিল, ‘বাবা, তুমি কি চাও?’ দুঃখীরাম বলিল, ‘আমি কিছুই চাই না। তুমি বুড়োমানুষ বনের ভিতর কোন আসিয়াছ? কত জন্তু আছে, শীঘ্র চলিয়া যাও।’ বুড়ি বলিল, ‘বাপু, তুমি আমাকে প্রাণে বাঁচাইয়াছ, আমি তোমাকে কিছু না দিয়া অমনি যাইতে পারিতেছি না।’ দুঃখীরাম কিন্তু কিছুই লইবে না, সুতরাং বুড়ি চলিয়া গেল। কিন্তু যাইবার সময় চুপিচুপি বলিয়া গেল, ‘তুমি কিছু লইলে না-আচ্ছা আমি তোমাকে এক বর যাইতেছি যে, তুমি যাহা ইচ্ছা কর তাহাই হইবে।’ দুঃখীরাম ততক্ষণে কুড়াল হাতে অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে, সুতরাং এ সকল কথা সে শুনিতে পাইল না।
আজ দুঃখীরামের ঢের বেলা হইয়া গিয়াছে। কখন কাঠ কাটা হইবে, সেই কাঠ বাজারে বিক্রি হইবে, তবে তাহার পেটে দুটি ভাত পড়িবে। এ-সকল কথা ভাবিয়া বেচারীর মনটা একটু দঃখিত ছিল, তাই তত সাবধান হইয়া পথ চলিতে পারিতেছে না। সামনে একটা ছোট গাছ পড়িয়াছিল, তাহাতে হোঁচট খাইয়া দুঃখীরাম পড়িয়া গেল। একে মন ভাল নহে, তাহার উপর এরূপ দূর্ঘটনা হইলে কাহার না রাগ হয়? দুঃখীরাম রাগিয়া বলিল, ‘দূর হ ছাই। এ মুল্লুকে গাছপালা না থাকিলেই ভাল ছিল।’
যেই এ কথা বলা, আর অমনি সেখানকার যত গাছপালা সব কোথায় চলিয়া গেল, যেখানে ভয়ানক বন ছিল,সেখানে খালি মাঠ ধূ ধূ করিতে লাগিল। কি সর্বনাশ! এখন কাঠই বা কোথা হইতে মিলে, আর দুঃখীরামের খাওয়াই বা কি করিয়া হয়? বেচারা ব্যাপার দেখিয়া একেবারেই অবাক! ইহার কারণ কিছুই ঠিক করিতে না পারিয়া আপনমনে খালি হাটিয়া চলিল। বেলা ঢের হইয়াছে ক্ষুধা আরো বেশী হইয়াছে, এমন অবস্থায় শুধু পথ চলিলেই কত কষ্ট, তাহাতে আবার হাতে প্রকাণ্ড কুড়াল। সে যে-সে কুড়াল নয়,জল্লাদের কুড়াল। সাধারন কুড়ালের দুখানার সমান তাহার একখানা ভারি হয়। সেদিন দুঃখীরামের কাছে সেটা যেন দশটা কুড়ালের মত ভারি ঠেকিতে লাগিল, আর সেটাকে বহিয়া নিতে ইচ্ছা হয় না। সুতরাং দুঃখীরাম সেটাকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া বলিল আর পারি না, অত বড় কুড়ালের হাত পা-থাকা উচিত, তাহা হইলে আমার সঙ্গে চলিতে পারে।’
কুড়াল তাহাই করিল। কোথা হইতে মাকড়সার পায়ের মতন তাহার সব পা হইল। আর সে টুকটাক করিয়া দুঃখীরামের পিছু পিছু চলিল। দেখিয়া শুনিয়া বেচারার মাথায় আরো গোল লাগিয়া গেল। সে একভাবেই চলিয়া যাইতে লগিল, আর ভাবিতে লাগিল, হইল কি!
