বিকেল বেলা সমীক স্কুল থেকে ফিরে রানার বাড়ি গিয়ে বলল “কোচিং এ যাবার আগে আজকে আমাকে একবার দিদার বাড়ি ঘুরে যেতে হবে বুঝলি ! মা একটা জিনিস দিয়েছে ,সেটা দিতে। বলছিলাম কি রানা তুইও আমার সাথে চল ,ওখান থেকেই একেবারে আমরা কোচিং এ চলে যাবো।
ইতিমধ্যে রানার মা ঘরে এসে সমীক কে দেখে হেসে বললেন “তুমি কি খাবে সমীক?মিষ্টি ,নোনতা ,কোল্ডড্রিংক ,সরবত সব আছে কিন্তু।” সমীক বলল , ” কিচ্ছুনা কাকীমা , স্কুল থেকে ফিরে এইমাত্র ভাত খেয়ে এলাম ,পেটে একদম জায়গা নেই, পরের দিন যা দেবেন সব খেয়ে নেবো। ” রানার মা হেসে বললেন , ” আচ্ছা , তাহলে আর জোর করছি না , কিন্তু কথামত আরেকদিন এসে যা দেবো খেতে হবে কিন্তু। ” সমীক হেসে বলল ” হ্যা কাকীমা , সে আর বলতে ! “
ওরা দুজনে সাইকেলে বসে গল্প করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌছে গেলো সমীকের দিদার বাড়ি। কলিং বেল একবার বাজতেই দরজা খুলে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন একজন বৃদ্ধা ।সমীক কিছু বলার আগেই রানা বৃদ্ধাকে প্রনাম করে বলল “আমি সমীকের স্কুলের বন্ধু দিদা , সমীকের টিফিন বাক্স থেকে আপনার বানানো দারুন দারুন খাবার খেয়েছি সেই ছোটবেলা থেকে ,আজকে সমীকের জন্য আপনাকে অনেকদিনের দেখার ইচ্ছাও আমার পূর্ণ হয়ে গেলো। ” বৃদ্ধা রানার মাথায় হাত রেখে বললেন , “যারা বলে যে আজকাল কার ছেলেমেয়েরা একদম আলাদা ,ভালবাসা ও সম্মান তাদের কাছে বইয়ের পাতার শব্দ মাত্র ,তারা যে কতটা মিথ্যে কথা বলে, তা আমার থেকে ভালো বোধ হয় আর কেউ জানে না। ” তারপর সমীকের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন ,” এই যে সবেধন নীলমনি ,ভিতরে না এসে বন্ধুকে নিয়ে বুঝি এখানেই দাড়িয়ে থাকবি ? আমি জানি দিদার বাড়ির পুরনো দরজাটা বরাবরই খুব পছন্দ তোর ,বন্ধুর সামনে সমসময়ের মত আজকেও কি তাহলে কানটা ধরে ভিতরে নিয়ে যাবো ? ” সমীক হেসে বলল , ” আপনি আদেশ করুন মহারানী ,যাহা বলিবেন ,যতদূর বলিবেন আপনাকে ছায়ার মতন অনুসরণ করিব,সেই আদি অনন্ত কালের অভ্যাসমতই। ” বৃদ্ধা হেসে বললেন, ” তবে তাই করো আমার আজ্ঞাধারী মানিক জোড় ।”
রানা আর সমীককে ড্রয়িং রুমের সোফাতে বসিয়ে বৃদ্ধা বললেন ,”বস তোরা ,আমি আসছি এখনি। ” সমীক ব্যাগ থেকে দিদার জন্য মায়ের দেওয়া প্লাস্টিক বের করে সামনের টেবিলে রেখে রানাকে বলল ,”এবার হবে আসল মজা “। রানা কিছু না বুঝতে পেরে সমীক কে জিজ্ঞেস করতে যেতেই বৃদ্ধা একটা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলেন ,সেটা টেবিলে রাখতেই দুজনে দেখলো ট্রে তে রাখা আছে দু বাটি ভর্তি পায়েস ,অন্য দুটো প্লেটে রঙ বেরঙের মিষ্টির সাথে বিপুল পরিমান নিমকি রাশি। ” বৃদ্ধা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন ,”আমি জানি তোরা স্কুল থেকে ফিরে খালি পেটে আমার বাড়ি আসিসনি ,তাই একদম অল্পই দিয়েছি,কথা না বলে খেয়ে নে চটপট ,আবার পড়তে যেতে হবে তো। ” রানা বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাওয়ায় সমীক ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল ,”কোনো লাভ নেই , এনার মত নির্দয়ী মহিলা ইহজগতে আর একটাও আছে বলে আমার মনে হয় না ,চুপচাপ যা পারিস যেভাবে পারিস খেয়ে নে , নাহলে আজকে এখানেই সারা রাত কাকুতি মিনতি তে কেটে যাবে তোর,সকাল হলে বুঝবি তার সবটাই ছিল পন্ডশ্রম। ” রানা এরপর আর কথা না বাড়িয়ে সামনে রাখা পায়েসের বাটিটা হাতে তুলে নিল ,আইঢাই পেট নিয়ে কষ্ট হলেও মনে মনে একটা কথা স্বীকার না করে সে পারল না ,ভরা পেটেও যে কোনকিছুর স্বাদ এরকম তৃপ্তি দিতে পারে তা সে আজকের আগে কোনদিনও উপলব্ধি করেনি।
