তিন ডাকাবুকো বন্ধু-দ্বিতীয় কাণ্ড- সাপুড়ে

সন্তু, রন্তু ও অন্তু এখন ক্লাস সেভেনে পড়ছে। গত বছর ওই ছেলেধরা গুণ্ডাটাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য থানার ইন-চার্য নিবারণ দত্ত ওদের সাহসের খুব প্রশংসা করে সরকার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিশেষ পুরস্কারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন – সেই টাকা দিয়ে ওদের বাড়ি থেকে তিনটে সাইকেল কিনে দিয়েছে। এখন ওরা সাইকেল নিয়ে বাই বাই করে চার দিকে ঘুরে বেড়ায়। ওদের বাড়ি থেকে পৈ পৈ করে বারণ করে দিয়েছে ওই পড়ো বাড়ির দিকে যেন একেবারেই না যায় – সাপের ভয়ে ওরাও অবশ্য ওই বাড়ির আশে পাশে ঘেঁসে না। গরমের ছুটির অলস দুপুরে ওরা ঝিলের ধারে বসে ব্যাঙ বাজি খেলতে খেলতে গল্প করছিলো হঠাৎ নজরে এলো ওই পড়ো বাড়ির কাছে ঝিলের জলে কী একটা বড় ধরনের প্রাণী জলের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ভালো করে দেখে রন্তু চেঁচিয়ে উঠলো,
‘আরে, আরে, এটা তো ওই সাপটা – ব্যাটা মাছ, ব্যাঙ এ সব খেতে জলে নেমেছে। এদিকে ঘুরলেই তো চিত্তির। বাপরে, গত বছর যা দেখেছি – ’
বলেই রন্তু ভয়ে একটু শিউরে উঠলো – গত বছর ওটার মুখোমুখি হওয়ার সেই দৃশ্য ওর মনে এখনো জ্বল জ্বল করছে। ওর কথা শুনে অন্তুর গায়েও কাঁটা দিলো,
‘ওই দানবের একেবারে ফনার সামনে – আমি জীবনেও ভুলবো না, বাপরে।’

সন্তু সাপটাকে আগে দেখে নি তাই দূর থেকে জলের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এখান থেকে তো মনে হচ্ছে ফুট দশেক লম্বা হবে আর বেশ মোটা সোটা – তোরা অবশ্য একেবারে সামনে থেকে দেখেছিলি – ভগবানের দোহাই, তোরা খুব বেঁচে গিয়েছিস। আমার জন্য তোরা যমের দরজা থেকে ফিরে এসেছিস। ওই লোকটার উপর আমার এখনও ভীষণ রাগ আছে – আমার নাকের সামনে একটা রুমাল একটু নাড়তে আমি যেন কেমন হয়ে গিয়ে – ওর হাত ধরে পবাতে চলে এলাম। বেশ খানিকটা পর বুঝতে পারলাম ব্যাটা আমাকে আটকে বাড়িতে মুক্তিপণ আদায় করার ধান্দায় আছে। যাকগে, সব কিছু ভালোয় ভালোয় হয়ে গিয়েছে না হলে হয়তো আমরা তিন জনই এই পৃথিবীতে থাকতাম না।’

রন্তু ও অন্তু ওর কথা চুপ করে শুনছিলো হঠাৎ অন্তু লাফিয়ে উঠলো,
‘দ্যাখ, দ্যাখ, ঝিলের পাড় দিয়ে আর একটা সাপ মনে হচ্ছে এদিকে আসছে – এটা আবার কোথা থেকে এলো? একটা তো জলে – তবে এটা কি ওটার সঙ্গী?’
বলতেই সন্তু ও রন্তু তাকিয়ে দেখে ওই রকম চেহারার আর একটা সাপ শ খানেক ফুট দূরে ঝিলের পাড় দিয়ে খুব দ্রুত এদিকে আসছে – দেখেই সন্তু বললো,
‘গতিক সুবিধার নয় রে – ওটা নিশ্চয়ই দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়েছে তাই তাড়া করে আসছে। যে ভাবে আসছে তাতে মনে হয় দৌড়ে ওর সাথে পাত্তা পাওয়া যাবে না – তাড়াতাড়ি সাইকেলে উঠে পালাই না হলে আর রক্ষে নেই।’

