তমসকাল— রেজানুর রহমান

বাসায় ঢুকেই গলগল করে বমি করে ফেললেন আবদুল আজিজ। সোমা দরজা খুলে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আবদুল আজিজকে বাথরুমে বমি করতে দেখে চিৎকার দিল- মা ওমা দেখে যাও। বাবা বমি করতেছে। সুফিয়া রান্নাঘরে কৈ মাছ ভাজছিলেন। মাছের সাইজ দেখে এমনিতেই তার মন খারাপ। পইপই করে বলেছিলেন মাছ যেন দেশী এবং বড় হয়। কে শোনে কার কথা? এমন মাছ এনেছে একটা কামড় দিলে আরেকটা দেবার জায়গা পাওয়া যাবে না। এই ধরনের মাছ ভেজে লাভ আছে? শুধু শুধু তেল আর মশলা খরচ। সোমা এবার জোরে চিৎকার দিল- মা ওমা দেখে যাও বাবা বমি করতেছে। মা, ওমা… আরও কয়েকটা মাছ ভাজা বাকি আছে। চুলায় আগুন কমিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুফিয়া। বাথরুমের দরোজা খোলা। আবদুল আজিজ ওয়াক… ওয়াক… শব্দ করেই চলেছেন। সোমা হাত দিয়ে তার মাথা ধরে আছে। সুফিয়া দৌড়ে এলেন। সোমাকে ঠেলে আগে বেসিনের দিকে তাকালেন। বেসিনে বমির সঙ্গে খাবারের সিমটম দেখে বললেন- যা ভাবছিলাম তাই তো দেখতেছি। তোমাকে আর কত বলব হোটেলের ভাজাপোড়া কিছু খাইবা না? আমার কথা কানে যায় না? কথা বলতেছ না ক্যান? আবদুল আজিজ আবারও গলগল করে বমি করলেন। বমিতে দুর্গন্ধ ছুটেছে। সুফিয়া নাক চেপে ধরে মেয়ের দিকে তাকালেন, দ্যাখ ভালো কইর‌্যা দ্যাখ। আইজ নিশ্চয়ই হালিম খাইছে। ওই যে ডাইল দেখা যায়। ঠিক আছে আইজ থাইক্যা বাসায় রান্না বন্ধ। সবাই হোটেলে খাবে… আবদুল আজিজ আবার বমি করতে চাইলেন। কিন্তু এবার বমি হল না। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো ফুলে উঠেছে। দুটি চোখেরই পাপড়ি ভিজে গেছে। আবদুল আজিজকে শক্ত করে ধরল সোমা, বাবা খুব কী খারাপ লাগতেছে? আজিজ কোনো জবাব দিলেন না। বেসিনের কল খুলে মুখে পানির ঝাঁপটা দিলেন। কুলি করলেন কয়েকবার। তারপর সোমার শরীরে ভর দিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে সোফার ওপর ধপ করে বসলেন। তাকে ক্লান্ত এবং অসহায় দেখাচ্ছে। সোমা উৎকণ্ঠা নিয়ে আজিজের পাশে বসল। বাবা এখন কেমন লাগতেছে? মুখোমুখি সোফায় সুফিয়া বসে আছেন। তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে পলাশ। সোমা আবার প্রশ্ন করল, বাবা এখন কেমন লাগতেছে? আজিজ অসহায় চোখে সুফিয়ার দিকে তাকালেন। তারপর মাথা নিচু করে বললেন, ভালো! কি হয়েছে তোমার? হঠাৎ বমি করলে… মেয়ের কথা কেড়ে নিলেন সুফিয়া। এত প্রশ্ন করতেছিস ক্যান? আমার কাছে তো সব কিছুই পরিষ্কার। রাস্তার কোনো বাজে হোটেলে বোধহয় বাসি হালিম খাইছে। এই একটা মানুষকে আমি ঠিক করতে পারলাম না… সুফিয়াকে মৃদু ধমক দিল সোমা। মা তুমি চুপ কর তো। আগে বাবার কাছে শুনি কি হয়েছিল। বাবা বল না, কী হয়েছিল? হোটেলে বাসি হালিম খেয়েছ? আবার বমির বেগ হচ্ছে। নিজেকে সংযত করলেন আজিজ। মাথার ওপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। অথচ প্রচণ্ড গরম লাগছে। পাঞ্জাবি খুলে ফেললেন। সোমা বলল, বাবা ঘরে চল। শুয়ে থাক। ভালো লাগবে।

 

