গৃহকর্তা ঘরেই ছিলেন। এমন সময় গৃহে প্রবেশ করল এক চোর। ঘরের সব কিছু হাতিয়ে নিতে লাগল। সহসা ঘুম ভেঙে গেল গৃহকর্তার। তিনি জেগে উঠে দেখলেন চোর তাঁর ঘরের সব জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। জেগে উঠে তিনি চোরকে হাতে নাতে ধরে ফেললেন। চোর ধরা পড়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। গৃহকর্তার পা ধরে কাঁদল এবং বলল,
“আজ পাঁচ দিন যাবৎ আমার ছেলে-মেয়েরা অনাহারে আছে। তাদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে পারিনি। ওদের কান্না সহ্য করতে না পেরে চুরি করতে এসেছি হুজুর। আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
তার কথা শুনে দয়া হল গৃহকর্তার। লোকটির করুণ কাহিনীতে তাঁর মন গলে গেল। তিনি বুঝলেন লোকটি হয়তো সত্যিই পেশাদার চোর নয়। তিনি তখন চোরটিকে কোনো রকম শাস্তি না দিয়ে বরং আরও অনেক জিনিসপত্র ও খাবার তুলে দিলেন চোরটির হাতে। তারপর বললেন,
“এগুলো নিয়ে যাও, অভুক্ত সন্তানদের খেতে-পরতে দিও। আর কখনও চুরি করবে না।”
ওপরের গল্পের যে গৃহকর্তা, তিনিই দয়ার সাগর হাজী মুহম্মদ মহসীন। এই মহান মানুষটির নাম না জানে এমন মানুষ হয়তো বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। আজও সবার কাছে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। পুরো বাঙালি জাতি—মুসলিম, হিন্দু সকলের কাছে তিনি সমান শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। দান, দয়া ও মানবতার ইতিহাসে তিনি এক কিংবদন্তি পুরুষ। তাঁর দয়া ও মহানুভবতার কথা আজও রূপকথার মতো প্রচলিত।
হাজী মুহম্মদ মহসীনের জন্ম ১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী শহরে। পিতা ছিলেন আগা মুহম্মদ ফয়জুল্লাহ, মায়ের নাম জয়নব খানম। হাজী ফয়জুল্লাহর আদি নিবাস ছিল সুদূর পারস্যে। সেখান থেকে মহসীনের পূর্বপুরুষেরা ভাগ্যের অন্বেষণে এসেছিলেন এ দেশে এবং স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এই হুগলী শহরে।
হাজী ফয়জুল্লাহ যে সময় হুগলীতে এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তখন আগা মোতাহার নামে অপর এক ধনী ব্যবসায়ীও এখানে বসবাস শুরু করেন। তিনিও ভাগ্যের অন্বেষণে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তখন দিল্লির বাদশাহ ছিলেন আওরঙ্গজেব। আগা মোতাহার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ছিলেন। প্রথমে দিল্লিতে এসে বাদশাহর অধীনে খাজাঞ্চির পদে নিযুক্ত হন। তাঁর কর্মদক্ষতায় বাদশাহ শীঘ্রই তাঁর প্রতি খুশি হন এবং যশোর ও নদীয়া জেলার অনেকগুলো জায়গীর দান করেন।
এই জায়গীরদারি পেয়ে আগা মোতাহারও দিল্লি থেকে চলে আসেন হুগলীতে এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তারপর জায়গীরদারির পাশাপাশি শুরু করেন লবণের ব্যবসা। এখানে এসে মোতাহার দোরদানা খানম নামের এক রমণীকে বিয়ে করেন। সুখেই কাটছিল তাঁর সংসার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুখ দীর্ঘস্থায়ী হল না। তাঁদের ঘরে কোনো সন্তান এল না। তাই মোতাহার সন্তান লাভের আশায় আরেকটি বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল জয়নব খানম।
দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে হয়তো কোনো সন্তান হবে—এই আশায় তিনি আবার দিন গুনতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও কিছু হলো না। অবশেষে সব দিকে নিরাশ হয়ে তিনি পোষ্যপুত্র গ্রহণ করলেন। কিন্তু তাতেও তাঁর মন ভরল না। এরপর শুরু হল দুই স্ত্রীর ঝগড়া।
