তো?’—– অলোক কুমার বসু

ব্যাংকের কাউন্টারের সামনে লম্বা সোফাটায় রতন কখন এসে বসে আছে লক্ষ্যই করেনি সুপ্রিয়া। অবশ্য কখনই বিশেষ লক্ষ্য করার মতো ছিল না সে। ‘তৈলঢালা স্নিগ্ধ তনুনিদ্রা রসে ভরা, দৈর্ঘ্যে ছোট বহরে বড় বাঙালি সন্তান।’ গোঁফটা বড় করে আর চোখে নতুন চশমা লাগিয়েও বিশেষ সুবিধে হয়নি। এখন উঠে এসে তার পাশে খালি জায়গাটায় বসাতে নজর পড়ল আর কি রকম একটা করে উঠল শরীরটা তার। মুখটা তেতো মতন।
বিয়ের আগে যখন প্রথম তাকে দেখতে আসে রতন, তখন জানলা দিয়ে একনজর দেখেই বলেছিল সুপ্রিয়া ‘ইস রে, এই নাকি বর!’ আর মুখ বাড়িয়ে তার বন্ধু সুলতা দেখে বলেছিল- যা :, তেমন খারাপ না তো। বেশ তো গায়ে-গতরে ভালা। অনেক দূর থিক্যা আসছে না? তয় এট্টু আউলিয়া গেছে গা’।
হ্যাঁ, ওই যে- একে বেড়াল কালো, তায় গাঙ সাঁতরে এলো।
আর আসা মানে কি সহজ। খুলনা সুন্দর বনের দু’কূল ভাসানো পরশ নদী নৌকায় পার করে, খানিকটা হেঁটে, খানিকটা রিকশা-ভ্যানে করে তাদের দেশের বাড়িতে বর এসেছিল তাকে দেখতে। আট বছর আগেকার একদিন। সুপ্রিয়া তখন মামার বাড়িতে থেকে রাজশাহী কলেজে পড়ে। কিন্তু ঠাকুরমা বলেছিলেন, মেয়ে দেখানো হবে দেশের বাড়ি থেকে। তাই এ ব্যবস্থা। সবাই কত খুশি। ‘ব্যাঁইট্যা তো কি হইসে, নোয়াপাড়ার সাহা বইল্যা কতা। অর্থাৎ ‘কিন্তু তারা উচ্চঘর, কংশ রাজের বংশধর!’
বিয়েতে সবাই এসেছিল। শুধু তার গৃহশিক্ষক তাপসদা আসেননি। তাপসদা তখন আমেরিকায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তার নাকি সেইদিন কি একটা পরীক্ষা ছিল ঢাকায়। তারপর এতদিন পরে তাপসদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল রতনের সূত্রেই। রতন একটা এনজিওতে চাকরি করে। তারা বিশ্বব্যাংকের দেয়া কোনও ঋণ থেকে সাহায্য পায়। তাপসদা এখন ওয়াশিংটনের লোক। মাস ছয়েকের জন্য ঢাকায় এসেছেন। তিনি এসেছিলেন পরিদর্শনে। তারপর আলাপের সূত্রে রতন জেনেছে উনি তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের লোক। তারপর বাড়িতে নিমন্ত্রণ এবং ‘দেখো তো চেয়ে আমারে তুমি চিনিতে পারো কি না?’