আজিজ অসহায়ের মতো মেয়ের দিকে তাকালেন- পলাশ কোথায়? পলাশ… পলাশ কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। অথচ আজিজ তাকে দেখতে পাননি। তাহলে কী তার কোনো বড় সমস্যা হয়েছে? সুফিয়া আঁতকে উঠলেন। তোমার কী খুব খারাপ লাগতেছে? না। তাহলে এমন করতেছ ক্যান? পলাশ তো তোমার কাছেই খাড়ায়া আছে। আজিজ একবার সুফিয়া একবার সোমা একবার পলাশের দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমরা সবাই বসতো আমার পাশে। আমি কিছু কথা বলব। পলাশ বাদে সবাই সোফার ওপর বসে আছে। আজিজ সাহেবের কথা শুনে পলাশ মায়ের গা ঘেঁষে সোফার ওপর বসল। আজিজকে প্রশ্ন করল তোমার কী হয়েছে বাবা? আজিজ ছেলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ফেললেন। অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে উঠল সবাই। সুফিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলেন- অ্যাই কি হইছে তোমার? হ্যা… সোমা আজিজকে বলল- বাবা, ও বাবা কি হয়েছে? কাঁদছ কেন? পলাশ জানতে চাইল- কোনো দুঃসংবাদ বাবা? সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে সোমাকে বললেন, তোর মেজ মামাকে একটা ফোন দে তো। বল তোর বাবা কেমন জানি করতেছে। তাড়াতাড়ি আসতে বল। সোমা উঠে যাচ্ছিল। আজিজ মেয়েকে ডেকে বসালেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন- তোমরা বস। আমার কিছু কথা আছে। কি কথা বাবা? বল। সোমা সোফায় বসতে বসতে বলল। আজিজ উদাস চোখে তাকালেন। ধর আমি মারা গেলাম। তোরা কে কী করবি? সুফিয়া এবার চিৎকার দিয়ে কেঁদে ফেললেন। তুমি কি বলতেছ এইসব? কি হইছে তোমার? সোমা তোর মেজ মামাকে ফোন কর। বল তোর বাবা কেমন জানি করতেছে, পলাশ তুই করতো… সুফিয়াকে থামিয়ে দিলেন আজিজ। তুমি অস্থির হয়ো না। আমার কিচ্ছু হয় নাই। বাসায় ফেরার পথে রাস্তার উপর দুইটা মানুষকে চোখের সামনে মরতে দেখলাম। একজন রিকশা চালক, অন্যজন প্যাসেঞ্জার। রিকশায় আসতেছিল। তাদেরকে ট্রাক চাপা দিয়ে চলে যায়। রাস্তার ওপর জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করতেছিল। হাজার মানুষের ভিড়। কেউ হাসপাতালে নেয়ার গরজ করল না। বরং ভিড় করে তামাশা দেখল। আমিও দেখলাম। চোখের সামনে দুইটা মানুষ জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে মারা গেল। ইস। কী বীভৎস সে দৃশ্য। দুইজন মানুষ মারা গেল। শত শত মানুষ কাছে থেকে এই দৃশ্য দেখল। যেন মানুষের মৃত্যু কোনো ঘটনাই না। একজন অন্যজনকে বলতেছিল- একটা মরছে, আরেকটা এখনও বাইচ্যা আছে। দ্যাখতাছোস না লড়াচড়া করে… আরে না ব্যাটা দুইটাই মরছে। দ্যাখতাছোস না কোনো লড়াচড়া নাই, সারা শব্দও নাই। আমার কি মনে হয় জানো লোক দুইটাকে হাসপাতালে নেয়া গেলে বেঁচে যেত। আমি কেন এই কাজটা করলাম না। ছিঃ ছিঃ আমি এতটা অমানুষ। বলেই আবার গলগল করে বমি করে ফেললেন আজিজ। সঙ্গে সঙ্গে সারা বাসায় আবার হৈ চৈ পড়ে গেল। সুফিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

 
২.