যাইতে যাইতে দুঃখীরাম একেবারে নিজের দেশের বাজারে গিয়া উপস্থিত। প্রভুভক্ত কুড়াল সঙ্গেই আছে। সে এমনিভাবে চলিয়াছে, যেন চিরকাল তাহার ঐরকম করিয়াই চলা অভ্যাস।
একটা কুড়াল যদি লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া তোমার সামনে দিয়া চলিয়া যায়, তুমি তাহা হইলে কি কর? আর তেমন একটা কুড়াল যদি বাজারে গিয়া উপস্থিত হয়,তাহা হইলে বাজারের লোকগুলিই বা কি করে? বাজারে প্রথম মোড়েই এক গোয়ালার দোকান। সেখানে এক বড়লোকের দারোয়ান ঘি কিনিতে আসিয়াছে। গোয়ালার হাতে ঘিয়ের বাটি দিয়া সবে সে পৈঠায় বসিয়া তামাকু খাইবার আয়োজন করিতেছিল, এমন সময় হঠাৎ ফিরিয়া চাহিয়া দেখে, দুঃখীরামের সেই কুড়াল হাত-পা সুদ্ধ একেবারে তাহার সামনে উপস্থিত। ‘হায় বাপ’ বলিয়া চারি হাত-পা উর্দ্ধে উঠাইয়া দারোয়ানজী আপনিই এক লাফে একেবারে গোয়ালার ঘাড়ে গিয়া উঠিল। গোয়ালাও তাড়াতাড়ি দারোয়ানজীকে ঠেলিয়া মাখনের হাঁড়িতে, ঘরে দরজা আঁটিল। তারপর যখন দেখিল যে, সেটা কাহাকেও কিছু বলে না, তখন দরজা খুলিয়া তাহার পিছু পিছু তামাশা দেখিতে চলিল।
সেদিন বাজারে কেনাবেচা বন্ধ। বাবুদের চাকর যাহারা বাজার করিতে আসিয়াছিল, তাহারা সকলেই কুড়ালের পিছু পিছু চলিয়াছে, তাহাদের বাজার করা আর হয় নাই। দোকানীরাও তাহাই করিতেছে-পুলিশ-পাহারাদার সকলেই সেই কুড়ালের পিছু চলিয়াছে। চাকরদের সান লইতে বাবুরা আসিয়াছিলেন, তাঁহারাও সেই কুড়ালের তামাশা দেখিতেই রহিয়া গেলেন। এইরূপ করিয়া দেশের প্রায় কল লোক সেইখানে আসিয়া জড়ো হইল। দুঃখীরামের সেই মামা আর মামাত ভাই কেষ্ট আর হরিও তাহাদের ভিতরে ছিল।
কেষ্ট আর হরি প্রথমে কুড়ালের তামাশা দেখিতেই ব্যস্ত ছিল, তারপর একবার যেই দুঃখীরামের মুখের উপর চোখ পড়িল, অমনি তাহাদের বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল। ভাল করিয়া দেখিয়া তাহারা বেশ বুঝিতে পারিল যে, এ দুঃখীরাম। সুতরাং তাহারা তাড়াতাড়ি মন্ত্রীর নিকট গিয়া খবর দিল, ‘মন্ত্রীমহাশয়, সেই দুখেটা আসিয়াছে।’ মন্ত্রী অবিলম্বে এই সংবাদ রাজাকে দিলেন আর বলিলেন, ‘মহারাজ, কুড়াল কি কখনো হাঁটে? এ নিশ্চয় কোন জাদু-টাদু শিখিয়া বদ মতলবে এখানে আসিয়াছে। রাজা শুনিয়া বলিলেন, ‘ঠিক বলিয়াছ, মন্ত্রী। এখনি দশজন সিপাহী পাঠাইয়া দাও, উহাকে বাঁধিয়া নিয়া আসুক।’ রাজার হুকুমে দানবের মত দশটা পালোয়ান দুঃখীরামকে আনিতে চলিল।
