দাদু ও চাঁদ

সারা আকাশটায় জোছনার মাতামাতি। ডাল পাতায় জোছনার মাখামাখি। মধ্য আকাশে ঝুলে স্থির হয়ে আছে গোলগাল চাঁদ। আজ পূর্ণিমার চাঁদ। কোথাও এক টুকরো মেঘও নেই। হাজার দিঘির শাপলা ফুলের মত ফুটে আছে আকাশের তারা। কতো লক্ষ কোটি তারা! টুকু শুনেছে আকাশের পরে নাকি আরো আকাশ আছে। ওই আকাশ কি এই আকাশের চেয়ে বড়? কতো বড়? পরের আকাশেও কি গোলগাল চাঁদ আছে? আছে হাজার হাজার তারা? আছে রাত? দিন? টুকুর মনে হাজার হাজার প্রশ্ন দৌড়ে। দাদু জানলার গরাদ ধরে বসে আছে। দাদুর চোখে আলো আকাশ ছুঁয়ে গেছে। দাদুর চোখে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। বুকে অনেক কষ্ট। দাদু একাকী হয়ে গেলে শরীরের কোষগুলো আর কাজ করতে চায় না।

নিরবে চোখের জল মুছে। দাদুর এমন কষ্টে টুকুর বুকটাও হুহু করে উঠে। টুকু দাদুর কাছাকাছি আসে। পিঠে আলতো হাত রাখে। থুতনি রাখে। দাদু একটুও ফিরে তাকায় না। টুকু নরম করে বলে, জেগে আছো? বাইরে কী দেখছো? দাদু জবাব দেয় না। উদাস চোখে চাঁদের দিকে চেয়ে থাকে। টুকু বলে, তুমি কী ভাবছো আমি জানি। দাদুর ঘাড়টা আস্তে আস্তে বাম দিকে ফিরতে থাকে। এক সময় তামাম মুখটা টুকুর দিকে এসে স্থির হয়। অদ্ভূত চোখে কিছুক্ষণ তাকায়। টুকু ফের বলে, তুমি কী ভাবছো আমি জানি। দাদু অপলক চোখে বলে, কী? -তুমি আববুকে নিয়ে ভাবছো। -কী করে বুঝলে? -আমি তোমার ছেলের ছেলে তাই। -তোমার আববু জোছনাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। একদিন জোছনা রাতে একটি অঘটন ঘটেছিল। বাইরে আজকের মতই। ফকফকে জোছনা ছিল। সেদিন রাত দু’টো বাজে। দরোজাটা হা করে খোলা। তোমার আববুর রুমে তোমার আববু নেই। আমরা বাইরে এসে দেখি তোমার আববু পেয়ারা গাছের নিচে বসে কবিতা লিখছে। পাশে দু’চারটে জোনাক পোকা ছাড়া আর কেউ নেই। আমরা সেদিন তার সাহস দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। ঘরে ফিরে এসে আমরা কপালে হাত দেই, বড় আলমারিটা খোলা। এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে কাপড় চোপড়। স্বর্ণের বাক্সটা খালি দেখে তোমার দাদী মুর্ছা যায় যায় অবস্থা। এতো স্বর্ণ হারিয়ে কে না মূর্ছা যায়? এই ঘটনার পর তোমার আববুর সাথে তিনদিন কথা বলেনি তোমার দাদী। -মাত্র তিন দিন? -তিন দিন মানে তোমার দাদীর কাছে ছিল তিনশ বছর। -কতো ভরি স্বর্ণ ছিল? -একশর ওপরে। -বাপরে, দাদীর কাছে এতো স্বর্ণ ছিল? -তখনকার দিনে একশ দুইশ ভরি স্বর্ণ নেহায়েত কম। বড় লোকদের কাছে হাজার হাজার ভরি স্বর্ণ থাকত। আর আমাদের তো মাত্র একশ ভরি।

