তালগাছের ছায়া—(Misk Al Maruf)

  1. আমাদের ফরিদপুর সদর এলাকায়, নড়াইল ঘাটের ভাঙন বাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা তালগাছকে ঘিরে একটা কথা বহু বছর ধরে চলে আসছে, একদম ফিসফিস করে রাতের অন্ধকারে। এটা কেবল লোককথা ছিল না ছিল এক ঠান্ডা সতর্কবাণী:

​“তালগাছ যত উঁচু তার ছায়া তত গভীর। আর গভীর ছায়ায় মানুষ একা হাঁটলে… কারো না কারো ঘাড় ভাঙে।”

​আমি অভ্র যুক্তিবাদী। আমার বন্ধু মিলন ছিল আমার সঙ্গী। আমি বলতাম, “ভূত-টূত কিছু না। মানুষের মনের ভুল।” কিন্তু মিলন শুধু মাথা নাড়ত।

​আর সেই ভুলটা ভাঙল আজ থেকে তিন বছর আগে, শ্রাবণের এক রাতে। সেদিন মিলনকে সেই তালগাছের কালো ছায়া থেকে টেনে আনতে গিয়ে যা দেখেছিলাম, তা কোনো বিজ্ঞান কোনো যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

​আমাদের এলাকা ফরিদপুর হলেও এই পথটা ছিল নরকের এক নীরব প্রবেশদ্বার। ভাঙন বাঁধের ঠিক পাশে দাঁড়িয়েছিল সেই তালগাছ, যা স্থানীয়দের কাছে ‘মৃত্যু-বৃক্ষ’ নামে পরিচিত ছিল।

​গাছটার বয়স কত কেউ জানত না। এর কোনো ডালপালা ছিল না বললেই চলে ছিল শুধু একটা বিশাল কালচে কঙ্কালসার শরীর। উচ্চতায় প্রায় সত্তর ফুট হবে। দিনে দেখলে মনে হতো এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রাতে… এর চরিত্র যেত পাল্টে।

​চাঁদহীন রাতে বিশেষ করে শ্রাবণে এর ছায়াটা পড়ত যেন পথ গ্রাস করার জন্য। সেই ছায়াটা দেখতে একটা বিশাল, কালো মানুষের কঙ্কালের মতো লাগতো।

​গ্রামের মানুষ বলতো: “ওই ছায়া পার হইস না। কারো ডাক শুনলে পিছনে তাকাইস না। কারণ যে ঘাড় মটকায়, সে ছায়ার গোড়ায় বসা থাকে।”

​মিলন এই ভয়ে কাঁপত, তবুও আমাদের কনটেন্ট তৈরির কাজের জন্য বাড়ি ফেরার এটাই ছিল সবচেয়ে কাছের এবং দ্রুততম রাস্তা। আমাদের জেদ এবং তাড়াহুড়ো আমাদের মৃত্যু-বৃক্ষের পথে টেনে নিয়ে গেল।

​তারিখটা আমার নির্ভুল মনে আছে: ১৪ আগস্ট, ২০২২। রাত ১টা ৪১ মিনিট। ঘড়ির কাঁটা নয়, আমার মনের আতঙ্ক ওই সময়টা আজও মনে করিয়ে দেয়।

​রাতভর বৃষ্টি হচ্ছিল। বাতাস বইছিল যেন উন্মত্ত ঢেউয়ের মতো। আমি আর মিলন কাজ শেষে মোটরসাইকেলে ফিরছি। আমি চালাচ্ছি, মিলন পেছনে।

​তালগাছের কাছাকাছি আসতেই বাতাসের দাপটে গাছটা ডানে-বামে এমনভাবে দুলতে শুরু করল যেন সে কোনো অদৃশ্য শক্তির হাতে খেলনা। যতবার গাছটা দুলছিল, ততবার তার ছায়াটা মুহূর্তের জন্য সরে গিয়ে রাস্তাটাকে অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছিল। এই আলো-ছায়ার খেলাটা আমার কাছে প্রথমে মজার লাগলেও, একটা চাপা অস্বস্তি অনুভব করছিলাম।

​মিলন হঠাৎ শান্ত, প্রায় মৃতস্বরে বলল,

“দোস্ত, চল অন্য রাস্তা ধরি। আমার মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাদের দেখছে।”

আমি হেসে উঠলাম, “আরে রাখ তো! ভূত টুত নাই।”

​আমার কথা শেষ হতে না হতেই, তালগাছের পাশ কাটার ঠিক মুহূর্তে, মিলন আমার কাঁধে হাত রাখল। সেই স্পর্শ ছিল বরফ ঠান্ডা, যেন রক্ত চলাচল থেমে গেছে। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল না, বরং এক নিরেট আতঙ্কে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল:

​“তুই থাম। তাড়াতাড়ি ব্রেক কর!”

