
বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি, পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, ইরানের মিষ্টিভাষী কবি শেখ সাদির নাম এখনো মানুষের মুখে মুখে। এই কবি ইরানের ঐতিহাসিক শহর শিরাযে জন্মগ্রহণ করেন। কবিদের একটা কাজ হলো দেখা। সাগর, নদী, পাহাড়, মরু যেখানেই চোখ যায় সেখানেই দৃষ্টি মেলে ধরার একটা স্বভাব সব কবিরই থাকে। এ কারণে বড় বড় কবিরা অতিরিক্ত ভ্রমণ করেন। তবে, সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আর কবিদের দৃষ্টি এক রকম নয়। কবিরা যা দেখেন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেন। ঐ দৃষ্টির নাম ‘তৃতীয় দৃষ্টি’ বলা যায়। যে চোখ বা নয়ন দিয়ে কবিরা দেখেন তাকে বলা যায় ‘তৃতীয় নয়ন’।
কবিরা তৃতীয় নয়ন দিয়ে যা দেখেন সেসব সাধারণ মানুষকে বোঝানো মুশকিল। স্বয়ং কবি সাদির জীবনেই সেরকম একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আমরা সেই ঘটনাটিই প্রচার করেছি। তাহলে প্রথমেই শোনা যাক আজকের গল্প ‘তৃতীয় নয়নের বিপদ’।
কবি শেখ সাদি এক শহর থেকে আরেক শহরে ভ্রমণে যেতেন। তবে সবসময় বেড়াতে যেতেন ঘোড়ায় বা অন্য কোনো বাহনে চড়ে। অনেক দূর দূরান্তে যেতে হলে তো আর হেঁটে যাওয়া যায় না! সেজন্যেই বাহনের দরকার ছিল। কিন্তু একদিন একটু ব্যতিক্রম হলো। সাদি নিজেই ভাবলেন- সবসময় তো বাহনেই যাই আজ একটু পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াব। যেই ভাবা সেই কাজ। হাঁটতে শুরু করলেন কবি সাদি।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল একটা প্রাণীর পায়ের ছাপ। তিনি মাটিতে বসে খুব ভালো করে পায়ের ছাপটি ভালোভাবে দেখে নিশ্চিত হলেন-উটের পায়ের ছাপ। বসে থেকেই সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন চার পায়ের ছাপ চলে গেছে অনেকদূর। মনে মনে ভাবলেন একটি উট তাহলে তাঁর আগে এ রাস্তা ধরে সামনের দিকে গেছে। সাদি উঠে দাঁড়িয়ে উটের পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে লাগলেন।
কিছুদূর যাবার পর দেখলেন রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠা তরতাজা ঘাস অর্ধেক খাওয়া। বাঁ পাশের ঘাসগুলোই খাওয়া হয়েছে, ডান পাশের ঘাসগুলোতে মুখই দেয়নি। সাদি ঘাসের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে কী সব ভাবলেন। তারপর ঘাসের পাশে বসে উটের পায়ের ছাপ খুঁজলেন এবং দেখলেন পায়ের ছাপ সামান্য এলোমেলো হয়ে আবারো সামনের দিকে চলে গেছে ছন্দময় চালে।
সাদি আবার ঘাসের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন: উটটি নিশ্চয়ই কানা। ডান চোখ কানা। কেননা বাঁ চোখ দিয়ে যতোটুকু ঘাস সে দেখতে পেয়েছে সেটুকু ভালোভাবে খেয়েছে। কিন্তু ডান চোখ দিয়ে যেহেতু দেখতে পায়নি, তাই ওপাশের ঘাসগুলো তরতাজা রয়ে গেছে। সেগুলোতে মুখই লাগায়নি কানা উট। সাদি আনমনে হাঁসলেন-উট আবার কানা।
কবিদের এরকম বিচিত্র চিন্তা থাকে, দৃষ্টি থাকে, যা সাধারণ মানুষের থাকে না। এ কারণে সাধারণ মানুষ কবিদেরকে অনেক সময় পাগল বলে অভিহিত করে। যদিও প্রকৃত সত্য হলো কবিদের দৃষ্টি যতদূর যায়, যত সম্প্রসারিত হয় অন্যদের তেমনটা হয় না।
এই দূরদৃষ্টির কারণেই কবিরা যা আজ দেখেন বা ভাবেন অন্যরা তা দেখে বা ভাবে বহু যুগ কিংবা বহুকাল পর। ঘাসের তরতাজা সবুজ পেছনে ফেলে কবি সাদি এগিয়ে যান সামনের দিকে। উটের রচিত পায়ের ছন্দ দেখতে দেখতে কবির নজরে পড়ে যায় আবার নতুন একটি রেখা। দেখতে ছায়ার মতো। এ আবার কীসের রেখা! কবিকে ভাবিয়ে তোলে। ভাবতে ভাবতে রেখা ধরে সামনে যেতে যেতে হঠাৎ তিনি দেখলেন এক গুচ্ছ মাছি ঐ রেখার ওপর বসে আছে।