টিভিতে টকশো দেখছিলেন বজলুল হুদা। টকশো তো নয় যেন ঝগড়াঝাটির অনুষ্ঠান। সরকারি-বেসরকারি দুই পক্ষের দুই নেতা সাম্প্রতিক ইস্যু নিয়ে কথা বলছেন। কথা কাটাকাটি আর ঝগড়াঝাটি দেখে মনে হচ্ছে কেহ… নাহি ছাড়ে সমানে সমান। মাঝখানে বসে আছেন উপস্থাপক। তিনি ঝগড়া থামানোর চেয়ে নির্বাক হয়ে কখনও এদিকে কখনও ওদিকে তাকাচ্ছেন আর মিটমিট করে হাসছেন। বজলুল হুদার মনে হল এখন ফোন করার সুযোগ থাকলে সরাসরি উপস্থাপককে ফোন করে বলতেন- এই যে ভাই, আপনি চুপ করে বসে আছেন ক্যান? ঝগড়া থামান। ওরে বাবা! পরিস্থিতি তো জটিল আকার ধারণ করেছে। উপস্থাপক তখনও মিটমিট করে হাসছেন। মোবাইল বাজছে। এত রাতে কার ফোন? হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিয়ে মনিটরে নম্বর দেখলেন বজলুল হুদা। সুফিয়ার ফোন? সুফিয়া সাধারণত এত রাতে ফোন করে না। কোনো দুঃসংবাদ? টিভির সাউন্ড কমিয়ে মোবাইল রিসিভ করলেন বজলুল হুদা। হ্যালো। কে সুফিয়া?
মামা আমি সোমা।
কিরে মা? এত রাতে?
তুমি কি ঘুমাচ্ছ?
না। টিভি দেখতেছি। হ্যা খবর বল। এত রাতে কি জন্য?
তুমি কি আমাদের বাসায় আসতে পারবে?
এখন?
কেন?
সোমা সংক্ষিপ্তভাবে তার বাবার ঘটনা বলল। সব কিছু শুনে টিভি বন্ধ করে দিয়ে বজলুল হুদা প্রশ্ন করলেন- তোর বাবার অবস্থা এখন কেমন?
ভালো না। কিসব আবোল-তাবোল বলতেছেন। তার ধারণা লোক দুইটাকে হাসপাতালে নেয়া গেলে বেঁচে যেত। একটা লোক নাকি তাকে রিকোয়েস্ট করেছিল হাসপাতালে নেয়ার জন্য। তোর বাবাকে ফোন দেতো!
বাবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। এখন ডাকা ঠিক হবে না।
তোর মা কোথায়?
জায়নামাজে বসেছে। কান্নাকাটি করতেছে।
ফোনটা দে।

 
সুফিয়ার হাতে ফোন দিল সোমা। সবেমাত্র মোনাজাত শেষ করেছেন সুফিয়া। মোবাইল নিয়ে কেঁদে ফেললেন, বজলু- বুবু কি হয়েছে বলতো!
সোমা তোকে কিছু বলে নাই?
বলেছে।
তুই কি একটু আসতে পারবি?
এত রাতে?
সকালে আসি?
ঠিক আছে আসিস কিন্তু।
হ্যাঁ আসব। দুলাভাই কি ঘুমাচ্ছে?
হ্যা
পলাশ কোথায়?
ওর ঘরে। কাল ওর একটা ভাইভা আছে।
কোন কোম্পানিতে ভাইবা?
…আমি বলতে পারব না।
ওকে একটু দাও তো।
পলাশের রুমে গিয়ে পলাশকে মোবাইল দিলেন সুফিয়া।
পলাশ একটা গল্পের বই পড়ছিল। মোবাইল হাতে নিয়ে সুফিয়াকে প্রশ্ন করল- কার ফোন?
তোর বজলু মামার।
হ্যালো মামা!
কি করতেছিস? একটা গল্পের বই পড়তেছি।
কাল নাকি তোর চাকরির ইন্টারভিউ?
ইন্টারভিউ দুইদিন আগে দিয়েছি মামা।
তবে যে তোর মা বলল- মা আন্দাজে বলেছে।
কোথায় ইন্টারভ্যু দিলি?
একটা টিভি চ্যানেলে। রিপোর্টার পদের জন্য।
তুই তাহলে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক হবি?
হ্যা মামা।

 
খারাপ না। নোবেল প্রফেশন। তবে ঝুঁকি আছে।
কোন পেশায় ঝুঁকি নাই মামা?
হ্যা এইটা ঠিক বলেছিস। তা হ্যারে তোর বাপের ঘটনাটা বল তো।
মা তোমাকে বলে নাই। না। খালি কান্নাকাটি করল। যা বলার সোমাই বলল।
তোর বাবা বোধহয় ভয় পেয়েছে।
হ্যাঁ। তবে মামা আমার কি ধারণা বলব?
বল।
বাবা যা দেখেছে সব সাজানো ঘটনা। আমার এক বন্ধুর বেলায় এরকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল।
সেটা কেমন?
