মো মোরসালিন তখন ২২ বছরের যুবক। বি.কম পাস করে এলেঙ্গা হাইস্কুলে বাণিজ্যের শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে। এখানেও ওর বাবার পরিচয়টা বেশ কাজে দিয়েছিল। ম্যানেজমেন্ট কমিটির প্রধান আকবর মিয়া ছিলেন ওর বাবার বন্ধু। তিনি খবর পেয়েছিলেন সয়ার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নজরুল মাস্টারের ছেলে সেকেন্ডডিভিশন পেয়ে বি.কম পাস করেছে। আকবর মিয়া নিজেই সাইকেল চালিয়ে সয়ায় গিয়ে মোরসালিনের সঙ্গে দেখা করে এই চাকরিটা জুটিয়ে দিয়েছিলেন। একাত্তরে মোরসালিনের বয়স ছিল মাত্র এক বছর। বাবার কোনো স্মৃতি তার মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু চাকরি এবং বিবাহের মতো তার জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাবা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন আর ঘরে ফেরেননি। কিন্তু তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে বাবাকে সে পেয়েছে। আর আমেনা তার নিজের রূপ সম্পর্কে যে কথাটি বলে তার এক বর্ণও মিথ্যা নয়। বরং সে কমই বলে।
যখন ওদের বিয়ে হয় তখন আমেনার বয়স আঠার। টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার রূপ-সৌন্দর্য ধীরে ধীরে গোলাপ কুঁড়ির মতো ফুটতে শুরু করেছে। গায়ের রং শ্যামলা, বেতস লতার মতো ছিপছিপে গড়ন। মিশমিশে কালো চুল পিঠ ছড়িয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। চোখ-মুখ ভ্রু সব মিলিয়েই একটা লাবণ্য- যা চোখে পড়ার মতোই বৈকি!
সংসারে মোরসালিনের মা ছাড়া আর কেউই ছিল না। দুই চাচা আর এক ফুপু তাকে সবসময় আদরে আদরে আর চোখে চোখে রাখত।
স্কুলে কাজে যোগদানের পহেলা দিনেই বাধল বিপত্তি। ম্যানেজমেন্ট কমিটির সহ-সভাপতি খোকা মিয়া সেদিন এলেঙ্গা বাজারের টি স্টলে বসে বেশ আয়াস করেই দুধে আর চিনিতে ভরা তার প্রিয় চায়ে ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করে ফু পেরে পেরে গরম চায়ে মুখ লাগাচ্ছিলেন- এমন সময় স্কুলের দফতরি এসে মর্মন্তুদ সংবাদটি দিয়ে বলল, সয়ার শহীদ মুক্তি নজরুল মাস্টারের পোলা এইমাত্র জয়েন অইলো। খবরটা শুনে উত্তেজনায় খোকা মিয়ার চায়ের কাপ হাতের মধ্যেই উপুড় হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে হাতে ফোসকা পড়ে গেল। রাগে ক্ষোভে সেই ব্যথার অনুভূতিটা চাপা পড়ে রইল। সে উড়ে চলে এলো স্কুলে। হেডমাস্টারের রুমে বসে সে সময় আকবর মিয়া চা খাচ্ছিলেন। রাগে থরথর করে কাঁপছিলেন খোকা মিয়া। দাঁতে দাঁত চেপে খোকা মিয়া আকবর মিয়ার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমার এত বড় সাহস আমার অনুমতি ব্যতিরেকে তুমি স্কুলে নতুন মাস্টার নিয়েছ! আমার মেয়ের জামাইও বি.কম পাস। তাকে মাস্টারিটা দেব বলে কালকেই তাদের বাড়িতে গিয়ে বলে এসেছি। আজ বিকালে মেয়ে আর জামাই আসছে। আর এর মধ্যেই তুমি একটা মুক্তির পোলারে স্কুলে ঢুকাইয়া দিলা?
আকবর মিয়া খোকা মিয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর ঠাণ্ডা নিরুত্তেজ কণ্ঠে বলেন, তুমি রাজাকার ছিলা- রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের বলত, মুক্তি। এতকাল পরও তুমি সেই মুক্তির কবল থেকে বেরুতে পারনি।
মোরসালিন এ সময় ক্লাস শেষ করে হেডমাস্টারের রুমের পাশে অবস্থিত টিচারদের কমনরুমে যাওয়ার সময় তার বাবার নাম উচ্চারিত হতে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। আকবর মিয়া তখন বলে চলেছে- মোরসালিনের বাবা মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দিয়েছিল বলেই আজ আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমরা একসঙ্গেই যুদ্ধ করেছি আর তুমি ছিলে রাজাকার। যুদ্ধের পরে আমরা মিলেমিশে দেশটা গড়ার জন্যই তো তোমাকে মাফ করে দিয়েছিলাম এবং এই স্কুল কমিটিতে আমিই তোমাকে ঢুকিয়েছি। মোরসালিনের বাবার আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ তাদের কিছুই দেয়নি। তাই বাবার ঋণ শোধ দেয়ার জন্য নয় ঋণ স্বীকার করার জন্যই আমি নিজে গিয়ে ওকে স্কুলে নিয়ে এসেছি।
খোকা মিয়া যে একজন রাজাকার ছিল- সে কথাটা লোকজন প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, আকবর মিয়া আবার জনসমক্ষে সেই প্রসঙ্গটি টেনে আনায় খোকা মিয়া কিছুটা বিব্রত হয়। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আমতা আমতা করে বলে, বিষয়টি কমিটিতে উঠতে পারত- আমি তো কমিটির একজন ভাইস চেয়ারম্যান…
আকবর মিয়া বলে, গতকাল আমরা কমিটির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তটি নিয়েছি। তোমার বাড়িতেও লোক গিয়েছিল। তারা জানিয়েছে, তুমি নাকি তোমার বেয়াই বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছ।
এমন সময় দরজার সামনে মোরসালিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আকবর মিয়া তাকে ভেতরে আসতে বলে। মোরসালিনকে দেখিয়ে আকবর মিয়া খোকা মিয়ার উদ্দেশে বলে, এই হল নজরুল মাস্টারের পোলা মোরসালিন- আমাদের স্কুলের বাণিজ্যের নতুন মাস্টার। আকবর মিয়া মোরসালিনকে এমনভাবে খোকা মিয়ার কাছে উপস্থাপন করলেন যে, মোরসালিনের চাকরিটা ফাইনাল। এ নিয়ে আর ওজর-আপত্তির কোনো অবকাশ নেই। আকবর মিয়া মোরসালিনের উদ্দেশে বললেন, তোমার খোকা চাচা সালাম দাও।
দরজার বাইরে ও যখন দাঁড়িয়েছিল, তখন খোকা মিয়া যে একজন রাজাকার ছিল- সেটা শুনেছে। ওর যখন বোঝবার বয়স হয়েছে, তখন থেকেই তার একটা উপলব্ধি হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারের সম্পর্কটা হচ্ছে সাপ আর নেউলের। সেই উপলব্ধি থেকে ও প্রথম দিনেই বুঝতে পারল এখানে চাকরি করাটা ওর জন্য সহজ হবে না। যারা দেশ আর দেশের মানুষের বিরুদ্ধে থাকে তারা খুব জটিল আর কঠিন প্রকৃতির মানুষ। ও খোকা মিয়াকে সালাম দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার করার অভিপ্রায়ে বলল, চাচা দেখেন, বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স মাত্র এক বছর। আমি আপনাদের এ রাজনীতির মধ্যে নেই। আমারে মাফ কইরা দিয়েন। মোরসালিনের কথা শুনে আকবর মিয়া খুবই আশ্চর্য হন। অনেকটা ধমকের সুরেই বলেন, এটা কি বললা মিয়া! তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে, এ তো খুবই গৌরবের বিষয়।