 
তাপসদার সঙ্গে তার যে আবার কোনোদিন দেখা হবে তা ভাবতে পারেনি সুপ্রিয়া। ওনার বাবা-মাও নেই আর। এক বোন তার বোধ হয় ইন্ডিয়ার কোনও ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। খুলনায় ওনাদের সম্পত্তি সব হয় বিক্রি নয়তো বেদখল হয়ে গেছে।
নতুন অফিসে বৃহস্পতিবার সকালবেলা এ সময়টা বড় তাড়াহুড়া থাকে সুপ্রিয়ার। ক্লায়েন্টদের কাগজপত্র পাঠানোর নানা কমিটমেন্ট থাকে। আগামীকাল শুক্রবার, পরশুদিন শনিবার-দু’দিনই ঢাকাসহ সারাবাংলাদেশে সরকারি অফিস বন্ধ। তার সঙ্গে তাল রেখে আজকাল প্রাইভেট কোম্পানিও বন্ধ থাকে প্রায় সবই।
সবাই মিলে খুব করে বিদ্যুৎ বাঁচায়। বেশ ভালো বুদ্ধি। আরও একদিন করে বাঁচালে আরও খুশি হতো সুপ্রিয়া। ও যে আর্কিটেক্ট ফার্মে কাজ করে সেটাও দু’দিন বন্ধ। কিন্তু ব্যাংক থেকে কিছু টাকা আজ না তুললেই নয়। ঈদের আগে এটা শেষ সপ্তাহ। অন্য সময় অফিসের পিয়ন সাগর তুলে দেয় তার টাকা। এবারে ঈদের আগে সে দেশে গেছে। ও নিয়মিত যে ব্যাংকে টাকা রাখে সে অ্যাকাউন্টে টাকা অল্প আছে। সে তুলনায় দিলকুশা কমার্শিয়াল এরিয়ায় এ ব্যাংকে ওর অ্যাকাউন্টটা অনেকদিন অপারেট করা হয়নি। বেশ কিছু টাকা পড়ে আছে এখানে।
সামশেরের জন্য গুলশানের আড়ং থেকে চিকেনের কাজ করা একটা ভালো পাঞ্জাবি সেট নেবে এবারে। এটা ওদের বিয়ের পর তৃতীয় ঈদ। প্রত্যেক ঈদে ও সামশেরকে নিজের থেকে কিছু না কিছু কিনে দিয়েছে। যেমন বাবাকে শার্ট আর মাকে শাড়ি দিয়েছে পুজোর সময়। টাকাটা তুলে নিয়ে অফিসে ফিরবে সে।
স্টেট ব্যাংকের সবই ভালো, কিন্তু এ উপমহাদেশের রাজকীয় ব্যাংক তো, তাড়াহুড়ো নেই কোনও। আসুন বসুন কথা হোক পরিচয় হোক। ভেতরে কারও সঙ্গে দেখা করলে এক কাপ চাও খাওয়াবেন ওনারা। টাকা? তাও পাবেন একটু বসুন না ভাই। জিরিয়ে নিন একটু। চেকটা জমা দিয়ে একটা টোকেন নিয়ে পে-কাউন্টারের সামনে লম্বা সোফাটার একপাশে বসে ছিল সে। এখন প্রতীক্ষা কখন ডাক আসে।
যখন এরকম কোনও পাবলিক প্লেসে আসতে হয় তখন নিজের সম্বন্ধে সচেতন না হয়ে উপায় থাকে না সুপ্রিয়ার।
কি করবে, গায়ের রঙ এমন যে মেমসাহেবদের বলে ‘দূরে থাকে’, অথৈ দীঘি দীঘল চোখ, তাকালে মনে হয় জিজ্ঞাসা করছে ‘ও ছেলে, সাঁতার জানো তো?’, সমুদ্র থেকে উঠে আসা ভেনাসের মতো এমন পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হাইটের মেয়ে তো আর বাংলাদেশের পথেঘাটে যত্রতত্র দেখা যায় না, তাই সব চোখ তারই দিকে, আর তার চোখ দরকার না হলে মাটির দিকে। কেউ বলে দেয়নি সুপ্রিয়াকে, নিজেই শিখেছে সে, জানে চোখে চোখ মিললে নানা অনর্থ। ‘মনের নাম মধুমতি, চোখের নাম আয়না’।
সামশের চায় ও বাইরে বেরোনোর সয় বোরখা ব্যবহার করুক। বলতেই পারে বাথরুমে øানের সময় গায়ে সাবান মাখানো থেকে রাতের বিছানা পর্যন্ত সর্বত্রই সুপ্রিয়ার যেভাবে উপাসনা করে সামশের। এসব ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিকে এখন সে সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অধিকার বলে মনে করে। আর কেউ তার অভ্যাস পাবে এটাও সহ্য হয় না তার। একজন যে আগেই পেয়ে গেছে সে জন্যও দুঃখ করে মাঝে মাঝে। শরীরে এখানে ওখানে কয়েকটা দাগের ব্যাখ্যা চায়। বলে ‘লাভ বাইট?’। হেসে এড়িয়ে যায় সুপ্রিয়া। অনেক বলে কয়ে বোরখার আবদারটা বাদ দিতে রাজি করিয়েছে সে। আটাশ বছর বয়েসে এ নতুন খাঁচায় ঢুকতে চায় না তার মন।

 