ওবাড়ি থেকে বেরিয়ে কোচিং এর পথে চলার সময় রানাকে চুপ করে হাঁটতে দেখে সমীক বলল ,”কিরে রানা ,কথা না বলার সাথে তাড়াতাড়ি হজমের কোনো সম্পর্ক আছে বলে তুই জানিস নাকি ?” রানা এতক্ষণের জমা রাগ আর চেপে না রেখে সমীককে বলল ,”তোর এত খিদে ছিল যখন তুই আমাদের বাড়িতে কিছু খেলি না কেন ? আমার মা কে কেন এভাবে মিথ্যে বললি যে তুই খেয়ে এসেছিস ? ” সমীক হেসে বলল ,” ও এই ব্যাপার ! তোকে এখনি আমার মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারি যা তোর মিথ্যে সন্দেহ মুহুর্তে দূর করে দেবে ,তবে এটা সত্যি যে ভাত খাওয়ার আগে যদি আমি জানতাম যে আজকে আমাকে দিদার বাড়ি আসতে হবে তাহলে নিশ্চই ব্যাপারটা তোর ভাবনা মতই হত ,জেনে শুনে এত বড় মূর্খামি করার বয়স আর আমার নেই ,কিন্তু এমন মায়ের যোগ্য মেয়ে আমার মা ,টাইমিং নিয়ে সে কোনো ভুল করবেনা সেটাই তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত। ” রানা বলল , “তাহলে… তুই দিদাকে বাধা দেওয়ার ..মানে বোঝাবার একটা চেষ্টা পর্যন্ত করলি না,তাই ভাবলাম ….” | সমীক হেসে বলল ,”আজ না করলেও সেই ছোট থেকে অনেকদিন অনেকভাবে চেষ্টা করেছি বলেই আমি জানি ,হার যখন মানতেই হবে তা প্রথমেই মেনে নেওয়া ভালো ,বিনা যুদ্ধে জয়লাভের আনন্দে তার উজ্জ্বল মুখ আমার যাই যাই করা প্রাণ পাখিকে যেভাবেই হোক শিকল ঠিক পরিয়েই দেবে,কতবার যে দিদার টেবিলে রাখা জোয়ানের আরক শেষ মুহুর্তে আমাকে স্বর্গলাভের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে ,তার হিসাব চিত্রগুপ্ত নিশ্চই অনেক চেষ্টা করেও শেষমেষ আর রেখে উঠতে পারেননি ।” রানা হেসে বলল , ” দিদা কি সবাইকেই এত এত খাবার ….” সমীক হেসে বলল “একদম! ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাড়িতে আসা সবাইকে। পাড়ার মাঠে খেলতে আসা ছেলেগুলো তেষ্টা পেলে দিদার বাড়ি আসলে, সেদিন আর তাদের বাকি খেলার মায়া ত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না ,কোনমতে নিজেদের পেট নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলেই জীবনের অসাধ্যসাধনের ব্যাপারে একটা নিদারুন আত্মবিশ্বাস তাদের বেশ কিছুদিন চনমনে করে রাখে। রানা হেসে বলল “সত্যি আজকাল কার দিনে এমন মানুষ….” তাকে শেষ করতে না দিয়েই সমীক বলল ,”জানিস রানা ,আমার দিদার বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই ,এই বয়সেও সব কাজ দিদা নিজের হাতে করে , মা অনেক বলেও কখনো কিছু বদলাতে পারেনি। দিদার মতে ওই ডাক্তারের লিখে দেওয়া অসুধ নাকি শুধু শ্বাস প্রশ্বাসই যা বন্ধ হতে দেয় না , মন কে ভালো রেখে শরীর কে বাঁচার মত বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র অসুধ হল কাজ ,ব্যস্ততাই মানুষকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সকল রকম অক্ষমতা ভুলিয়ে রাখতে পারে। তবে একটা মজার ব্যাপার আছে জানিস রানা ,দিদা একা বাজারে যায় ঠিকই ,রোজকার দরকারী জিনিসও কেনে আর সকলের মত কিন্তু দোকান থেকে ফেরার সময় দিদার হাতে কোনো জিনিস কখনো থাকে না ,থাকে দিদার পাশে হাঁটা অন্য কারো হাতে ,সে হাত পাড়ার চিন্টু,সবুজ,পাখিরও হতে পারে অথবা অজস্র অজানা হাতের মধ্যে কোনো একজনের যে দিদার সাথে একটা অলৌকিক বাঁধনে বাঁধা ..এ বাঁধন শুধু মিষ্টি নিমকি খাইয়েই হয় ভেবেছিস ? আমার মনে হয় ,এ হল পরকে আপন করার এক অকৃত্তিম কৌশল যা আয়ত্ত করতে হলে দিদার মতই জীবনকে লাভ ক্ষতির হিসেব নিকেশ থেকে একদম আলাদা করে ফেলতে হয় আর মনের ভিতর রাখতে হয় এক সীমাহীন ভালবাসার সমুদ্র ,যার ভাগ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সকলকে উজার করে দিতে থাকলেও তাতে কখনো কোনদিন এক বিন্দু ঘাটতি অতি বড় ভগবানের আতস কাঁচেও ধরা পরবে না।