দালিয়া-ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অশ্বারোহী, পদাতিক, নিশান, হস্তী, বাদ্য এবং আলোকে ধীবরের ঘর দুয়ার ভাঙিয়া পড়িবার জো হইল । রাজপ্রাসাদ হইতে স্বর্ণমণ্ডিত দুই শিবিকা আসিয়াছে ।

আমিনা জুলিখার হাত হইতে ছুরিখানি লইল । তাহার হস্তিদন্তনির্মিত কারুকার্য অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিল । তাহার পর বসন উদ্‌ঘাটন করিয়া নিজের বক্ষের উপর একবার ধার পরীক্ষা করিয়া দেখিল । জীবনমুকুলের বৃন্তের কাছে ছুরিটি একবার স্পর্শ করিল , আবার সেটি খাপের মধ্যে পুরিয়া বসনের মধ্যে লুকাইয়া রাখিল ।

একান্ত ইচ্ছা ছিল , এই মরণযাত্রার পূর্বে একবার দালিয়ার সহিত দেখা হয়, কিন্তু কাল হইতে সে নিরুদ্দেশ । দালিয়া সেই যে হাসিতেছিল তাহার ভিতরে কি অভিমানের জ্বালা প্রচ্ছন্ন ছিল ।

শিবিকায় উঠিবার পূর্বে আমিনা তাহার বাল্যকালের আশ্রয়টি অশ্রুজলের ভিতর হইতে একবার দেখিল — তাহার সেই ঘরের গাছ , তাহার সেই ঘরের নদী । ধীবরের হাত ধরিয়া বাষ্পরুদ্ধ কম্পিত স্বরে কহিল , “ বুঢ়া, তবে চলিলাম । তিন্নি গেলে তোর ঘরকন্না কে দেখিবে । ”

বুঢ়া একেবারে বালকের মতো কাঁদিয়া উঠিল ।

আমিনা কহিল , “ বুঢ়া , যদি দালিয়া আর এখানে আসে তাহাকে এই আঙটি দিয়ো । বলিয়ো , তিন্নি যাইবার সময় দিয়া গেছে । ”

এই বলিয়াই দ্রুত শিবিকায় উঠিয়া পড়িল । মহাসমারোহে শিবিকা চলিয়া গেল । আমিনার কুটির , নদীতীর , কৈলুতরুতল অন্ধকার, নিস্তব্ধ, জনশূন্য হইয়া গেল ।

যথাকালে শিবিকাদ্বয় তোরণদ্বার অতিক্রম করিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল । দুই ভগ্নী শিবিকা ত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিল ।

আমিনার মুখে হাসি নাই , চোখেও অশ্রুচিহ্ন নাই । জুলিখার মুখ বিবর্ণ । কর্তব্য যখন দূরে ছিল ততক্ষণ তাহার উৎসাহের তীব্রতা ছিল — এখন সে কম্পিতহৃদয়ে ব্যাকুল স্নেহে আমিনাকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল । মনে মনে কহিল , ‘ নব প্রেমের বৃন্ত হইতে ছিন্ন করিয়া এই ফুটন্ত ফুলটিকে কোন্‌ রক্তস্রোতে ভাসাইতে যাইতেছি । ”

কিন্তু তখন আর ভাবিবার সময় নাই । পরিচারিকাদের দ্বারা নীত হইয়া শতসহস্র প্রদীপের অনিমেষ তীব্র দৃষ্টির মধ্য দিয়া দুই ভগিনী স্বপ্নাহতের মতো চলিতে লাগিল , অবশেষে বাসরঘরের দ্বারের কাছে মুহূর্তের জন্য থামিয়া আমিনা জুলিখাকে কহিল , “ দিদি। ”

জুলিখা আমিনাকে গাঢ় আলিঙ্গনে বাঁধিয়া চুম্বন করিল ।

উভয়ে ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল ।

রাজবেশ পরিয়া ঘরের মাঝখানে মছলন্দ-শয্যার উপর রাজা বসিয়া আছে । আমিনা সসংকোচে দ্বারের অনতিদূরে দাঁড়াইয়া রহিল ।

জুলিখা অগ্রসর হইয়া রাজার নিকটবর্তী হইয়া দেখিল , রাজা নিঃশব্দে সকৌতুকে হাসিতেছেন ।

জুলিখা বলিয়া উঠিল “ দালিয়া! ” -আমিনা মূর্ছিত হইয়া পড়িল ।

দালিয়া উঠিয়া তাহাকে আহত পাখিটির মতো কোলে করিয়া তুলিয়া শয্যায় লইয়া গেল । আমিনা সচেতন হইয়া বুকের মধ্য হইতে ছুরিটি বাহির করিয়া দিদির মুখের দিকে চাহিল , দিদি দালিয়ার মুখের দিকে চাহিল , দালিয়া চুপ করিয়া হাস্যমুখে উভয়ের প্রতি চাহিয়া রহিল- ছুরিও তাহার খাপের মধ্য হইতে একটুখানি মুখ বাহির করিয়া এই রঙ্গ দেখিয়া ঝিক্‌‌মিক্ করিয়া হাসিতে লাগিল ।

গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদ পড়িতে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!