জুলিখা আমিনার অবস্থা চিন্তা করিয়া ভারি বিমর্ষ হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল । এমন সময় হঠাৎ ধুপ্ করিয়া একটা লম্ফের শব্দ হইল এবং পশ্চাৎ হইতে কে একজন জুলিখার চোখ টিপিয়া ধরিল ।
জুলিখা ত্রস্ত হইয়া কহিল , “ কেও । ”
স্বর শুনিয়া যুবক চোখ ছাড়িয়া দিয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; জুলিখার মুখের দিকে চাহিয়া অম্লানবদনে কহিল , “ তুমি তো তিন্নি নও । ” যেন জুলিখা বরাবর আপনাকে ‘ তিন্নি ‘ বলিয়া চালাইবার চেষ্টা করিতেছিল , কেবল যুবকের অসামান্য তীক্ষ্মবুদ্ধির কাছে সমস্ত চাতুরী প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে ।
জুলিখা বসন সংবরণ করিয়া দৃপ্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া দুই চক্ষে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করিল । জিজ্ঞাসা করিল , “ কে তুমি । ”
যুবক কহিল , “ তুমি আমাকে চেন না। তিন্নি জানে । তিন্নি কোথায় । ”
তিন্নি গোলযোগ শুনিয়া বাহির হইয়া আসিল । জুলিখার রোষ এবং যুবকের হতবুদ্ধি বিস্মিতমুখ দেখিয়া আমিনা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল ।
কহিল , “ দিদি , ওর কথা তুমি কিছু মনে করিয়ো না । ও কি মানুষ। ও একটা বনের মৃগ । যদি কিছু বেয়াদপি করিয়া থাকে আমি উহাকে শাসন করিয়া দিব । – দালিয়া, তুমি কী করিয়াছিলে । ”
যুবক তৎক্ষণাৎ কহিল , “ চোখ টিপিয়া ধরিয়াছিলাম । আমি মনে করিয়াছিলাম তিন্নি । কিন্তু ও তো তিন্নি নয় । ”
তিন্নি সহসা দুঃসহ ক্রোধ প্রকাশ করিয়া উঠিয়া কহিল , “ ফের! ছোটো মুখে বড়ো কথা! কবে তুমি তিন্নির চোখ টিপিয়াছ । তোমার তো সাহস কম নয় । ”
যুবক কহিল , “ চোখ টিপিতে তো খুব বেশি সাহসের দরকার করে না ; বিশেষত পূর্বের অভ্যাস থাকিলে । কিন্তু সত্য বলিতেছি তিন্নি , আজ একটু ভয় পাইয়া গিয়াছিলাম । ”
বলিয়া গোপনে জুলিখার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া আমিনার মুখের দিকে চাহিয়া নিঃশব্দে হাসিতে লাগিল ।
আমিনা কহিল , “ না , তুমি অতি বর্বর। শাহজাদীর সম্মুখে দাঁড়াইবার যোগ্য নও । তোমাকে সহবত শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক । দেখো , এমনি করিয়া সেলাম করো । ”
বলিয়া আমিনা তাহার যৌবনমঞ্জরিত তনুলতা অতি মধুর ভঙ্গিতে নত করিয়া জুলিখাকে সেলাম করিল । যুবক বহুকষ্টে তাহার নিতান্ত অসম্পূর্ণ অনুকরণ করিল ।
বলিল , “ এমনি করিয়া তিন পা পিছু হঠিয়া আইস । ” যুবক পিছু হঠিয়া আসিল ।
“ আবার সেলাম করো । ” আবার সেলাম করিল ।
এমনি করিয়া পিছু হঠাইয়া , সেলাম করাইয়া , আমিনা যুবককে কুটিরের দ্বারের কাছে লইয়া গেল ।
কহিল , “ ঘরে প্রবেশ করো । ” যুবক ঘরে প্রবেশ করিল ।
আমিনা বাহির হইতে ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া কহিল , “ একটু ঘরের কাজ করো । আগুনটা জ্বালাইয়া রাখো । ” বলিয়া দিদির পাশে আসিয়া বসিল ।
