বলা বাহুল্য , স্ত্রীর জ্বরভাব অতি সত্বর ছাড়িয়া গেল । আমার অন্তরাত্মা কহিতে লাগিল , ‘ আর সব ভালো হইল , কিন্তু তোমার বাংলা বিদ্যা সম্বন্ধে তোমার স্ত্রীর মনে এই-যে সংস্কার , এটা ভালো নয় । তিনি নিজেকে মস্ত বিদুষী বলিয়া ঠাওরাইয়াছেন — কোনোদিন-বা মশারির মধ্যে নাইট-স্কুল খুলিয়া তিনি তোমাকে বাংলা পড়াইবার চেষ্টা করিবেন । ‘
আমি কহিলাম , “ ঠিক কথা- এই বেলা দর্প চূর্ণ না করিলে ক্রমে আর তাহার নাগাল পাওয়া যাইবে না । ”
সেই রাত্রেই তাহার সঙ্গে একটু খিটিমিটি বাধাইলাম । অল্প শিক্ষা যে কিরূপ ভয়ংকর জিনিস , পোপের কাব্য হইতে তাহার উদাহরণ উদ্ধার করিয়া তাহাকে শুনাইলাম । ইহাও বুঝাইলাম , কোনোমতে বানান এবং ব্যাকরণ বাঁচাইয়া লিখিলেই যে লেখা হইল তাহা নহে — আসল জিনিসটা হইতেছে আইডিয়া । কাশিয়া বলিলাম , “ সেটা উপক্রমণিকায় পাওয়া যায় না- সেটার জন্য মাথা চাই । ” মাথা যে কোথায় আছে সে কথা তাহাকে স্পষ্ট করিয়া বলি নাই , কিন্তু তবু বোধ হয়, কথাটা অস্পষ্ট ছিল না । আমি কহিলাম , “ লিখিবার যোগ্য কোনো লেখা কোনো দেশে কোনোদিন কোনো স্ত্রীলোক লেখে নাই । ”
শুনিয়া নির্ঝরিণীর মেয়েলি তার্কিকতা চড়িয়া উঠিল । সে বলিল , “ কেন মেয়েরা লিখিতে পারিবে না । মেয়েরা এতই কি হীন । ”
আমি কহিলাম , “ রাগ করিয়া কী করিবে । দৃষ্টান্ত দেখাও-না । ”
নির্ঝরিণী কহিল , “ তোমার মতো যদি আমার ইতিহাস পড়া থাকিত তবে নিশ্চয়ই আমি ঢের দৃষ্টান্ত দেখাইতে পারিতাম । ”
এ কথাটা শুনিয়া আমার মন একটু নরম হইয়াছিল , কিন্তু তর্ক এইখানেই শেষ হয় নাই । ইহার শেষ যেখানে সেটা পরে বর্ণনা করা যাইতেছে ।
‘ উদ্দীপনা ‘ বলিয়া মাসিক পত্রে ভালো গল্প লিখিবার জন্য পঞ্চাশ টাকা পুরস্কারঘোষণা করিয়াছিল । কথা এই স্থির হইল , আমরা দুইজনেই সেই কাগজে দুটা গল্প লিখিয়া পাঠাইব , দেখি কাহার ভাগ্যে পুরস্কার জোটে ।
রাত্রের ঘটনা তো এই । পরদিন প্রভাতের আলোকে বুদ্ধি যখন নির্মল হইয়া আসিল তখন দ্বিধা জন্মিতে লাগিল । কিন্তু প্রতিজ্ঞা করিলাম , এ অবসর ছাড়িয়া দেওয়া হইবে না- যেমন করিয়া হউক , জিতিতেই হইবে । হাতে তখনো দুই মাস সময় ছিল ।
প্রকৃতিবাদ অভিধান কিনিলাম , বঙ্কিমের বইগুলাও সংগ্রহ করিলাম । কিন্তু বঙ্কিমের লেখা আমার চেয়ে আমার অন্তঃপুরে অধিক পরিচিত , তাই সে মহদাশ্রয় পরিত্যাগ করিতে হইল । ইংরেজি গল্পের বই দেদার পড়িতে লাগিলাম । অনেকগুলো গল্প ভাঙিয়া-চুরিয়া একটা প্লট দাঁড় করাইলাম । প্লটটা খুবই চমৎকার হইয়াছিল , কিন্তু মুশকিল এই হইল , বাংলা-সমাজে সে-সকল ঘটনা কোনো অবস্থাতেই ঘটিতে পারে না । অতিপ্রাচীন কালের পাঞ্জাবের সীমান্তদেশে গল্পের ভিত্তি ফাঁদিলাম ; সেখানে সম্ভব-অসম্ভবের সমস্ত বিচার একেবারে নিরাকৃত হওয়াতে কলমের মুখে কোনো বাধা রইল না । উদ্দাম প্রণয় , অসম্ভব বীরত্ব , নিদারুণ পরিণাম সার্কাসের ঘোড়ার মতো আমার গল্প ঘিরিয়া অদ্ভুত গতিতে ঘুরিতে লাগিল ।