ওরা দৌড়ে গাছ তলায় রাখা সাইকেলে উঠবার সময় দেখে সাপটা ঠিক বুঝতে পেরেছে তাই ঝিলের পাড় ছেড়ে মাঠে নেমে এসেছে – ওদের থেকে পঞ্চাশ / ষাট ফুট দূরেই হবে। এখন ওরা বুঝতে পারলো সাপটা এঁকে বেঁকে কী জোরে চলেছে। আর কোন দিকে না তাকিয়ে প্রাণের ভয়ে সাইকেলের প্যাডেল গায়ের জোরে ঘুরিয়ে তিনজন দৌড়ালো বাড়ির দিকে – যতবারই পেছনে তাকায় দেখে সাপটা ওদের তাড়া করেই চলেছে। মিনিট দশেক পর প্রায় আধ মাইলের উপর তাড়া করে তবেই সাপটা ফিরে গেলো আর ওরাও মাঠের শেষে সাইকেল থেকে নেমে দেখলো সাপটা ধীরে ধীরে পবার দিকে ফিরে যাচ্ছে। তিন জনই দর দর করে ঘামছে – রন্তু কপালের ঘাম মুছে বললো,
‘বাপরে বাপ, কী তাড়াটাই করলো – একে বারে দম ছুটিয়ে দিয়েছে। সাপ যে এত জোরে চলে এই প্রথম দেখলাম। মনে হয় ও ব্যাটারও দম ফুরিয়েছে না হলে কী হতো খোদা জানে – আমরা সাইকেল নিয়ে কোথায় ঘুরতাম বল্‌?’

ওরা ফিরে রন্তুদের রোয়াকে এসে বসলো – তিন জনই একেবারে চুপ – সাপের এভাবে তাড়া খাওয়ার ভয়টা এখনও পুরো কাটিয়ে উঠতে পারে নি। বেশ খানিক ক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্তু ধীরে ধীরে মুখ খুললো,
‘আগের বার তার মানে ওখানে এই দুটো সাপই ছিলো – একটা পেছনের জঙ্গল থেকে বেরোয় নি – ওটা বেরোলে কী হতো ভাবতেও ভয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। নাঃ, এদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে না হলে আমাদের এত সুন্দর গল্প করার জায়গায় আর যাওয়া যাবে না তাছাড়া ওই খেজুরের রস তোলার বন্ধুদের যে কোন সময় মহা বিপদ হতে পারে। কি করা যায় বলতো?’

রন্তু একটু সময় ভেবে বললো,
‘ওই দুটোকে যেভাবে হোক ধরতে হবে কারণ এরা তো সাধারণ সাপ নয় আর যেখানে সেখানে পাওয়াও যায় না তাই মেরে ফেলাটা ঠিক উচিত হবে না। আচ্ছা, কোলকাতার চিড়িয়াখানাতে খবর দিলে ওরা এসে ধরতে পারবে না?’

অন্তু একটু হাসলো,
‘ওখানে খবর দেওয়াটা মানে কোলকাতাতে যেতে হবে তাও আমাদের কথায় কতোটা পাত্তা দেবে কে জানে। আচ্ছা, একবার ওই গ্রামে খবর নিলে হয় না কোন ভালো সাপুড়ে ওখানে আছে কিনা যে এত বড় আর হিংস্র এই সাপ দুটোকে ধরতে পারে? মাঝে মাঝেই তো ওদিক থেকে সাপুড়ে আসে এখানে সাপের খেলা দেখাতে।’

তখন ঠিক হলো আরো দু এক দিন দেখা যাক কোন সাপুড়ে এদিকে আসে কিনা – তারপর না হয় সাইকেল নিয়ে সাবধানে ওই গ্রামে যাবে সাপুড়ের খোঁজে।

 

দিন দুয়েক পর এক দুপুরে রন্তুদের রোওয়াকে বসে ওরা লুডো খেলছিলো হঠাৎ বড় রাস্তার দিক থেকে সাপুড়ের বিনের আওয়াজ ভেসে আসতেই অন্তু লাফিয়ে উঠলো,
‘ওই তো সাপুড়ের বাঁশির আওয়াজ – চল্‌, চল্‌, ওকে জিজ্ঞেস করা যাক সাপ দুটোকে ধরতে পারবে কি না?’