আচ্ছা চলো, ঘুম পাচ্ছে। -আর একটু বসো দাদু। চাঁদটাকে দেখি। আববু চাঁদকে অনেক ভালোবাসতো। আববু আমাকে চাঁদ দেখিয়ে বলতো, চাঁদে যাবে? আমার কি ডানা আছে যে উড়াল দিয়ে চাঁদে যাবো? -তোমাকে এক জোড়া ডানা বানিয়ে দেবো। শক্ত ডানা। ঠিক আছে? ডানা বানিয়ে দেয়ার কথা শুনে আমি খুশিতে নেচে উঠেছিলাম। আববুর এসব কথা মনে পড়লে আমার এখন হাসি পায়। -তুমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছো। সত্যটা তুমি ধরতে পারছো। -আববুর কবিতা কি তুমি পড়েছো? -পেপারে ছাপা হলে পড়তাম। -বাপরে, আববু তাহলে অনেক বড় কবি ছিল। -আমিও চেয়েছিলাম সে কবি হোক, লেখক হোক। -কবি হতে হলে কী করতে হয় দাদু? -অনেক অনেক পড়তে হয়। অনেক অনেক লিখতে হয়। নজরুল রুটির দোকানে বসে বসেও পড়তো। রাইফেল কাঁধে নিয়েও লিখতো। -আমিও কবি হবো দাদু। আববুর মতো কবি। অনেক বড়ো কবি। টুকু এক পা এক পা করে হাঁটে আর চারদিক বিস্ময়ভরা চোখে তাকায়। এই কোন রাজ্যে এসে পড়েছে টুকু? থরে থরে সাজানো গাছগাছালি। সবগুলোই নানান রঙের। পাতাগুলো একটু একটু নড়ছে। কিন্তু কোথাও বাতাস অনুভব হচ্ছে না। পাশেই একটি নদী বয়ে চলেছে। ছোট ছোট ঢেউ। ঢেউগুলো ঝিকিমিকি রঙ তুলেছে। আকাশে কয়েকটি চাঁদ ঝুলে আছে। একটুও সূর্যের তেজ নেই কোথাও। আশপাশের এসব দৃশ্য আকাশ-ছোঁয়া অবাক করে দিচ্ছে টুকুকে। একটা লোককে দুড়দাড় হেঁটে আসতে দেখে টুকু ওদিকে দৃষ্টি ফেলে রাখে। লোকটি আসতে থাকে। আসতে থাকে। কী চেহারা হয়েছে আববুর! কী নিখুঁত এবং পরিপাটি আববু! অসাধারণ ঝলমলে পোশাক! কিন্তু চেহারায় কিছুটা মলিনতার ছাপ। আববুকে জড়িয়ে ধরতে মন চাইছে টুকুর। কিন্তু পারছে না। -ভালো আছো টুকু? -জি আববু। তুমি কেমন আছো? -আছি, ভালো আছি। -আমরা একদম ভালো নেই। মা’ও ভালো নেই। দাদুও ভালো নেই। দাদু ঘুমাতে গেলেও চোখের পানি ফেলে। মা’ও তা-ই করে। -তুমি চাঁদে যেতে চেয়েছিলে না? -আমাদের তো রকেট নাই। রকেট ছাড়া কি চাঁদে যাওয়া যায়? -ডানা আছে না? -ডানা দিয়ে চাঁদে যাওয়া যায় না আববু। -এখান থেকে যাওয়া যায়। চাইলে এখানে আকাশও ছোঁয়া যায়। পৃথিবীর মতো এখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। এখানে সব শক্তিই সমান

তুমি চাইলেই ডানা পেয়ে যাবে। দেবো? আকাশ থেকে দু’টো ডানা সমান দূরত্বে নামতে দেখে টুকু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। ডানা দু’টো পরীর ডানার চেয়েও সুন্দর। কী চমৎকার কারুকাজ এই ডানায়! ডানা দু’টো টুকুর পিঠের দু’পাশে লেগে গেল। টুকু ওজনে দ্রুত হাল্কা হয়ে যেতে থাকল। পা দু’টো মাটির গালিচা থেকে পৃথক হতে থাকল। আববু বলল- তুমি ডানাকে যা বলবে ওরা তা-ই শুনবে। কথা বলতে চাইলে কথাও বলবে। এখন রেডি হও টুকু। এক দুই তিন…….। খাট থেকে কিছু পড়ার শব্দ হল। শব্দটা দাদুর কানে যেতেই দাদু ধড়মড় করে উঠে পড়ল। দাদু বাতি জ্বালাল। টুকু লম্বা হয়ে নিচে পড়ে আছে। দাদু তাকে বুকে জড়িয়ে খাটে উঠাল। আম্মুও দৌড়ে এসে টুকুর পাশ ঘেঁষে বসল। দাদু বলল-স্বপ্ন দেখছিলে? -হুঁ।
-কী স্বপ্ন দেখছিলে? -আববুর সাথে কথা হলো। আববু আমাকে এক জোড়া ডানা পরিয়ে দিয়ে বলল- যাও, উড়ে যাও, চাঁদটা ছুঁয়ে দিয়ে এসো। বাংলাদেশে তুমি অনেকবার চাঁদে যেতে চেয়েছিলে। পারোনি। তুমি গেলে? -খাট থেকে পড়ে না গেলে এতোক্ষণে চাঁদেই পৌঁছে যেতাম। দাদু ঠোঁটের আগায় এক চিলতে হাসল। টুকুর চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে বলল- আমার কথা কিছু বলেনি? তোমার কথা বলেছে। আম্মুর কথা বলেছে।
আম্মু গলায় এক আকাশ আগ্রহ ঢেলে বলল- আমার কথা কী বলেছে? -তোমাকে যেন কোনদিন কষ্ট না দেই। আববু নাকি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এসব কষ্টের জন্য মাফও চেয়েছে। আম্মুর দু’চোখ ছাপিয়ে অশ্রু নামতে শুরু করল। আম্মুর গলাটা এক সময় ফ্যাসফ্যাসে শব্দে রূপ নিল। আম্মুকে এসব মিথ্যা বলাটা ঠিক হলো কি না টুকু ভাবতে শুরু করল।

আরো পড়তে পারেন...

প্রতিজ্ঞা– শিশুতোষ গল্প

সেই ছোট বেলা থেকেই আমি খুব চঞ্চল স্বভাবের ছিলাম। সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। লেখাপড়ার…

অহংকারের ফল

এক পালোয়ান মল্ল যুদ্ধে খুব পারদর্শিতা অর্জন করেছিলো। মল্ল বিদ্যায় সে তিনশত ষাটটি কৌশল আয়ত্ব…

ভিক্ষুক

সবুজ গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা। বাংলাদেশের অন্যতম নদীগুলোর মধ্যে মেঘনা একটি বৃহৎ…