কিছুটা প্রতিবাদের ভঙ্গিতে মোরসালিন বলে, বুঝ হওয়ার পর থেকে তো আমি মুক্তিযুদ্ধের কিছু দেখিনি। যদি এটা এতটাই গৌরবের হবে তবে তো দেশের মানুষ এ নিয়ে গর্ব অনুভব করবে। আজ পর্যন্ত এই আপনিই আমাদের বাড়িতে প্রথম গেলেন। বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন বলে এই চাকরিটা দিলেন। খোকা মিয়াকে দেখিয়ে মোরসালিন বলে, এই উনি এটা পছন্দ করলেন না। ভবিষ্যতে অসুবিধেয় পড়তে পারি বিধায় আমি স্পষ্ট করলাম আমি যুদ্ধের রাজনীতি করি না। খোকা মিয়ার মুখটা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে ওঠে।
মোরসালিন বলে, আমাদের ডাল-ভাত খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে। আমি কোনো জটিলতার মধ্যে যেতে চাই না। আমি বরং চাকরিটা ছেড়েই দেই।
আকবর মিয়ার মুখটা এবার কঠিন হয়ে ওঠে। এটা দেখে খোকা মিয়া কিছুটা ভড়কে যায়। আকবর মিয়া গলায় গাম্ভীর্র্য এনে বলেন, কমিটির নয়জনের মধ্যে আটজনই তোমার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তুমি থাকবে। হেডমাস্টারের উদ্দেশে আকবর মিয়া বলেন, ওকে ক্লাসের রুটিনটা দিয়ে দাও।
বাড়িতে এসে মোরসালিন মাকে সব বলার পর মা খুব চিন্তিত হন। বলেন, আকবর মিয়া কেন তোমাকে এই ঝামেলার মধ্যে জড়াল! আকবর মিয়া আর খোকা মিয়া এই দুজনেই ছিল তোমার বাবার বাল্য বন্ধু। খোকা মিয়াদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। ৭১-পাক সেনারা যখন টাঙ্গাইল থেকে উত্তরে আসতে আসতে একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তখন দুপুর বেলা তোমার বাবার পরনে ছিল লুঙ্গি আর গায়ে ছিল একটা গেঞ্জি। আমাকে বলল, বউ আমার হাফ শার্টটা দাও তো। আমি তো তখন নতুন বউ-ই তার মুখের ওপর কোনো কথা বলার সাহস হয়নি। ঘরের ভেতর থেকে তার ঘিয়ে রঙের হাফ শার্টটা এনে দিলাম। বললাম, পাজামাও কি এনে দেব? তোমার বাবা আমার মুখের দিকে ক্ষণিকের তরে তাকাল। মাথা নাড়ল। বলল, ভালো থাকিস। তারপর হন হন করে বেরিয়ে গেল। বাড়ির সামনের খেতের আল ধরে। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখলাম, সূর্যের দিকে মুখ করে পশ্চিম দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। এই যাওয়াই যে তার শেষ যাওয়া হবে সেটা বোঝার বয়স আমার হয়নি।
খোকা মিয়া একদিন তার দলবল নিয়ে এসে বাড়িটা পুড়িয়ে দেয়ার কথা বললে- তাকে কিছু টাকা, কয়েকটা মুরগি আর একটা বখরি দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়।
তোমার দাদা-দাদি-চাচারা তার অনেক খোঁজ করেছে। কোথায় সে গেল, কোথায় কি করছে কেউই সঠিক কোনো খবর দিতে পারল না। একদিন প্রায় ভোর বেলায় একজন অচেনা লোক এসে আমার খোঁজ করল। ঘুমন্ত বাড়িটা হঠাৎ যেন জেগে উঠল। লোকটি বলল, আমার সময় খুব কম। একটা চিঠি আমার হাতে দিয়ে বলল, নজরুল ভাই ভালো আছেন। তার জন্য দোয়া করবেন। বলে হন হন করে মিলিয়ে গেল। মা তোরঙ্গ ঘেঁটে যক্ষের ধনের মতোই অতি সযত্নে রাখা একটি হীরের টুকরো যেন ছেলের হাতে গুঁজে দিলেন। রোল টানা কাগজে লেখা ছোট্ট একটি চিঠি। বউ, যুদ্ধে আছি। যখন তোমার কাছে শার্ট চাইলাম, তখনও জানি না। আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। দেখা হলে ভালো, না হলে মাফ কইরা দিও। আমার মনে কয় পোলাই হইব। নাম রাখবা মোরসালিন। এই নামের একটি সুন্দর পোলা যুদ্ধে এসে মইরা গেল। তার চেহারাটা এখনও চোখের সামনে ভাসে। আমার পোলাটা যদি তার মতো দেখতে অইতো! আহা কি সুন্দর ছেলেটা, গুলিটা একবারে বুকের মধ্যে লাগল। আমার পাশেই ছিল সে। ভালো থাইকো। ইতি নজরুল।
বাবার স্মৃতিবিজড়িত চিঠিটা পেয়ে বুকের ভেতরে যতটা তোলপাড় হওয়ার কথা ছিল মোরসালিনের তা হল না। এমনকি তার নামটা যে তার বাবারই দেয়া সেটাও তার মাঝে অনুরণন তুলল না। তবে বুকের ভেতর একটা হাঁসফাঁস টের পায়। নিঃশ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে সে উঠোনে যায়। তারপর হাঁটতে থাকে খেতের আল ধরে। তিরতিরে বাতাসে সবুজ ধানের গাছ একটু একটু করে দুলছিল। সূর্যের তেজটা মরে গেছে। বিদায় ঘনিয়ে আসছে বলে তার মুখটা ক্রমশ ম্লান হয়ে উঠেছে। একটা গুঁতো খেয়ে মোরসালিন খেতের আল থেকে পড়ে যায়। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখে ছিপছিপে গড়নের একটা সুন্দর মুখের মেয়ে তার পড়ে যাওয়া দেখে খিল খিল করে হাসছে। মোরসালিন তালটা সামলাতে পেরেছিল বলে খন্দের মধ্যে পড়ে যায়নি। পড়ে গেলে তো মেয়েটার সামনে কি লজ্জাটাই না পেত সে! মেয়েটার মাথায় ছাতা ধরেছে তারই বয়সী একটা কাজের মেয়ে। কাঁধে মুড়ির টিন আর অন্য হাতে একটা পোঁটলা নিয়ে কাজের একটা ছেলে হন হন করে এগিয়ে যাচ্ছিল খেতের আল ধরে। মোরসালিন অন্যমনস্ক ছিল বিধায় ওদের দেখেনি। কাজের ছেলেটার গুঁতো খেয়ে তার হুঁশ ফিরে আসে। মোরসালিন নিজেকে সামলে নিয়ে আবার আলে উঠে আসে। মেয়েটা এবং তার দুই সহচরের দিকে একবার তাকায় মোরসালিন। ওরা থমকে দাঁড়িয়েছে। মোরসালিন কিছুটা ভড়কে যায়। সে ওদের বিপরীত দিকে দ্রুত পা চালায়। ছেলেটা মুড়ির টিন আর পোঁটলা ফেলে মোরসালিনের দিকে এগিয়ে আসে। মোরসালিন একবার ভাবে দৌড় দেবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত নেয়। সে পুরুষ মানুষ এবং যোদ্ধার ছেলে। দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে। ছেলেটা ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, আপা আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসতেছে। মোরসালিন অবাক হয়। এই এত বয়স হল মা-খালা-ফুপু ছাড়া আর কোনো অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে কখনও কথা বলেছে বলে ওর মনে পড়ে না। মেয়েটি এসে বলে, মোকসেদ হল একটা ইডিয়েট। মেয়েটির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কাজের মেয়েটি বলে আর আমি একটা স্টুপিড তাইনা আপা। মেয়েটিকে ধমকে দিয়ে বলে, থাম তুই। তারপর মোরসালিনের দিকে ভালোভাবে তাকায় মেয়েটি। মোরসালিনও। চারটি চোখ যেন মিলে যায় একটি সরল রেখায়। মেয়েটি বেশিক্ষণ তার চোখ ধরে রাখতে পারে না। চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে, আপনাকে ওভাবে ধাক্কা মারাটা ওর উচিত হয়নি। যদি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতেন!