গল্পের বই বন্ধ করে বিছানায় আয়েশ করে বসল পলাশ। তারপর ঘটনাটা বলতে শুরু করল- মামা এটা বছর খানেক আগের ঘটনা। রাত আনুমানিক একটা হবে। রক্তাক্ত এক লোক রাস্তায় পড়ে আছে। জবাই করা মুরগির মতো কাতরাচ্ছিল। আমার এক বন্ধু ওর নাম তন্ময়। পলাশের কথা কেড়ে নিলেন বজলুল হুদা। এত রাতে তোর বন্ধু রাস্তায় কেন?
এইটা তুমি কি বলতেছ মামা? ঢাকায় একটা দেড়টা কোনো রাত হল?
ভদ্রঘরের ছেলেরা এত রাতে বাইরে থাকে না।
তুমি কি ঘটনাটা শুনবে?
ঠিক আছে বল।
তন্ময় রিকশায় যাচ্ছিল। রাস্তায় একটা লোককে কাতরাতে দেখে রিকশা থেকে নামে। লোকটাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেয়ার পথে হঠাৎ সে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। পকেট থেকে পিস্তল বের করে তন্ময়ের বুকে ঠেকিয়ে ধমক দেয়- অয় ব্যাটা যা আছে দিয়া দে।
বজলুল হুদা আঁতকে উঠলেন। তার মানে ঘটনাটা ছিল সাজানো।
হ্যাঁ।
তারপর কি হল? তন্ময়ের কাছে হাজার খানেক টাকা ছিল। টাকা, হাতের ঘড়ি, মোবাইল ফোন নিয়ে লোকটা চম্পট দেয়। এই ঘটনার পর থেকে মামা আমি কোনো কিছুই বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা বাবার সামনে যা ঘটেছে সব কিছুই সাজানো। ভাগ্য ভালো বাবা কোনো ট্রাপে পড়েনি। হবে বোধ হয়। মন্তব্য করে টেলিফোন রাখতে গিয়ে চমকে উঠলেন বজলুল হুদা।
কে চিৎকার করছে রে?
বাবা।
আবার কি হল?
বুঝতে পারতেছি না।
আমি কি আসব?
আস। বলেই লাইন কেটে দিল পলাশ।
পাশের ঘর থেকে আজিজ সাহেবের কান্না আর চিৎকার ভেসে আসছে। হে খোদা আমাকে মাফ করে দিও… পলাশের মনে হল বাবা ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি করছে। না, এসবের কোনো মানে হয় না। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে?

 
৩.
গোঙানির শব্দ হচ্ছে। কে যেন বাঁচার জন্য আকুতি করছে। ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হচ্ছে গোঙানির শব্দ। আবদুল আজিজ কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন। ঘরের ভেতরই শব্দ হচ্ছে। কিন্তু মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে গোঙানির শব্দ হচ্ছে কোত্থেকে? আজিজ কী ভুল শুনছেন? চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করলেন। শব্দটা এখন বেশ স্পষ্ট। ভাই আমি আমি মরি নাই। বাইচ্যা আছি। আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়া চলেন। ভাই, ও ভাই… কী আশ্চার্য! এই সংলাপ তো বেশ পরিচিত। তবে এত তেজ ছিল না। বেশ ক্ষীণ ছিল। বাসযোগে অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলেন আবদুল আজিজ। শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে প্রচণ্ড জ্যামে বাস থামল। সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড়। চারদিক থেকে আরও মানুষ ভিড়ের দিকে দৌড়ে আসছে। যাত্রীদের মধ্য থেকে একজন বাসের চালককে জিজ্ঞেস করল, কি হইছে ড্রাইভার সাহেব? এক্সিডেন্ট। বিরক্ত কণ্ঠে জবাব দিল ড্রাইভার। কেউ মারা গেছে? ড্রাইভার এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হেলপারের উদ্দেশ্যে চিৎকার দিল, অয় সোলেমান দ্যাখ তো কি হইছে। সোলেমান দৌড় দিল ভিড়ের দিকে। সামনে লোকজনের ভিড় দেখে মনে হচ্ছে না সহসাই জ্যাম ছুটবে না। বাস থেকে নামলেন আবদুল আজিজ। হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন। লোকজনের চিৎকার চেচামেচিতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কোনমতে ভিড় কেটে সামনে গিয়ে ভয়ে চমকে উঠলেন আবদুল আজিজ। পাশাপাশি দুইজন মানুষ রাস্তার উপর পড়ে আছে। একজনের মুখ আকাশের দিকে। একজন উপুর হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভিজে আছে চারপাশে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত হাসপাতালের কথা