তিন বৃদ্ধের গল্প–খোকন রেজা

[আমি তখন নটরডেম কলেজের ছাত্র। দেশের সেরা কলেজগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে খ্যাত। দেশের সেরা সেরা ছাত্রদের মাঝে নিজেকে কখনো কখনো ভীষণ অসহায় মনে হতো। ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম এই সেরা ছাত্রগুলোর সিংহভাগই আমারই মতন অতি সাধারন আর লুকিয়ে লুকিয়ে ওরা আমারই মত ‘মাসুদ রানা’ আর ‘রিডার্স ডাইজেষ্ট’ পড়ে আর কলেজ ক্যান্টিনে বসে ক্যাপস্টেন বা ষ্টার সিগারেট ফুঁকে। দিব্যি করে বলতে পারি চেক করা হলে প্রায় সবারই কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে এগুলোর মধ্যে অন্ততঃ দুটা হয়তো পাওয়া যেতোই। পরবর্তীতে বাংলা ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ অবশ্য রিডার্স ডাইজেষ্টের প্রচার সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল।
তখনকার রিডার্স ডাইজেষ্টে (সম্ভবতঃ হংকং থেকে ছাপা হতো)পড়া কয়েকটি ঘটনা বা গল্প আজও স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। স্মৃতিপট থেকে নেয়া কিছু গল্প এগুলো…]
ভদ্রমহিলা ঘরের দরজা খুলেই দেখতে পেলেন ৩জন বৃদ্ধ লোক বসে আছেন দুয়ারের উঠোনের একপাশে পেতে রাখা একটি টুলে। তাদের ক্ষূধার্ত মনে হওয়ায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন তারা কিছু খাবেন কিনা, এবং খাওয়ার জন্য তিনি বৃদ্ধদের ঘরের ভেতর আমন্ত্রন জানালেন যদিও তিনি তাদের কাউকেই চেনেন না। তারা জিজ্ঞেস করলেন গৃহকর্তা বাসায় আছেন কিনা। ভদ্রমহিলা জানালেন গৃহকর্তা কর্মক্ষেত্রে এবং তার ফিরতে অনেক দেরি হবে। গৃহকর্তা না ফেরা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবেন এবং তিনি ফিরলে একসাথে বসে খাবেন বলে তারা জানালেন…
গোধুলি বিকেলে স্বামী বাসায় ফিরলে প্রিয়তমা স্ত্রী সব খুলে বলায় তিনি বৃদ্ধদের ঘরে এনে আপ্যায়িত করতে স্ত্রীকে অনুরোধ জানালেন।
ভদ্রমহিলা বৃদ্ধদের ভেতরে সাদর আমন্ত্রন জানালেন। বৃদ্ধরা জানালেন তারা একসাথে ভেতরে যাবেন না। ভদ্রমহিলা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন..’কেন?’
বৃদ্ধদের একজন অপর দুই বৃদ্ধের দিকে ইশারা করে বললেন: ‘এর নাম হলো সম্পদ, ওর নাম হলো সাফল্য আর আমি হলাম ভালবাসা, এখন তুমি ভেতরে যাও আর তোমার স্বামীর সাথে পরামর্শ করে আমাদের জানাও কাকে তোমরা ঘরের ভেতর চাও?’…
আনন্দে আত্মহারা স্বামী স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমি সম্পদকে ভেতরে নিয়ে আসো, বিত্ত বৈভবে ভরে উঠবে আমাদের সংসার’। স্ত্রী দ্বিমত পোষন করে বললো, ‘আমরা বরং সাফল্যকে ডাকি, সাফল্যইতো জীবনের লক্ষ্য’…
রান্নাঘরে ব্যস্ত সুশিক্ষিতা,কর্মঠ,বিনয়ী ও বুদ্ধমতি পুত্রবধু কর্মরত অবস্হায় অনেকটা উচ্চস্বরেই বললো, ‘বাবা মা, তোমরা বরং ভালাবাসাকেই ডাকো, ভালবাসায় ভরে উঠুক আমাদের সোনার সংসার’- সবার মন জয় করা, বিচক্ষণা পু্ত্রবধুর কথা স্বামী স্ত্রী কেউই ফেলতে পারলেন না।
দ্বার খুলে ভদ্রমহিলা ভালবাসাকে ভেতরে আসার আমন্ত্রন জানালেন। ভালবাসা উঠে দাঁড়ালেন, সঙ্গে সঙ্গে সম্পদ আর সাফল্যও উঠে দাঁড়ালেন। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি শুধু ভালবাসাকে ডাকছি, আপনারা দুজনও যে আসছেন?’..
বৃদ্ধত্রয় সমস্বরে বলে উঠলেন,’তুমি যদি সাফল্য বা সম্পদকে ডাকতে তাহলে আমরা বাকি দুজন বাইরেই বসে থাকতাম, কিন্তু ভালবাসাকে ডাকলে বলে আমরা সবাই তাকে অনুসরন করছি, যেখানেই ভালবাসা সেখানে সাফল্য আর সম্পদ থাকবেই’…
ভালবাসা জীবনকে পরিপুর্ন করে, ভালবাসা হৃদয়ের অস্তিত্বকে বলে দেয় জীবন ভালবাসার জন্যই। জীবনের গ্লানিভরা আর যন্ত্রণাভরা অনুশোচনায় ভুগতে না হলে …এসো ভালবাসি…ভালবাসাই জীবনের একমাত্র প্রমিত, মহিমান্বিত চালিকাশক্তি

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!