গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
তখন তিনি বুঝলেন যে, বিশ্বাসী তোতাপাখিটাকে শুধু শুধুই মেরে ফেলেছেন। দুঃখে অনুশোচনায় কেঁদে ফেললেন তিনি কিছু করার আর কিছু নেই তখন। কারুর জীবন নিয়ে নেবার ক্ষমতা আছে রাজা-বাদশাহের কিন্তু ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা তো নেই ”
বড় ভাইয়ের বলা শেষ হল। খান চুপ করে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছেন। তারপর তিনি ইঙ্গিতে মেজ ভাইকে বলতে আদেশ দিলেন। সে বলল :
শাহানশাহ, আমিও আপনাকে একটি কাহিনী শোনাব । এটিও বহুদিন আগের ঘটনা, ঘটে অন্য দেশে, অন্য বাদশাহের জীবনে । ঐ বাদশাহ্ ছেলেবেলা থেকেই শিকার ভালবাসতেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তেজীঘোড়ায় চেপে তিনি স্তেপে বিভিন্ন বন্য জন্তু, পাখির পিছনে ধাওয়া করে বেড়াতেন । বাদশাহের ছিল চমৎকার একটা শিকারী ঈগলপাখি যেমনটি আর কোন শিকারীর ছিল না। পাখিটা তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল ।
একদিন বাদশাহ্ একটা সাইগার (মোটাতাজা প্রাণী) পিছনে ধাওয়া করতে করতে এসে উপস্থিত হলেন প্রাণহীন এক মরুভূমিতে । সূর্যের নির্মম উত্তাপ, একফোটা জলও নেই, বাদশাহের এদিকে তেষ্টায় বুক ফাটছে । হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন একটা পাহাড়ের গা বেয়ে সরু একটা জলের ধারা নেমে আসছে। বাদশাহ সোনার পেয়ালা বার করে, তাতে সেই জল নিয়ে খেতে যাবেন এমন সময় ঈগলটা হঠাৎ পেয়ালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সবটা জল ফেলে দিল ।
বাদশাহ প্রচণ্ড রেগে গেলেন, চীৎকার করে উঠলেন ঈগলটার প্রতি, তারপর আবার একটু জল ধরলেন। কিন্তু পাখিটা আবার উড়ে এসে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পেয়ালাটার ওপর, বাদশাহের হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল পেয়ালাটা । প্রচণ্ড রাগে বাদশাহ্ শূন্য পেয়ালাটা তুলে নিয়ে সেটা দিয়ে আঘাত করলেন পাখিটার মাথায়। পাখিটা মরে পড়ে গেল। তারপর তিনি আবার জলধারাটায় কাছে গেলেন—আর ভয়ে জমে গেলেন: পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসছে বিরাট এক সাপ। জল নয়, প্রাণঘাতী বিষ বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গা বেয়ে! লাফিয়ে ঘোড়ায় উঠে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন বাদশাহ্। কিন্তু সেদিন থেকে তিনি বুঝলেন, তাড়াহুড়ো না করে সতর্ক হওয়াই ভাল, বাদশাহ্ বলেই যে তিনি সর্বনাশা ভুলের হাত থেকে রেহাই পেলাম তা নয় । আর ভাল মন্দের তফাৎ করতে পারেন কেবল পণ্ডিতেই, শক্তিশালী ব্যক্তি নয়।’
হয়েছে! চুপ কর! হুঙ্কার দিয়ে খান উঠে দাঁড়ালেন । তোমরা দু’জনেই ভাইয়ের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেছ, এখন বদমাশটার ঘাড় থেকে সব দোষ নামিয়ে ওকে নিয়ে পালাতে চাও। তোমাদের কথা অনুযায়ী এই দাঁড়াচ্ছে যে, ওর কোন দোষ নেই আর আমি অন্যায়, অবিচার করছি ওর প্রতি । তাই যদি হবে তাহলে ও তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল কেন আমার কাছে?
ভাইয়েরা বলল, তা আমরা জানি না’, ওকেই জিজ্ঞেস করুন।’
‘বন্দীকে নিয়ে এস!’ চীৎকার করে খান প্রহরীকে আদেশ দিলেন। ছোট ভাই এসে খান আর উজীরদের সামনে দাঁড়াল । তার চোখের দিকে তাকিয়ে খান জিজ্ঞেস করলেন :
সত্যি করে বল, কোনরকম ধূর্তমিই তোকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না জানবি,– কি উদ্দেশ্যে তুই কাল রাতে তলোয়ার হাতে নিয়ে আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলি?’
আপনাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য হুজুর, ধীরভাবে বলল ছোট ভাই।
‘তুই ছাড়া আর কে আমার মৃত্যু ঘটাতে পারত?’
‘যে সাপটা আপনাকে ছোবল মারতে এসেছিল, যেটাকে আমি তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলেছি, সেটা। ‘
‘সাপ? কি যা-তা বলছিস! আমার শয়নকক্ষে সাপ আসবে কোথা থেকে?’ অবাক হলেন খান ।
আপনার বহু অভিজ্ঞ উজীয়রা, যাদের ওপর আপনার অগাধ বিশ্বাস, তারাই এ প্রশ্নের উত্তর ভাল দিতে পারবে ।’
খান নিজের শয়নকক্ষে গিয়ে ঢুকলেন, তারপর খানিক বাদে বেরিয়ে এলেন ধীর পায়ে, মাথা নীচু করে । জলভরা চোখে ভাইদের মধ্যে ছোটজনের কাছে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে আবেগপূর্ণ কষ্ঠে বললেন:
তুমি আমার বিশ্বস্ত বন্ধু, জীবনরক্ষাকারী, ক্ষমা কর আমায়! তোমাকে এমন কষ্ট দেবার বিনিময়ে তুমি যা চাও তাই দেব তোমায়, সবার সামনে শপথ করে বলছি, যে তুমি আর তোমার ভাইয়েরা যা চাও তাই পাবে।’
তরুণটি তখন বলল : “আমাদের তিনজনকে ছেড়ে দিন, শাহানশাহ, আপনার কাজ থেকে আমাদের মুক্তি দিন ; আমাদের আবার ভ্রমণে বেরোবার অনুমতি দিন। আমাদের পথ এখনও শেষ হয় নি, সব থেকে বড় জ্ঞানভাণ্ডার জীবনের বইটা আধখানাও পড়া হয় নি আমাদের।
এমন প্রার্থনা আশা করেন নি বাদশাহ । আবার প্রচণ্ড রাপে মুখচোখ লাল হয়ে গেল তার । কিন্তু যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তা রাখতেই হবে।
আবার পথে রওনা দিল তিন ভাই ।