ওরা দৌড়ে বড় রাস্তায় এসে দেখে একটা বছর বাইশের ছেলে কাঁধের বাঁকের দুদিকে গোটা তিনেক করে সাপের ছোট ছোট ঢাকনা দেওয়া ঝুড়ি ঝুলিয়ে বিনটা বাজাতে বাজাতে চলেছে। সন্তু ওকে ডাকলো,
‘ও সাপুড়ে ভাই, একটু শোন।’
ছেলেটা ওদের কাছে এলে রন্তু জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি সাপ ধরতে পারো?’
ছেলেটা হাসলো,
‘সাপ ধরা আর সাপ খেলানোই তো আমাদের কাজ। এক একটা সাপ ধরার জন্য কিন্তু পাঁচ টাকা করে লাগবে। তা সাপটা কোথায় লুকিয়ে আছে?’
অন্তু গম্ভীর গলায় বললো,
‘এটা কিন্তু আজে বাজে সাপ নয় একেবারে কাল কেউটে – যেমন লম্বা তেমনি স্বাস্থ্যবান চেহারা।’
এবার ছেলেটার ভুরু একটু কুঁচকে গেলো,
‘তোমরা কোথায় একে দেখেছো? কতটা লম্বা?’
অন্তু উত্তর দেবার আগেই সন্তু বললো,
‘একটা পুরাতন বাড়িতে – ওখানে কেউ থাকে না। আর লম্বাতে প্রায় দশ ফুট খানেক তো হবেই – কী বলিস অন্তু?’
অন্তু ও রন্তু মাথা নাড়লো,
‘ফণাটাই মাটি থেকে প্রায় ফুট দুয়েক উঁচুতে উঠেছিলো। তবে সাপ কিন্তু দুটো।’

শুনে ছেলেটা চিন্তিত মুখে বললো,
‘না ভাই – এত বড় সাপ তো আমি ধরতে পারবো না – একটা ছোবল খেলেই চোখ উল্টে যাবে। বরং আমার গুরুজীকে খবর দেবো – উনিই পারবেন এই সাপ ধরতে। ঠিক আছে, দু এক দিনের মধ্যেই গুরুজীকে নিয়ে আসবো সাপ দুটো ধরার জন্য।’

দু দিন পর দুপুরে ওরা রোয়াকে এসে বসার প্রায় সাথে সাথেই আবার সাপুড়ের বিনের আওয়াজ ভেসে এলো বড় রাস্তা থেকে। ওরা দৌড়ে বড় রাস্তায় এসে দেখে ওদের পাড়ার মোড়ে ছেলেটা বিন বাজাচ্ছে – সাথে একটা বুড়ো মত মুখে কাঁচা পাকা দাড়িওয়ালা আর মাথায় মস্তো বড় পাগড়ি বাঁধা লোক দাঁড়িয়ে – ওর হাতে একটা ফুট ছয়েক লম্বা লাঠি যার মাথাতে মোটা লোহার তার দিয়ে ইংরেজী ‘Y’ এর মত লাগানো। ছেলেটার কাঁধের বাঁকে আজ সাপের ঝুড়ির বদলে তিনটে বড় বেতের ঝুড়ি আর গোটা তিনেক মোটা চটের বস্তা। ওর হাতেও বাঁকানো লোহার হুক লাগানো লম্বা একটা লাঠি। সন্তুদের দেখে ছেলেটা গুরুজীকে বললো,
‘গুরুজী, এরাই সেই কাল কেউটের কথা বলছিলো।’

ওদের দেখে গুরুজীর ভুরু কুঁচকে গেলো – বাচ্চাগুলো সাপের আষাঢ়ে গল্প বলে নি তো? কী দেখতে কী দেখেছে? তাই একটু টেরচা সুরে বললো,
‘তোমরা কী ভাবে দেখলে? কোথায়? গায়ের রং কী?’

