দহনচক্র

আবেদার মেয়ে হয়েছে।
তার জন্মের উৎসবে ধুমধাম হবে, এটা তো জানা কথা। আবেদাদের সমাজে সবচেয়ে বড় উৎসব হল নবজাতকের জন্ম-মহোৎসব। জন্মের মোচ্ছব। জন্মেও দেখা যাবে না, এমত স্তরের মোচ্ছব।
জরায়ুর ভার হালকা হয়ে যাবার পর সৃষ্টির আনন্দে আবেদা ঝলমল করছিল তো বটেই, আজ তাতে যোগ হয়েছে সৃষ্টির গর্ব। ওর বাবার তরফের সব আত্মীয়দের মত আবেদাও চায় এবছর ভুট্টা, মরিচ, ক্যাকাও আর তামাকের আবাদটা যেন বাকি সব বছরের চেয়ে একটু বেশি ভরভরন্ত হয়। সবাই জানুক, মেয়ে তার ফেলনা নয়। যে শিশুটির নাম একটু পরেই রাখা হবে, পয়মন্ত হওয়ার দায়িত্ব তাকেও তো কিছুটা নিতে হবে।
কোলের কাছে দড়ির দোলনায় একটা টাটকা তেঁতুলের তেল-চকচকে বীচির মত গুটলি হয়ে শুয়ে আছে ওর মেয়ে। বোজা-চোখের উপর চোখের পাপড়িগুলো কেৎজাল পাখির রঙিন পালকের মত বিছিয়ে রাখা। চোখের মণিটাকে আদরে ঢেকে রেখেছে ঝিল্লীর মত পাতলা তিরতিরে নীলচে চামড়া। মুখের উপর রোদ পড়েছে মেয়ের। আবেদা চেয়ে থাকে।
আবেদা মা হয়েছে। তাই আত্মজার জন্য কলিজার ভিতর-নিংড়ানো সমস্ত রক্ত একটা বিশাল ঢেউতোলা সমুদ্র হয়ে গিয়েছে; আর ঐ মহাসমুদ্রের মধ্যে ওর পুরানো পৃথিবীটা একটা ছোটখাট গোলগাল ফাঁপা তামার বল হয়ে ভাসছে। ভাসছে, ভাসছে…কিন্তু এর মধ্যে কোথাও শিশুটির বাপের চিহ্নমাত্র নেই! পতিপ্রেম নামে যে কোনো আবেগ থাকতে পারে, স্বামীর বিগ্রহের পায়ে একটা বিশ্বস্ত অনুগত নারীদেহ যে মোমের মত গলে গলে নুয়ে পড়তে পারে কোনোদিনও, ওরও যে একটা স্বামী আছে যাকে ও কোনোদিন একটা মোমের মতই ভালবেসেছিল—এই বোধগুলো চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল যেন এখন এখানে মেয়ের সামনে বসে।
সৃষ্টির গর্ব বুঝি এমনই ধ্বংসমুখী হয়। অন্যসব পুরাতন অনুভূতির সৌধ গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে না দিয়ে সেই গর্ব মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। অতীতে চর্চিত মহিম আবেগগুলোকে এই গর্বের পাশে বালকের শিশ্নের মত হাস্যকর লাগতে থাকে। তাই যদি না লাগল, তবে সৃষ্টির আর কী দাম?
