ডুমরুধরের কুমির শিকার –ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাকধ্যায়

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,-শুনিয়াছি যে,সন্দুরবনে নদী নালায় অনেক কুমির আছে!তোমার আবাদে ঐ জলাভূমিতে কুমির কিরূপ?

ডমরুধর বলিলেন,-কুমির!আমার আবাদের কাছে যে দনী আছে,কুমিরে তাহা পরিপূর্ন।খেজুরের পাতার মতো তাহারা ভাসিয়া বেড়ায়।অথবা কিনারায় উঠে তারা পালে পালে রৌদ্র পোহায়।গরু মানুষ,ভেড়া,বাগে পাইলেই লইয়া নিয়া যায়।কিন্তু এসব কুমির কে আমতা গ্রাহ্য করি না।একবার আমার আবাদের নিকট এক কুমিরের আবির্ভাব হইয়াছিল।ইহার দেহ বৃহৎ,তাল গাছের ন্যায় বড়।ইহার উদর এই দালান টার মত,অন্যান্য কুমির জিবজন্তুকে চিড়িয়া ভক্ষন করে।কিন্তু এ কুমির আস্ত মানুষ,আস্ত গরু গিলিয়া ফেলিত।রাত্রি সে লোকের ঘরে ও গোয়ালে সিঁদ দিয়া মানুষ ও গরু-বাছুর লইয়া যাইত।লাঙ্গুলে জল আনিয়া দেয়াল ভিজাইয়া গর্ত করিত।ইহার জ্বালায় নিকটস্থ আবাদের লোক অস্থির হয়ে পড়িল।প্রজাগন পাছে আবাদ ছাড়িয়া পলায়ন করে,আমাদের সেই ভয় হইল।তাহার পর নাঙ্গলের আঘাতে নৌকা ডুবাইয়া আরোহিদিগনকে ভক্ষন করিতে লাগিল।সে নিমিত্ত ও পথ দিয়া নৌকায় যাতায়াত অনেক বন্ধ হয়ে গেল।

এই ভয়ানক কুমিরের হাত থেকে কিরূপে বাচা যায় এরূপ ভাবিতেছি।এমন সময় আমাদের আবাদের নিকট এক খানি নৌকা ডুবাইয়া তাহার আরহিদিগকে একে একে আমাদের সমক্ষে সে গিলিয়া ফেলিল।এই নৌকায় এক ভদ্র লোক সপরিবারে পূর্ব-দেশে

যাইতে ছিলেন।নদীর তিরে দাঁড়াইয়া দেখিলাম যে,তাহার গৃহিনির সর্বঙ্গ বহুমূল্যের অলঙ্কারের ভূষিত ছিল।তোমরা যান যে কুকিরের পেটে মাংস হজম হয়,গহনা পরিপাক পায় না।কুমির যখন সেই স্ত্রীলোককে গিলিয়া ফেলিল,এখন আমার মনে এই চিন্তা উদয়

হইল,-চিরকাল আমি কপালে-পুরুষ।যদি এই কুমির কে আমি মারিতে পারি,তাহলে এর পেট চিরিয়া ওই গহনা গুলো বাহির করিব।অশ্তত পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আমার লাভ হইবে।এইরূপ চিন্তা করে আমি কলিকাতায় গমন করিলাম।বড় একটি জাহাজের নঙ্গর কিনিয়া উকো ঘসিয়া তাহাতে ধার করিলাম।তাহার পর,যে কাছিতে মনোয়ারি জাহাজ বাঁধা থাকে সেরুপ এক কাছি ক্রয় করিলাম।এইরূপ আয়োজন করিয়া আমি আবাদে ফিরিয়া আসিলাম।আবাদে আসিয়া শুনিলাম যে কুমির একটা মানুষ খাইয়াছে চারদিন পূর্বে এক বুড়ি বেগুন মাথায় করিয়া হাটে বেঁচিতে যাইতেছিল।সে যেই নদীর ধারে গিয়াছে,আর কুমির তাহাকে ধরিয়া বেগুন ঝুড়ি সহিত আস্ত গিলিয়া ফেলিয়াছে।তাহাতে সাঁওতাল প্রজাগন খেপিয়া উঠেছে।বলিতেছে যে,আবাদ ছাড়িয়া তাহারা দেশে চলিয়া যাইবে।