রন্তু জবাব দিলো,
‘আমি আর অন্তু একটার প্রায় মুখোমুখি হয়েছিলাম – আমাদের প্রায় বুকের সমান ফণা তুলেছিলো আর আমাদের হাতের দুই বিঘতের মত চওড়া সেই ফণা, কালো রঙের আর পিঠে কেমন ক্রসের মতো দাগ – দেখেই আমরা তো একেবারে স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন আগে অন্যটা আমাদের তিন জনকে তাড়া করেছিলো – ভাগ্যিস সাইকেল নিয়ে পালিয়েছিলাম না হলে দৌড়ে পাত্তা পেতাম না – তাও প্রায় আধ মাইলের উপর আমাদের তাড়া করে এসেছে।’

বুড়ো দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললো,
‘তার মানে কাল কেউটে না হয়ে যায় না। খোদার অনেক দোয়া তোমরা জানে বেঁচে গিয়েছো। একটু নড়লেই ওটা ছোবল দিতো আর ওর বিষে হাতি পর্যন্ত উল্টে যায় – মানুষ তো কোন ছার। এত বড় সাপ ধরা খুব বিপজ্জনক কাজ তাও আবার জোড়া সাপ – তোমরা যেও না – ভীষণ বিপদ হতে পারে।’

সন্তু জোর দিয়ে বললো,
‘আমরা দূর থেকেই না হয় দেখবো – তবে আমাদের যেতেই হবে।’

ওর কথার জোর শুনে বুড়ো সাপুড়ে আস্তে করে বললো,
‘ঠিক আছে দাদাবাবুরা চলো তাহলে।’

সন্তুরা সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে সাপুড়েদের সাথে হেঁটেই চললো ঝিলের ধারের ‘পবার’ দিকে। হাঁটতে হাঁটতে গুরুজী ছেলেটাকে বললো,
‘এরা সাধারণতঃ জোড়াতেই থাকে – ওখানে ওদের বাচ্চা কাচ্চারাও থাকতে পারে। তবে এক সাথে দুটো বেরিয়ে এলে ওদের সামলানো ভীষণ মুস্কিল হবে – প্রচণ্ড বিপদ হতে পারে আর সেটাই আমাকে চিন্তায় ফেলেছে। তোকে খুব সাবধানে আমার সাথে তাল দিয়ে কাজ করতে হবে – আমার কথার একদম নড়চড় করবি না।’

তারপর অন্তুদের দিকে ফিরে বললো,
‘এই রকম বড় কাল কেউটে থাকলে আশে পাশে অন্য কোন সাপ, ইঁদুর, ছুঁচো, ইত্যাদি কিছুই থাকবে না কারণ কাল কেউটে সব খেয়ে নেয়। এরা ১৭ / ১৮ ফুট অবধি লম্বা হতে পারে আর সাধারণতঃ খুব নিরিবিলি জায়গাতেই থাকে আর বাঁচেও অনেক দিন – প্রায় উনিশ কুড়ি বছর। লোক দেখলে এমনিতে আক্রমণ করে না তবে এরা রগচটা ধরনের আর রেগে গেলে ভীষণ সাংঘাতিক আর হিংস্র হয়ে ওঠে – এমন তাড়া করবে যে দৌড়ে ওদের কাছে পাত্তা পাবে না। মনে হয় তোমরা ঝিলের ধারে লাফালাফি করছিলে বলেই হয়তো রেগে ওভাবে তাড়া করেছিলো – সাইকেল ছিলো বলে তিন জনেই বেঁচে গিয়েছো। জন্তু জানোয়ার বা মানুষের হাঁটাতে মাটিতে যে কাঁপুনি হয় সেটা থেকেই ওরা বুঝতে পারে কোথায় আর কতটা দূরে। এদের চোখের দৃষ্টিও ভীষণ তীক্ষ্ণ – অনেক দূর অবধি দেখতে পায়। সেই জন্যই বলছি তোমরা দাদাভাইরা দূরে থাকবে। কী হতে কি হয় বলা তো যায় না।’

সন্তু জিজ্ঞেস করলো,
‘আচ্ছা গুরুজী, এই সব সাপ ধরে তোমরা কী করো? মেরে ফেলো না কি?’

গুরুজী লম্বা জিভ কেটে বললো,
‘ও কথা বলো না দাদাভাই – গুণাহ হবে। এরাই তো আমাদের জীবন – আমাদের পেটের ভাত দিচ্ছে। বড় শহরে সাপের বিষ কেনার অফিস আছে – মাঝে মাঝে পুষ্যিদের নিয়ে ওখানে বিষ বিক্রি করে আসি। ঐ বিষ থেকে ওরা সাপের কামড়ের ওষুধ বানায়। বিষাক্ত সাপও বিক্রি করি ওদের কাছে আর সাধারণ সাপ হলে জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দেই। এত বড় কাল কেউটের ওরা ভালোই দাম দেবে – তারপর হয়তো চিড়িয়াখানায় রেখে দেবে কারণ এদের তো চট করে পাওয়া যায় না।’