অপরাধ স্বীকার করার ভঙ্গিতে মোরসালিন বলে, না দোষটা তো আমারই। আমিই তো রাস্তা আগলে দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়েটি প্রতিবাদ করার ভঙ্গিতে বলে, তাই বলে ও ধাক্কা মারবে নাকি! মানি লোকের মান রাখতে হবে না! ওর বলার ধরন দেখে মোরসালিন হেসে ফেলে। বলে, ইউ আর ভেরি কাইন্ড হার্টেড- তোমার মনটা খুবই কোমল। বলেই সংশোধন করার ভঙ্গিতে বলে, সরি তুমি বলে ফেললাম। মেয়েটি সায় জানানোর ভঙ্গিতে বলে, তুমি বলে ভালোই করেছ। তাহলে আমিও তোমাকে তুমি বলতে পারব। পালিমার চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ে তো! তাই আমার বাবা এবং মা কেউই আমাকে কাউকে আপনি বলা শেখায়নি। পড়ি কুমুদিনী কলেজে। সেকেন্ড ইয়ারে। কদিন ছুটি ছিল। আবার ফিরে যাচ্ছি হোস্টেলে। আমার নাম আমেনা।
তোমার?
-মোরসালিন।
-তোমার নামটা সুন্দর। আমার নামটা সেকেলে…
কাজের মেয়েটি হঠাৎ মোরসালিনের দিকে তাকিয়ে বলে, উনার চেহারাটাও সুন্দর। হিরোর মতো। আমেনার মুখ কিছুটা রক্তিম হয়ে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, এই জন্য তোকে আমি কি বলি?
মেয়েটি ফোঁস করে ওঠে বলে, স্টুপিড বলেন। নাছোড়বান্দার ভঙ্গিতে মেয়েটি আবারও বলে, স্টুপিড বলেন আর ননসেস বলেন- মেয়েটি তার ডান হাতের বুড়ো আর প্রথমা আঙ্গুল দুটি একত্র করে বলে, উনি একটা হিরোই…
আমেনা ঠাট্টার সুরে বলে, আর তুই একটা হিরোইন…
মেয়েটি তার জিভ বের করে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে বলে, ছিঃ ছিঃ আপা এইটা কি কইলেন! মোরসালিনকে দেখিয়ে মেয়েটি বলে, উনি হিরো আর আপনি হিরোইন বলে সামনে দৌড় দেয়। মেয়েটিকে সমর্থন করার ভঙ্গিতে মোরসালিন বলে, ও কিন্তু মিথ্যে বলেনি-
আমেনা লজ্জা পায়। বলে, কার ব্যাপারে
মোরসালিন সহজ ভঙ্গিতে বলে, কার আবার? তোমার!
মেয়েটিকে সমর্থন করার ভঙ্গিতে আমেনা বলে, আর তোমার! তোমার ব্যাপারেও কি ও মিথ্যে বলেছে? বলে আমেনা আর কথা বাড়ায়না। হন হন করে এগিয়ে চলে। মেয়েটিও ফাজিল কম না। মোরসালিনের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বলে বাই বাই…
তারপর থেকে মোরসালিনের যে কি হল- মনটা সবসময় অস্থির থাকে। একদিন স্কুল শেষ করে টাংগাইল শহরে আসে। পায়ে পায়ে চলে আসে কুমুদিনী কলেজের সামনে। কলেজ ছুটি হয়ে গিয়েছে সম্ভবত কিছুক্ষণ আগে। মেয়েরা কলেজ গেটের সামনে জটলা করছে। সে মনে মনে ভাবে এ কি কলেজ না কারাগার! আবার ভাবে গেটটা খুলে দিলেই তো সব মেয়েরা শহরের রাস্তায় ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেবে। তার চোখ দুটো তার অজান্তেই আমেনাকে খুঁজতে থাকে। তারপর সত্যিই অবাক হয়- ওই তো আমেনা দাঁড়িয়ে! সে হাত নাড়ে। আমেনাও। তারপর আমেনা একটা পুঁটুলি ছুঁড়ে দেয় মোরসালিনের উদ্দেশ্যে। আরেক জন যুবক সেটা খুঁজে পেতে সাহায্য করে মোরসালিনকে। যুবকটা টিপ্পনি কাটে, এই তো পেয়ে গেলেন পরশ পাথর!