ভাবা। আহতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। কয়েকশ মানুষের মধ্যে কেউই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অর্থাৎ লোক দুটোকে যে প্রথমে হাসপাতালে নেয়া জরুরি এ নিয়ে কারোই কোনো আগ্রহও নেই। তবে তামাশা দেখার স্টাইলে ভিড় করছে সবাই। কে একজন হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠল, অয় একটা মনে হয় বাইচ্যা আছে। ঐ যে মাথা লড়তাছে… হাতও লড়তাছে। অতি উৎসাহী একজন কাছে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার ভঙ্গিতে বলল, না না একটাও বাইচ্যা নাই। কিন্তু আবদুল আজিজের কেন যেন মনে হল দুজনেই বেঁচে আছে। আকাশের দিকে মুখ করে রাস্তার ওপর যে পড়ে আছে তার পাশে গিয়ে বসলেন আজিজ। মনে হল লোকটি চোখ খোলার চেষ্টা করছে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলছে- ভাই আমি মরি নাই। আমি বাইচ্যা আছি। আমারে একটু হাসপাতালে নিয়া যান। ভাই… ভয়ে চমকে উঠলেন আজিজ। কেন যেন মনে হল মৃত মানুষ কথা বলছে। চট করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আজ কি যে হয়েছে, আশপাশে কোথাও ট্রাফিক পুলিশ নাই। চারপাশে ট্রাফিক জ্যাম দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বাস, ট্রাকের অস্থির ড্রাইভারেরা বারবার হর্ন বাজাচ্ছে। আবদুল আজিজ নিজেও অস্থির হয়ে উঠলেন। মনে হল নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না। কে যেন কানে কানে বলল, আজিজ আজাইর‌্যা এই ঝামেলায় জড়াইস না। হাসপাতাল, থানা পুলিশ নানা ঝামেলায় পড়বি। তার চেয়ে পালা। ভাগ, জলদি ভাগ… দূরে কোথায় যেন একটা শব্দ হল। ইলেকট্রিকের খাম্বায় আঘাত করলে যেমন হয় তেমন শব্দ। এলাকার নাইট গার্ড খাম্বায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। কিন্তু সে হুশিয়ার, সাবধান বলল না কেন? কি আশ্চার্য, একথা ভাবতে না ভাবতেই নাইট গার্ডের সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো- হুশিয়ার সাবধান। সঙ্গে সঙ্গে ঢং ঢং শব্দ হল। বিছানায় উঠে বসলেন আজিজ। এতক্ষণ তিনি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালালেন। ঘরের ভেতর সুফিয়া ছাড়া আর কেউ নেই। বিছানায় চিংড়ি মাছের মতো কুঁজো হয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে সুফিয়া। আজিজ সুফিয়াকে ডাক দেয়ার কথা ভাবলেন। পরক্ষণেই মন শায় দিল না। বেচারি ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। লাইট নিভিয়ে নিজেও ঘুমানোর কথা ভাবলেন আজিজ। সুইচ টিপতে যাবেন এমন সময় আবার মনে হল কানের কাছে কে যেন কথা বলছে- ভাই আমি মরি নাই। বাইচ্যা আছি। আমারে একটু হাসপাতালে নিয়া যান… বিচলিত হয়ে উঠলেন আজিজ। লোক দুটো কি এখনও
রাস্তায় পড়ে আছে? কাতরাচ্ছে? আহা! ওদের ফ্যামিলির লোকজনের কি হবে? না, কাজটা ঠিক হয় নাই। লোক দুটোকে হাসপাতালে নেয়া উচিত ছিল। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। বিছানা থেকে নামলেন আজিজ। সুফিয়া যাতে টের না পায় এমন সতর্কতায় প্রথমে ঘরের দরোজা খুললেন। তারপর ড্রয়িং রুম পেরিয়ে সদর দরজার সিটকানি খুলে রাস্তায় নামলেন। রাস্তা একদম ফাঁকা। রাত কত হবে? ঘড়ি দেখে আসা উচিত ছিল। অনুমান করলেন আজিজ। আড়াইটা থেকে তিনটা হবে। এত রাতে একা যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? এছাড়া লোক দুটো নিশ্চয়ই এখন রাস্তায় পড়ে নেই। বেঁচে থাকুক অথবা মারা যাক নিশ্চয়ই তাদেরকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাসায় ফিরে যাবার কথা ভাবলেন আজিজ। তখনই আবার কানের কাছে একই শব্দ শুনলেন- ভাই আমি মরি নাই। বাইচ্যা আছি। আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়া যান। ভাই… ফুটপাত ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলেন আজিজ।
৪.
