দুঃখিনী মা—-মুহাম্মদ ইরবাহীম বাহারী

দুঃখি বু ও দুঃখি বু তুমি এখানে! আর আমি সারা বাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান। ঐ দেখ, এক বাবু আসছে তোমার খোঁজে। হাতের কোদালটি এক পাশে রেখে দুঃখি তাকিয়ে দেখে ওলী মাঝির মেয়ে রোকেয়া হাতের ইশারায় রাস্তার দিকে কি যেন ইঙ্গিত করে দেখাচ্ছে। একটি সাদা ধবধবে প্রাইভেট কার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে এইদিকে। দুঃখির দিকে। আগে পিছে গাঁয়েরই বেশ কিছু ছেলে পেলে। ওরাও যেন হাত দিয়ে দুঃখিকে দেখাচ্ছে কার আরোহীদের। কি বলছিস রোকেয়া আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। এই ক’টি শীমের বীজ লাগাবো এই জন্যই এখানে আসলাম। আর তোরা আমার কাজে বাধা দিচ্ছিস। আরে না-না দুঃখি বু বাধা দেব কেন, সত্যি কথা বলছি। ঐ দেখ সাদা গাড়িটা না, ওটায় চড়ে আসছে বাবু। রোকেয়া রাস্তা থেকে ধেয়ে আসা কারটি দুঃখিকে দেখায়। দুঃখি বু; ঐ বাবু কিন্তু তোমার নাম জানে না, বলে কি ঐ যে মস্কো শহরে বিয়ে হয়েছিল পরে স্বামী হারা হয়ে এখানে থাকে। আমরা তো প্রথমে বুঝতেই পারিনি কি বলতে চায় ঐ লোকটা। কাকে খুঁজে? পরে হাসান কাকুইনা কইল বাবু যা বলতে চায় তা হচ্ছো তুমি। তোমাকে বাবু খুঁজছে। দুঃখি বু, সত্যিই বাবু টানা একটা রাজ পুত্তর। দেখতে রাজ পুত্রের মতোই। পরনে জিন্সের প্যান্ট শার্ট, গলায় টাই হাতে সোনালী রংয়ের ঘড়ি….। কিন্তু দুঃখি বু আমি বুঝতেই পারছিনা ও তোমায় কেন খুঁজছে? একটানা কথাগুলো বলে যায় রোকেয়া। এর মাঝে দুঃখি দেখে আঠার বিশ বছরের এক তাগড়া যুবক সাদা প্রাইভেট কার থেকে নেমে এক প্রকার হন্যে হয়েই সোজা তার দিকে এগিয়ে আসছে।

দুঃখি একটি নাম; একটি মেয়ের নাম। যার বয়স এখন ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর হবে। কিন্তু দেখলে মনে হয় পঞ্চাশ বছরের বুড়ো। দুঃখির আসল নাম মরিয়ম জামিলা। বাবা ছিলেন আমিরাবাদ নুরজাহান হাই স্কুলের পিয়ন। প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ে একদিন আমিরাবাদ নুরজাহান হাই স্কুল দুমড়ে মুচড়ে বিধ্বস্ত হয়। স্কুলের প্রতি একান্ত অনুরাগী কর্মচারী-পিয়ন রহমান বিধ্বস্ত স্কুলের ফাইল পত্র কুড়াতে গিয়ে ছেঁড়া তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। বিয়ের মাত্র দেড় বছরের মাথায় স্বামী হারিয়ে সাহারা বিবির সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনও দুঃখির জন্মের তিন মাস বাকী। পেটের সন্তানের কচি মুখের আশায় অনিবার্য ধৈর্য ধরেছিল সে দিন সাহারা বিবি। কিন্তু তারপরও চিন্তায় চিন্তায় কংকালসার হয়ে পড়েছিল সাহারা। দুর্বল শরীর নিয়ে একদিন প্রসব বেদনায় ছটপট করতে থাকে সাহারা। প্রতিবেশীরা যখন তার সাহায্যে এগিয়ে এল, তখন সাহারা একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে চির নিদ্রায় শুয়ে পড়ল। সেদিন এই অসহায় মেয়েটির লালন পালনের দায়িত্ব নিজেই নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন প্রতিবেশী জাহের চৌধুরী। তিনি মেয়েটির নাম রেখেছিলেন মরিয়ম জামিলা। ডাকেন দুঃখি বলে।