কবি একটু নীচু হয়ে দেখতেই মাছিগুলো উড়ে গিয়ে একটু দূরে সেই রেখার ওপরই বসে পড়ে। কবি খুব ভালোভাবে চিন্তা করতে লাগলেন আর ছায়ার মতো রেখাটির সামনে পেছনে তাকাতে লাগলেন। মাছি বসতে দেখে কবি ভাবলেন এই রেখা সিক্ত মানে ভেজা রেখা। রেখাটি নিশ্চয়ই দুধের, সেজন্যেই মাছি বসেছে। কবি আবারো হাসলেন। আহা রে, অ্যাকে তো কানা উট, তার উপরে দুধের পাত্রটাও ফুটো।
সবই কবির ভাবনা, সুচিন্তিত কল্পনা। বাস্তবতা যে কী সেটা কে জানে! কবি এগিয়ে যান ছন্দময় চতুষ্পদী চিহ্ন দেখে দেখে। এবার একটু এগুতেই দেখেন পায়ের ছাপ পাশে বড় একটা গর্তের মতো। মহিলার জুতোর ছাপও তার পাশে দেখা গেল। কবি মনে মনে বললেন তার মানে উট এখানে শুয়ে বিশ্রাম নিয়েছে। উটের পিঠে ছিল এক মহিলা সওয়ারি। সেও উটের পিঠ থেকে এখানে নেমেছে।
সাদি আবারো সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন চারটি পায়ের ছাপ চলে গেছে আগের মতোই। কবি ভাবলেন- উট সওয়ারি মহিলা একটু বিশ্রাম নিয়ে আবারো রওনা হয়ে গেছে।
কবি ভাবলেন একটু দ্রুত এগিয়ে গেলে হয়তো দেখা হয়েও যেতে পারে। তাহলে নিজের ভাবনাগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল আছে কিনা মিলিয়ে নেওয়া যেত। কবি তাই আবারো পা বাড়ালেন। এবার আগের চেয়ে একটু দ্রুত গতিতে।
একটু এগুতেই দেখলেন হন্যে হয়ে একটা লোক এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। তার চেহারায় পেরেশানির সুস্পষ্ট ছাপ। সাদি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কী হয়েছে? আপনাকে এরকম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন? লোকটি বলল: আমার উট পালিয়ে গেছে। তুমি এদিক দিয়ে যেতে দেখনি?
সাদি জানতে চাইলেনঃ আচ্ছা তোমার উটের কি ডান চোখ কানা? লোকটি জবাব দেয়ঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার উটের ডান চোখ কানা। সাদি জানতে চাইলেনঃ উটের পিঠে কি দুধ ভর্তি একটা পাত্র ছিল? লোকটি জবাব দেয়ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ! দুধের পাত্রটা ভর্তি ছিল।
সাদি বলেনঃ আমি অবশ্য তোমার উটটাকে দেখিনি… লোকটি বলল: দেখনি? যদি না-ই দেখে থাক..তাহলে এইসব আলামত কীভাবে দেখলে! তুমি আমার উট চুরি করে লুকিয়ে রেখেছো.. সাদি বললেনঃ এটা কী ধরনের কথা বলছো? তোমার উট কি একটা ইঁদুরের মতো যে আমি এই জনমানবহীন মরুতে তাকে লুকিয়ে রাখবো? আমি কিছু কিছু আলামত দেখতে পেয়েছি, যা থেকে চিন্তা করেছি এ ধরনের একটা উট এ পথ দিয়ে গেছে..।
লোকটা কোনো কথা না বলে তার হাতের লাঠি দিয়ে সাদিকে মারতে শুরু করে দিল। মার খেতে খেতে সাদি চেষ্টা করেছিল লোকটাকে বোঝাতে যে তিনি নির্দোষ। মারের ফাঁকে লোকটার নজর পড়ে গেল সামনের দিকে। সে দেখতে পেল- একটা উট খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে।
মার বন্ধ করে লোকটা দ্রুত দৌড়ে গেল উটের দিকে। লোকটি চলে গেলে সাদি আপনমনে স্বগতোক্তি করলেনঃ হে কবি! তৃতীয় নয়নের অধিকারী দূরদর্শী কবি! এতো বিচক্ষণ চিন্তা কর, কিন্তু কেন তৃতীয় নয়নে দেখা ছবি দেখাতে গেলে চক্ষুহীনকে! কেন, এ কাজ করলে আজ তুমি! কেন তুমি যে উট দেখনি, তার বর্ণনা দিতে গেলে! তোমার কি ভাবা উচিত ছিল না, সবকিছু জানলেও না বলাই ভালো, সব বলতে হয় না। তোমার কি উচিত ছিল না, আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করাঃ ‘উট দেখেছো, দেখনি’।
এই ঘটনার পর থেকে ‘উট দেখেছো, দেখনি’ এটি একটি প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়ে গেল। আর প্রবাদটি বলার সময় একজন আরেকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করে, যা কিছু জানো, সব মুখে না আনাই ভালো। উটকো ঝামেলায় না জড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে হ্যাঁ, আছড়ে না পড়ায় বিজয় নেই, পড়ার পর উঠে দাঁড়ানোর মাঝেই বিজয়।