এদিকে বাজারের লোকেরা দুঃখীরামকে তত গ্রাহ্য করে নাই, কিন্তু তাহার কুড়ালটাকে রাজার কাছে লইয়া যাইতে অনেক চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু সে কুড়ালের গায়ে কি ভয়ানক জোর! তাহার গলায় দড়ি বাঁধিয়া বাজারের সমস্ত লোক মিলিয়া কত টানিল, কিছুতেই তাহাকে এক পাও নাড়িতে পারিল না। বরং তাহারা যে দশ মিনিট ধরিয়া প্রাণপণে ‘হিঁয়ো’ করিয়াছে, ততক্ষণে দুঃখীরামের কুড়ালই তাহাদিগকে আধ মাইল খানেক টানিয়া লইয়া গিয়াছে।
এমন সময় রাজার পালোয়ানেরা আসিয়া দুঃখীরামকে বাঁধিতে লাগিল। দুঃখীরমের কাছে আজ আর কিছুই আশ্চর্য বলিয়া বোধ হয় না। সে কেবল দেখিতেছে, এরপর কি হয়। স্বয়ং বড় মন্ত্রী পালোয়ানের সঙ্গে আসিয়াছেন,আর বলিতেছেন, ‘শক্ত করিয়া বাঁধ।’ এ কথা শুনিয়া দুঃখীরাম নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বলিল, ‘অন্যে বেলা বলা খুব সহজ; তোমাকে একবার ওরকম করিয়া বাঁধিত তবে দেখিতে কেমন লাগে।’
অমনি চারটা পালোয়ান মন্ত্রীমশায়কে চিত করিয়া ফেলিয়া ঠিক দুঃখীরামের মতন করিয়া বাঁধিতে লাগিল। মন্ত্রীমহাশয় প্রথমে আশ্চর্য বোধ করিলেন, তারপর চটিয়া লাল হইলেন। কিন্তু পালোয়ানেরা তাঁহাকে গ্রাহ্য করিল না। রাগে মন্ত্রীমহাশয়ের কথা বাহির হইতেছে না, চোখ দুটো ফুটিয়া বাহির হইবার উপক্রম হইয়াছে, গলার শিরা ফুলিয়াছে, মুখে ফেনা উঠিতেছে। কিন্তু পালোয়ানেরা তথাপি তাহাকে বাঁধিতে কসুর করিতেছে না। বেশ করিয়া বাঁধিয়া তারপর পরীক্ষা করিয়া দেখিল, ঠিক দুঃখীরমের মতন বাঁধা হইয়াছে কি না। যখন দেখিল যে দুজনকেই ঠিক একরকম করিয়া বাঁধা হইয়াছে, তখন তাঁহাদিগকে কাঁধে করিয়া রাজার নিকট লইয়া চলিল। বাজারের লোকেরা এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখিয়া অবাক হইয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
এই সকল লোক যখন রাজার কাছে উপস্থিত হইল, তখন রাজামহাশয়ের ভারি রাগ হইল এমনও নহে। মন্ত্রীর বাঁধন তিনি নিজ হাতে খুলিয়া দিলেন, তারপর তাঁহাকে লইয়া দুঃখীরমের বিচার করিতে বসিলেন। যে সকল পালোয়ান মন্ত্রীমশায়কে বাঁধিয়া আনিয়াছিল, প্রথমে তাহাদের ফাঁসির হুকুম হইল। দুঃখীরামের সম্বন্ধে একটা হুকুম দিবার পূর্বেই আহারের সময় হওয়াতে মাঝখানে রাজামহাশয় উঠিয়া গেলেন, খাওয়া-দাওয়ার পর দুঃখীরামের হুকুম হইবে।
দুঃখীরাম বেচারা সেই বাঁধা অবস্থাতেই পড়িয়া আছে। তাহার চারধারে বিস্তর প্রহরী আছে, দর্শদিগেরও অধিকাংশই রহিয়া গিয়াছে। দুঃখীরামের দুঃখের কথা আর কি বলিব। অন্য কষ্টের বিষয় আর এখন ততটা ভাবে না, কিন্তু ক্ষুধা ত কিছুতেই থামিয়া থাকিবার নহে। রাজামহাশয়, মন্ত্রীমহাশয়, সকলেই আহার করিতে গিয়াছেন। কত সুখাদ্য জিনিস খাইয়া তাঁহারা পেট ভরিয়া আসিবেন। দুঃখীরাম দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, ‘আহা, ওসব জিনিস যদি আমাকে কেহ এখন আনিয়া দিত!’