শ্যামলী মোড়ে মানুষজন নেই বললেই চলে। তবে রাস্তায় পণ্যবাহী ট্রাক এলাকা কাঁপিয়ে দ্রুতগতিতে আসছে, যাচ্ছে। ফুটপাতে ছিন্নমূল মানুষ লাশের মত শুয়ে, উপুড় হয়ে, চিৎ হয়ে পড়ে আছে। দূর থেকে জায়গাটা শনাক্ত করার চেষ্টা করলেন আজিজ। ওই তো ঐখানেই পড়েছিল দুইজন মানুষ। একজন চিৎ হয়ে অন্যজন উপুড় হয়ে। জায়গাটা তো খালি। তাহলে কী তাদেরকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে? বেঁচে আছে না মরে গেছে? এলাকার কেউ কি বলতে পারবে? দূরে ফুটপাতের ওপর একজন মহিলা একজন পুরুষকে জাপটে ধরে চিৎকার দিচ্ছে- হারামজাদা ব্যাডা, খাটাইশের গুষ্টি, অয় তোর মা বইন নাই? আমারে তুই… ভাবছস। এই যে পুলিশ ভাই, এইদিকে আসেন তো! আসেন বিচার কইর‌্যা দিয়া যান… মুহূর্তের মধ্যে কোত্থেকে যেন কিছু মানুষ ছুটে এল। ছোটখাটো একটা ভিড় দেখা দিল। একজন পুলিশ দায়সারা ভঙ্গিতে ভিড় কেটে মহিলার সামনে এসে দাঁড়াল। অয় কি হইছে? মহিলা পুরুষটির জামার কলার ধরেই রেখেছে। তার পাশে একটি বাচ্চা ছেলে ঘুম ঘুম চোখে বসে আছে। পুলিশ এবার ধমক দিল, কি হইছে? কেস কী? মহিলা চিৎকার দিল- এই খাটাসরে জিগান।
তুই বল। জোরে ধমক দিল পুলিশ। মহিলা আগের মতোই চিৎকার দিল। এই খাটাসের সাহস কত! আমি ঘুমায়া আছি। হঠাৎ জাইগ্যা দেহি আমার পাশে শুইয়া আছে। পুলিশ শান্ত গলায় লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, নাম কী? জামাল উদ্দিন। থাকেন কোথায়? কোনো উত্তর দিল না লোকটি। মহিলার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। পুলিশ হঠাৎ খপ করে লোকটির ঘাড়ে হাত রাখল- চলেন। অয় তুইও আয়… লোকটির ঘাড়ে হাত রেখেই সামনের দিকে হাঁটতে থাকল পুলিশ। ভিড় ছুটল তার দিকেই। মহিলা তার ছেলেকে কোলে নিয়ে পুলিশের পিছু পিছু যেতে চাইছে। কিন্তু ছেলেটি যেতে চাইছে না। মহিলা রেগে গোটা কয়েক কিল বসিয়ে দিল ছেলেটির পিঠে। তারপর ছেলেকে রেখে একাই পুলিশের পিছু রওয়ানা দিল। সবকিছু কেমন যেন অবিশ্বাস্য ঠেকছে আজিজের কাছে। পাশেই দুজনের কথপোকথন শুনে অবাক হয়ে গেলেন। আপনি কি মনে করতেছেন এক হাতে তালি বাজছে? মানে? মহিলারও দোষ আছে? হ্যাঁ আছে। এইটা হইল একটা নাটক। লোকটিকে ডাক দিলেন আজিজ। ভাই শোনেন। ঝাঁপ খুলে দোকানের ভেতর উঠতে যাচ্ছিল লোকটি। অবাক হয়ে আজিজের দিকে তাকাল। আজিজ এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন- ভাই রাতে এখানে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল… হ্যাঁ। একজন মারা গেছে। আরেকজনের অবস্থা খুবই খারাপ। বোধহয় বাচব না। কি হয় আপনার? মানে? যারা এক্সিডেন্ট করেছে তারা কি আপনার পরিচিত? আজিজ এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। লোকটি দোকানে উঠে বসেছে। ঝাঁপ বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আনমনে বলল- এই শহরে সাধারণ মানুষ হইল কুত্তা বিলাইয়ের মতো। চিন্তা করেন এক্সিডেন্টের পর মানুষ দুইটা রাস্তার ওপর ঘণ্টা খানেক পইর‌্যা ছিল। শত শত মানুষ ভিড় কইর‌্যা তামাশা দেখতেছিল অথচ সঙ্গে সঙ্গে যদি হাসপাতালে নেয়া যাইত, বাইচ্যা যাইত অভাগারা। যেটা মরছে সেটা নাকি কোন অফিসে চাকরি করে। মনে করেন তার ফ্যামিলির লোকজন হয়তো অপেক্ষা করতেছে… তার হয়তো একটা ছেলে অথবা মেয়ে আছে… হ্যাগো ভবিষ্যৎ কী? আচ্ছা ধরেন হেই ব্যাডা যদি সাধারণ লোক না হইয়া কোনো নেতা হইত। টেলিভিশন চ্যানেলের লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু কইর‌্যা দিত। আচ্ছা সাধারণ মানুষই তো ভোট দিয়া নেতা বানায়? তাইলে সাধারণ মানুষের এই অবস্থা ক্যান? লোকটি দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিল। আজিজ অসহায়ের মতো শ্যামলী মোড়ের ফুটপাত ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলেন।
৫.