চেক জমা দেয়ার সময় কাউন্টারের ভদ্রলোক ওর দিকে তাকিয়েছিলেন একবার। আগে ওর সিঁথিতে জ্বল জ্বল করত সিঁদুর। এখন আর নেই। লক্ষ্য করেছে বোধ হয়। সুপ্রিয়া অনেককাল আসেনি এ ব্যাংকে তবে ভদ্রলোক তাকে আগে নিশ্চয় দেখেছেন। মুখচেনা। সামশেরের সঙ্গে বিয়ের আগে ইসলাম গ্রহণের সময় ওর একটা নতুন নাম দিয়ে গেছেন মৌলভী সাহেব। আকলিমা খানম। আকলিমা খানম সুপ্রিয়া। বাংলাদেশে আরাব মুসলিম নামের শেষে এ বাংলা ডাক নাম রাখা বেশ চালু। যেমন রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। কিন্তু এ ব্যাংকের খাতায় নাম ও পাল্টায়নি। ওখানে সুপ্রিয়া সাহাই আছে আগের মতো। একটা হাল্কা সবুজ রঙের কুর্তা আর পাঞ্জাবি পরেছে ও। সঙ্গে সাদা মেঘ রঙের ওড়না। পাজামা কুর্তা বেশ কাজের পোশাক। তবে সঙ্গে ওড়না না থাকলে ওর পক্ষে এটা পরে বাইরে বেরোনো মুস্কিল। অন্যমনস্কভাবে হাতের টোকেনটা নিয়ে খেলা করছিল সুপ্রিয়া। মাঝে মাঝে সামনের ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে-বোর্ডের দিকে দেখছিল কখন ওর টোকেন নম্বর আসে। ওর পাশের ভদ্রলোক উঠে যেতে রতন এসে পাশে বসল ওর। এতদিন পরে দেখেও তার দিকে দু’বার তাকাতে ইচ্ছে করে না সুপ্রিয়ার।
‘বেশি পাল্টাওনি তুমি, আগের মতোই আছ।’
যেন আকাশের দিকে মুখ করে বলে রতন। কোনও উত্তর দেয় না সুপ্রিয়া। এসব অধ্যায় একটা রক্তমাখা পাতায় অনেকদিন আগে শেষ হয়ে গেছে।
এখন আবার পাশে এসে বসেছে। আলাপ শুরু করার চেষ্টা আবার। কি মতলব লোকটার। দেখতে না চাইলেও নজরে পড়ে নতুন চকচকে ঘি রঙের একটি জামা পরেছে। চশমার আগেকার ভারি ফ্রেম পাল্টে সোনালি হাল্কা একটা ফ্রেম। তাপসদার মতো। ওর নতুন বউয়ের প্রেশক্রিপশন নাকি নিজে নিজেই সাজবার চেষ্টা? ওদের ছাড়াছাড়ি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা বিয়ে করেছে রতন। অফিসে এক সহকর্মীর কাছে জেনেছে সুপ্রিয়া। রতনের বাড়ির কাছে থাকে সে।
‘বোঝলেন আপা, সবৎসা ভাগিনি, আগেই ব্যবস্থা ছিল দ্যাখেন গিয়া। তবে গাভিনিটি ভালা। এ গুড কাউ।
‘বলেছিল ফাজিল ছেলেটি। শুনে কৌতূহল হলেও মুখে তাকে এক ধমক দিয়েছিল সুপ্রিয়া এ আবার কেমন কথা মেয়েদের সম্বন্ধে!’
– আহা যা সত্য তাই তো কইসি ম্যাডাম।
– সব সত্যি এভাবে বলতে হয় না।
এই লাইসেন্স দিতে নেই ছেলেদের। জানে সুপ্রিয়া।
নম্বরটা এলে বাঁচে সে। দশ হাজারের বেশি হলে আর তাড়াতাড়ি টেলারপেমেন্ট হয় না। পুরো সই মিলিয়ে পাঠায় কাউন্টারে। জিনিসপত্র জামাকাপড় সবকিছুর যা দাম আজকাল, সবার জন্য পছন্দমতো কিছু নিতে গেলে ওর কমে হয় না। সামশের ছাড়াও তার পল্লবও আছে তো। সেই ছোট্ট সোনাটাকে সাজাতে হবে না উৎসবের দিনে?