জাহের চৌধুরী নিজ ঘরে একজন আয়া রাখেন দুঃখির লালন পালন দেখা শুনার জন্য। আয়া হাসিনার তত্ত্বাবধানে দুঃখি বড় হলেও জাহের চৌধুরী সারাটা সময় মেয়েটাকে চোখে চোখে রোখেন, আদর করেন। দেখেন নিজ সন্তানের মতোই। দুঃখি হাসিনাকে বুবু ডাকে আর জাহের চৌধুরীকে ডাকে নানা।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার দুঃখি নাম ঘুছে যায়। কতই বা হবে বয়স মেয়েটির, প্রায় তিন বছর। তার হাসি তমাশা, জ্ঞান, বুদ্ধি, দুষ্টামী দেখলে কে-ইবা বলবে বাপ-মা হারা এই এতিম অন্যের ঘরে বেড়ে উঠছে। দুঃখিকে কেউ এখন আর দুঃখি বলে ডাকে না। ডাকে জামিলা বলে। জাহের চৌধুরীই একদিন সকলকে বলে দিয়েছিলেন দুঃখিকে এখন থেকে কেউ আর দুঃখি বলে ডাকবে না। ডাকবে জামিলা বলে।

সারাদিন জামিলা নানা খেলা, গল্পে মাতিয়ে রাখে পুরো বাড়িটা। একা একা কথা বলে, আয়নায় দাঁড়িয়ে হাসে খেলে, এইভাবে কাটে তার প্রতিদিন। হয়ত বাগানে খেলছিল; হঠাৎ করে বলে উঠবে, ‘‘দেখ দেখ কি সুন্দর প্রজাপতি।’’ আবার হাততালি দিয়ে হয়ত গানই জুড়ে দিল, ‘‘প্রজাপতি প্রজাপতি-কোথায় পেলে এত সুন্দর পাখা।’’

প্রতিদিন নানা যখন বাজারে যান জামিলার জন্য একটা না একটা খেলনা তিনি নিয়েই আসেন। আজ লাল টুকটুকে পুতুল, কাল চাবি দেয়া খেলনা গাড়ি, আরও কত কি। একদিন জামিলা  জাহের চৌধুরীকে প্রশ্ন করল, ‘‘আচ্ছা নানা ফ্যান যখন ঘুরে, তখন এত বাতাস কেন আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়? ফ্যানের ভিতর কি বাতাসের বাসা?’’

কখনো হয়তো জিজ্ঞেস করে; ‘‘নানা এত বড় আকাশটা আমরা ছোট ছোট দুটো চোখ দিয়ে দেখি কিভাবে?’’ জামিলার এই প্রশ্নে ভীষণ মজা পান জাহের চৌধুরী। মনে মনে, ভাবেন সত্যিই মেয়েটি চমৎকার, মেধা ও চিন্তায় সে অন্য দশটা মেয়ে থেকে ভিন্ন হবে নিশ্চয়।

সময় চলে যায়। মানুষের জীবনেরও পরিবর্তন ঘটে। জিপিএ-৫ নিয়ে এস.এস.সি পাশ করে ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হয় জামিলা।

জাহের চৌধুরী মেয়েটিকে সাথে করে কলেজে নিয়ে যান। আবার ক্লাস শেষে এক সাথে বাড়ি ফিরে আসেন। চৌধুরী সাহেবের একান্ত ইচ্ছা; উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন তিনি জামিলাকে। মেধা, জ্ঞান, বিচক্ষণতা, চিন্তা ও সময়ানুবর্তিতা কোন দিকেই কমতি নেই ওর। নিজের দু’টি ছেলেকে স্ব হস্তে তৈরি করে ছিলেন জাহের চৌধুরী। বড় ছেলে মাসুম বর্তমানে ও, আই, সি, তে কর্মরত। ছোট ছেলে নোমান কেমব্রীজে এম ফিলে গবেষণারত। কোন মেয়ে ছিলনা চৌধুরী সাহেবের। তাই নিজ মেয়ের আসনেই বসিয়েছেন তিনি জামিলাকে। এমনই সময়ে একদিন ছোট ছেলে নোমানের চিঠি পেয়ে তার সকল পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে। নোমান পরিষ্কার ভাষায় বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে জামিলার জন্য তিনি যা করেছেন এতেই যথেষ্ট হয়েছে। এখন আর ওকে ঘরে আটকিয়ে রেখে লাভ নেই। একটি ভাল পাত্র দেখে ওর স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করাই হবে উত্তম। আগামীতে বড় ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা………… পরিবারের আরও অনেক বিষয়ে লিখেছে নোমান।