রাজা মহাশয় আহারে বসিয়াছেন, সোনার পাত্রে শত ব্যাঞ্জন সাজাইয়া তাঁহার সামনে রাখিয়াছে তাহার সুগন্ধে নাকে গেলে লম্বা লম্বা নিশ্বাস টানিতে ইচ্ছা হয়, জিভে জল আসে। হাত ধুইয়া সবে রাজামহাশয় খাইবার উপক্রম করিয়াছেন, অমনি থালাসুদ্ধ খাবার জিনিস কোথায় মিলাইয়া গেল! মন্ত্রীমহাশয়েরও ঐরূপ দশা হইল।
এদিকে দুঃখীরামের আপে শেষ না হইতে না হইতেই তাহার সামনে রাজা ও মন্ত্রীর আহারের সমস্ত আয়োজন আসিয়া হাজির হইল। দুঃখীরাম তাহাতে কিছুতেই আশ্চর্য বোধ করিল না। তাহার খালি দুঃখ হইতে লাগিল, ‘হায় হাত পা বাঁধা!’ বলিতে বলিতে তখনি তাহার বাঁধন খুলিয়া গেল, সে এক লাফে উঠিয়া বসিয়া দু হাতে লুচি, মাংশ, পোলাও, পায়স, মেঠাই, মোণ্ডা মুখে পুরিতে লাগিল।
প্রহরীরা ব্যাপার দেখিয়া এতক্ষণে হতবুদ্ধি হইয়া ছিল। হঠাৎ তাহাদের চৈতন্য হইল। একজন বলিল, ‘আরে ধর, পালাবে।’ আর একজন বলিল, ‘কোথায় আর পালাবে, আমরা এতজন চারধারে দাঁড়িয়ে আছি। আহা, বেচারার সামনে এত জিনিস এসেছে,একটু খেয়ে নিতে দে।’ ও কথা শুনিয়া সকলেই বলিল, ‘আহা, খাক্ খাক্! দুঃখীরাম ইহাতে কৃতার্থ হইয়া বলিল, ‘বাপুসকল, তোমরা রাজা হও।’
সেই রাজসভায় রাজার সিংহাসন ছিল। দেখিতে দেখিতে সেখানে তেমনি আরো হাজার সিংহাসন হইল। তারপর সকলেই রাজার মত বেশভূষা হইল, আর তাহারা এক-একটা সিংহাসনে উঠিয়া বসিল।
রাজামহাশয় সভায় আসিয়া দেখেন, তাঁহার মতন ঢের রাজা সভায় বসিয়া আছে। তাহারা তাহাকে বলিল, ‘মহারাজ, উহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হউক।’ রাজা আর কি করেন, এতগুলি রাজার অনুরোধ ঠেলিয়া ফেলা ত সহজ কথা নয়। কাজেই দুঃখীরাম তাড়াতাড়ি খালাস পাইল।
এমন সময় মন্ত্রীমহাশয় আসিয়া উপস্থিত। তিনি এতগুলি রাজাকে একঠাঁই দেখিয়া একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। যেদিকে চান সেই দিকেই রাজা, আর মন্ত্রীমহাশয় খালি দু হাতে সেলাম করেন। সেদিন পেটে ভাত অল্পই পড়িয়াছিল, তাহাও হাজার রাজাকে সেলাম করিতে করিতে কখন হজম হইয়া গেল।
দুঃখীরামের কথা শুনিয়া মন্ত্রীমহাশয় যার পর নাই ব্যস্ত হইলেন। জোড়হাতে তিনি রাজাদিগকে অনুনয় করিতে লাগিলেন, ‘দোহাই ধর্মাবতারগণ, পুনরায় ইহার বিচার করিতে আজ্ঞা হয়। এমন দুষ্ট লোককে সহজে ছাড়িয়া দিবেন না, কখন কার সর্বনাশ করে তার ঠিক নাই।’ এই কথা শুনিয়া রাজাদের ভিতর হইতে একজন বলিল, ‘সর্বনাশটা যে কে করলে, তা ত বুঝতে পারছি না। আমি তোমার মেথর ছিলাম, আর আজ আমাকে রাজা করে দিয়েছে। এই এখনি তুমি দু হাতে আমাকে কত সেলাম করলে!’