‘বলছি যে পাল্টাওনি বেশি।’ আর একবার নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চায় রতন। সুপ্রিয়া যেন কানেই নেয় না। পাল্টেছি কোথায় তুমি কি জানো? মনে মনে বলে সে। টোকেনটা হাত থেকে নিয়ে ব্যাগের ভেতর রাখে। বাম হাতের চুড়িগুলো এপাশ ওপাশ করে একবার।
-‘তোমার মোবাইলের নম্বর পাল্টে ফেলেছ। ভুল করেছিলাম এ কথা বলারও কোনও সুযোগ পাই না।’
রতন হাল ছাড়ে না।
‘কোনও দরকার নেই তার।’ এবার অস্ফুটভাবে বলে সুপ্রিয়া।
– না দরকার আছে।
নিচের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে রতন।
স্ক্রিনে তিনটে নতুন নম্বর ওঠে- ৩৫, ৩৬, ৩৭।

 
৩৭টা সুপ্রিয়ার। ব্যাগটা হাতে করে নিয়ে সেটা খুলে আবার টোকেনটা বের করে সে। তারপর উঠে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে হাঁটা দেয়। পেছনে পেছনে রতনও আসে। আগের দুটো নম্বরের একটা বোধ হয় ওর। সুতরাং ওর টোকেনটাই আগে চায় কাউন্টারের ক্যাশিয়ার। টাকাটা গুনে নিয়ে পাশে দাঁড়ায় রতন।
‘চার চারটা বছর চরম যন্ত্রণা দিয়ে শেষ হয়নি এখন আবার রাহুর মতো উদয় হল। দেখা হতেই আবার খাজুরি শুরু করেছে” মনে মনে ভাবে সুপ্রিয়া।
কাউন্টারের ভদ্রলোক কিন্তু টাকা দেয় না সুপ্রিয়াকে। হাসিমুখেই বলে অবশ্য- ‘ম্যাডাম একটু অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন। একটু কাজ আছে আপনার এই টাকাটা দেওয়ার আগে।’
– ‘এ আবার কি নতুন উপদ্রব, ভাবে সুপ্রিয়া।
– চৌধুরী সাহেবকে আমি চিনি, চলো যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।
– তার কোনও দরকার নেই।
বলে সুপ্রিয়া। ডিভোর্স এবং তারপর নতুন বিয়ের পর এই ব্যাংকের কোনও কাগজপত্র পাল্টায়নি সে। কে জানে সেখান থেকে আবার কোন ভেজালের সৃষ্টি হয়।
– আমি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস ডিটেল এখনও কিছু পাল্টাইনি এখানে।
অস্ফুুটভাবে প্রায় স্বগতোক্তি করে সুপ্রিয়া। কথাটা শোনে রতন। বলে
– হ্যাঁ সে তো হতেই পারে, আমার অ্যাকাউন্টের ওয়ারিশও তো তুমিই রয়ে গেছ। পাল্টানো হয়নি।
এসব কথার কোনও উত্তর দেয় না সুপ্রিয়া। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার চৌধুরী বললেন ‘অনেকদিন পরে আপনি ব্যাংকে এসেছেন ম্যাডাম। প্রায় দেড় বছর পর। আপনার অ্যাকাউন্ট নন-অপারেটিভ হয়ে গেছে। আজকাল বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম করে দিয়েছে। আপনার অ্যাকাউন্ট নম্বরও চেঞ্জ হবে। টেন ডিজিট, আরটিজি করা যাবে এখন। সব কিছু আধুনিক হয়ে যাচ্ছে কি না। এখন আবার এ ফর্মটা সই করতে হবে। এখানে আর একজন অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের ইনট্রোডাকশন হলে ভালো হয়। অনেকের সই সময় গেলে একটু পাল্টে যায় তো। তাই এই সাবধানতা।’
এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়েছিল রতন। এগিয়ে এসে বলে,
– দিন চৌধুরী সাহেব। আমিই ইন্ট্রোডাকশন করে দিচ্ছি। ওর ওরিজিনালটাতেও আমারই সই ছিল।