মোরসালিনের বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। হাত-পাও থাকে না স্থির। এদিক-সেদিক তাকায়, না কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না। পোঁটলাটা খুলে ফেলে। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে আমেনা লিখেছে- আমার মন বলছিল আজ তুমি আসবেই-আসবে। তুমি না এসে থাকতে পার না। সামনের সপ্তাহে বাড়ি যাব। দেখা হবে। ভালো থেক। ইতি আমেনা।
তারপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। মোরসালিনের মা একদিন গেল চেয়ারম্যান বাড়ি। চেয়ারম্যান বললেন, আপনার ছেলের সব খবরই আমি রাখি। মোরসালিনের বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওর প্রতি দেশের মানুষের দোয়া আছে। জীবনে নিশ্চয়ই ও দাঁড়িয়ে যাবে। সামনে আমেনার পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলেই শুভ কাজটা সেরে ফেলতে চাই। আমার মেয়েটা মাশ আল্লাহ সুন্দরী। ওর জন্যে পাত্রের অভাব হবে না। কিন্তু তাতে কি আমার মেয়ের সায় থাকবে! গ্রামের মেয়ে গ্রামের ছেলের সঙ্গেই মানাবে ভালো। কিন্তু বিষয়টা গোপন রাখাই ভালো।
স্কুলে যেতে মন চায়না মোরসালিনের। এরমধ্যে এক সন্ধ্যায় এলেঙ্গা বাজার থেকে ফিরছিল। বাজারের একটা সরু গলিতে খোকা রাজাকারের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। লোকটার চোখের আগুন দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। মনে হল সে একটা চাক্কু ওর বুকের ভেতরে আমূল বসিয়ে দেবে। সে দৌড়ে পালিয়ে গেল। এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো তার বুকের কলকব্জাগুলো দ্রুত উঠানামা করছিল। সে মায়ের কোলে মাথা রেখে স্থির হওয়ার চেষ্টা করছিল। সব শুনে মা বলল, চেয়ারম্যান সাহেব বলেছেন, বিয়ের পরেও আমেনা কুমুদিনীতেই পড়বে। তাই তোকে আর মাস্টারি করতে হবে না। শহরে থাকবি। একটা ছোটখাটো ব্যবসাও তোকে ঠিক করে দেবেন।
টাংগাইলের থানা পাড়ায় একটা ছোটখাটো বাসা নিয়ে মোরসালিন-আমেনা সংসার পাতে। আর মোরসালিন খোলে একটা কম্পিউটারের দোকান। আর বিয়ে পরীক্ষার ঠিক কমাস আগে আমেনার কোলজুড়ে এল ঠিক চাঁদের মতো একটি ছেলে, আমেনা তার নাম রাখল তপু। ছোট্ট দুঅক্ষরের নাম- তপু। তপুর বয়স যখন মাত্র এক। রাতে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আর তপুও হেসে ওঠে খিলখিল করে- সে হাসি কিছুতেই থামে না। আমেনাও গান ধরে চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো… ও রজনীগন্ধা…। আমেনার গান শুনে মোরসালিন অবাক হয়। বলে এত সুন্দর তোমার কণ্ঠ! ঘরে চুপি চুপি এসে মোরসালিন গান শুনছিল। মোরসালিনের কথা শুনে আমেনা লজ্জা পায়।
মোরসালিন আমেনাকে বলে, আমাকে কখনও কেন তুমি বলনি, এত সুন্দর তোমার কণ্ঠ- তোমার আর কোনো না-ই আমি শুনব না- কালকেই তোমাকে রতন অধিকারীর কাছে নিয়ে যাব। আমেনা কিছু বলে না। মৃদ কণ্ঠে বলে, আমার কিন্তু ইচ্ছা নজরুল সঙ্গীত শেখার। একবার পূজোর ছুটির পরে আমাদের কলেজে গানের আসর বসেছিল। আমাদের সহপাঠিনী তপতির বোন শিপ্রা দি একটা নজরুলের গান গেয়ে সবাইকেই কাঁদিয়েছিলেন। কথাগুলো এখনও যেন কানে বাজে… ওর নিশিথ সমাধি… গুন গুন করে গানের কয়েকটি কলি গায় আমেনা। মোরসালিন অবাক হয় বলে, তোমার বাবা এত ভালো মানুষ, তোমাকে গান শিখতে দেননি- এটা ঠিক মেনে নেয়া যায় না।
হাসতে হাসতে আমেনা বলে, গুন গুন করে গাইতেই আমার ভালো লাগে। আর এখন তপুই আমার সব- গান টান লাগবে না। তপুও সায় জানায়। খিলখিলিয়ে আবার হেসে ওঠে।
বিএ-টা পাস করার পর তপুকে নিয়েই থাকে আমেনা। আর তপুটাও মায়ের বুকে মুখ গুঁজে থাকে সারাক্ষণ। তপু স্কুলে যায়। ছুটি হলেই দৌড়ে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। অন্য মায়েরা এ দৃশ্য দেখে বলে, ছেলে তো আর চিরকাল খোকা থাকবে না! আরেক মা একটু ভারিক্কি কিসিমের। সুযোগ পেলেই জ্ঞান দেন। তিনি একদিন বললেন, যেসব ছেলে ও মেয়েরা মায়ের নেউটে হয় তাদের জ্ঞানের বিকাশ হয় না। মনোবিজ্ঞানীরা তাদেরকে হ্যান্ডিকাপ চিলড্রেন বলে। কিছুটা উষ্মার সঙ্গে আমেনা তাকে বলে, আই লাইক মাই হ্যান্ডিকাপ সান- বলে মাথাটা একদিকে কাত করে তপুকে নিয়ে অপেক্ষমাণ রিকশায় গিয়ে ওঠে।
সেই তপু বড় হয়। কলেজে ভর্তি হয়। মা-বাবা চেয়েছিল, তপু ঢাকায় পড়বে। তপুর অনেক বুদ্ধি। বলেছিল, এক ছেলেকে পড়াতে গিয়ে তোমরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবে! বাবা বলেছিল, এক ছেলে পড়াবার সামর্থ্য আমার আছে। তপু বলেছিল, মাকেও যে আমার সঙ্গে যেতে হবে। বুড়ো মানুষের মতো মুখ করে তপু বলেছিল, তোমাদের আক্কেল পছন্দ আর কোনো কালে হবে। বাবার দোকানের পাশে মাও একটা কোচিং স্কুল খুলেছে। অংকে তপু খুব ভালো। মাঝে মাঝে সে অংকের ক্লাস নেয়। আর ধীরে ধীরে একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে। বাবার ব্যবসায় আর মার স্কুলে তপু অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
আমেনা খেয়াল করে তপুরই প্রায় সমবয়সী একটি মেয়ে তপুর সঙ্গে ঘুর ঘুর করে। একদিন বিকালে তপু দোকানে আসেনি। মেয়েটি বারবার এসে ঘুরে যাচ্ছে। দেখে আমেনার মায়া হয়। মেয়েটিকে ডাকে। বলে, তপুকে খুঁজছ? আমেনা ভেবেছিল, মেয়েটি হয়তো খুব লজ্জা পাবে। কিন্তু সে রকম কোনো অভিব্যক্তি তার মুখে ফুটে ওঠল না। স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল, হ্যাঁ। কিছুটা বিরক্ত মুখেই বলল, বারবার মোবাইলে কল দিয়েও পাচ্ছি না। তপুর মার মুখটা বিষাদে ছেয়ে যায়। তপুকে যেন মেয়েটি তার কাছ থেকে তার অজান্তেই কেড়ে নিয়ে গেছে। তপুর নীরবতায় সে যেন তার মার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
তপু যে সত্যি বড় হয়ে গেছে এবং তার একজন বন্ধু আছে। আছে একটা আলাদা জগত সেটা অনুধাবন করে আমেনার খুব অস্বস্তি লাগে। বিষয়টা স্বাভাবিক করার জন্যে আমেনা মেয়েটিকে বসতে বলে এবং ঠাণ্ডা কিছু পান করবে কিনা জানতে চায়। মেয়েটি অভিমানী কণ্ঠে বলে, আমি ঠাণ্ডা গরম কিচ্ছুই খাব না। যেতে যেতে বলে, তপুকে বলবেন, আমি খুব মাইন্ড করেছি। মেয়েটির মোবাইল বেজে ওঠে। মেয়েটি খুব ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কথা বলতে বলতে এগুতে থাকে। আমেনার বুঝতে বাকি থাকে না, এ তারই গুণধর পুত্র মেয়েটির মান ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমেনাও জেদী হয়ে ওঠে। মোবাইলে কল দেয়। লাইন ব্যস্ত। পেছন থেকে তপু সেই তার ছোট্ট বেলার অভ্যেস মতো মাকে জাপটে ধরে। আমেনাও আর কোনো ভণিতা না করে স্পষ্ট জানতে চায়- কে সেই মেয়েটি। তপুও সহজে ধরা দিতে চায় না। বলে, মেয়ে! কোন মেয়ে? আমেনা ছেলের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, যে মেয়েটির সঙ্গে এতক্ষণ মোবাইলে কথা বলছিলি!
তপু স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে অনুসূয়ার কথা বলছ?
