ডেলিয়া ( শ্রীলঙ্কার রূপকথা )

 

ড্যাফোডেলিয়া ছিল এক মিষ্টি আর অনিন্দ্য সুন্দরী এক পরীর নাম । তার রূপ ছিল মিষ্টি বুনো ফুলের মত।সূর্যের আলোর মত ঝলমলে সোনালী চুল আর লাপিস লাজুলির মত গাঢ় নীল চোখ।সে সব সময় আনন্দে উচ্ছল থাকত আর তার মিষ্টি খিল খিল হাসি ছিল রংধনুর চেয়েও মোহনীয়। সে যেখানে যেত কাঁচের চূড়ির মত রিনিকঝিনিক হাসির শব্দ শোনা যেত ।

 

তার শখ ছিল ফুলের ছবি আঁকা । তার ছিল সুন্দর এক রঙ এর বাক্স আর একটা জাদুর আঁকার তুলি ।  যখনই সে তার সেই জাদুর তুলি রঙ এর বাক্সে চুবিয়ে আলতো   করে ফুল গুলোকে ছুঁইয়ে দিত তখন তারা অসাধারণ সুন্দর রঙে ঝলমলিয়ে উঠত।

 

 

 

সে তার জাদুর তুলির ছোঁয়ায় রঙধনুর সাত রঙে ফুলগুলোকে সাজিয়ে দিতে এতটাই পছন্দ করত যে সারা রাত সে তার রঙের বাক্স আর তুলি নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াত , সব বাগানের ফুলেদের একটু খানি রঙ এর ছোঁয়ায় সাজিয়ে তুলতে।

আর ফুলেরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত ড্যাফোডেলিয়ার জন্য ।সারারাত ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে সে রাঙিয়ে তুলত ফুলেদের আর দিনের আলো ফোটার আগেই উড়ে চলে যেত । এরপর যখন সূর্য উঠত তখন ফুলেরা সবাই রঙ বেরঙ এর সাজে হেসে উঠত । এই যে সারারাত ড্যাফোডেলিয়া তাদের সাজিয়ে তুলত এটা শুধু ফুলেরাই জানত আর কেউ নয় । .

একদিন সে যখন উড়ে উড়ে ফুলেদের সাজুগুজু করাচ্ছিল তখন হঠাত করেই এমন এক বাগানে এসে পড়ল যেখানে একটাও ফুল ছিল না । পুরো বাগানটাই ছিল বিমর্ষ আর ঠিক এর মাঝখানে ছিল এক আজব কুটির । যেহেতু সাজিয়ে তোলার মত একটাও ফুল বাগানে ছিল না তাই সে ঝটপট সেখান থেকে চলে যেতে চাইল । ওমা বাগানের সীমানার কাছা কাছে এসে সে হঠাত শুনতে পেল কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।

কে কাঁদে ? চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করল ড্যাফোডেলিয়া। কিন্তু সে কাউকে দেখতে পেল না । আবার ও সে শুনতে পেল ফোঁপানির শব্দ । শব্দটা বাগানের ভিতর থেকেই আসছে ।

 

কিন্তু এই বিমর্ষ বাগানটা তো পরিতাক্ত , আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠল ড্যাফোডেলিয়া। কেমন ভয়াবহ চেহারার কাঁটা গাছের বেড়া দিয়ে ঘেরা রয়েছে চারপাশ ।

কে কাঁদে ? কার মনে এত্ত দুঃখ ? মনে মনে ভাবল আর বেড়ার উপর দিয়ে আস্তে করে উকি মারল ড্যাফোডেলিয়া ।

ওহ হো ! কি করছ ? দয়া করে ভিতরে যেওনা । আতংকিত কন্ঠে চিৎকার করে উঠল সব বুনো ফুলেরা ।

কেন? আমি কেন ভিতরে যাব না ? বিস্মিত কণ্ঠে জিগ্যেস করল ড্যাফোডেলিয়া ।

আহ ! একসাথে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল ফুলেরা , এই বাগানটা এক ডাইনির । সে তার বাগানে কোন ফুলকেই পছন্দ করে না আর তাদের থাকতেও দেয় না । সে অন্য কাউকেই তার বাগানে প্রবেশ করতে দেয় না । এমনকি একটা ছোট্ট মৌমাছি ও তার বাগানে প্রবেশ করতে পারে না ।

তাইতো বলছি ড্যাফোডেলিয়া ,যদি তুমি এই বাগানে প্রবেশ কর তাহলে অনেক বড় ঝামেলা আর বিপদে পড়বে ।
বুনো ফুলেরা কথা থামাতেই আবার ড্যাফোডেলিয়ার কানে ভেসে এল ফোঁপানির শব্দ ।

 

ওহ হো ! কে কাঁদছে এমন করে ,আমার তো সহ্য হচ্ছে না ,আমি অবশ্যই ভিতরে যাব ,একথা বলেই আবার ভিতরে উঁকি মারল ড্যাফোডেলিয়া ।

হা ঈশ্বর !! তুমি ! বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল ড্যাফোডেলিয়া ।

 

এক ছোট্ট মিষ্টি ফুল ঝোপের আড়ালে দাড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল । ছোট্ট মিষ্টি ফুল কে খুব বিবর্ণ আর ভঙ্গুর মনে হচ্ছিল । ফুলটি এমন হাপুস নয়নে কাঁদছিল যে ড্যাফোডেলিয়া তা সহ্য করতে পারছিল না।

 

ওহ মিষ্টি ছোট্ট ফুল ,তুমি কেন এমন আকুল হয়ে কাঁদছ ? নরম স্বরে শুধাল ড্যাফোডেলিয়া ।