রাত্রে আমার ঘুম হইত না; দিনে আহারকালে ভাতের থালা ছাড়িয়া মাছের ঝোলের বাটিতে ডাল ঢালিয়া দিতাম । আমার অবস্থা দেখিয়া নির্ঝরিণী আমাকে অনুনয় করিয়া বলিল , “ আমার মাথা খাও , তোমাকে আর গল্প লিখিতে হইবে না — আমি হার মানিতেছি । ”
আমি উত্তেজিত হইয়া বলিলাম , “ তুমি কি মনে করিতেছ আমি দিনরাত্রি কেবল গল্প ভাবিয়াই মরিতেছি । কিছুই না । আমাকে মক্কেলের কথা ভাবিতে হয় — তোমার মতো গল্প এবং কবিতা চিন্তা করিবার অবসর পড়িয়া থাকিলে আমার ভাবনা কী ছিল । ”
যাহা হউক , ইংরেজি প্লট এবং সংস্কৃত অভিধানে মিলাইয়া একটা গল্প খাড়া করিলাম । মনের কোণে ধর্মবুদ্ধিতে একটু পীড়াবোধ করিতে লাগিলাম — ভাবিলাম , বেচারা নিঝর ইংরেজি সাহিত্য পড়ে নাই , তাহার ভাব সংগ্রহ করিবার ক্ষেত্র সংকীর্ণ ; আমার সঙ্গে তাহার এই লড়াই নিতান্ত অসমকক্ষের লড়াই ।
উপসংহার
লেখা পাঠানো হইয়াছে । বৈশাখের সংখ্যায় পুরস্কারযোগ্য গল্পটি বাহির হইবে । যদিও আমার মনে কোনো আশঙ্কা ছিল না , তবু সময় যত নিকটবর্তী হইল , মনটা তত চঞ্চল হইয়া উঠিল ।
বৈশাখ মাসও আসিল । একদিন আদালত হইতে সকাল-সকাল ফিরিয়া আসিয়া খবর পাইলাম , বৈশাখের ‘ উদ্দীপনা ‘ আসিয়াছে , আমার স্ত্রী তাহা পাইয়াছে ।
ধীরে ধীরে নিঃশব্দপদে অন্তঃপুরে গেলাম । শয়নঘরে উঁকি মারিয়া দেখিলাম , আমার স্ত্রী কড়ায় আগুন করিয়া একটি বই পুড়াইতেছে । দেয়ালের আয়নায় নির্ঝরিণীর মুখের যে প্রতিবিম্ব দেখা যাইতেছে তাহাতে স্পষ্ট বুঝা গেল , কিছু পূর্বে সে অশ্রুবর্ষণ করিয়া লইয়াছে ।
মনে আনন্দ হইল , কিন্তু সেইসঙ্গে একটু দয়াও হইল । আহা , বেচারার গল্পটি ‘ উদ্দীপনায় ‘ বাহির হয় নাই । কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারে এত দুঃখ! স্ত্রীলোকের অহংকারে এত অল্পেই ঘা পড়ে ।
আবার আমি নিঃশব্দপদে ফিরিয়া গেলাম । উদ্দীপনা-আপিস হইতে নগদ দাম দিয়া একটা কাগজ কিনিয়া আনাইলাম । আমার লেখা বাহির হইয়াছে কি না দেখিবার জন্য কাগজ খুলিলাম । সূচীপত্র দেখিলাম , পুরস্কারযোগ্য গল্পটির নাম ‘ বিক্রমনারায়ণ ‘ নহে , তাহার নাম ‘ ননদিনী ‘, এবং তাহার রচয়িতার নাম — এ কী! এ যে নির্ঝরিণী দেবী!