চৌধুরী সাহেবও ভাবেন সত্যিই তো, বাবা মা হারা একটি এতিম মেয়ের জন্য তিনি কমই বা কি করেছেন। হয়তোবা তার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ হবে না। উচ্চ শিক্ষিত করতে পারবেন না তিনি জামিলাকে। অপরদিকে তার সময়ও ফুরিয়ে আসছে। দিনের পর দিন শরীরটা নজু হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার অন্তিম সময়। এখন একজন ভালো ছেলের হাতে জামিলাকে তুলে দেয়াই হবে তার প্রধান কাজ। এতে তার দুই ছেলেও খুশী হবে আবার জামিলার জীবনও নতুন কুলে আশ্রয় পাবে।

জামিলাকে নিয়ে কলেজ থেকেই বাড়ি ফিরছিলেন জাহের চৌধুরী। বাড়ির সদর দরজায় দেখেন মুন্সী বাড়ির ওহিদ মুন্সী দাঁড়িয়ে। কুশল বিনিময়েই চৌধুরী সাহেব জানতে চান, দেশে কবে আসলেন মুন্সী সাহেব। ঢাকার অবস্থা কি? ব্যবসা বাণিজ্য কেমন চলছে? ইত্যকার আরও বহু কথা। ভাব বিনিময়ে দু’জন আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

ওহীদ মুন্সী এবার কথা শুরু করল। চৌধুরী সাহেব, জানলাম আপনার নানতি মানে জামিলাকে ডাক্তারী পড়াতে আপনার একান্ত ইচ্ছে। মেয়েটির জন্য তো আর আপনি কম করেননি। বয়সও অনেক হয়েছে আপনার, ওদিকে প্রবাসী ছেলেদের তাগাদাও আপনার প্রতি রয়েছে। মুন্সী ওহীদ বলে চলেন, আমার ছেলে মুন্সী মামুন আজ দুই বছর মস্কো প্রবাসী। ইঞ্জিনিয়ারিং এ উচ্চ ডিগ্রী নিচ্ছে মামুন ওখানে। আপনার যদি ইচ্ছা থাকে তাহলে মামুনের বউ করে আমি জামিলাকে নিয়ে যেতে চাই। আমার আপনার ইচ্ছার আলোকে মামুন জামিলাকে ডাক্তার হিসেবে তৈরি করবে। চৌধুরী সাহেবের মাথাটা অলক্ষ্যেই আল্লাহ্র পায়ে সেজদাবনত হয়ে পড়লো। নিজে নিজেই বলে ওঠেন ওহীদ চৌধুরী সত্যিই মেয়েটি ভাগ্যবতী। পথকলি হয়ে যে মেয়ে বেড়ে ওঠার কথা, আজ যে কিনা অন্যের ঘরে ঝি এর কাজ করবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। সময় তাকেই আজ মুন্সী বাড়ির সেরা সন্তান ঢাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি মুন্সী ওহীদের একমাত্র ছেলের বউয়ের আসনে বসিয়েছে।