সুফিয়াকে কোনোভাবেই থামান যাচ্ছে না। তিনি যাকেই কাছে পাচ্ছেন তাকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। অথচ আজ একটা খুশির দিন। পলাশ চাকরি পেয়েছে। টিভি রিপোর্টারের চাকরি। সাংবাদিকতা পেশা আজিজ সাহেবের খুবই পছন্দ। বাসায় থাকলে এতক্ষণে তিনি যে কী করতেন! ড্রয়িংরুমে পলাশ এবং বজলুল হুদা মুখোমুখি বসে আছেন। বজলুল হুদা রাতে আসতে পারেননি। কিন্তু সকালে খবরটা শোনার পরই ছুটে এসেছেন। তিনি কোনোভাবেই হিসাব মিলাতে পারছেন না। রাত-দুপুরে একটা মানুষ এভাবে হাওয়া হয়ে গেল। কোথায় যেতে পারে? পলাশকে তিনি আবার একই প্রশ্ন করলেন, তোর কি মনে হয়? কোথায় যেতে পারে তোর বাবা? আমি তো আন্দাজ করতে পারতেছি না। তোরা কখন বুঝলি উনি বাসায় নেই। রাত তখন ৪টা কি সাড়ে ৪টা হবে। মার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দৌড়ে গেলাম মায়ের ঘরে। দেখি ঘরে বাবা নাই। মা হাউমাউ করে কাঁদতেছেন। এখন কি করা যায় বলত? আমার মাথায় কিচ্ছু আসতেছে না। তোকে তো আজকেই জয়েন করতে হবে? হ্যাঁ। তিন মাসের ট্রেনিং। তারপর… তোর এই পেশাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। মনোযোগ দিয়ে কাজ করবি। সদর দরোজায় কলিং বেল বাজছে। পলাশের মনে হল আজিজ সাহেব ফিরেছেন। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। নাইট গার্ড সোলেমান দাঁড়িয়ে আছে। পলাশকে দেখে সালাম দিল। সোলেমানকেই খুঁজছিল পলাশ। তার কাছে আজিজ সাহেবের ব্যাপারে কোনো ক্লু পাওয়া যেতে পারে। সোলেমান দরোজা পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে বজলুল হুদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল পলাশ- মামা ও আমাদের এই এলাকার নাইট গার্ড। বাবার সম্পর্কে ও হয়তো কিছু জানতে পারে। তাই ডেকেছি। আচ্ছা সোলেমান- জি স্যার। তোমার তো কাল সারারাত ডিউটি ছিল? জি। তোমাকে কেন ডেকেছি আন্দাজ করতে পারতেছ? না। ভেবে বল। ভয়ে ভয়ে তাকাল সোলেমান- স্যার আমার কি কোনো ভুল হইছে? না। তাহলে? আমার বাবাকে চেন তো তুমি? চিনব না কেন? খুব ভালো মানুষ। কাল রাতে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। রাস্তায় কি তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে? সোলেমান চমকে উঠল। বলেন কি স্যার। আমার সঙ্গে তো দেখা হয় নাই। রাত তখন কত হবে? সুফিয়া অজ্ঞান হয়ে গেছেন। সোমা দৌড়ে এলো ড্রয়িং রুমে। বজলুল হুদাকে বলল- মামা, ও মামা সর্বনাশ হয়ে গেছে। মা কথা বলতেছেন না। হঠাৎ সারা বাসায় ভয় আর আতংক দেখা দিল। সবাই সুফিয়ার রুমের দিকে পা বাড়াল। সোলেমান মনে মনে বলল- হুশিয়ার… সাবধান…
৬.