 

ওই মাঠে এসে ওরা খুব ভালো করে চারদিক দেখে ঝিলের কাছে এলো – দুই সাপুড়ে সমস্ত ঝোপ ঝাড় গুলো ভালো করে দেখে নিলো তারপর ঝিলের জলের দিকে নজর দিলো। নাঃ, মনে হচ্ছে সাপ দুটো বাইরে নেই। এবার ওরা ওই পড়ো বাড়ির কাছে এলে রন্তু ওদের দেখিয়ে দিলো প্রথম দিন ওরা সাপটাকে কোথায় দেখেছিলো আর ওটা কোন দিকে চলে গিয়েছিলো। তারপরই ওরা তিন জন চটপট একটু দূরের একটা আম গাছের উপর উঠে পড়লো যেখান থেকে বাড়ির পেছনের দিকটা ভালো করে দেখা যায়। গত মাস কয়েকে বাড়ির ভেতরের দিকের জঙ্গল অনেকটা বেড়ে গিয়েছে তবে পেছনের সিঁড়ির সামনের চাতালটা যেখানে ওই ছেলেধরাকে অন্তু ও রন্তু পিটিয়েছিলো সেখানটা মোটামুটি পরিষ্কারই আছে। অন্তু আম গাছের উপর দিকের একটা মোটা ডালে উঠে ভালো করে নজর দিয়ে বাড়ির পেছনের সিঁড়ির নিচে চাতালটা দেখেই চমকে ফিস ফিস করে বললো,
‘এই রন্তু সন্তু, পেছনের চাতালে ওটা কি রে? – – ওরে বাপরে, একটা সাপ তো ওখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে রোদ পোয়াচ্ছে রে আর পেছনের ঘরের দরজাও দেখি খোলা। তাড়াতাড়ি গুরুজীকে ডাক এখান থেকে জায়গাটা যেন ভালো করে দেখে নেয়।’

সন্তু তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে একটু এগিয়ে খুব আস্তে গুরুজীকে ডাকতেই গুরুজী চোখ তুলে সন্তুর হাত ছানি দেখে এগিয়ে এসে আম গাছের যে ডালটায় অন্তু বসে ছিলো সেখানে উঠে এলো। ওখান থেকে ওরা হঠাৎ দেখে পেছনের জঙ্গল থেকে আর একটা বিরাট সাপ ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছে আর ওটাকে দেখে কুণ্ডলী পাকানো সাপটা একটু মাথা তুলে আবার নামিয়ে নিলো আর অন্য সাপটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঘরে ঢুকে গেলো। গুরুজী আস্তে করে বললো,
‘এত বড় কাল কেউটে আগে আমি দেখি নি তার উপর জোড়া। মনে হয় ঘরেই বাসা বেঁধেছে। এদিকের জানালাটা তো খোলা – ওখান দিয়ে বেরিয়ে আসবে না তো?’
সন্তু বললো,
‘ওই জানালাটা প্রায় ফুট চারেক উঁচুতে – সাপটা কি এতটা উঠতে পারবে?’
‘কি জানি – সবই খোদার হাতে।’

আম গাছ থেকে নেমে গুরুজী সঙ্গের ছেলেটার সাথে নিচু গলায় একটু সময় আলোচনা করে ওদের বললো,
‘দাদাভাইরা, আমাদের যাই হোক না কেন তোমরা কোন রকম সাহায্য করতে আসবে না আর চার দিক ভালো করে দেখে শুনে তবেই গাছ থেকে নামবে। কথাটা মনে রেখো।’

তারপর গুরুজী ও ছেলেটা বস্তাগুলো ও ঐ দুটো লাঠি নিয়ে খুব সাবধানে গেট দিয়ে ঢুকে ওই সুঁড়ি পথ ধরে বাড়ির পেছন দিকে এগিয়ে গেলো। শেষের ঘরের খোলা জানালার নিচে এসে গুরুজী জানালার কোণা দিয়ে ভেতরটা দেখে নিয়ে ছেলেটার কানে কানে কী যেন বোঝালো তারপর মাথার পাগড়ি খুলে বাঁ হাতে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে আর ডান হাতে লাঠিটাকে শক্ত করে ধরে খুব ধীরে এগিয়ে গেলো পেছনের চাতালের দিকে। ছেলেটা একটা বড় পাথর তুলে গুরুজীর প্রায় গায়ে সেঁটে চললো। অন্তুরা উত্তেজনাতে আম গাছের ডাল শক্ত করে চেপে ধরেছে – কত বড় বিপদ হতে পারে ওরা ঠিক ধারনা করতে পারছে না। ছেলেটাকে বড় পাথরটা তুলতে দেখে অন্তু ফিসফিস করে বললো,
‘ঐ পাথরটা দিয়ে কী করবে রে?’