কান্না ভরা চোখে মুখ তুলে তাকাল ছোট্ট ফুলটি , জান আমি না ভীষণ একা বলল সে । কেউ আমার কাছে আসে না কারন আমি খুব বিবর্ণ আর মলিন । মৌমাছি আর প্রজাপতিরা কেউ আমার কাছে আসেনা কারন আমি একটুকুও মিষ্টি আর সুন্দর না । একফোঁটা রঙ নেই আমার …… ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল ফুলটি ।

এ কথা শুনে ড্যাফোডেলিয়া খুব দুঃখ পেল ।

 

ইশ রে !! আর কেদনা সোনামণি , আমি তোমাকে তুলির ছোঁয়ায় দেব চমৎকার রঙ ,তখন তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাবে … বলল ড্যাফোডেলিয়া । একথা বলেই সে বেড়ার নীচ দিয়ে বাগানে প্রবেশ করল ।

হায় হায় কি করছ তুমি ?  ভয়ে চিৎকার করে উঠল সব বুনো ফুলেরা । যেওনা ড্যাফোডেলিয়া   ,নয়ত ডাইনি তোমায় ধরে ফেলবে ।  কিন্তু ড্যাফোডেলিয়া কারও কথায় কান না দিয়ে সোজা বাগানের ভিতর চলে যেতে চাইল ফুলটিকে রঙিন করে তুলতে ।

 

তখন গাছের ডালে বসা এক হামিং বার্ড বলে উঠল ,দাড়াও ড্যাফোডেলিয়া আমি আগে ভিতরে গিয়ে দেখি আসি দুষ্ট ডাইনিটা কি করছে ।   এ কথা বলেই সে ফুড়ুৎ করে উড়ে ভিতরে চলে গেল আর একটু পর উড়তে ঊরতে এসে বলল ,ইশ ডাইনিটা ঘুমাচ্ছে ,জলদি জলদি ভিতরে যাও ড্যাফোডেলিয়া ।

 

একথা শোনা মাত্র ড্যাফোডেলিয়া একটুকু দেরি না করে ভিতরে চলে গেল আর আশে পাশের সমস্ত ফুল আর প্রজাপতিরা চিৎকার করে বলল ,সাবধানে থেক সাবধানে থেক গো মিষ্টি পরী ।

বিবর্ণ ফুলটি খুশিতে ঝলমল করে উঠল । ড্যাফোডেলিয়া  যেইমাত্র তার রঙের তুলি ফুল টিকে ছোঁয়াবে ঠিক সেই মুহূর্তেই কে যেন তার পা ধরে হ্যাঁচকা টান দিল ।

 

ব্যাথায় ককিয়ে উঠে পিছন ফিরে তাকিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠল ড্যাফোডেলিয়া , কারন সেই দুষ্টু ডাইনি ড্যাফোডেলিয়ার পা ধরে টান দিয়েছে ।

কি করছিস তুই এখানে , রাগে গড়্গড় করে উঠল দুষ্টু ডাইনি ।

 

 

ইয়ে আমি না ওই ছোট্ট বিবর্ণ ফুল টিকে রঙ করতে এসেছি , ভয়ে বিড়বিড় করে বলল ড্যাফোডেলিয়া।

 

কি ? এত্ত বড় সাহস !! দাড়া দেখাচ্ছি মজা , একথা বলেই দুষ্টু ডাইনি ধাক্কা দিয়ে ড্যাফোডেলিয়াকে ফেলে দিল আর তার  হাতের রঙের বাকেট/বালতি টা কেড়ে নিয়ে সব রঙ ড্যাফোডেলিয়ার মাথায় ঢেলে দিল ।

 

ওহ না ! দুঃখে কষ্টে ড্যাফোডেলিয়া তার মাথা ঝাকিয়ে রঙ ফেলার চেস্টা করতে লাগল ,তার সুন্দর ঝলমলে সোনালী চুল বেয়ে রঙের ধারা ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছিল ,আর তক্ষনি ঘটল এক আজব ঘটনা !!

 

রঙের ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই অসাধারন সুন্দর এক একটা সোনালী ফুল মাটি ভেদ করে উঁকি দিচ্ছিল । অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত বাগান সেই সোনালী ফুলে ছেয়ে গেল ।

এসব দেখে ডাইনি ভয়ংকর রেগে গেল । ডাইনির কুটিরটাও ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল । কিছুতেই কিছু করতে না পেরে দুস্টু ডাইনি তার ব্যাগ বোচকা বেধে চলে গেল দূরে আরও দূরে ।

এসব দেখে পূব আকাশে সূর্য টা আর ঝলমল করে জ্বলে উঠল আর সেই বিবর্ণ ছোট্ট ফুলটিও নতুন রঙে সেজে গুজে খুশিতে হাত তালি দিয়ে উঠল । বাগানের সব প্রজাপতি আর পাখিরা নেচে গেয়ে হই হুল্লোড়ে মেতে উঠল ।

 

ড্যাফোডেলিয়াও খুশিতে গান গেয়ে উঠল ফুল পাখি আর প্রজাপতিদের সাথে আর গান গাইতে গাইতেই সে উড়ে চলে গেল পরী রাজ্যে । আর তারপর কি হল জান ? সবাই মনোযোগ দিল সেই সোনালী ফুলের দিকে ,আহ কি সুন্দর একদম ড্যাফোডেলিয়ার মত ।এরপর থেকে পৃথিবীর সব্বাই সেই ফুল কে ডাকে ড্যাফোডিল বলে …………… আজও বাগানে যখন ঝকঝকে সূর্যের আলোয় সোনালী ড্যাফোডিল ফোটে তখন সবাই ড্যাফোডেলিয়ার কথা মনে করে ।
( সমাপ্ত)

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!