আজ রাতেই বিয়ে। টেলিফোনে বিয়ে হবে। পাত্র মানে মামুন ফোন করবে মস্কো থেকে। আর এখানে কবুল করবে জামিলা। আগামী কাল দুপুরের ফ্লাইটে জামিলা মামুনের উদ্দেশ্যে মস্কো রওয়ানা হবে। সাথে যাবেন শাশুড়ী এবং শ্বশুর মুন্সী ওহীদ। বেশ তো। আজ কাল তো ফোনে অনেক বিয়েই হচ্ছে। জাহের চৌধুরী কোন আপত্তি তোলেন না। মনে একটু ইতস্তত ভাব জন্মেছিল একবার, পাত্র না দেখে বিয়ে! আবার নিজেই নিজের মনকে প্রবোধ দেন। মামুন তার এলাকারই ছেলে, ছোটকালে দেখেছেনও তিনি মামুনকে। উচ্চ ডিগ্রী নিতে ব্যস্ত মামুন। জামিলার উপস্থিতিতে মামুন আরো পুলকিত হবে। উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে একদিন দু’জনেই জাতির সেরা সম্পদে পরিণত হবে। ফিরে আসবে দেশে, সেদিন হয়তোবা জীবিত থাকবেন না জাহের চৌধুরী নিজে।

কিন্তু না। জামিলার সুখ স্থায়ী হয়নি। হারিয়ে গেছে তার সর্বস্ব। মুন্সী ওহীদ জামিলাকে ঠকিয়েছে। প্রতারণা করেছে জামিলার জীবনের সাথে। একটা সম্ভাবনা-একটা প্রতিভাকে গলাটিপে হত্যা করেছে মুন্সী ওহীদ। বিয়ের মাত্র নয় মাসের মাথায় মারা গেছে মামুন। মস্কো আসার কয়েক দিন পরেই মামুন আক্রান্ত হয় ব্লাড ক্যান্সারে। অনেক চেষ্টার পরও যখন বুঝলেন মামুন আর সেরে উঠবে না তখনই মুন্সী ওহীদ সিদ্ধান্ত নেয় তার উত্তরাধিকারের জন্য ছেলেকে তিনি বিয়ে করাবেন। কিন্তু কীভাবে? জানলে কিংবা মামুনকে দেখলেতো আর কেউ মেয়ে দিবেনা। তাই উচ্চ শিক্ষায় ব্যস্ততার অযুহাতে মামুনকে মস্কোতে রেখে জামিলার মত একটি সম্ভাবনাকে তিনি ভাগিয়ে নিলেন। বলা যায় মেহেদী হাতেই জামিলা স্বামী মামুনের ডেড বডি নিয়ে মস্কো থেকে ঢাকার বারিধারার শ্বশুরালয়ে উঠে। মামুনের মৃত্যুর চার মাস পর জামিলা জন্ম দেয় এক পুত্র সন্তান। মামুনের নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখা হয় মারুফ।

ভেবে ছিল জামিলা ছেলের মুখ দেখে দিব্যি বেঁচে থাকবে বাকী জীবন। বিরাট বড় লোক শ্বশুর, ছেলেহারা হলেও বউমা আর নাতি মারুফকে নিয়ে সুখেই বাকি জীবনটা কেটে যাবে। কিন্তু না সেই কপালও নেই জামিলার। ওরা নাতির জন্য ট্রেন্ড গবর্নেস রেখেছে। একেবারে চাইল্ড কেয়ার সার্টিফিকেট পাওয়া আয়া। জামিলাকে ওরা বিশ্বাস করেনি। ও যদি বাচ্চাটাকে গলা টিপে মেরে ফেলে ওদের প্রতারণার প্রতিশোধ নেয়।

এদিকে দুই বছর জামিলার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি চৌধুরী পরিবারের। মস্কো থাকাকালে চৌধুরী সাহেবের দু’টো চিঠি পেয়েছিল জামিলা। কিন্তু কোন উত্তর লিখতে পারেনি। মুন্সী ওহীদ চিঠি দিবে বলেছিল জামিলাকে। স্বামীর ডেড বডি নিয়ে ঢাকায় আসার পর চৌধুরী সাহেবের  সাথে তার সকল যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। চৌধুরী সাহেব জানেন না জামিলা আজ কোথায়। মস্কোর ঠিকানায় নানা আবারও কোন চিঠি দিয়েছেন কিনা তাও জানেনা জামিলা।