সন্তু ও অন্তু দুজনেই মাথা নাড়লো মানে ওরাও ঠিক বুঝতে পারছে না। তারপরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুত ঘটে গেলো। গুরুজী খুব আস্তে বাড়ির কোনাটা ঘুরে পেছনের চাতালে আসতেই সেই অল্প শব্দে সাপটা কুণ্ডলী থেকে যেই না মাথা তুলেছে গুরুজী বিদ্যুৎবেগে হাতের লাঠির ‘Y’ মাথাটা দিয়ে নিঁখুত ভাবে সাপটার গলার কাছে আটকে মাটিতে চেপে ধরেছে আর ছেলেটা সাথে সাথে পেছনের ঘরের দরজাটা এক টানে বন্ধ করে ঐ পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে দিয়েছে যাতে চট করে খুলে না যায় – তারপরই ওর হাতের হুক লাগানো লাঠিটা দিয়ে সাপের শরীরের মাঝামাঝি গায়ের জোরে চেপে ধরলো। সাপটা প্রচণ্ড জোরে হিস্‌ হিস্‌ আওয়াজ করে লেজের দিক দিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ঠিক নাগালের মধ্যে পেলো না। এদিকে বাইরের সাপটার আওয়াজে ঘরের ভেতরের সাপটা ফোঁস ফোঁস শুরু করেছে কিন্তু পাথরের জন্য বেরিয়ে আসতে না পেরে সেই ফোঁসফোঁসানি আরো বেড়ে গেলো। সন্তুরা কোন দিনও সাপের এই রকম ফোঁসফোঁসানি আর হিস্‌হিসানি শোনে নি – ওরা ভয়ের চোটে আম গাছের ডাল জড়িয়ে ধরেছে যাতে হঠাৎ পড়ে না যায়। সাপটা সমস্ত শরীরকে মুচড়ে লাঠি দুটো থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে – সন্তুরা বুঝতে পারছে গুরুজী ও ছেলেটা গায়ের জোরে সাপটাকে চেপে রাখতে একেবারে ঘেমে নেয়ে উঠেছে – ওরা জানে একটু ঢিলে হলেই সাপটা পিছলে বেরিয়ে আসবে আর তার মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। এবার ছেলেটা চট করে হাতের লাঠিটা পা দিয়ে চেপে ধরে একটা বস্তা গুরুজীর দিকে এগিয়ে দিতেই গুরুজী বাঁ হাতে শরীরের সমস্ত সমস্ত জোর দিয়ে লাঠিটাকে চেপে রেখে ডান হাত দিয়ে বস্তাটাকে সাপের মাথার নিচের দিকে ঢুকিয়ে চোখের পলকে ওটা দিয়ে মাথাটাকে চেপে ধরে লাঠিটা ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে সাপের মাথার চার দিকে বস্তাটাকে জড়িয়ে সাপের শরীরের দিকে বস্তাটা টেনে নামিয়ে নিতেই সাপের মাথা ও শরীরের প্রায় ফুট দুয়েক ওই বস্তার মধ্যে ঢুকে গেলো। এর মধ্যে ছেলেটা লাঠি ছেড়ে দিয়ে সাপটার শরীরের মাঝখানটাকে বগলদাবা করে বস্তার ভেতর দিকে ঠেলে মিনিট খানেকের মধ্যেই ওটাকে বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে গুরুজী বস্তার মুখে লাগানো একটা শক্ত দড়ি টেনে খুব শক্ত করে বস্তার মুখটা বেঁধে ফেললো। বস্তার মধ্যে সাপটার কী তড়পানি, মনে হচ্ছে বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে আর সেই সাথে প্রচণ্ড হিস্‌হিসানি – বস্তা তো মাটিতে গড়াতে শুরু করেছে। ওদিকে বিশেষ নজর না দিয়ে ওরা দুজনে সিঁড়ির পাশের কাঁটা গাছের ঝোপে লুকিয়ে লাঠি দিয়ে দরজা আটকে রাখা পাথরটা একটু সরাতে ঘরের সাপটা প্রায় সাথে সাথে দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতেই পলক ফেলার আগে গুরুজী ওর মাথাটা লাঠি দিয়ে চেপে ধরতে ছেলেটা দরজাটা শক্ত করে সাপের গায়ে চেপে ধরে বস্তাটা ওটার মাথার নিচে দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে দুজনে মিলে আগের মত সাপটাকে বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে শক্ত করে বস্তার মুখ বেঁধে দিলো। দরজার জন্য সাপটার দাপাদাপি ঘরের মধ্যে হওয়াতে এবারের কাজটা বেশ সহজ ভাবেই হয়ে গেলো। এবার ছেলেটা তাড়াতাড়ি ঝুড়ি দুটো এনে তার মধ্যে বস্তা দুটোকে ঢুকিয়ে ঢাকনা চাপা দিয়ে খুব শক্ত করে ঝুড়ি দুটো বেঁধে ফেললো কিন্তু তাহলেও বস্তার মধ্যে সাপ দুটোর দাপানিতে মনে হচ্ছে ঝুড়ি দুটোই যেন ফেটে যাবে। এর মধ্যে গুরুজী আর একটা বস্তা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকতে রন্তু বললো,
‘মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে এদের বাচ্চা কাচ্চারা আছে।’

