তালির ভিসা–জাহিদুজ্জামান

 

 

অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গেল, শুনতে পেলাম মায়ের কান্নার আওয়াজ। পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়লাম; কারণ এটা কোন নতুন ঘটনা নয়, প্রতিদিনই তাহাজ্জুত নামাজের সময় মা এরকম কান্নাকাটি করে। অন্য কোন নামাজের সময়ও হয়ত বা কান্নাকাটি করে, কিন্তু তাহাজ্জুত নামাজের কান্নাকাটি আমাদের সবার কাছে পরিচিত।

আজকে তার কান্নার আওয়াজ কিছুতেই থামছে না। আমি বিছানা ছেড়ে মায়ের ঘরে গেলাম। আমার মমতাময়ী মা আল্লার কাছে হাত তুলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। ছোটবেলা যখন রাত্রে পাশ ফিরে মাকে কাছে না পেতাম বুঝতাম মা তাহাজ্জুত নামাজে বসেছে, চুপি চুপি উঠে গিয়ে মায়ের পাশে এরকম বসে থাকতাম, মা ঠিকই টের পেত। এক একবার সালাম ফিরিয়ে আমাকে চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিত, আমি ঘুমের ঘোরে মায়ের চুমো নিয়ে মায়ের আঁচল ধরে বসে থাকতাম। ঘুম জড়ানো গলায় বলতাম, মা তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না, বিছানায় চলো।

বড়ো হবার পরে ঘুম ভেঙ্গে পাশ ফিরে মাকে না পেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলি না, মা বিছানায় চল তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না। মাও আমাকে আর আগের মত চুমো খায় না। আজকে মায়ের পাশে ইচ্ছে করে বসেছি, যদি মা হঠাৎ করে একটু আগের মত আদর করে দেয়।

মা সালাম ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো কিরে খোকা ঘুমাসনি কেন, শরীর খারাপ করবে তো? বললাম, মা তুমি আমাকে একটু আগের মত আদর করে দাও না, মা আমার চিবুক ধরে কপালে চুমু খেলো দেখলাম মায়ের চোখ ভরা জল। আমি ভিজে গেলাম তার চোখের জলে।

জিজ্ঞেস করলাম, মা এত কান্নাকাটি করছ কেন, আমরা কি তোমাকে কোনো কষ্ট দিয়েছি? মা বললো, নারে আমি ইতালির বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য কান্নাকাটি করছি। আমি আকাশ থেকে পড়লাম, বললাম, মা তুমি আমাদেরকে রেখে ইতালির মানুষজন নিয়ে কান্নাকাটি কর? মা বললো, সেকি! তুই তো আমাকে এই করুণ কাহিনীর কথা বলেছিস! আমার মনে পড়লো মাকে আমি কি বলেছি।

আমার এক বড় ভাই ইতালি যাবার জন্য ভিসার আবেদন করেছিল। ইতালিয়ান এম্বাসী ভিসা দেওয়ার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছে; সেখানে উল্লেখযোগ্য শর্ত হল ভিসা পেতে হলে ইতালীয় বুড়ো-বুড়িদের দায়-দায়িত্ব নিতে হবে এবং তাদের একাউন্টে টাকা জমা রাখতে হবে। বুঝাই যাচ্ছে সে দেশের সরকার এবং বুড়ো-বুড়িদের ছেলে-মেয়েরা তাদের দায়-দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না।

মাকে এই ঘটনা বলেছি কয়েক দিন আগে। আজকে মনে হল মা এতদিন কেন গম্ভীর হয়েছিল। এই ঘটনা শোনার পর থেকে মা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল; আজকে তার বহিঃপ্রকাশ।

মা আমার হাত ধরে বললো, খোকা তুই ইতালি যা। আমি বললাম মা এসব তুমি কি বলছো? সে বললো, জি বাবা, তুই ইতালি গিয়ে আমাকে যেমন ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিস সবাইকে তেমন ভালবাসা দিবি, সকল দুঃখ ভুলিয়ে দিবি। আমি বললাম, মা এটা তো ওদেশের কালচার, মা-বাবা বৃদ্ধ হলে ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দেয়। মা বললো, তোকে ইতালি যেতে হবে; এই কালচার ঠিক না এটা তাদের সবাইকে বোঝাতে হবে।

আমি মায়ের কাছ থেকে চলে এলাম। মা হয়ত বা জানে না বাংলাদেশেও ওল্ড হোম আছে। যেই মায়ের হাতের পরশ ছাড়া এক সময় ঘুম আসতো না, সেই মাকে ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ে তার ছেলে-মেয়েরা।

ইতালির এক বৃদ্ধার কথা ভাবলাম। বাংলাদেশী কোন ছেলে অথবা মেয়ে তার দায়িত্ব নিয়ে হয়ত ইতালি যাবে; মাসে মাসে তার অর্থনৈতিক ব্যাপারটাও হয়ত বা দেখবে, কিন্তু সেই বৃদ্ধার ছেলে-মেয়ের মমতা কি তারা কখনো দিতে পারবে? যেই ছেলে-মেয়েদের পৃথিবীর সমস্ত বিপদ থেকে আগলে রেখে বড় করেছে মা, ছেলেটি চিৎকার করে উঠলে মা দৌঁড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস বাবা, কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস বাবা বলে সমস্ত শরীর চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিত সে ছেলেটি আজকে তার মায়ের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না – কি অবিশ্বাস্য কথা!

মা আমার রুমে এসে বললো, খোকা তুই ইতালি যাবি কিনা সে কথা তো বললি না। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, মা এই কালচার পরিবর্তনের জন্য আমি আজীবন লড়াই করে যাব।

 

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!