- আমি সাইদুল, এই ঢাকা শহরের বুকে সিএনজি চালিয়ে খাই। এই কাজ আমাকে মধ্যবিত্তের জীবন দিয়েছে তবে মাঝে মাঝে এমন রাতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় যা নরকের থেকেও ভয়ংকর।
সেদিন ছিল ভরা গ্রীষ্মের রাত। আকাশে চাঁদ ছিল কিন্তু দূষণ আর ধুলোয় তার আলো ম্লান। ঘড়িতে তখন প্রায় দেড়টা। ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের প্রায় জনশূন্য এক অংশ ধরে ফিরছিলাম। শীতল কিন্তু ভারি বাতাস যেন আসন্ন কোনো দুর্যোগের পূর্বাভাস। শেষ যাত্রীটিকে নামিয়ে দিয়ে যেই না আমি সিএনজি ঘুরিয়ে ফিরতি পথের প্রস্তুতি নিচ্ছি অমনি ঘটে গেল সেই বিভীষিকাময় ঘটনা।
পেছন থেকে একটি দ্রুতগামী প্রাইভেট কার তীব্র গতিতে এসে আমার নামিয়ে দেওয়া যাত্রীকে আঘাত করে। বিকট ধাতব শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে উঠল। আমার বুক ধড়ফড় করে উঠল। যাত্রীটি একটা চিৎকার করারও সুযোগ পেল না বাতাসের ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার উপর পড়ে গেল।
আমি সিএনজির স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। চারপাশে হঠাৎই নেমে এল এক গভীর অসহনীয় নিস্তব্ধতা। প্রাইভেট কারের চালক এক মুহূর্তও না থেমে দ্রুত গতিতে পালিয়ে গেল। আমি চিৎকার করতে চাইলাম আর সাহায্য চাইতে চাইলাম, কিন্তু গলার কাছে একটা মাংসপিণ্ড আটকে ছিল যেন। আমার কণ্ঠস্বর বের হলো না। চোখের সামনে তখন সবকিছু অন্ধকার।
কিছুক্ষণ পর যখন ঘোর কাটল তখন কেবল একা আমি আর রাস্তার ওপর পড়ে থাকা নিথর দেহটা। একটা অচেনা শীতল ভয় আমার শরীরকে অবশ করে দিচ্ছিল। আমি ভয়ে ভয়ে সিএনজি থেকে নামলাম। মৃতদেহটির কাছে যেতেই ফরমালিনের মতো একটা তীব্র গন্ধ আমার নাকে এলো, না সেটা ফরমালিন নয় বরং সেটা ছিল সদ্য ঝরে যাওয়া রক্তের গন্ধ আর ভাঙা হাড়ের তীব্র ঝাঁজ।
মৃতদেহটির ঠিক পাশে রাস্তার ধারে পড়েছিল একটি চামড়ার ব্যাগ। কালো মাঝারি আকারের। আমার চোখ সেই ব্যাগের দিকে গেল। কৌতূহল? নাকি আদিম লোভ? আমি জানি না। একসময় সেই ভয়ের চেয়ে লোভের তাড়না তীব্র হয়ে উঠল। কাঁপা হাতে ব্যাগটি খুলতেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ব্যাগের ভেতর বাণ্ডিল করা হাজার হাজার টাকার নোট! এত টাকা আমি জীবনে দেখিনি। এক মুহূর্তে সব নীতি, নৈতিকতা, ভয় সব কিছু পরাজিত হলো সেই টাকার কাছে।
লোভ তখন আমার ভয়কে পুরোপুরি গ্রাস করেছে। আমি দ্রুত আশেপাশে তাকালাম। নির্জন রাস্তা। এই মুহূর্তে আর কেউ দেখছে না। আমি এক পাশবিক তাড়নায় মৃতদেহটি টেনে রাস্তার পাশের ঝোপের দিকে ঠেলে দিলাম। তারপর ব্যাগ নিয়ে সিএনজি চালিয়ে তীব্র গতিতে পালিয়ে এলাম। সেই রাতের বাতাস আমার কানে ফিসফিস করে বলেছিল, “তুই শেষ, সাইদুল। তুই শেষ।”
বাড়িতে এসে স্ত্রী রিনার কাছে সবটা খুলে বললাম। সে প্রথমে আমার উপর প্রচণ্ড রেগে গেল। “সাইদুল, তুমি ব্যাগ চুরি করেছ!” তার চোখে ছিল ঘৃণা। কিন্তু যখন আমি টাকার বাণ্ডিলগুলো মেঝেতে ঢেলে দিলাম, তখন তার সেই ঘৃণার দৃষ্টি পলকে বদলে গেল। টাকার পাহাড় দেখে সে চুপ হয়ে গেল। সেই নীরবতা ছিল সম্মতির নীরবতা, পাপের নীরবতা।
পরের কয়েকটা দিন আমাদের সংসারে অদ্ভুত এক শান্তি নেমে এল যা আদতে ছিল এক পঙ্কিলতা। নতুন শাড়ি রিনার জন্য সোনার দুল, পুরনো ফার্নিচার বদলে নতুন সোফা। কিন্তু এই সুখ স্থায়ী হলো না। পাপের পুঁতিগন্ধ আমার জীবনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করল।