আমেনা অনুযোগের সঙ্গে বলে, আমি তো তার নাম জানিনে আর মেয়েটা আমাকে খুব একটা পাত্তাও দিল না- পরক্ষণেই আমেনার মনে পড়ে যায় মেয়েটির নাম! অনুসূয়া- এ তো মুসলমান নাম নয়- কিরে মেয়েটি হিন্দু নাকি!
তপু আবারও মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ও একটা মেয়ে, আমার বন্ধু- ফেসবুকের পাতায় পেয়েছি ওকে… তোমাকে ওর কথা বলব বলব করে আর বলাই হয়নি…
আমেনা অভিমানে ঠোঁট ফোলায়। বলে, তার আর সময় কোথায়?
তপু মার কথায় গুরুত্ব না দিয়েই বলতে থাকে। জান মা- অনুসূয়ার মা নেই। বাবা সি অ্যান্ড বি ইঞ্জিনিয়র। ওরা নতুন এসেছে এখানে। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। বাবার সময় নেই- অনুসূয়ার মা নেই শুনে আমেনা মুষড়ে পড়ে বলে বলিস কি! ওকে এক্ষুণি কল দে- মার কথা শুনে তপু হাসে। বলে, কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা কর, তপুর কথা শেষ না হতেই তপুর মোবাইল বেজে ওঠে। কথা বলতে বলতে তপু ভুলেই যায় তার মার অস্তিত্বের কথা। কথা বলতে বলতে তপু এগিয়ে যায়।
আমেনা একবার ভাবে তপুকে ডাকে। পরক্ষণেই ভাবে তপু যেভাবে তন্ময় হয়ে কথা বলছে তাতে নিশ্চয়ই ওর ডাক শুনতে পাবে না। একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে বুকের ভেতর। ভাবে খাঁচা ছেড়ে পাখি যেভাবে উড়ে যায় তেমনি ওর বুকের মাঝে আবদ্ধ খাঁচা থেকে তপু যেন বেরিয়ে গেল। অনতি দুই তরুণের মিলনের যে আকাক্সক্ষা যে তীব্রতা তাকে রুখে দেবার শক্তি যে কারও নেই- এমনকি মা-রও না। এটাই বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমেনা লাটিমের মতোই ঝিম ধরে বসে থাকে।
মোরসালিন স্ত্রীর মুখে এক খণ্ড মেঘ দেখে কিছুটা ভড়কে যায়। শুধোয় ওমন করে মুখ ভার করে বসে আছ যে! জলভরা চোখে আমেনা তাকায় স্বামীর দিকে। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে, আমাদের তপু হাতছাড়া হয়ে গেল! আমেনার কথা মোরসালিন বুঝতে পারে না। সে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকায় আমেনার দিকে- বলে, ওই যে হিন্দু মেয়েটি… মোরসালিনের মুখে এবারে হাসি ফুটে ওঠে। বলে, অনুসূয়ার কথা বলছ? ও তো খুব ভালো মেয়ে। তপু তাকে পরীক্ষায় খুব সাহায্য করছে বলে ওর বাবা মোবাইলে এই তো গতকালই আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। ওর বাবা ঠাট্টা করে ওদের বলে লাভ বার্ডস! আমেনা ফোঁড়ন কেটে বলে এ সব মানুষ পোলাপানদের বেশি আসকারা দেয়! ধিঙ্গি ছেড়ি তাকে শাসন করবে না? মোরসালিন হাসে। বলে, মা-মরা মেয়েকে বাবা কি শাসন করবে! আমেনা লজ্জা পায়। ভাবে তার মন তো এত ছোট নয়- মেয়েটার সম্পর্কে কত আজেবাজে কথা বলল সে!
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আমেনা বলল, একদিন মেয়েটি আর তার বাবাকে বল না আমাদের এখানে খেতে! মোরসালিন যেন আমেনার মুখ থেকে এ কথাটি শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বলে, একদিন কেন এক্ষুণি বলে দিচ্ছি। এ কথা শোনার পর আমেনা তার মুখের ঘোমটা টেনে দেয় যেন অনুসূয়ার বাবা এই সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে!
মোবাইলে মোরসালিনের নেমন্তন্ন পেয়ে অনুসূয়ার বাবাও রসিকতা করতে ছাড়ে না। বলে, তপুর মা মানে আমার দিদির থেকে নেমন্তন্ন না পেলে তো আমি আসতে পারি না। মোরসালিন মোবাইলটা আমেনার দিকে এগিয়ে দেয়। আমেনা বলে, দাদা আসেন। অনুসূয়ার বাবা বলে, বোনের বাড়িতে ভাই যাবে তাতে তো নিমন্ত্রণের প্রয়োজন নেই। এমনিই মস্করা করলাম আর কি! কাজ-কর্ম নিয়ে তো খুব ব্যস্ত থাকি- আসব একদিন।
ছোট্ট মফস্বল শহরের জীবন প্রায়শই নিস্তরঙ্গ। কিন্তু তপুর ব্যস্ততার শেষ নেই। কলেজ, কম্পিউটারের দোকান, অনুসূয়াকে ম্যাথে সাহায্য করা- তার মোবাইলটা বেজে চলে বিরামহীন। যাই কিছু হোক- তপুর জীবনে একটাই দুষ্টুমি- সারা দিন ও যেখানেই থাকুক না কেন- পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে চমকে দেয়া। আর প্রতিবারই ওর মা আঁতকে উঠবে- এটা দেখেতে তপু বেশ মজা পায়। আর মাঝে মধ্যে তপু ইচ্ছে করেই মার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। মা যখন ব্যাকুলভাবে খুঁজে তপুকে ও ঠিক গুটিসুটি মেরে ঠিক পেছন থেকে এসে মাকে জড়িয়ে ধরবে। ছেলে হারানো মায়ের উৎকণ্ঠা এবং ফিরে পাওয়ার স্বস্তি বেদনা আর হাসির সমীকরণ- এ যেন অংকেরই একটা জট খোলার প্রচেষ্টা মনে হয় তপুর কাছে। কক্সবাজারে গিয়ে সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউয়ের মাঝে তলিয়ে গিয়ে আবার উপরে উঠে আসছিল তপু। সমুদ্রের বালুকা বেলায় এই দৃশ্য দেখে বাবা-মা বেশ মজাই পাচ্ছিল। এক সময় ওরা লক্ষ্য করে তপু তো আর উঠে আসছে না। মার শরীরটা হিম হয়ে আসে। মোরসালিনকে কথাটা বলতে সাহসও পায় না আমেনা। আর পেছন থেকে সেই চেনা, উষ্ণ দুটি হাত আমেনাকে জড়িয়ে ধরে। আমেনা এই প্রথম ছেলেকে ভৎর্সনা করেন। আর ছেলেও অভিমানে গাল ফোলায়। তারপর অনেক সাধ্য-সাধনা করে ওরা ছেলের মান ভাঙ্গিয়েছিল।
ছোট্ট শহরটা হঠাৎ করে একটা গতি পায়। ঢাকার শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দোলা এসে লাগে এখানেও। শহরের কেন্দ্রস্থলে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে প্রতিদিন বিকালে শহরের তরুণ-তরুণীরা এখানে জমায়েত হয়। বয়োভারে বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা ৭১-এর যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন। দিনে দিনে এখানে সমাগম বাড়ে। মোরসালিনের বয়স তখন এক। হারানো বাবার কথা মনে করে মাঝে মাঝে ওর চোখ দুটি অশ্র“ সজল হয়ে ওঠে। একদিন ও আমেনার কাছে ধরা পড়ে যায়। গুটিসুটি মেরে তপু ঘরে এসে মাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরতে যাবে এমন সময় ওর দাদার কথা শুনতে পায়। আর তপু লাফিয়ে ওঠে- হোয়াট! মাই গ্র্যান্ড ফাদার ওয়াজ অ্যা ভেলিয়ান্ট ফ্রিডম ফাইটার- ওহ্ মাই গড… আই অ্যাম অ্যা গ্র্যান্ড সান অব অ্যা ফ্রিডম ফাইটার! স্বাধীনতার পেছনে আমাদেরও কনট্রিবিউশন আছে! মোরসালিন কিছু বলে না। আমেনাই তপুর দাদার বীরত্বগাথা বলতে থাকে। তপু অবাক বিস্ময়ে বলে, মাই গ্র্যান্ড ফাদার ওয়াজ অ্যা মার্টার! তপু বাবার দিকে তাকিয়ে চোখেমুখে বিরক্ত মাখিয়ে বলে, তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বিহেভ লাইক অ্যা টাইগার নট এজ অ্যা ক্যাট… আমি আমার ব্লগে আজই ঘোষণা দিচ্ছি হু ইজ আই এ্যাম বলে উত্তেজনায় টগবগ করতে করতে তপু বেরিয়ে যায়।