– ও, অবশ্যই।
হাসি মুখেই তার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দেন চৌধুরী। সুপ্রিয়া আর কথা বাড়ায় না। টাকাটা তার পাওয়া দরকার। সই করার সময় তার হাতের ওপর কাটা দাগটা লক্ষ্য করে রতন। রান্নাঘরের খুন্তির মার। আরও অনেক রক্তপাত হয়েছিল সেদিন। দেখে মনে হয়েছে হাতে স্টিচ হয়েছে। গোলাপি রক্তাভ চামড়ার ওপর আরও সাদা একটা লাইন। দু’পাশে তেঁতুলে বিছের পায়ের মতো স্টিচের দাগ বোধ হয়। এইটুকু দেখা যাচ্ছে। বাকি শরীর তো ঢাকা দেয়া আছে। সেখানে কোথায় কি হয়েছে কে জানে। তার আগের দাগওতো আছে কয়েকটা। সে রাতের পর আর বাড়ি ফেরেনি সুপ্রিয়া। কোনও বন্ধুর বাড়ি চলে গিয়েছিল রক্তাক্ত হাতটা নিয়ে। রতনের ভাগ্য ভালো। থানা পুলিশ করেনি সুপ্রিয়া। না হলে এখন চকচকে ঘি রঙের জামা না পরে ডোরাকাঁটা জামা গায়ে দিয়ে জেলের ঘানি টানতে হতো রতনকে। পাথর ঘুরিয়ে সরষে থেকে তেল বের করতে হতো কিংবা কলাই থেকে ডাল। বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আইন বেশ কড়া।
এসব কিছুই হয়নি। এমনকি আদালতে কোনও মামলাও ওঠেনি। ডিভোর্স বাই মিউচুয়াল কনসেন্ট।
আমার ধারণাটা ঠিক ছিল না।
কাউন্টারেও পেছন ছাড়ে না রতন।
– আমার খুব ভুল হয়েছিল।
এসব কথার কোনও জবাব না দিয়ে খুব নির্বিকারভাবে কাউন্টার থেকে টাকাগুলো তোলে সুপ্রিয়া। তারপর ব্যাগটা গুছিয়ে নিতে একবার সোফায় গিয়ে বসে। পাশে আবার এসে বসে রতন।

 
– আমাকে কেউ একজন বলেছিল তুমি তাপস বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেছ। পরে জেনেছি উনি তখন ঢাকায় ছিলেন না। তার এক বন্ধু বললেন, তার দিন পনের আগেই তার বাংলাদেশের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখনই ওয়াশিংটনে ফিরে গেছেন তিনি। আবার কোনও দিন এ দেশে ফিরবেন কি না ঠিক নেই। সেদিন তুমি যেমন শুধু নাজমার কাছে গেছ বলেছিলে সেটাই ঠিক। পথে তাপস বাবুর সঙ্গে দেখা করেছ বলে আমার যে ধারণা হয়েছিল এটা ঠিক না।
ওর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে হাতের ব্যাগটা গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুপ্রিয়া। রতন বলতেই থাকে,
– তাপসদা বোধ হয় সত্যি আমাদের ভালো বন্ধু ছিলেন। কিন্তু এভাবে কাউকে কোনও খবর না দিয়ে কিছু না বলে চলে গেলেন। তোমার হাতের দাগটা এখনও ভালো হয়নি। খুব অন্যায় হয়েছে রাগের মাথায় এভাবে মারধর করা।
বলে যাবে না কেন। তাপস যে চলে যাচ্ছে তা জানত সুপ্রিয়া। তার সব যন্ত্রণা আর কষ্টের সেই তো ছিল একমাত্র সমব্যথি। এর আগেও বেধড়ক মার খাওয়ার পর ওর গেস্ট হাউসে গিয়ে দেখা করেছিল সুপ্রিয়া। পিঠের কাপড় সরিয়ে দেখিয়েছিল লম্বা আড়াআড়ি দাগ। দেখে শিউরে উঠে ছিলেন তাপসদা, আগে প্রণাম করলে আশীর্বাদ করতেও মাথায় ছাড়া হাত দেননি তিনি, কিন্তু সেদিন দাগটায় নয়, তার পাশে পিঠে আলতো করে হাত দিয়ে বলেছিলেন :
– একি সুপ্রিয়া। এ কিসের দাগ?