বাংলাদেশে আমার স্ত্রী ছাড়া আর কাহারো নাম নির্ঝরিণী আছে কি । গল্পটি খুলিয়া পড়িলাম । দেখিলাম , নির্ঝরের সেই হতভাগিনী জাঠতুতো বোনের বৃত্তান্তটিই ডালপালা দিয়া বর্ণিত । একেবারে ঘরের কথা — সাদা ভাষা , কিন্তু সমস্ত ছবির মতো চোখে পড়ে এবং চক্ষু জলে ভরিয়া যায় । এ নির্ঝরিণী যে আমারই ‘ নিঝর ‘ তাহাতে সন্দেহ নাই ।
তখন আমার শয়নঘরের সেই দাহদৃশ্য এবং ব্যথিত রমণীর সেই ম্লানমুখ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম ।
রাত্রে শুইতে আসিয়া স্ত্রীকে বলিলাম , “ নিঝর , যে খাতায় তোমার লেখাগুলি আছে সেটা কোথায় । ”
নির্ঝরিণী কহিল , “ কেন , সে লইয়া তুমি কী করিবে । ”
আমি কহিলাম , “ আমি ছাপিতে দিব । ”
নির্ঝরিণী । আহা , আর ঠাট্টা করিতে হইবে না ।
আমি । না , ঠাট্টা করিতেছি না । সত্যিই ছাপিতে দিব ।
নির্ঝরিণী । সে কোথায় গেছে, আমি জানি না ।
আমি কিছু জেদের সঙ্গেই বলিলাম , “ না নিঝর , সে কিছুতেই হইবে না । বলো , সেটা কোথায় আছে। ”
নির্ঝরিণী কহিল , “ সত্যই সেটা নাই । ”
আমি । কেন , কী হইল ।
নির্ঝরিণী । সে আমি পুড়াইয়া ফেলিয়াছি ।
আমি চমকিয়া উঠিয়া কহিলাম , “ অ্যাঁ , সে কী! কবে পুড়াইলে । ”
নির্ঝরিণী । আজই পুড়াইয়াছি । আমি কি জানি না যে , আমার লেখা ছাই লেখা । স্ত্রীলোকের রচনা বলিয়া লোকে মিথ্যা করিয়া প্রশংসা করে ।
ইহার পর হইতে এ পর্যন্ত নিঝরকে সাধ্যসাধনা করিয়াও এক ছত্র লিখাইতে পারি নাই ।
ইতি শ্রীহরিশচন্দ্র হালদার।
উপরে যে গল্পটি লেখা হইয়াছে উহার পনেরো-আনাই গল্প । আমার স্বামী যে বাংলা কত অল্প জানেন , তাহা তাঁহার রচিত উপন্যাশটি পড়িলেই কাহারো বুঝিতে বাকি থাকিবে না । ছিছি নিজের স্ত্রিকে লইয়া এমনি করিয়া কি গল্প বানাইতে হয় ? ইতি শ্রীনির্ঝরিনি দেবী।
স্ত্রীলোকের চাতুরী সম্বন্ধে দেশী-বিদেশী শাস্ত্রে-অশাস্ত্রে অনেক কথা আছে — তাহাই স্মরণ করিয়া পাঠকেরা ঠকিবেন না । আমার রচনাটুকুর ভাষা ও বানান কে সংশোধন করিয়া দিয়াছেন , সে কথা আমি বলিব না — না বলিলেও বিজ্ঞ পাঠক অনুমান করিতে পারিবেন । আমার স্ত্রী যে কয়-লাইন লিখিয়াছেন তাহার বানান-ভুলগুলি দেখিলেই পাঠক বুঝিবেন , সেগুলি ইচ্ছাকৃত— তাঁহার স্বামী যে বাংলায় পরমপন্ডিত এবং গল্পটা যে আষাঢ়ে , ইহাই প্রমাণ করিবার এই অতি সহজ উপায় তিনি বাহির করিয়াছেন — এইজন্যই কালিদাস লিখিয়াছেন , স্ত্রীণামশিক্ষিতপটুত্বম । তিনি স্ত্রীচরিত্র বুঝিতেন । আমিও সম্প্রতি চোখ-ফোটার পর হইতে বুঝিতে শুরু করিয়াছি । কালে হয়তো কালিদাস হইয়া উঠিতেও পারিব । কালিদাসের সঙ্গে আরো একটু সাদৃশ্য দেখিতেছি । শুনিয়াছি , কবিবর নববিবাহের পর তাঁহার বিদুষী স্ত্রীকে যে শ্লোক রচনা করিয়া শোনান তাহাতে উষ্ট্রশব্দ হইতে র-ফলাটা লোপ করিয়াছিলেন — শব্দপ্রয়োগ সম্বন্ধে এরূপ দুর্ঘটনা বর্তমান লেখকের দ্বারাও অনেক ঘটিয়াছে — অতএব , সমস্ত গভীরভাবে পর্যালোচনা করিয়া আশা হইতেছে , কালিদাসের যেরূপ পরিণাম হইয়াছিল, আমার পক্ষেও তাহা অসম্ভব নহে । ইতি শ্রীহঃ
এ গল্প যদি ছাপানো হয় , আমি বাপের বাড়ি চলিয়া যাইব । শ্রীমতী নিঃ
আমিও তৎক্ষণাৎ শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করিব । শ্রীহঃ
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।