পা টেনে টেনে জাহের চৌধুরীর বাড়ির ভেতরে এসে ঢুকে জামিলা। জাতীয় জাদুঘরে রাখা কংকালের মত হাড় সর্বস্ব শরীর। বিবর্ণ চোখ জোড়া কোটরে বসে গেছে মমির চোখের মত। দু’বছরের ব্যবধানে আজ জামিলাকে চেনারই কোন সুযোগ নেই। একটি অস্ফূট আর্তনাদ করে জামিলা পড়ে যায়। কতক্ষণ পড়ে ছিল কে জানে। চেতনা ফিরে পেয়ে আবারও পা টেনে টেনে গিয়ে দাঁড়ায় চৌধুরী সাহেবের ঘরের দরজায়। না…… কোন সাড়া শব্দ নেই। রাত কয়টা বাজে! নয় কিংবা দশটা! অত সময়েই কি সবাই ঘুমিয়ে পড়ল! এবার দরজার কড়া নাড়ে জামিলা। ধাক্কা দেয়, ডাকে নানা ও নানা হাসিনা বুবু-কিন্তু কোন সায় মিলে না।

এত রাত্রে চৌধুরী বাড়িতে কথার শব্দ শুনে পাশের বাড়ির ওলী মাঝি এগিয়ে আসে টর্চ  লাইট জ্বালিয়ে। কে? কে রে? আমি………..। সময়ই সব বলে দেয়। জামিলা তার দুঃখের কাহিনী অবিরাম বলে যায়। সুবোধ বালকের মতোই সব কাহিনী শুনে আর মাঝে মাঝে ঢোক গিলে ওলী মাঝি। ওলী মাঝির কথায় কাটা গায়ে নুন ছিটার মতই লাগে জামিলার কাছে। ‘‘তোমার বিয়ের এক বছর পর চৌধুরী সাহেব ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে বারবারই তোমার কথা বলেছেন। আর্তনাদ করেছেন…….। চৌধুরী সাহেব এর জানাযায় তার দুই ছেলে এসেছিলেন। তাদের চলে যাওয়ার পর এই বাড়ি শূন্য।’’

যে-দুঃখি জামিলা হয়ে সুখের নীড়ের আশায় সুদূর মস্কো পাড়ি জমিয়েছিল, সে-ই আবার দুঃখি হয়ে চৌধুরী বাড়িতে ফিরে এল। পাড়ার ছেলে মেয়েরা এখন জামিলাকে দুঃখি-বু বলেই ডাকে। বহু দিনের পরিচিত বাড়ির দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিল দুঃখি। আবার শুরু হয় নিয়তির সাথে যুদ্ধ।

পাড়ার ছেলে মেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো, চৌধুরী সাহেবের কবরে ফুল গাছ লাগানো, বাগানের পরিচর্যা করা, বাড়িটা পরিষ্কার রাখা, এই করেই দুঃখির জীবন অতিবাহিত হয়ে চলল। এরই ধারাবাহিকতায় বাড়ির পাশে শীমের বীজ বপন করছিল দুঃখি।

এই দিকে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে মারুফ। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মারুফ দেখে আসছে দেয়ালের সাথে তার মৃত পিতার ছবি ঝুলানো। প্রায় সময় দাদু ভাইয়া ঐ ছবিটি তুলে নিয়ে তোয়ালে দিয়ে ধুলাবালি মুছে দেন; আদর করেন-চুমো খান। মারুফকেও বলেন আদর দেয়ার জন্য। মারুফ জানে তার আববু বেঁচে নেই। আববুর কথা মনে পড়লে আলক্ষ্যেই তার অন্তরটা কেঁপে ওঠে। কিন্তু তার মা কোথায়? মায়ের প্রসঙ্গ আসলেই দাদা ভাইয়া ও দাদু আম্মা যেন এড়িয়ে যান। একদিন স্কুল থেকে এসে মারুফ তার মায়ের কথা জানতে চায়। ক্লাসের অন্য ছেলে মেয়েদের প্রায়ই তাদের মা বাবা সাথে করে স্কুলে নিয়ে আসে। মারুফ জানে তার বাবা নেই, কিন্তু আম্মু কেন তাকে স্কুলে নিয়ে যায় না? মারুফ গুলশান কসমোপলিটন হাই স্কুলের ছাত্র। কিন্তু দাদু মণি তার কথা শুনতেই রাজি নন। মারুফকে বুকে জড়িয়ে দাদু মণি বলেন, সোনামণি তোমার ওসব চিন্তার সময় হয়নি। তুমি ভালভাবে লিখাপড়া কর। মারুফ চিৎকার দিয়ে ওঠে। আমার আম্মু কোথায়? কোথায় আমার আম্মু? আর্তনাদ করে সেদিন দীর্ঘ সময় কেঁদেছিল মারুফ। এখন আর মারুফ মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে না। মনে মনে ভাবে আববুর সাথে আম্মুও হারিয়ে গেছে হয়তবা। কিন্তু সে বুঝে ওঠে না কেন তার আম্মুর একটি ছবিও সে আজ পর্যন্ত দেখেনি……।