আবেদার আর ওর স্বামীকে ভাল লাগে না। ও বেশ বুঝতে পারে। ভাল লাগার প্রয়োজন যে ফুরিয়েছে, সঙ্গে এটাও বুঝতে পারে। তাই ও নিজেকে অযথা মহাপাতকী মনে করে না। শান্তিমত হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছোট্ট মেয়েটার মুখের উপর পড়া রোদের ঝালর সরায়।
আজকের নামকরণ অনুষ্ঠানে শামান ব্যাটা ওর মেয়ের আসল নাম যা-ই রাখুক, ডাকনাম মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে আবেদা। ইশতাহ্‌ব।
ইশতাহ্‌ব।
ওর বাবার তো আর কষ্ট করে ভেবে ভেবে মেয়ের নাম বের করার দরকার নেই। অবলীলায় নিজের নামের অংশটুকু জুড়ে দেবে সময় মত, ঠিক যেমন অবলীলায় বীর্যবাহকের সামান্য শ্রমে ইশতাহ্‌বকে জন্ম দিয়েছে সে।
বদ্ধ আঁতুড়ঘর ছাড়ার পর আজ অনেকদিন পর নিজের বাপের বাড়ির বসতভিটায় ফেরত এসে আবেদার খুব ভাল লাগতে থাকে। ভাল লাগার আরো একটা কারণ হল, এই ঘরের সাথে ওর স্বামীর কোনো স্মৃতি বিজড়িত নেই। এই ঘরের একমাত্র স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে শুধু একটা রাত, যে রাতে ভিতরবাড়ির এই কাদামাটি-লেপা নিশ্ছিদ্র নিরন্ধ্র তালপাতার বেড়া আলতো হাতে ঠেলে সরিয়ে আৎল এসেছিল ওর ঘরে। সদ্য যৌবনাগম হওয়া আৎল। সারা অঙ্গে তামাকের পুরুষালী গন্ধ মাখা চৌদ্দ বছর অতিক্রম করা পুরুষ আৎল। (সেদিনই প্রথম আইনত ধোঁয়া টানার অনুমতি পেয়েছিল সে।)
লুকিয়ে এসেছিল সে। সেই মুহূর্তে তার থাকার কথা ছিল নির্বাসনঘরে। টানা কয়েকদিন উপবাস করার কথা ছিল তার পাণ্ডববর্জিত প্রকোষ্ঠে।
পালিয়ে আসা আৎলকে লাগছিল গ্রামবাসীর তাড়া খাওয়া একটা খেদানো জাগুয়ারের মত। আহা রে!
জলার ধারের জাগুয়ারের মতই ততদিনে তার গজিয়েছে গভীর মাংসল বুক, চওড়া ঘেরের হাত-পা-উরু-বাহু আর ক্ষুধিত হাতের পাঞ্জা।
“সবই তো আছে! লেজটা কই রে তোর? দে দেখি কোথায় লুকায়া রাখছস চোট্টা বিলাই!”, আবেদা সেদিন খিলখিল হেসে বলেছিল আৎলকে।
(জবাবে অশ্লীল রসিকতা ছুঁড়ে দেওয়ার ক্ষমতা আৎলের আছে, এটা তার কোনো শত্রুও বলবে না। কিন্তু ক’দিন আগেও যে নারী তার খেলার সাথী ছিল, তাকে লজ্জা কিসের?)
এখনো মনে আছে আবেদার। আৎলের উপনয়নের রাত ছিল তখন। উৎসবের ঘটা ঠিকমত মজে নি তখনো।
বাইরের উঠানে পাড়ার লোকের মাতাল নাচের হল্লা চলছিল। প্রায়-বিগতযাম প্রহরে জেনিপা’র রসে চুবানো কুচকুচে কালো নকশা-আঁকা আৎলের শরীরকে মধ্যমণি করে ওরা দু’জন সেই রাতে আসল যুবক-যুবতী হয়েছিল।
নিজের উপনয়নের কথা, সত্যি বলতে, আবেদার ভাল মনেও নেই। রীতি অনুসারে বারো বছর বয়সেই ওর উপনয়ন হয়েছিল, প্রথম রজোদর্শনের কিছুদিন পর। সমবয়সী ছেলে বিধায় আৎলেরটা হয়েছিল তার বছর দুয়েক পরে, ওর চৌদ্দতে পা দেয়ার দিন। আবেদা জানে, শিশু জন্মদানের গর্বের অনুরূপ গর্ব আবেদার যদি জীবনে কোনোদিন হয়ে থাকে, তো সেটা হয়েছিল আৎলের যৌবনপ্রাপ্তির দিনে— আৎলের উপনয়ন উৎসবে।