চোখ ফেরাতে পারছেন না আজিজ। মেয়েটির দিকে তাকিয়েই আছেন। বাবার লাশের পাশ থেকে তাকে সরানো যাচ্ছে না। যেই তাকে সরাতে যাচ্ছে তাকেই জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে- আমার আব্বুকে এনে দেন, আব্বুরে ও আব্বু! চোখ খোল… মেয়েটি এখন যাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সম্পর্কে সম্ভবত তার চাচা। কাঁদতে কাঁদতে সান্ত্বনা দিচ্ছে- তিতলী, মা আমার শোন। এভাবে কাঁদিস না। তোকে শক্ত হতে হবে। লক্ষী মা আমার, শোন… আহ্হারে এভাবে কাঁদে না। তোকে অনেক শক্ত হতে হবে। এ সময় পাশেই দাঁড়ানো দুজন লোক একে অপরের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিল। এখন ফ্যামিলিটার কি হবে বলেন তো? মেয়েটার তো বিবাহ ঠিক হয়েছিল? এখন কি হবে? জয়নাল সাহেবের তো এই একটাই মেয়ে? হ্যাঁ। সাত বছরের একটা ছেলেও আছে। এটা তো ওনার ভাড়া বাসা? হ্যাঁ। বেচারা ঢাকা শহরে একটা জায়গাও কিনতে পারে নাই। অথচ তার অনেক সুযোগ ছিল। সুযোগ ছিল মানে। উনি যদি শুধু হ্যাঁ বলতেন, তাহলেই হতো। এখন ফ্যামিলিটার কি হবে বলেন তো। জয়নাল সাহেবের ওয়াইফ কি কিছু করেন? না। হাউজ ওয়াইফ। মেয়েটা কোথায় পড়ে? লালমাটিয়া কলেজে। ভালো ছাত্রী। ওর কি বিবাহ ঠিক হয়েছিল? হ্যা। পাত্রপক্ষের কেউ কি আসছে? না। এই বিয়ে হবে না। লোকটির মন্তব্য শুনে আজিজ সাহেব চমকে উঠলেন। পরীর মতো সুন্দরী এই মেয়ের বিয়ে হবে না? পরিবারটির কারও সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলবেন? কথাই বা শুরু করবেন কিভাবে? অনেক কষ্টে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঠিকানা নিয়ে জিগাতলার এই বাসায় এসেছেন আজিজ। পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে চান? কিন্তু কিভাবে? পাশেই দাঁড়ানো লোক দুটি বকবক করে চলেছেন। একথা সেকথা। হঠাৎ একজন অন্যজনকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা এক্সিডেন্টটা হল কিভাবে? ট্রাক চাপা দিয়েছে। জয়নাল সাহেব কী রিকশায় আসতেছিলেন? হ্যাঁ। রিকশাওয়ালা নাকি বাইচ্যা গেছে। হ্যাঁ। জয়নাল সাহেবকেও বাঁচানো যাইত বুঝলেন। এক্সিডেন্টের পর পরই তাকে যদি হাসপাতালে নেয়া যাইত… অস্থির হয়ে উঠলেন আজিজ। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। এখনও কারও সঙ্গে তার পরিচয় হয়নি। কাজেই চলে যাওয়াই ভালো? বাবার লাশের পাশে বসে আছে তিতলী। যাকেই পাচ্ছে তাকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আব্বু, আব্বুরে… কথা বল আব্বু কথা বল। না এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। চলে যাবার কথা ভাবলেন আজিজ। তিতলীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। বলতে ইচ্ছা করছে, মারে তুই এভাবে কাঁদিস না। থাম। থাম বলতেছি। আমরা তো আছি… লোকজন কেমন যেন সন্দেহ ভরা চোখে তাকাচ্ছে। ওরা কি জেনে ফেলেছে আজিজ ইচ্ছা করলে জয়নালকে হাসপাতালে নিতে পারত। তাহলে বেঁচে যেত জয়নাল। যাবার জন্য পা বাড়াতেই চমকে উঠলেন আজিজ। তার কানের কাছে আবার একই সংলাপ ভেসে এলো। এবার সংলাপটা আরও করুণ- ভাই আমি মরি নাই। আমি বাইচ্যা আছি। আমাকে হাসপাতালে… ভয় এবং আতংকে আজিজ সামনের দিকে দৌড়াতে থাকলেন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!