একদিন রিনা আলমারির দরজা খুলে চিৎকার করে উঠল। আমি ছুটে গিয়ে দেখি ভিতরের দৃশ্যটা এমন ছিল যে আমার হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার জোগাড়। আলমারির চারপাশ যেখানে আমরা টাকাগুলো লুকিয়ে রেখেছিলাম, সেখানে হাজার হাজার সাদা কিলবিলে লার্ভা পোকা ভরে আছে। শুধু আলমারিতে নয়, টাকাগুলোর ভাঁজে ভাঁজেও সেই লার্ভা। এ যেন টাকার নয় পাপের জীবাণু।
আমরা আতঙ্কিত হয়ে কীটনাশক ছিটালাম, কিন্তু কোনো কাজ হলো না। বরং লার্ভার সংখ্যা আরও বাড়তে লাগল। আর তখনই শুরু হলো সেই অদ্ভুত শব্দ।
রাতে যখন ঘর অন্ধকার করে শুতাম তখন শুনতে পেতাম ফিসফিস শব্দ। খুবই ক্ষীণ, কিন্তু স্পষ্ট। যেন কেউ আমাদের নাম ধরে ডাকছে অথবা যেন লার্ভাগুলোই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। একদিন রাতে লার্ভাগুলো দেখছিলাম, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লার্ভাগুলো একসাথে নড়ে উঠছে যেন তারা শব্দের প্রতি সাড়া দিচ্ছে।
আমার মন হিম হয়ে গেল। এটা স্বাভাবিক পোকা নয়। এটা কোনো বৈজ্ঞানিক ঘটনা নয়। এ হলো এক অতৃপ্ত আত্মা, যার ধন আমি চুরি করেছি। আমার পাপ আজ লার্ভা রূপে আমার বাড়িতে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসেছে।
এরপরের বিভীষিকা এল বাইরে। একদিন গভীর রাতে সিএনজি নিয়ে ফিরছিলাম। হাইওয়ের প্রায় সেই একই নির্জন অংশ। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। দূর থেকে দেখলাম রাস্তার পাশে একজন দাঁড়িয়ে। হেডলাইটের আলো যত তার উপর পড়ছে, আমার শ্বাস তত ঘন হয়ে আসছে।
তিনি… তিনি সেই নিহত যাত্রী।
লোকটির শরীরজুড়ে এক্সিডেন্টের ক্ষত মুখ বিকৃত, পচন শুরু হয়েছে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর তার সারা শরীর জুড়ে কিলবিল করছে সেই একই সাদা লার্ভা পোকা। লোকটা নিঃশব্দে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি ভয়ে হাত-পা নাড়তে পারছিলাম না। সিএনজির স্টিয়ারিং ধরেই আমার শরীর জমে গেছে।
সে একেবারে সিএনজির জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। পচা শরীরের তীব্র, বমি-আসা গন্ধে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। সে তার ভাঙা কণ্ঠস্বর, যা যেন হাজার বছর ধরে চাপা পড়ে ছিল সেই ফিসফিস আওয়াজে বলল:
“আমার ব্যাগ… আমার ব্যাগটা ফেরত দাও, সাইদুল… আমার শেষ সম্বল… আমার পরিবারের জন্য…”
কথা শেষ করেই সে নিঃশব্দে অন্ধকারের ভেতর মিলিয়ে গেল, যেন সে ছিল কেবল বাতাসের একটা প্রতিচ্ছবি। আমি সেই রাতে বাড়ি ফিরে রিনাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলাম। সে প্রথমে বিশ্বাস করল না, ভাবল আমি হয়তো ভয় পেয়ে ভুল দেখছি।
কিন্তু পরের কয়েকদিনে ঘরে অদৃশ্য পায়ের শব্দ, দরজায় মৃদু ঠকঠক, বিছানার নিচে হঠাৎ দেখা যাওয়া লার্ভার সারি সব মিলিয়ে রিনাও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো এটা আর সাধারণ কোনো গল্প নয়। এটা আমাদের পাপের ছায়া, এক অতৃপ্ত আত্মার তীব্র হাহাকার।
আমরা দু’জনই জানি, আর এভাবে বাঁচা যাবে না। একদিন রাতে যখন ঘরের কোণে লার্ভার কিলবিলে আওয়াজ সবচেয়ে বেশি, তখন আমি হাঁটু গেড়ে বসে আর্তনাদ করে উঠলাম:
“তুমি কী চাও? আমাকে ছেড়ে দাও! আমি টাকা ফেরত দেব!”