মোরসালিন কিছুটা ঘাবড়ে যায়। বলে, তপুকে কথাটা বলে কি ভালো করলে? আমেনা অবাক হয়। বলে, বিষয়টি নিয়ে তোমার এই লুকুচুরি আমার একদম পছন্দ নয়। মোরসালিন ততধিক কালো মুখ করে বলে, তুমি তো ওদের চেন না। আমি চিনি। তারা পারে না এমন কাজ নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোরসালিন ঘর থেকে বেরোয়।
রক্তের টান। পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হয় মঞ্চের দিকে। দেখে খোকা মিয়া এক কোণায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনছে। মোরসালিনের মুখ থেকে রক্ত সরে যায়। কদিন আগে শুনেছিল, খোকা মিয়ার ভাইয়ের ছেলেটা নিখোঁজ অনেকদিন। ছেলেটার শ্বশুর বাড়ি থেকে এসে বউটাকে নিয়ে গেছে। দশ/বারো বছরের একটা ছেলেও ছিল। বউ চেয়েছিল ছেলেটাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু তার পরিবারের লোকজনরা তাকে অন্যত্র বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ছেলেটাকে তারা এখানেই রেখে যায়। কাজের লোকের মতোই তাকে খাটাত। সপ্তাহ দুয়েক আগে ছেলেটার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে পাশের বিল থেকে। লোকজনের সন্দেহ, ভাইয়ের ছেলের সম্পত্তি হাত করার উদ্দেশ্যেই নাকি তাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। আমেনার সঙ্গে এ সব নিয়ে কখনও আলোচনা করে না মোরসালিন। ভাবে যুদ্ধের প্রতিপক্ষ বাবার সূত্রে সে তারও যেন প্রতিপক্ষ। সেটা স্কুলে তার চাকরিপ্রাপ্তির ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিষয়টি তার বুকের মাঝেই চাপা দিয়ে রেখেছে। মোরসালিন চায়নি আমেনা তাকে নিয়ে সব সময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকুক। কিন্তু ছাই চাপা দিয়ে যেমন ভেতরের আগুন দাবিয়ে রাখা যায় না- তেমনি বিষয়টি ক্রমশঃ মোরসালিনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
মোরসালিন নিজেকে হালকা করার জন্য আমেনাকে সবকিছু খুলে বলে। আমেনা তাকে আশ্বস্ত করে বলে, মনে হয় না সে তোমার সঙ্গে এখন কোনো দ্বন্দ্বে জড়াবে। মোরসালিন যেন আপন মনেই বলে, কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে তার চোখ দুটি যেন জ্বলে ওঠছিল। ভয়ংকর সেই চোখ। তুমিও দেখলে ভয় পেয়ে যেতে। এই এতক্ষণে আমেনাও যেন কিছুটা ঘাবড়ে যায়। কিন্তু তপুকে কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না। সে একদিন মঞ্চে ছোটখাটো একটা বক্তৃতাও দিয়ে ফেলে। মুহুর্মুহু করতালিতে তার বক্তৃতা সভায় আলোড়ন তুলে।
আড়ালে দাঁড়িয়ে খোকা মিয়া তপুর বক্তৃতা শুনছিল। মোরসালিনের সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়। তার চোখের ত্র“রতা দেখে মোরসালিন কিছুটা আতংকিত হয়। হঠাৎ-ই ওর মনে হয় শকুনের যেন একটা থাবা তপুর দিকে এগিয়ে আসছে। সে দ্রুত মঞ্চে গিয়ে তপুকে শকুনের হাত থেকে আগলে রাখার জন্য তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তপু ভাবে ওর বাবা খুশি হয়ে ওকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। সে বাবার হাত ধরে উপস্থিত দর্শকদের সামনে বাবাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলে- এই আমার মুক্তিযোদ্ধা দাদার একমাত্র পুত্র এবং আমার বাবা। দর্শকরা করতালি দিয়ে পিতা-পুত্রকে স্বাগত জানায়। কুণ্ঠার বদলে এই প্রথম মোরসালিন বেশ গর্ব অনুভব করে। আবেগ উদ্বেলিত কণ্ঠে বলে, বাবা যখন যুদ্ধে গিয়েছিলেন তখন আমার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। আজ এতকাল পরে আমি যেন আশপাশে আমার বাবার উপস্থিতি টের পাচ্ছি। দর্শকরা আবারো করতালি দিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানায়।
পিতা-পুত্র যেন একটা গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে বাড়ি ফেরে। সব শুনে আমেনা আফসোস করে বলে, এ রকম একটি ঐতিহাসিক ঘটনার আমি সাক্ষি হতে পারলাম না।
তারপর থেকে পরিবারের তিনজনই রোজ সন্ধ্যায় মঞ্চে যায়। একদিন মোরসালিনের মনে হয় সে দোকানে তালা না দিয়েই চলে এসেছে। দোকানের পাশেই একটা গলি পথ। সেখান থেকে হঠাৎ খোকা মিয়া এতক্ষণ যেন ওঁৎ পেতে বসেছিল। মোরসালিন তাকে দেখে অবাক হয়। বলে আপনি? আমার তো এ সময়ে ফেরার কথা ছিল না। মনে হচ্ছে আপনি যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন! খোকা মিয়া বলে, দেখলাম, দোকানে তালা না দিয়েই চলে গেলে- ভাবলাম ওখানে গিয়ে তো তোমার ঠিকই মনে পড়বে এবং ফিরে আসবে। আমার ধারণাই ঠিক হল। খোকা মিয়ার কথা শুনে মোরসালিন অবাক হয়। তার মুখের ভাষা পড়ে মোরসালিন বুঝতে পারে- তাকে সে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু এবারে মোরসালিন ভয় পায় না। সে একজন মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত সন্তান। রাজাকারকে ভয় পাবে কেন? সে চোখ-মুখ শক্ত করে বলে, আপনি মনে হয় আমাকে কিছু বলতে চান?! খোকা মিয়া বলে, তুমি বুঝলে কি করে? মোরসালিন বলে, আপনার মুখ দেখে। খোকা মিয়া হাসে আর মাথা নাড়ে। বলে, তোমাদের মাঝে একটা আবেগ এসে গেছে। বর্ষায় নদীতে যেমন আসে। তবে একটা কথা তোমাকে বলতে চাই- অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার ফল অনেক সময় ভালো হয় না। শুনছি তোমার ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালো- তোমাদের একটাই ছেলে। সোনার ধন মানিক। তার কথা মাথায় রেখ। হঠাৎ মোরসালিনের রক্ত মাথায় ওঠে যায়। সে চিৎকার করে বলে কি বলতে চান আমার ছেলের ব্যাপারে?