টানা একপ্রহর তামাকের উষ্ণ ধোঁয়ায় স্নান করিয়ে পরিশুদ্ধ করা হয়েছিল সেদিন আৎলকে।
ওদের গুচ্ছগ্রামের বুড়ো শামান পুরোহিত মন্ত্রতন্ত্র পড়েছিল সেদিন অনর্গল। সারা অঙ্গে দামী পালকের পরিচ্ছদ। এত দামী যে কাছে যেতে সাহসে কুলোয় না। আবেদার চেয়ে একটু ছোট শিশুরা প্রার্থনাঘরের একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভিড় করে দেখছিল। বুড়োর কালচে ঠোঁট বেয়ে বিড়বিড় করে নামছিল দুনিয়ার ফতোয়া; আর একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লেই বুড়ো তার ঝোলা থেকে শুকনো তামাকপাতা বের করে তাতে খানিকটা ছাই ডলে গুলি পাকিয়ে নিজের মাড়ির নিচে গুঁজে দিচ্ছিল। বুড়ো সম্মোহক ফতোয়া দিয়ে নির্ঘাত তৈরি করে যাচ্ছিল একের পর এক চিত্রকল্প। ক্ষুধার্ত ইমিশ কুমীর আর শয়তান ইগুইয়ানা হাঁ করে আছে; কংকালের ফাঁপা মুণ্ডু থেকে উঁকি মারছে বিষধর সাপ; জলপ্রপাতের বুকের পথ বেয়ে হাঁটার পিচ্ছিল কোটর পাহারা দিচ্ছে শূল-হাতে কবন্ধ আত্মা– ধরলেই মুণ্ডু কেড়ে নেবে; এদের চোখে ধুলা দিয়ে এদের শরীর ফেঁড়ে সাঁই করে ঈগলের মত উড়তে হবে আৎলকে অনিশ্চিত আকাশের চূড়ায়। ভাবতে যদি ভয় হয়, যদি পেট মোচড়ায়, তো আৎলের এখনো নাক টিপলে দুধ গলে। আৎল কোনো পুরুষই নয়। নেহাত কোমরে লাল সুতার ঘুনসি বাঁধা শিশু।
অনুষ্ঠানের মধ্যে আৎলকে চুরি করে করে দেখেছিল আবেদা সেদিন। আকাশের দেবতার মত সুন্দর লাগছিল ছেলেটাকে। তাঁতে বোনা মেটে বাদামী সাধারণ সুতির কাছার সঙ্গে নীবিবন্ধে ঝুলানো নীলচে পুঁতির সামান্য আভরণ না থাকলেও ওর কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। একটু পর পর শামানের ফুঁক দেওয়া ধোঁয়ার আবরণ ভেদ করে ওর মুখটা দেখা যাচ্ছিল। সঙ্গে ওর ঠোঁটের মাঝ বরাবর গেঁথে রাখা হাড়ের গয়নাটাকে অল্প অল্প কাঁপতে দেখা যাচ্ছিল। ও- ও কি মন্ত্র পড়ছিল শামানের সাথে সাথে?
আত্মারা ওকে কী বলছিল কে জানে?
আবেদা শুধু মাছের চোখ মেলে চেয়ে ছিল ঐ ধোঁয়ার জটার দিকে। আর আকুল হয়ে ভাবছিল প্রতিবার ধোঁয়া সরে গিয়ে আৎলের মুখ ভেসে ওঠার জন্য ক্ষণেকের যে অপেক্ষা, তার চেয়ে সুন্দর কোনো অপেক্ষাই নয়।
যুবতী আবেদা কৈশোরের ওপারে বসে ছিল আৎলের জন্য।
বয়ঃসন্ধি আর বয়ঃপ্রাপ্তির মধ্যে শুধু চিকন ধোঁয়ার পর্দার তফাত।
ঐ পর্দাটুকুকে আবেদা আজও প্রেম বলে মানে।