এবার শব্দটি এলো স্পষ্ট, কিন্তু ভয়ংকর শীতল:
“আমার লাশ… ঢাকা মেডিকেলের মর্গে… অজ্ঞাত পরিচয়ে পড়ে আছে… আমাকে… আমার পরিবারের কাছে পৌঁছে দাও… আমি মুক্তি চাই…”
আমার শরীরে তখন ভয়, অপরাধবোধ আর দায়িত্ববোধের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। আমার চুরি করা টাকার চেয়েও এখন আমার কাছে বড় হয়ে উঠল একটি লাশের মুক্তি। পরদিন ভোরে আমি রিনাকে ব্যাগটা দিয়ে বললাম সে যেন পরিবার খুঁজে টাকাটা ফেরত দেয়। আর আমি বেরিয়ে পড়লাম আমার শেষ মিশনে ঢামেক মর্গ।
ভোর রাত। তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ। বাইরে থেকেই একটা গাঢ়, তীব্র ফরমালিনের গন্ধ ভেসে আসছিল। সেই গন্ধের সাথে মেশানো ছিল স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল আর এক অজানা ভয়ের নীরবতা।
আমি কেয়ারটেকারকে মোটা অঙ্কের টাকা দিলাম। সে প্রথমে ইতস্তত করলেও, টাকার কাছে মানুষের নীতি হার মানল। সে ফিসফিস করে বলল, “লাশ নড়ে না, বাবু। কিন্তু রাতে মর্গ নড়ে।”
মর্গের ভেতরে প্রবেশ করে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। আলো-আঁধারির খেলায় প্রতিটি সাদা চাদর যেন এক একটি ভূত। সারি সারি বেঞ্চে লাশগুলো পড়ে আছে। ফরমালিনের তীব্রতা এমন যে, যেন আমার ত্বকও পুড়ে যাচ্ছে। আমার হাত-পা কাঁপছিল।
আমি একে একে প্রতিটি চাদর সরাতে লাগলাম। প্রতিটা মুখ, প্রতিটি ক্ষত সবই অচেনা। কিন্তু কোথাও সেই লার্ভা-আক্রান্ত দেহটা নেই। আমি যখন প্রায় আশা ছেড়ে দিচ্ছি, তখন মর্গের একদম ভেতরের কোণে, যেখানে আলো খুবই ক্ষীণ, সেখানে একটি লাশের চারপাশে অস্বাভাবিকভাবে অসংখ্য লার্ভা ছড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ফরমালিনের এত তীব্রতার মধ্যে কোনো পোকা বেঁচে থাকা অসম্ভব।
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। কাঁপা কাঁপা গলায় কেয়ারটেকারকে বললাম:
“এইটা… এইটাই সেই লোক।”
কেয়ারটেকার ভয়ে ফিসফিস করে বলল:
“এই লাশটার কাছে রাতে কেউ যায় না। লাশের চোখ ফাঁকা, বাবু। লোকে বলে রাতের ঘরে এটা নড়ে। আমি দেখিনি…”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি সাহস করে লাশের মুখের কাপড় সরালাম।
সেই মুহূর্ত… আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত। লাশের ফাঁকা, সাদা চোখগুলো, যা লার্ভা দিয়ে ঢাকা ঠিক যেন সেই রাতে আমার দিকে তাকানো আত্মার চোখের প্রতিচ্ছবি। আমি চিৎকার করে উঠলাম, পা পিছলে মেঝেতে পড়ে গেলাম। তবুও আমি জানি আমাকে এই কাজ শেষ করতে হবে। আমি সমস্ত শক্তি এক করে লাশটাকে কাপড়ে মুড়িয়ে দ্রুত মর্গ থেকে বের হলাম।
সিএনজিতে সেই লাশ নিয়ে আমি ফিরতি পথ ধরলাম। ফর্সা হতে শুরু করেছে। পূর্বাকাশে কমলা আভা। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস বইছে, কিন্তু সিএনজির ভেতরে ফরমালিন আর পচা মাংসের গন্ধ।
অনেক কষ্টে আমি লোকটির গ্রামের বাড়ি খুঁজে বের করলাম। ফযরের আলোয় যখন আমি তাদের দরজায় কড়া নাড়ি তখন একটা ঘুমন্ত পরিবার আতঙ্কিত হয়ে বেরিয়ে এল। আমি কোনো কথা বলার সাহস পেলাম না। শুধু লাশটা নামিয়ে তাদের দরজার সামনে রেখে দিলাম। রিনা আগের দিনই এসে টাকার ব্যাগটা তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
পরিবারটি লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। মা-বাবা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সবার কান্নার আওয়াজ সেই ভোরের নীরবতাকে ভারী করে তুলল।
আমি দ্রুত সিএনজি ঘুরিয়ে ফিরতে লাগলাম। হঠাৎ একটা মৃদু, শীতল হাওয়ার ফিসফিস শব্দ আমার কানে এলো, স্পষ্ট:
“ধন্যবাদ… আমার পরিবার… আমি শান্তি পেলাম…”
সেই দিনের পর থেকে আর কখনো লার্ভা দেখা যায়নি। দরজায় ঠকঠক শব্দ নেই। নির্জন রাস্তায় কোনো আত্মা এসে দাঁড়ায়নি। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে অজ্ঞাত পরিচয়ে পড়ে থাকা সেই আত্মা মুক্তি পেয়েছে। আর আমি? আমি পাপের ভার কিছুটা হালকা করে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছি।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।