খোকা মিয়া মুখটা কঠিন করে বলে, অত চেঁচাইওনা। কিছু যদি একটা ঘটে যায়… মোরসালিন নিজেকে আর সামলাতে পারে না। বলে, কিছু একটা ঘটে যায় মানে কি? রাজাকার তোরে খুন কইরা ফালামু। কৌতূহলী লোকজন দাঁড়িয়ে যায়। খোকা মিয়া আর কথা বাড়ায় না। সে আত্মগোপন করে।
মোরসালিন দোকানে তালা লাগিয়ে দ্রুত মঞ্চে ফিরে যায়।
কেউ একজন তখন বক্তৃতা করছিল। মোরসালিন তার হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে বলে, এই মাত্র একজন রাজাকার আমাকে শাসিয়ে গেল। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে…। যুদ্ধে আমার বাবা প্রাণ দিয়েছেন- আবার যদি একটা মুক্তিযুদ্ধ হয় তবে বাবার মতো আমিও প্রাণ দিতে প্রস্তুত। মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকারের ভ্রুকুটি সহ্য করতে হবে কেন? জনতা স্লোগান দেয়। ৭১-এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।
যে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে মোরসালিনের তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। সেই মোরসালিন এখন সেই যুদ্ধটাকেই যেন সে হৃদয়ে ধারণ করেছে। যে খোকা মিয়াকে দেখে সে এতদিন ভয়ে ভয়ে থাকত সে তাকে একটা শিক্ষা দেয়ার জন্য খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু কোথায় সে!
মাঝে একদিন ভোরবেলায় ঢাকা গিয়ে দোকানের কিছু মালপত্তর কিনে ফিরে আসে সন্ধ্যায়। বাসায় গিয়ে দেখে আমেনা একা রান্নাবান্না করছে। তপু নেই। মোরসালিন জানতে চায় তপু কোথায়? আমেনা বলে, ও তো বিকালে বলে গেল অনুসূয়াদের বাসায় যাচ্ছে। এরপর থেকে কল দিচ্ছি কিন্তু লাইন পাচ্ছি না। মোরসালিন অবাক হয়। লাইন পাচ্ছ না মানে কি? আমেনা আবার কল করে তপুর মোবাইলে। তপুর বিরক্তকর কণ্ঠ শোনা যায়। এত কল দিচ্ছ কেন? মোরসালিন আমেনার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে বলে, তুমি এখন কোথায় বাবা? তপু বলে, বাসায় আসছি। বলে তপু লাইন কেটে দেয়। মোরসালিন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আমেনা বলে, তোমার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। ও তো আসছেই। মোরসালিন কোনো কথা না বলে দ্রুত বাসার থেকে বেরিয়ে যায়।
রিকশা ও সিএনজি টেম্পো সবই তার পাশ কেটে যায় কিন্তু তপুকে সে দেখে না। তারপর দোকানে যায়। দোকান থেকে আবার বাসায়। তপু ফেরেনি। আমেনা তাকে আশ্বস্ত করে। অনুসূয়ার মোবাইল নাম্বার জানা নেই। মোরসালিন কল করে তার বাবাকে। বাবা বলে, আপনার শ্রীমান তো আমার সঙ্গে। ওকে এক্ষুণি নামিয়ে দিচ্ছি। মোরসালিনের হিম হয়ে যাওয়া শরীরে আবার রক্তের সঞ্চালন হয়। আমেনা আঁচল দিয়ে মোরসালিনের ঘাম জড়িত মুখটা মুছে দেয়। তারপর মাথাটা টেনে নেয় তার বুকে।
ছেলের জন্য ঢাকা থেকে যে জিন্সের প্যান্ট ও টি-শার্টটা এনেছিলেন কলেজে যাওয়ার সময় জিন্সের প্যান্টটা ঠিকই পড়েছে তবে ওর গায়ে চাপানো সুন্দর টি-শার্টটা তো মোরসালিনের কেনা নয়! কিন্তু তপু তো নিজের থেকে কোনো কিছু কেনে না। হয়তো বড় হয়েছে নিজেই সখ করে একটা শার্ট কিনেছে। ছেলে বড় হচ্ছে। নিজেরও একটা রুচি গড়ে ওঠেছে। কৌতূহলবশতঃ মোরসালিন ছেলেকে শুধায়- শার্টটা কবে কিনলি? হাতে ঘড়ির ফিতে বাঁধতে বাঁধতে তপু অকপটে বলে, শার্টটা আমি তো কিনিনি।
-তবে কোথায় পেলি? বাবা শুধায়।
-অনুসূয়া দিয়েছে। বলে তপু কলেজে চলে যায়। বাবা স্বর কিছুটা উঁচুতে তুলে বলে, মোবাইলটা বন্ধ রাখবিনা কখনও…
-কেন বাবা! তপু জানতে চায়।
-কলেজ থেকে ফিরে এলে বলব। বাবা উত্তরে বলে। তপু তার প্রিয় সাইকেলে পেডেল মারে।
আমেনার সঙ্গে অনুসূয়ার একটা সখ্য গড়ে ওঠেছে। মাঝে মাঝে ক্লান্ত অনুসূয়া তার মাথাটা এলিয়ে দেয় আমেনার বুকে। আমেনাও মাঝে মাঝে চুলে বিলি কেটে দেয়। বলে, এত সুন্দর চুল তোমার তেল দাওনা কেন? অনুসূয়া দাঁতে মুখে বিরক্তি এনে বলে, আই হেট দ্যাট। অনুসূয়া একদিন তার মার ছবিও আমেনাকে এনে দেখিয়েছিল। খুবই সুন্দরী ছিলেন তিনি। অনুসূয়া তার সব কিছুই পেয়েছে। যাবেন বলেই বোধ হয়, মেয়েকে সব দিয়ে গেছেন।
অনুসূয়াই প্রথম খবরটা জানালো আমেনাকে। দুপুর থেকে তপুকে সে লাইনে পাচ্ছে না। এ পর্যন্ত কম করে হলেও বিশটা মিস কল দিয়েছে সে। একটারও জবাব আসেনি। আমেনার বুকের ভেতরাটা ছ্যাৎ করে ওঠে। বলে, বলকি! ও তো সকালে দিব্যি কলেজে গেল। একটু পরে তপুর এক সহপাঠী তপুর প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে এল। কলেজ ছুটি হয়ে গিয়েছে। তপুর সাইকেলটা স্ট্যান্ডেই পড়ে ছিল। ভাবলাম ও ভুলে গিয়েছে। তাই নিয়ে এলাম।
তপুর বাবার আশংকাই ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে যেন। সন্ধ্যা অবধি তপুর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। তপুদের দোকানে অনেক লোকজন আসছে। অনুসূয়া আমেনার পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তপু ওর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। মোবাইলের মাধ্যমে কথা হচ্ছে নয় তো এসএমএসের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বার্তার বিনিময় হচ্ছে। যোগাযোগ থেমে নেই। সেই তপু সবকিছু কাট আপ করে থাকতে পারে এটা অনুসূয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