মন্ত্রীমহাশয় আশ্চর্য হইয়া দেখিলেন, সত্যি সত্যি তাঁহার মেথর রাজা সাজিয়া বসিয়া আছে, আর তিনি তাহাকে সেলাম করিয়াছেন। ক্রমে দেখা গেল যে, যত রাজা বসিয়া আছে সকলেই কেহ সহিস,কেহ পাইক, কেহ দারোয়ান, কেহ দোকানী, কেহ ভিখারী।
রাজামহাশয় আর মন্ত্রীমহাশয় লজ্জা রাখিবার আর স্থান পান না। রাজা তাড়াতাড়ি হুকুম দিলেন, ‘আবার বিচার হইবে, উহাকে ধর।’ কিন্তু কে ধরিবে? সবাই রাজা সাজিয়া বসিয়াছে, হুকুম খাটিতে কাহারো ইচ্ছা নাই, অগত্যা মন্ত্রীমহাশয়ই ধরিতে গেলেন। দুঃখীরাম তাহা দেখিয়া বলিল, “মন্ত্রীমহাশয়, অত কষ্ট করেন কেন? এই যে আমি হাজির আছি। কিন্তু আমার প্রাণদণ্ড হইলে আমাকে মারিবে কে? জল্লাদ যে রাজা হইয়া গিয়াছে। এখন আপনি আর রাজামহাশয় জল্লাদ হইলে তবে হয়।“
বলিতে বলিতে রাজা ও মন্ত্রীর সেই সুন্দর চেহারা আর জমকালো পোষাক কোথায় চলিয়া গেল, তাহার পরিবর্তে নেংটি-পরা, কুড়াল-হাতে, কালো ভূত দুই জল্লাদ জোড়হাতে হুকুমের অপেক্ষাকরিতে লাগিল। এখন হুকুম দেয় কে?
দুঃখীরাম এতক্ষণে বুজিতে পারিয়াছে যে, যে কারণেই হউক, সে যে ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছে, ঘটনায় তাহাই হইতেছে। ইচ্ছা করিলে এখন সে কি না করিতে পারিত। কিন্তু সে বলিল, ‘মহারাজ আপনার নুন খেয়েছি, আপনার নিকট অকৃতজ্ঞ হইব না। আপনার রাজত্ব আপনারই রহিল। এখন আমাকে বিদায় দিতে আজ্ঞা হউক।’
লজ্জায় রাজামহাশয় মাথা হেট করিয়া আছেন। দুঃখীরামের কথার তিনি আর কি উত্তর দিবেন। কেবল বলিলেন, ‘আমার সমস্ত রাজ্যই তুমি লইতে পারিতে, ইচ্ছা করিলে আমায় প্রাণেও মারিতে পারিতে। এখন তুমি যাহা বলিলে তাহাতে বুঝিলাম, তুমি মহৎ লোক। আমার অর্ধেক রাজ্য তোমার হউক, আমার কন্যাকে তুমি বিবাহ করিয়া সুখে রাজত্ব করো।’
দুঃখীরাম রাজকন্যাকে বিবাহ করিয়া পরমসুখে রাজত্ব করিতে লাগিল।
আর-সকলের কি হইল? মন্ত্রীমহাশয়ের সম্বন্ধে দুঃখীরাম কিছু বলে নাই, সুতরাং তিনি জল্লাদই রহিয়া গেলেন। যাহারা রাজা হইয়াছিল, তাহাদের সম্বন্ধে এক নতুন মুশকিল উপস্থিত হইল।
রাজা হইয়াছে বটে, কিন্তু এত রাজ্য কোথায় পাইবে? অথচ সকলেই বলে, ‘আমি রাজা হয়েছি যে, কাজ কেন করব?’ ইহাতে ভারি অসুবিধা হইতে লাগিল। দুঃখীরাম বলিল, ‘বাপুসকল, তোমাদের রাজা-টাজা হইয়া কাজ নাই, তোমরা যার যার যোগ্যতা অনুসারে কাজকর্ম কর গিয়া, আর সৎপথে থাকিয়া সুখে দিন কাটুক।’
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—–উপেদ্রকিশোর রায়চৌধুরী