সুপ্রিয়া জানে এমন হওয়া অন্যায়, কিন্তু তার ওইটুকু স্পর্শেই কেমন গা, হাত-পা শিরশির করেছিল ওর। কোনও রকমে বলেছিল,
– বেত তাপসদা, সুন্দর বনের বেত। তেল লাগানো পলিশ করা। কখন এনে আলমারির মাথায় রেখেছিল। লক্ষ্য করিনি। এখন ফেলে দিয়েছি। কিন্তু তাইতো নিষ্কৃতি নেই। কিছু না থাকলে হাত-পা চলবে, না হলে স্বামীত্বের অধিকারে এমন কিছু করবে যা কোথাও বলা যায় না।
– কিন্তু কেন?
-আমায় শাসন করার জন্য। রেগে যাওয়ার জন্য ওর বিশেষ কোনও কারণ লাগে না তাপসদা। আমি কারও সঙ্গে হেসে কথা বললেও রাগ হতে পারে, কেউ আমাকে বিশেষ খাতির করলেও হতে পারে। মাছের ঝোলে নুন কম হলেও হতে পারে।
– তাই বলে বেত এনে রাখবে! এতো পুরোপুরি প্ল্যান করা স্যাডিজম, সুপ্রিয়া। একটা মানসিক রোগ। তুমি কেন বিনা বাধায় সহ্য কর এসব? তুমি তো দুর্বল মানুষ নও। অফিসে চাকরিও তো কর একটা।
– বিনা বাধায় নয় তাপসদা, কিন্তু সেই সময় ওর গায়ে যেন অসুরের বল হয়। স্বামী যেমন হোক হিন্দুর ঘরে সে আজও মেয়েদের আশ্রয়, আমাদের সংস্কার, সেইখান থেকে মার এলে বাঁচি কি করে? আর কোথায় যাব তারওতো একটা যায়গা চাই। আপনি তো আমার বড় ভাইয়ের মতো তাপসদা, আমার এককালের মাস্টারমশাই। আপনার কাছে আমি একটু আশ্রয় পেতে পারি?
– তুমি আমার কাছে এসে থাকবে এতে আমার মানা করার কিছু নেই, রতনের সঙ্গে পরিচয়ের পর তোমরা দু’জনেই আমার কাছে আপনজন ছিলে সুপ্রিয়া। কিন্তু আজকে যা দেখলাম তাতে রতনের ওপর রাগ হচ্ছে খুবই। কিন্তু তুমি একলা এসে আমার কাছে থাকলে সামাজিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, আমি বিবাহিত মানুষ, এ দেশে জš§ হলেও এখন আমেরিকাই আমার স্বভূমি। বাংলাদেশে কাজে এসে অল্প দিনের অতিথি মাত্র। আর তুমি রক্তের সম্পর্কে আমার কেউ নও, অন্য কারও বিবাহিত স্ত্রী তার ওপর অপূর্ব সুন্দরী। আমার কাছে এসে তোমার থাকার কোনও সহজ মানে হবে না। জানি তোমার বাবা-মার তেমন সম্বল নেই, ভাইটাও দাঁড়ায়নি আজও। এভাবে কোন আÍীয়ের বাড়িওতো যাওয়া যায় না। একমাত্র যদি কোনও মেয়েদের হোস্টেলে থেকে চাকরি কর। শেষ আশ্রয় বোধ হয় সেটাই হতে পারে।
– না, শেশ আশ্রয় বোধ হয় মেঘনা নদী, সেটা তো আছে। কিন্তু গলায় কলসি বেঁধে যেতে হবে সেখানে। সাঁতার জানি যে!
