থিসলডাউনের প্রহরী–হাসান জাহিদঃ৩য় পর্ব

 

ওয়াশরুমের কাজ সেরে টেড ফিরে এসে চেয়ারে বসল। মহিব জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী কাজ করছ জানতে পারি কি? নিশ্চয়ই, লাফ দিয়ে উঠে টেড বলল, এদিকে এসো। ওর আহ্বানে মহিব লোকটার নির্দেশিত নোটিসবোর্ডের দিকে তাকাল। টেড ম্যাপে আঙুল রেখে বলল, প্লাজার এই সার্কেলকৃত স্থানটার তলদেশের মাটি দূষিত হয়ে পড়েছে। আগে এখানে গ্যাস স্টেশন ছিল। ওদের পল্যুশন মাটিকে দারুণভাবে কলুষিত করেছে। আমরা যন্ত্রপাতি আর ক্যামিকেলস দিয়ে মাটি দূষণমুক্ত করব।

এইখানে, এই কক্ষে এরকম একটা ম্যাপ আছে, কী কাজ হবে তার ইঙ্গিত দেয়া আছে – সেটা মহিবের নজরে পড়েনি। মহিব মিনমিনে সুরে বলল, তাহলে তো বেশ বড় কাজই তোমরা করছ।

 

টেড চলে গেলে মহিব ম্যাপে মনোনিবেশ করল। ম্যাপে দেখানো হয়েছে এই প্লাজা ও আশেপাশের কিছু এলাকার মাটি পিএইচসি (পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বন) দূষণে আক্রান্ত হয়েছে। আরো দেখানো হয়েছে কোন স্থানে এক্সকেভেশন করা হবে। প্রথমে এরা ডিওয়াটারিং-এর কাজ করবে। মহিব এখানকার চৌকিদার। সুতরাং আদার বেপারি হয়ে জাহাজের খবর নেয়া তার সাজে না। কিন্তু মন মানছিল না। কেউ যদি প্রশ্ন করে, কী কাজ হচ্ছে? তখন একটা জুতসই জবাব সে দিতে পারবে।

টেড খাস কানাডিয়, দেখতে সুপুরুষ আর বয়স সামান্য যুবা-উত্তর। রাজমাও কানাডিয়, কিন্তু তার ভেতরের ভালোমানুষির জন্য তাকে দেশি ভাবতে ভালো লাগে মহিবের। প্রকাণ্ড একটা ভুঁড়ি নিয়ে মহিলা যেভাবে দৌড়াচ্ছে, দেখে মনে হয় আস্ত একটা মিষ্টি কুমড়া গড়িয়ে চলছে। এরা যে পরিশ্রমী ও কাজেকর্মে আন্তরিক কানাডা আসবার আগে মহিব তা জানত, এখন স্বচক্ষে দেখছে। তবে সে ঝক্কিবিহীন একটা চাকরি চেয়েছিল।

আসা অব্দি হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে চাকরি পাওয়া এখানে রীতিমতো দ্বিতীয় জন্মপ্রাপ্তির মতো। আর পছন্দমতো চাকরিপ্রাপ্তি তো দুঃস্বপ্নকে অতিক্রম করে স্বর্ণমৃগের দেখা পাওয়া। এখানে আগমন ইস্তক এরকম স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে ঠেলেঠুলে চলছে দিনগুলো। আবেদন করে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় খুব দ্রুত উতরে যাবার মতো ভাগ্যবানদের একজন মহিব। আরো একটি বিষয়ে সে ভাগ্যবান। বিয়েথা করেনি বলে দেশে সে চাকরির টাকাগুলো জমাতে পেরেছিল।

ঢাকায় সে মেসে থাকত। খরচাপাতি তেমন ছিল না। মদ-মেয়েমানুষের অভ্যাস হয়নি, বাড়িতে টাকাপয়সা পাঠাবার কোনো গুরুভার ছিলনা। এরকম অনেক বিষয়ে সে ভাগ্যবান ছিল। কেবল একটা বিষয়ে ঘাটতি আছে তার – বউ নেই, কোনোকালে ছিলও না। একে একে বিয়াল্লিশটি বসন্ত পার করে দিয়ে এখন বিয়ের কথা শুনলে তার হাসি পায়। মা-বাবা বহু আগেই গত হয়েছেন, তাদের একমাত্র সন্তান সে। আগে ছিল বন্ধু পরিবেষ্টিত, এখন নিঃসঙ্গ।

কয়েকরাত আগে সে টহল দিয়ে পোষ্টে ফিরে এসে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের আগে তন্দ্রায় উঁকি দিয়ে গেল একটা মুখ। এক তরুণীর আদল। সাধারণত ঘুমঘোরে বা তন্দ্রায় কোনো তরুণীর মুখ দেখে না মহিব। দেখে কালো বিশাল নিগ্রোগুলোর চেহারা। টহলের সময় এদেরকে দেখে মহিব তটস্থ থাকে। এই নিগ্রোগুলোর চেহারা ভেসে আসে ঘুমের অতলে, দুঃস্বপ্ন তাড়া করে মহিবকে। একটা সময় শুয়ে শুয়ে কোনো তরুণীর সুশ্রী মুখাবয়ব দেখার চর্চা করত সে।

একসময় তা থেমে যায়। ততদিনে সে বুঝে গেছে বিয়ে তার ভাগ্যে সহসাই ঘটছে না। ভাল চাকরি পেলে বিয়ে করবে, এমন ভেবেছিল প্রথমে। ভালো চাকরি তার হয়েছিল কিন্তু অনেক সময় নিয়ে। তারপর ভাবল, চাকরিটা পোক্ত হোক। কিছু পয়সা জমুক। যখন ভালো একটা পুঁজি দাঁড় করালো তখন সে পাড়ি দিল দূরদেশে। সুতরাং বিয়ে নামের বিষয়টি অনিষ্পত্তিকৃত দীর্ঘসূত্রীয় মামলার মতো আজও ঝুলে আছে। কিন্তু হঠাৎ ওর মনের কোণে কোনো এক তরুণী কেন উঁকি দিয়ে গেল? অস্পষ্ট, কুয়াশাচ্ছন্ন একটি মুখ। মহিব চেষ্টা করল মুখটিকে মন থেকে সরাতে। কিন্তু পারল না। অতএব কোনো এক তরুণীর মুখদর্শন পর্ব চলতে থাকল।

রাতভোর বৃষ্টি ও কনকনে হাওয়া। অক্টোবরের শুরু। ক’দিন পরেই নামবে আসল ঠাণ্ডা। শুরু হবে স্নোফল। জমবে বরফ, অ্যান্টার্কটিকার মতো রূপ ধারণ করবে দেশটি। উত্তর গোলার্ধের এই দেশটিকে অনেকেই এই একটি কারণে পছন্দ করে না। বছরের সাতমাসই বরফে ঢেকে, ঠাণ্ডায় কাহিল হয়ে কাতরাতে থাকে।

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!