মোতাহারের মনের যখন করুণ অবস্থা, তখন ছোট স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নিল ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। এই কন্যার নাম ছিল মনুজান। ক্রমে মনুজানের বয়স বাড়তে লাগল, এক সময় পদার্পণ করল যৌবনে। একদিন পিতা কন্যাকে ডেকে বললেন,
“তোমার গলায় আমি একটি মাদুলি পরিয়ে দিয়ে গেলাম। এর অনেক দাম। আমার মৃত্যুর পর খুলে দেখো।”
পিতার ইচ্ছাই ছিল মনুজানের কাছে আদেশের চেয়েও বেশি মূল্যবান। তাই তিনি পিতার আদেশ পালন করে চললেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাদুলিটি ভেঙে দেখলেন—মোতাহার তাঁর সমস্ত সম্পত্তিই দান করে গেছেন কন্যা মনুজানকে।
জয়নব খানম দেখলেন স্বামী তাঁকে বঞ্চিত করে সব সম্পত্তি কন্যাকে দান করে গেছেন। তাতে তিনি ক্ষুব্ধ হলেন। তাই সম্পত্তির লোভে তিনি কন্যাকে হাতে রাখার জন্য পারস্য থেকে আগত হাজী ফয়জুল্লাহ নামে এক সভ্রান্ত ব্যক্তিকে বিয়ে করলেন।
মনুজানের তখন ১৩ বছর বয়স। তখনই ১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ মহসীনের জন্ম হয়। বংশে একটি পুত্র সন্তান হওয়াতে সবাই খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন মনুজান। তিনি সৎ ছোট ভাইকে নিয়ে যেন আনন্দে হাবুডুব খেতে লাগলেন, স্নেহ ও আদরে ভরিয়ে তুললেন মহসীনকে।
মনুজান নিজেই একদিন ভাইকে নিয়ে গেলেন স্থানীয় মক্তবে। মক্তবের পাঠ শেষ করে মহসীনকে ভর্তি করা হল মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি আরবি, ফারসি ভাষা শিখতে লাগলেন। ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় খুব ভাল ছিলেন মহসীন। তাঁর উন্নতি দেখে মা-বাবা এবং বড় বোন মনুজান সকলেই খুব খুশি হলেন।
এবার আরও উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে পাঠানো হল মুর্শিদাবাদ শহরে। এখানে এসে তিনি একটি নামকরা মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন। অল্প দিনের মধ্যে মহসীনের মনের গভীরতার পরিচয় পেয়ে মাদ্রাসার ওস্তাদগণ অবাক হয়ে গেলেন। চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল তাঁর নাম-সুনাম।
অবশেষে মহসীনের গুণের কথা মুর্শিদাবাদের নবাবের কানে গেল। তিনি ডেকে পাঠালেন এই প্রতিভাবান ছেলেকে এবং নবাবের অধীনে একটি উচ্চ সরকারি পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু মহসীন তা গ্রহণ করলেন না। ইতিমধ্যে পিতামাতার মৃত্যু হয়েছে। বাড়িতে বোন একা রয়েছেন। তাই মাতৃতূল্য বোনকে একা রেখে তিনি অন্য কোথাও আটকে থাকতে রাজি হলেন না।
এদিকে হুগলীতে মনুজানের ওপর বিপদ ঘনিয়ে এল। বিশাল বাড়িতে একলা যুবতী মেয়ে মনুজান। অপর দিকে বিশাল সম্পত্তি তাঁর হাতে। তাই কিছু দুষ্টু লোক তাঁর সম্পত্তি আত্মসাতের ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগল। এই ষড়যন্ত্রের কথা টের পেয়ে ভয় পেলেন মনুজান। তিনি তখনই সবকিছু লিখে পত্র দিলেন মহসীনের কাছে।
পত্র পেয়ে বিপন্ন বোনকে রক্ষার জন্য দ্রুত হুগলী চলে এলেন মহসীন। দীর্ঘ কয়েক বছর পর আবার ভাইবোনের মিলন হল। মহসীনকে কাছে পেয়ে মনুজান হাতে যেন চাঁদ পেলেন। মনুজান তখন ভাই মহসীনকে হুগলীতে থেকে বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য অনুরোধ করলেন।
বোনের আদেশে আর মুর্শিদাবাদ ফিরে যাওয়া হল না মহসীনের। তিনি হুগলীতে থেকে সম্পত্তির দেখাশোনা করতে লাগলেন। তখন তাঁর প্রধান কাজ হল বিবাহযোগ্য বোনকে সুপাত্রের হাতে দান করা। অতঃপর তিনি বরের খোঁজে বের হলেন।
শুভক্ষণে নবাবের নিযুক্ত হুগলীর ফৌজদার সালাহউদ্দিনের সঙ্গে বোনকে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন তিনি। বোন উপযুক্ত পাত্রের হাতে সমর্পণ করতে পেরে মহসীন এবার নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু বিষয়-সম্পত্তির প্রতি কোনো লোভ ছিল না মহসীনের।