– ছিঃ, এরকম কথা ভেবো না। সমস্যা থাকলে সমাধানও থাকবে। মেয়ে হিসেবে তোমার তো কোনও গুণগ্রাহির অভাব হওয়ার কথা নয়। যদি এমন কোনও মানুষ পাও যে তোমায় বিয়ে করতে রাজি তাহলে এ সম্পর্ক শেষ করতে দেরি করো না। তোমাদের সন্তানওতো হয়নি কোনও।
– হ্যাঁ সন্তান যে হয়নি সেও নাকি আমার দোষ অথচ আমার মেয়ে ডাক্তার ওকে কিছু টেস্ট করাতে বলেছে তা সে করাবে না।
-সবই বুঝলাম কিন্তু তোমার এ চুপচাপ সহ্য করাটা মাথায় ঢুকছে না। তুমি হাত-পা চালাওনা কেন? তোমার শরীরটা কি ওর থেকে ছোট?
– না, তা নয় তাপসদা। আমি কেমন যেন হয়ে যাই তখন, শেষ পর্যন্ত হেরে যাই, ময়াল সাপের মুখে পড়া হরিণের মতো। তখন আমাকে নিয়ে যা খুশি করে ও। তারপর এত খারাপ লাগে আমার। মনে হয় দূরে কোথাও পালিয়ে যাই এ অভিশাপ থেকে।
– এভাবে সহ্য করো না সুপ্রিয়া, বাধা দাও, জানবে তোমার নিজের সš§ান নিজের কাছেই আছে। আয়নার সামনে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ একবার। তুমি বলে যে মানুষটা সে কিন্তু অনেক ক্ষমতা রাখে। নিজেকে চিনতে শেখ।
তাপসদা চলে যাওয়ার আগেও আর একবার তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল সুপ্রিয়া। সেদিন বিকালে আকাশভাঙা বৃষ্টি নেমেছিল ঝমঝম করে। গুলশান লেকের ধারে ওনার চারতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন তাপসদা। ঘন কালো মেঘে আকাশ অন্ধকার। ভেতরে সব আলো নিভানো। মেঘের বুক চিরে বিদ্যুতের রেখা আকাশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে দৌড়চ্ছে তখন। মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছিল ওনার চুল।
– ভেতরে চলুন না তাপসদা।
– না এই বেশ ভালো, আমার এই রকম ঝড়-বাদল দেখতে খুব ভালো লাগে।
উনি তিনদিন পরেই চলে যাচ্ছেন তখনই জেনেছিল সে। কোন জগতে যেন ছিল তার মন। খুব করুণা ভরা চোখে ওর দিকে একবার দেখেছিলেন শুধু।
সুপ্রিয়ার তখন খুব কান্না পাচ্ছিল। ওকে একটা প্রণাম করে লিফটে নেমে এসেছিল সে। দাঁড়িয়েছিল নিচের লবিতে। বৃষ্টি থামলে রিকশা করে বাড়ি যায়। কিন্তু সেসব কথা রতনকে বলেনি সুপ্রিয়া। এখন তো বলার প্রশ্নই নেই।
ধীরে ধীরে ব্যাংকের গেটের দিকে এগোয় সুপ্রিয়া। তারপর ওখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে ফুটপাতে। আরও খানিকটা পেছনে পেছনে আসে রতন। সামনে কাবাব আর বিরিয়ানির দোকান থেকে বেশ একটা গন্ধও আসছে ওদের পেছন পেছন।
– শুনেছি তোমার একটা ছেলেও হয়েছে নতুন বিয়ের পর।

 
– হ্যাঁ হয়েছেই তো।
বেশ জোরের সঙ্গে বলে সুপ্রিয়া।
– কি নাম দিলে ছেলের?
আলাপের ছিন্ন সূত্রে গেঁরো বাঁধার চেষ্টা রতনের। সবৎসা গাভিনীতে মন ভরছে না, নাকি শিংয়ের গুঁতো খেয়েছে দু’চারটে?
– নাম দিয়েছি পল্লব, দিলওয়ার হোসেন পল্লব।
– তাপসদার ছেলের নামওতো পল্লব।
বলে রতন। এইবার ফুটপাতে ওর মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ায় সুপ্রিয়া, গলা তুলে জোর দিয়ে বলে :
– তো?
ওর যুদ্ধংদেহি ভাব দেখে ঘাবড়ায় রতন। কিন্তু তার উত্তরের অপেক্ষা করে না সুপ্রিয়, মুখ ফিরিয়ে নিজের পথে হাঁটা দেয় সে। বনের বাঘিনী যেমন জঙ্গলে হেঁটে যায়, অরণ্যের রানীর মতো।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!