তপুদের বাড়িটা লোকজনে ভরে গিয়েছে। এক সময় পুলিশও এসে খোঁজ-খবর নেয়। সবার চোখে-মুখে বিস্ময়- এই রকম একটা জলজ্যান্ত ছেলে নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল। এক সময় মোরসালিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, আমার যা কিছু আছে আমি সবকিছু দিতে রাজি- তবু আমার ছেলেটারে আপনারা এনে দেন। অপুর কলেজের শিক্ষকসহ ছাত্রছাত্রীরা সবাই ছুটে এসেছে। এক তরুণ ছাত্র নেতা বলে, প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আমাদের এখন উচিত ঢাকা-টাঙ্গাইল রোড অবরোধ করা। মোরসালিনের বাবা বলে, না বাবা এই অবরোধে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। মানুষকে কষ্ট দিতে চাই না বাবা। ছাত্রনেতা রুষ্ট হয়ে বলে, আমাদের তো এখন একশন চাই চাচা। মোরসালিনের বাবা দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করে বলে, এ একশন আমি চাই না বাবা।
তপুকে নিয়ে ছোট্ট শহরে একটা তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।
রাতভর খোঁজাখুঁজির মধ্যে কাটল। ভোরবেলায় সেই মর্মন্তুদ খবরটা পাওয়া গেল। পার্কের কোনায় তপুর লাশের সন্ধান মিলেছে। আমেনা খবরটা শোনার পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে তাকে নিয়ে গিয়েছে। অনুসূয়া কাঠ হয়ে বসেছিল তপুদের বাড়িতে- তপুর মায়ের পাশে। তপুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর অনুসূয়ার বাবা এসে অনুসূয়াকে নিয়ে যেতে চাইলে অনুসূয়া কোনো কথা বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। অনুসূয়ার অনঢ় ভঙ্গি দেখে ওর বাবাও আর কিছু বলতে সাহস পায় না। তবে মোরসালিনের আচরণ ছিল অন্যরকম। সে কোনোরকম কান্নাকাটি করছে না। শুধু বলছে, তোমরা আমার ছেলেটাকে নিয়ে এস। ডাক্তারকে বল, কাটাছেঁড়া করার দরকার নেই। আমার ছেলেটাকে তোমরা আর কোনো কষ্ট দিও না। মোরসালিনের কথা শুনে সবাই রুমালে চোখ মুছে।
কিছুক্ষণ পরে তপুর লাশটা নিয়ে আসা হয়। পরণে ছিল বাবার দেয়া জিন্সের প্যান্ট আর অনুসূয়ার দেয়া সুন্দর টি-শার্টটা। পুরো গেঞ্জিটা ছিল রক্তাক্ত। তপুর লাশ দেখে তার কলেজের ছাত্ররা সহ্য করতে না পেরে রাস্তায় রিকশা-গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে দেয়। তপুর বাবা ওদেরকে নিবৃত্ত করে। বাবারা মানুষকে কষ্ট দিও না।
তপুর খুনের ব্যাপারে পত্রিকায় নিয়মিত ফলোআপ খবর ছাপা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ছেলেরা আসে তপুদের বাড়িতে। এ রকম ঘটনার জের বড়জোর সপ্তাহ দুয়েক থাকে। কিন্তু তপুর ব্যাপারটা দিনে দিনে ডালাপালা ছড়াচ্ছে। এক তরুণ মেধাবী ছাত্রকে কেন এভাবে প্রাণ দিতে হল! এতে কার কি সিদ্ধি হল- এর চূলচেরা বিশ্লেষণ পত্রিকার কলামে ছাপা হয়। টক শোতেও বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। কোথাও কোথাও আবার প্রতীকী অনশন ধর্মঘটও পালিত হয়।
মোরসালিন পুলিশকে সব ঘটনা খুলে বলায় তারা সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে খোকা মিয়াকে গ্রেফতার করে। পুলিশ রিমান্ডে খোকা মিয়া স্বীকারুক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়। দ্রুত চার্জশিটও দিয়ে দেয়। খোকা মিয়া যে খুনিকে ভাড়া করেছিল- তার নামও বলে দেয়। তারপর খুনি নিজেই এসে থানায় আত্মসমর্পণ করে। তপু হত্যা মামলা বেশ গতিও পেয়েছিল। তপুর মা-বাবা পুলিশি তৎপরতায় বেশ সন্তুষ্টও ছিলেন।
আমেনার চেয়ে মোরসালিনের কষ্টা যেন আরও বেশি। একদিন দুটো ব্যাগে ওদের প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় গুছিয়ে মোরসালিন বলে, চলো গ্রামে ফিরে যাই। আমেনাও যেন মনে মনে তৈরি হয়েই ছিল। তাই আর কথা না বাড়িয়ে একটা রিকশায় গিয়ে ওঠে। প্রতিবেশী খালেক সাহেব বলে, ঘর-দুয়ার খুলে রেখেই কোথায় যাচ্ছেন? মোরসালিন বলে, গ্রামে। খালেক সাহেব বলে, তালা-টালা দিয়ে গেলেন না- চোরে এসে তো সব নিয়ে যাবে। মোরসালিন বলে, আমরা আর ফিরে আসছি না।
তারপর গড়িয়ে গেছে বছর দশেক। দেশে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এর মাঝে একটা খবর দেশে আলোড়ন তুলে। তপু হত্যার বিচার এবার হাইকোর্টে ওঠেছে। পত্রপত্রিকাও বেশ গরম হয়ে ওঠেছে। খবরটা মোরসালিন আর আমেনার কাছে গিয়েও পৌঁছায়। মোরসালিন বেশ বুড়া হয়ে গেছে। আমেনাও। দুঃখ-বেদনা তাদেরকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে গেল! ওরাও ব্যাগ গুছিয়ে হাইকোর্টের উদ্দেশে রওনা দেয়। এর পরপরই সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফারা ওদের খোঁজ নেয়ার জন্য গ্রামেও আসে।
খোকা মিয়াকে আনা হল আদালতে। সে হাঁটতে পারে না। এল ট্রলিতে। মোরসালিন আর আমেনা দেখল তাদের ছেলের হত্যাকারীকে। বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমেনার। লোকটার প্রতি তার সব ঘৃণা বুকের মধ্যে একটা দলা পাকালো। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। মোরসালিন আমেনার এই ব্যথটা অনুভব করতে পারে।
বাদীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন, ব্যারিস্টার অনুসূয়া (এই অনুসূয়া তপুর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী)।
বিচারের রায়ে খোকা মিয়াকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। তখন- সবার চোখ যায়, কাঠগড়ায় উপবিষ্ট আসামি খোকা মিয়ার দিকে। তার মাথাটা একদিকে হেলে পড়ে।
অনুসূয়া এসে আমেনাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, মা আমাকে কাঁদতে দাও। বাবা মারা গেলেও সেদিন আমি কাঁদতে পারিনি। আমার চোখে জল ছিল না। তুমি অনেক কেঁদেছ। আমি কাঁদিনি। আজ তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদব- আমাকে বাঁধা দিও না। আমেনা কিছু বলে না।
(এ গল্পের কাহিনী চরিত্র লেখকের কল্পনাপ্রসূত। বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই।)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।