একটু পরে গুরুজী মুখ বাঁধা বস্তাটা নিয়ে বেরিয়ে এসে খুব সাবধানে ঝুড়ি দুটো মাথায় নিয়ে আর তৃতীয় বস্তাটা হাতে ঝুলিয়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে অন্তুদের ডাকতেই ওরা আম গাছ থেকে ঝটপট নেমে দৌড়ে এসে ঝুড়ি দুটোর চার দিকে নাচতে শুরু করলো। গুরুজী ও ছেলেটা রীতিমত হাঁপাচ্ছে – একটু দম নিয়ে আর মুখের ঘাম মুছে গুরুজী বললো,
‘দাদাভাইরা, তোমাদের জন্যই এই প্রথম এত বড় দুটো সাংঘাতিক সাপ ধরতে পারলাম – একটু এদিক ওদিক হলেই আমাদের ছোবল খেয়ে মরতে হতো। ওদের গোটা চারেক বাচ্চাও পেয়েছি – বাচ্চা হলে কী হবে ওগুলোর ফোঁস কম ছিলো না – শুধু হাতে ধরতে ভয়ই করছিলো। এদের বিক্রি করলে ভালো টাকাই পাওয়া যাবে। আমার নাম মজিদ মিঞা আর এ হলো আমার ভাইপো সিরাজ – আমরা ঝিলের ওপাশে নবনারায়ণপুর গ্রামে থাকি। তোমাদের কোন দরকার হলে ওই গ্রামের যে কোন লোককে দিয়ে খবর পাঠালেই আমরা চলে আসবো।’

সিরাজ আস্তে আস্তে দুটো ঝুড়ি সহ বাঁকটা কাঁধে তুলে বললো,
‘গুরুজী, এরা তো বড্ড ভারি – রাস্তায় বার কয়েক বিশ্রাম নিতে হবে মনে হচ্ছে।’

গুরুজী খুব আনন্দের সাথে হাসলো,
‘ওরে, এত দিনে সত্যিকারের সাপ ধরেছিস – ওজনদার তো হবেই। এই না হলে সাপের রাজা। ও হ্যাঁ, দাদাভাইরা আর একটা কথা – তোমরা এ বাড়িতে আর এসো না – বাড়িটা ভালো না। খোদাকে ধন্যবাদ দাও যে তোমাদের কিছু হয় নি। তবে এ ধরনের কাল কেউটে বা কিং কোবরা তো পাহাড়েই থাকে – এখানে কোথা থেকে এলো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।’

সন্তুরা মনের আনন্দে ফিরে এলো – এখন আর ওদের ঝিলের ধারে গল্প করার আর খেলার কোন রকম ভয় নেই।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!