​আমি ব্রেক করতে বাধ্য হলাম। মোটরসাইকেল থেমে গেল। মিলন প্রায় ছিটকে নেমে গেল। তার চোখ দুটো স্থির পলকহীন। সে সোজা তালগাছের দিকে তাকিয়ে আছে।

​আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করলাম। রাস্তার ওপর সেই গাঢ় জমাট কালো ছায়াটা। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছায়ার ভেতর কিছু একটা ছিল। মানবাকৃতি না যেন একটা নিরেট, গাঢ় কালো স্তম্ভের মতো কিছু স্থির দাঁড়িয়ে আছে। শুধু চোখের ভুল? হয়তো…

​কিন্তু তার আগে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পেলাম না মিলন মাটিতে ঢলে পড়ল।

​আমি চিৎকার করে উঠলাম। বৃষ্টির মধ্যে দ্রুত গিয়ে তাকে ধরে উঠালাম। তার চোখ উল্টে আছে গলা শুকনো। তার হাত-পা কাঁপছে। সে দম ফুরিয়ে যাওয়ার মতো করে চিৎকার করে বলল:

​“আমার ঘাড় কেউ পেছন দিক থাইকা মটকায়ে ধরছে… হাত… ছাড় ছাড় ছাড়…”

​আমি পাগলের মতো চারদিকে তাকাচ্ছি। কেউ নেই। একদম কেউ নেই। শুধু ঝোড়ো বাতাস আর তালগাছের দুলুনি। আমি মিলনকে ধরে আছি, আর সে তখন নিজের সাথেই যুদ্ধ করছে। তার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে ভয়ে।

​তারপর যা ঘটল তা কোনো মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

​মিলনের মাথা! তার মাথাটা হঠাৎ করে, যেন একটা বিদ্যুতের ঝলকের মতো নিজের থেকেই ডানদিকে মোচড় খেল!

​যেন অদৃশ্য এক শক্তি তার ঘাড় ধরে টেনে দিয়েছে। আমি আমার দুহাত দিয়ে তার মাথা ধরলাম, সোজা করার চেষ্টা করলাম। আমার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও পারছিলাম না। আমার হাতের নিচে তার ঘাড়ের অস্থিসন্ধিতে চাপ পড়ছিল।

​একটা বীভৎস গা-ছমছমে ‘কড়মড়’ শব্দ হলো। শব্দটা যেন হাড় ঘষে যাওয়ার, কিছু ভেঙে যাওয়ার।

​আমার মনে হলো মিলনের শরীরটা নিথর হয়ে গেল। আমি চিৎকার করতে পারছিলাম না। এক সেকেন্ডের জন্য আমি স্থির হয়ে গেলাম মিলন কি মরে গেল? এই নীরব ঘাতকের হাতে?

​কোনোমতে তাকে টেনেহিঁচড়ে মোটরসাইকেলে বসিয়ে প্রায় উড়ন্ত গতিতে আমি গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে পৌঁছালাম।

​ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। অবাক কাণ্ড! কোনো হাড় ভাঙেনি! ঘাড়ের স্নায়ুও ঠিক আছে। ডাক্তার বললেন, “প্রচণ্ড মানসিক শক খেয়েছে। এর সাথে পেশির খিঁচুনি এমন হতে পারে।”

​একটু সুস্থ হওয়ার পর মিলন যখন কথা বলল তখন তার চোখ দুটো তখনও সেই রাতের আতঙ্ক বহন করছিল। সে ফিসফিস করে বলল, “অভ্র, তুই দেখিসনি, কিন্তু আমি দেখেছি। ছায়াটা নড়ছিল।”