এস,এস,সি পরীক্ষা শেষে মারুফের হাতে অনেক সময়। বন্ধুদের বাসায় বাসায় বেড়ানো, রাজধানীর দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে ঘুরে দেখা, শুয়ে শুয়ে বই পড়া, কলোনীর ছেলেদের সাথে ক্রিকেটের বল পিটানোই তার কাজ। কয়েকবার বলেছিল গ্রামে যাবে। কিন্তু দাদা ভাইয়ার একই কথা। এখন না আরও কিছুদিন পর। কিছুতেই মারুফ দাদা ভাইয়া ও দাদু আম্মাকে গ্রামে যেতে রাজি করাতে পারেনা।

একদিন অবসরে একটি পুরনো বই পড়ছিল মারুফ, বইটির নাম ‘‘গীতাঞ্জলী’’। তার আববুর প্রিয় বই ছিল এটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বইটি লিখে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। একটির পর একটি কবিতা পড়ে যাচ্ছিল মারুফ। পাতা উল্টাতে গিয়ে একটি ভাঁজ করা কাগজ পায় বইয়ের মাঝে। পড়েই মারুফের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। জাহের চৌধুরীর লেখা চিঠি। অধীর আগ্রহে পড়তে থাকে মারুফ। এক পর্যায়ে চিঠি শেষ হয়। দীর্ঘক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকে মারুফ। জাহের চৌধুরী জামিলাকে সম্বোধন করে এই চিঠি লিখেছে। এদের নাম তো সে কখনোই শুনেনি। তবে একদিন স্কুল থেকে এসে দাদা ভাইয়া এবং দাদু আম্মাকে জামিলা নাম নিয়েই কি জানি বলতে শুনেছে। মারুফের উপস্থিতিতে তারা অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। কিন্তু কেন জানি আজ জামিলা নামটি তার কাছে অতি পরিচিত মনে হচ্ছে। তার মন বলছে এর মাঝেই লুকায়িত আছে তার মায়ের ঠিকানা। জাহের চৌধুরীর একটি লেখায় মারুফের চোখ স্থির হয়ে পড়ে। ‘‘যে দিন মামুনের উদ্দেশ্যে তোমায় মস্কো পাঠিয়ে দিই, সেদিনই মনে হল আমি সর্বস্ব হারিয়ে একাকি হয়ে গেলাম………। মস্কোয় এটি আমার দ্বিতীয় চিঠি। কিন্তু তোমার কোন অবস্থাই জানতে পারছিনা আমি। মামুন তোমাকে কীভাবে গ্রহণ করেছে। নিশ্চয় ভালভাবে। আমার সময় শেষ হয়ে এল; তোমাকে দেখতে খুব-ই ইচ্ছে হচ্ছে……।

মারুফ আর ভাবতে পারে না। ঠিকানাটা পকেটে নিয়েই চুপিচুপি দাদু ভাইয়ের সাদা কারটির ড্রাইভিং সীটে উঠে বসে। বাতাসের আগেই যেন গাড়ি নিয়ে পৌঁছতে চায় ফেনীর বারাহিপুর চৌধুরী বাড়িতে। মারুফ দেখে হুবহু তার ছবি একজন মহিলা গাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে ঐ মেয়েটি, যে দুঃখি বু, দুঃখি বু বলে এই দিকে এসেছিল। দুঃখি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘‘আম্মু আমি তোমার মারুফ’’ বলে সাদা ধবধবে টয়োটা করোলা কার থেকে নেমে আসা যুবকটি তার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!