বড় বোনের বিয়ের পর আবার তিনি বের হলেন ঘর থেকে। শুরু হল দেশ ভ্রমণ। যখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৫ বছর, তখন তিনি পায়ে হেঁটে চলে এলেন মক্কায়। পালন করলেন হজ্ব। তারপর মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করলেন ইরান, ইরাক, তুরস্ক, সিরিয়া, মিশরের পথে। ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এক দেশ থেকে আরেক দেশে। মুসলিম দেশগুলো তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। এমন করে কেটে গেল ২৭ বছর।
তারপর ফিরে এলেন স্বদেশে। কিন্তু বিয়ে করে সংসার পাততে তাঁর আর মন চাইলো না। এরপর আবার বোনের অনুমতি নিয়ে এলেন মুর্শিদাবাদে। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর।
এদিকে মনুজানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর স্বামী মারা গেছেন। কিন্তু মনুজানের কোনো সন্তানাদি নেই। তা ছাড়া তিনিও তখন বার্ধক্যে উপনীত। স্বামীকে হারিয়ে সন্তানহীনা মনুজান এবার নিজেও একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। তিনি তাই আবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন—তাহলে এই বিশাল সম্পত্তি কে রক্ষা করবে? অনেক ভেবে তিনি কাতর হয়ে পড়লেন।
অতঃপর তিনি আবার ডেকে পাঠালেন তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাই মহসীনকে। বোনের ডাকে মুর্শিদাবাদ থেকে আবার মহসীন ফিরে এলেন হুগলীতে। বোন মনুজান বললেন,
“সংসারের এই ঝামেলা থেকে এবার আমাকে মুক্তি দাও ভাই। যে ক’টা দিন আছি, আমি আল্লাহর ধ্যানে কাটাতে চাই।”
এই বলে বড় বোন মনুজান তাঁর নিজের সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিলেন স্নেহের ছোট ভাই মহসীনের নামে। এর মাত্র কয়েক বছর পর ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে মনুজানের মৃত্যু হয়।
মহসীন ছিলেন সংসারবিরাগী মানুষ। ঘর-সংসার, ধন-দৌলতের প্রতি তাঁর কোনো লোভ ছিল না। কিন্তু বোনের এই বিশাল সম্পত্তি নিয়ে তিনি এখন কী করবেন? তাঁর তো ঘর নেই, সংসার নেই, এ সম্পত্তি ভোগ করার মতো কোনো বংশধরও নেই। তাছাড়া তিনি নিজেও এখন বৃদ্ধ। বয়স সত্তর বছর। আর ক’দিনইবা বাঁচবেন!
তাই তিনি স্থির করলেন এই বিশাল সম্পত্তি তিনি মানবজাতির কাজে ব্যয় করবেন। দেশের দ্বীন-দুঃখী ও দুস্থদের সেবায় তিনি নিজের সব কিছু বিলিয়ে দেবেন।
তার সম্পত্তির অধিকাংশই তিনি ব্যয় করেন শিক্ষার উন্নয়নের জন্য। তৎকালীন অনগ্রসর মুসলিম সমাজে শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অনেকগুলো স্কুল-কলেজ। মুসলমান ছেলে-মেয়েদের জন্য প্রবর্তন করেন “মহসীন বৃত্তি”। গঠিত হয় “মহসীন ফান্ড”। ভারতের মুসলমান ছেলে-মেয়েরা এই ফান্ড থেকে আজও বৃত্তি পেয়ে থাকে।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেন হুগলীর ইমামবাড়া, হুগলী মহসীন কলেজ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অনাথদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন কয়েকটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র।
তাঁর দানকর্ম নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক গল্প। তিনি রাতে সাথে টাকা নিয়ে ছদ্মবেশে শহরের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াতেন। দ্বীন-দুঃখী, অন্ধ—যাকে সামনে পেতেন তাকে মুক্তহস্তে দান করতেন। তিনি অনেক অভাবী পরিবারের যাবতীয় ব্যয় বহন করতেন।
তাঁর মতো দয়ার সাগর পৃথিবীতে খুব কমই জন্মেছেন। এই দয়ার সাগর হাজী মুহম্মদ মহসীন পরিণত বয়সে এখন থেকে প্রায় দু’শ বছর আগে, ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।