​”আমি তোকে থামতে বললাম কারণ আমি শুনলাম, কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে খুব কাছে থেকে। কিন্তু আমি মুখ ঘুরাতে পারছিলাম না।”

​সে হাঁপাতে শুরু করল। আমি তাকে শান্ত করলাম।

​”আমি তাকাতেই দেখি… তালগাছের গোড়ায় কেউ বসা ছিল সাদা, ফকফকা শরীর… কিন্তু তার মুখ ছিল না। চোখ ফিরাইতেই দেখি, ছায়াটার ভেতর থেকে দুইটা হাত বের হলো। কালো লম্বা শুকনো হাত। প্রথমে কাঁধে ধরল… তারপর সোজা আমার ঘাড়ে। তুই সামনে তাকিয়ে ছিলি কিন্তু ঠিক আমার পেছনে,

সেই ছায়াটা যেন মাথা থেকে উঠে আসছিল!”

​মিলন থেমে গেল। “সেটা আমার মাথাটাকে পাকিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমি মনে হয় এক রাতের জন্য বেঁচে গেছি।”

​আমার যুক্তিবাদী মন ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। আমি গিলে ফেললাম। সেই ছায়াটা আমি দেখেছিলাম সেটা কি সত্যিই নড়েছিল?

​পরের দিন আমি আর চুপ থাকতে পারিনি। গ্রামের প্রবীণদের কাছে গেলাম। তারা যা বলল তা আমার রক্ত হিম করে দিল। এই ঘটনা প্রথম নয়। এই তালগাছ এই ছায়া বছরের পর বছর ধরে একই কাজ করে আসছে:

​ ১৯৯৭ সালে এই গাছের নিচে এক ব্যবসায়ী মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃত্যুর কারণ? ঘাড় মটকে যাওয়া। ঘাতক কেউ ছিল না কেবল গভীর রাত ও গাছের ছায়া।

২০০৪ সালে দুই বন্ধু সাইকেল থেকে পড়ে যায়। একজন অক্ষত, কিন্তু অন্যজনের ঘাড় অদ্ভুতভাবে বেঁকে যায়। সে বাঁচেনি।

২০২০ সালে এক রিকশাচালককে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সে জ্ঞান ফিরে শুধু বলেছিল, “ছায়া আমার মাথাটা ঘুরায় দিছে।”

​প্রত্যেকটি ঘটনার সূত্র একই গভীর রাত, তালগাছের ছায়া আর ঘাড়ের অস্বাভাবিক ক্ষতি। লোককথা নয় এটা ছিল এক জ্যান্ত ইতিহাস।

​ঘটনার তিন বছর পার হয়েছে। মিলন এখন ভালো। কিন্তু পুরোপুরি নয়।

​সে আজও ওই রাস্তায় যায় না। তার ঘাড় মাঝে মাঝে আচমকা খটখট শব্দ করে ওঠে, যেন ভেতরে কিছু একটা জ্যাম হয়ে আছে।

​গত বছর এক ভয়াবহ নদীভাঙনে সেই বিশাল তালগাছটা শিকড় সমেত নদীতে ধসে পড়ে যায়। গ্রামের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। তারা ভেবেছিল অভিশাপ দূর হয়েছে।

​কিন্তু আসল আতঙ্ক শুরু হলো তারপর।

​আশ্চর্য বিষয় হলো গাছটা না থাকলেও, রাতে ওই জায়গায় গেলে আজও মনে হয় কাঁধে কেউ যেন আঙুল রাখল। হাওয়ার শব্দে মনে হয় কেউ পেছন থেকে ফিসফিস করে বলল, “একবার ঘাড় ঘুরাইয়া দেই?”

​গত মাসে দুই ছাত্র ওই পথ দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল। তারা দুজনেই অভিযোগ করেছে তাদের মাথা হঠাৎ করে ভারী হয়ে গেছিল। আর মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য ছায়া তাদের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

​তালগাছটা নেই। কিন্তু তার মৃত্যুর পরও তার ছায়া নাকি এখনও পড়ে। আমি জানি মিলন আমি এবং সেই দুই ছাত্র আমরা সবাই সেই চিহ্নের শিকার।

​সেই ছায়া আমাদের ছেড়ে যায়নি। সে কেবল সময়ের অপেক্ষা করছে।

“আপনার এলাকায় এ রকম তালগাছ আছে?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!