কহিল , “ দিদি , রাগ করিস নে ভাই , এখানকার মানুষগুলো এইরকমের । হাড় জ্বালাতন হইয়া গেছে । ”
কিন্তু আমিনার মুখে কিম্বা ব্যবহারে তাহার লক্ষণ কিছুই প্রকাশ পায় না । বরং অনেক বিষয়ে এখানকার মানুষের প্রতি তাহার কিছু অন্যায় পক্ষপাত দেখা যায় ।
জুলিখা যথাসাধ্য রাগ প্রকাশ করিয়া কহিল , “ বাস্তবিক আমিনা , তোর ব্যবহারে আমি আশ্চর্য হইয়া গেছি। একজন বাহিরের যুবক আসিয়া তোকে স্পর্শ করিতে পারে এত বড়ো তাহার সাহস। ”
আমিনা দিদির সহিত যোগ দিয়া কহিল , “ দেখ্ দেখি বোন । যদি কোনো বাদশাহ কিংবা নবাবের ছেলে এমন ব্যবহার করিত , তবে তাহাকে অপমান করিয়া দূর করিয়া দিতাম । ”
জুলিখার ভিতরের হাসি আর বাধা মানিল না; হাসিয়া উঠিয়া কহিল , “ সত্য করিয়া বল্ দেখি আমিনা , তুই যে বলিতেছিলি পৃথিবীটা তোর বড়ো ভালো লাগিতেছে , সে কি ঐ বর্বর যুবকটার জন্য । ”
আমিনা কহিল , “ তা, সত্য কথা বলি দিদি , ও আমার অনেক উপকার করে । ফুলটা ফলটা পাড়িয়া দেয় , শিকার করিয়া আনে , একটা-কিছু কাজ করিতে ডাকিলে ছুটিয়া আসে । অনেকবার মনে করি উহাকে শাসন করিব । কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা । যদি
খুব চোখ রাঙাইয়া বলি , ‘ দালিয়া , তোমার প্রতি আমি ভারি অসন্তুষ্ট হইয়াছি — দালিয়া মুখের দিকে চাহিয়া পরম কৌতুকে নিঃশব্দে হাসিতে থাকে। এদের দেশে পরিহাস বোধ করি এইরকম ; দু ঘা মারিলে ভারি খুশি হইয়া উঠে তাহাও পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি । ঐ দেখো-না , ঘরে পুরিয়া রাখিয়াছি — বড়ো আনন্দে আছে , দ্বার খুলিলেই দেখিতে পাইব মুখ চক্ষু লাল করিয়া মনের সুখে আগুনে ফুঁ দিতেছে । ইহাকে লইয়া কী করি বল্ তো বোন । আমি তো আর পারিয়া উঠি না । ”জুলিখা কহিল , “ আমি চেষ্টা দেখিতে পারি । ”
আমিনা হাসিয়া মিনতি করিয়া বলিল , “ তোর দুটি পায়ে পড়ি বোন । ওকে আর তুই কিছু বলিস না । ”
এমন করিয়া বলিল , যেন ঐ যুবকটি আমিনার একটি বড়ো সাধের পোষা হরিণ , এখনো তাহার বন্য স্বভাব দূর হয় নাই — পাছে অন্য কোনো মানুষ দেখিলে ভয় পাইয়া নিরুদ্দেশ হয় এমন আশঙ্কা আছে ।
এমন সময় ধীবর আসিয়া কহিল , “ আজ দালিয়া আসে নাই, তিন্নি ? ”
“ আসিয়াছে । ”
“ কোথায় গেল । ”
“ সে বড়ো উপদ্রব করিতেছিল , তাই তাহাকে ঐ ঘরে পুরিয়া রাখিয়াছি । ”
বৃদ্ধ কিছু চিন্তান্বিত হইয়া কহিল , “ যদি বিরক্ত করে সহিয়া থাকিস । অল্প বয়সে অমন সকলেই দুরন্ত হইয়া থাকে । বেশি শাসন করিস না । দালিয়া কাল এক থলু দিয়া আমার কাছে তিনটি মাছ লইয়াছিল । ” (থলু অর্থে স্বর্ণমুদ্রা)
আমিনা কহিল , “ ভাবনা নাই বুঢ়া; আজ আমি তাহার কাছে দুই থলু আদায় করিয়া দিব , একটিও মাছ দিতে হইবে না । ”
বৃদ্ধ তাহার পালিত কন্যার এত অল্প বয়সে এমন চাতুরী এবং বিষয়বুদ্ধি দেখিয়া পরম প্রীত হইয়া তাহার মাথায় সস্নেহ হাত বুলাইয়া চলিয়া গেল ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।