আত্মাদেরকে সাধাসাধি সেদিন আবেদাও করেছিল। চোখ খুলেই ও প্রার্থনা করছিল যেন আকাশ-ভাসিয়ে ঝড় উঠলেও ওই ধোঁয়ার আস্তরটা সরে না যায়। ধোঁয়াটুকু সরে গেলেই যেন সব অপেক্ষা ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধোঁয়াটুকু সরে গেলেই যেন সব প্রেম নিভে যাবে। ধোঁয়াটুকু সরে গেলেই যেন আৎল হারিয়ে যাবে আজীবনের জন্য। কিংবা যুবা হওয়ার বদলে সুড়ুত করে হয়ে যাবে কোমরে লাল ঘুনসি বাঁধা বামন-শিশু।
সেই তামাকের ধোঁয়া অবশ্য বহুদিন ধরে সরে-সরে মিলিয়ে গিয়েই আবার ফিরে-ফিরে আসতে কসুর করে নি। খিদে পেয়ে মার-খাওয়া বেহায়া বাচ্চা যেমন মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরে, সেরকম প্রতি দুপুরে বার-বাড়ির দাওয়া থেকে ধোঁয়া এসে আবেদার কানের কাছে ঘ্যান-ঘ্যান করেছে। পাশের বাড়ির বা হয়তো ওদেরই বাড়ির কেউ সুখটান টানছিল পেটের খিদে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য।
মনমরা সন্ধ্যায় পাকঘরের জানালা দিয়ে কতদিন ধোঁয়া এসে আবেদার মান ভাঙ্গিয়েছে! দিনের কাজ সেরে ওর বাবা হয়তো তখন তার ট্যারা চোখের মণি দুটোকে দূরে কোথাও নিবদ্ধ করে ঝোলা চোয়ালগুলোকে টান-টান করে তামাক খাচ্ছিল ভুট্টার খোলায় পেঁচিয়ে।
বাসররাতে বর আসারও আগে শামানের হাতে করে আবেদার কাছে এসেছে ধোঁয়া; সাগ্নিক ব্রাহ্মণ হয়ে ওর শুষ্ক যোনিকে পরিশুদ্ধ আর উর্বরা করতে। জমির শস্যের মত ওকে ফলবতী করতে।
বছর-বছর জমিতে চারা বুনবার আগে মহাউদ্যোগে গ্রামের চাষীরা মাঙ্গলিক তামাক জ্বালিয়েছে; অনাগত শিশুর হাসির মত মাইল-কে-মাইল ছড়িয়ে গিয়েছে সেই ধোঁয়া উদার আকাশে।
দেবতার পায়ে বলি চড়ানোর সময় দিগন্ত আচ্ছন্ন করে দিয়েছে ধোঁয়া। খড়্গনাসা দেবদূতের মত আসমান থেকে মতিচ্ছন্ন শিকারী যূথকে বুঝিয়েছে — ঈশ্বর যেহেতু নিজেই ধূমপায়ী, জীবনে একমাত্র ধোঁয়াই ঐশী।
ধোঁয়া দহন থেকে উঠে এসে সৃজন ঘটিয়েছে। মিলন ঘটিয়েছে। ফলন ঘটিয়েছে।
আবেদা তাই আজন্ম শিখেছে যে ধোঁয়াকে বিশ্বাস করতে হয়। গলবস্ত্র প্রণিপাত করতে হয়।
আৎল মরার পর যখনই বাতাসে তামাকপাতা পোড়ানোর গন্ধ ভেসে এসেছে, আবেদা মনে সান্ত্বনা পেয়েছে। আজন্ম মেনে আসা যেকোনো বিশ্বাস সত্য বলে প্রমাণিত হলে মানুষ যে সান্ত্বনা পায়, সেই সান্ত্বনা। দেব-দানো-আত্মা-ঈশ্বরকে কস্মিনকালেও চোখে না-দেখা ধর্মপ্রাণ মানুষ অজন্মার পরের সনে দৈবে ভুট্টাক্ষেতভরা সবুজ-হলুদ দেখে যে সান্ত্বনা পায়, সেই সান্ত্বনা।
আবেদার সন্তান ইশতাহ্‌বও আজ বাঁধা পড়ে যাবে ধোঁয়ার সাথে। জন্মে, বাল্যে, কৈশোরে, যৌবনে; একলা, সদলে; ফলনে, অজন্মায়; জীবন থেকে মৃত্যুর পূর্ণচক্রে।
শামানের ডাকের অপেক্ষায় আবেদা বসে থাকে।
তখনো কলম্বাসের নাম শোনেনি কেউ। আরিফকে নিশ্চয়ই পাড়ার সবাই আৎল নামে চিনত।
(আবেদার মনে নেই ওর নিজের নাম কী ছিল সেই সময়।)

দুঃখিত!