আবাদে আসিয়া আমি নঙ্গরটিকে বড়শি করিলাম।তাহাতে জাহাজের কাছি বাঁধিয়া দিলাম।নঙ্গরে অগ্রভাবে এক মহিষের বাছুর গাথিয়া নদীর জলে নিকট বাঁধিয়া দিলাম।নদীর ধারে দাঁড়াইয়া সে গাঁ-গাঁ শব্দে ডাকিতে লাগিল।তাহার ডাক শুনিয়া সন্ধ্যার ঠিক পূর্বে সেই প্রকাণ্ড কুমির আসিয়া হাজির হইল।তাহার লেজের ঝাঁপটে পর্বত প্রমাণ এক ঢেও উঠিল।সেই ঢেউয়ে বাছুর টি ডুবিয়া গেল।তখন আমরা আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না।পরক্ষনেই কাছি টান পড়িল।তখন আমরা বুঝতে পারিলাম যে নঙ্গরবিদ্ধ বাছুর কে কুমির গিলিয়াছে।বড়শীর ন্যায় নঙ্গর কুমিরের মুখে বাঁধিয়া গেছে।তাড়াতাড়ি পঞ্চাশ জন লোক আসিয়া দড়ি ধরিয়া টানিতে লাগিল।ভাগ্যে গাছে পাক দিয়া রাখিয়াছিলাম।তা না হইলে কুমিরের বলে এই পঞ্চাশ জন লোককে নদিতে পড়িতে হইত।

আমরা সেই রাক্ষস কুমির কে বড়শিতে গাথিয়াছি,ওই কথা শুনিয়া চারদিকের আবাদ হইতে অনেক লোক ছুটিয়া আসিল।প্রায় পাঁচশত লোক এই দড়ি ধরিয়া টানিটে লাগিল।দারুণ আসুরিক বলে কুমির ওই পাঁচশত লোকের শহিত ঘোর সংগ্রাম করিতে লাগিল।কখনও আমাদের ভয় হইল,সে জাহাজের দড়া চিড়িয়া যায়।কখনও ভয় হইল,গাছ উৎপাটিত হইয়া নদিতে গিয়া পড়ে।নিশ্চয় একটা না একটা বিভ্রাট ঘটিত,যদি না সাঁওতালগন কুমিরের মস্তকে ক্রমাগত তীর বর্ষন করিত।যদি না নিকটস্থ দুইটি আবাদের লোক বন্ধুক আনিয়া কুমিরের মাথায় গুলি না করিত।তীর ও গুলি খাইয়া কুমির মাঝে মাঝে জলমগ্ন হইতে লাগিল।কিন্তু নিশ্বাস লইবার জন্য পুনারায় তাহাকে ভাসিয়া উঠিত হইল।সেই সময় লোকেরা তাকে তির ও গুলি বর্ষন করিতে লাগিল।কুমিরের রক্তে নদীর জল বহুদূর পর্যন্ত লোহিত বর্নে রঞ্জিত হইল।সমস্ত রাত্রি কুমিরের সাথে আমাদের যুদ্ধ চলিল।প্রাতঃকালে কুমির হীনবল হইয়া পড়িল।বেলা নয়টার সময় তাহার মৃতদেহ জলে ডুবিয়া গেল।তখন অতি কষ্টে আমরা তাহাকে টানিয়া উপরে তুলিলাম।

বড়-বড় ছোরা বড়-বড় কাস্তে আনিয়া তাহার পেট চিরিতে চেষ্টা করলাম।কিন্তু সে রাক্ষস কুমিরের পেট অতি কঠিন ছিল।আমাদের সমুদয় অঙ্গ ভাঙিয়া গেল।অবশেষে করাতি আনাইয়া করাতের দ্বারা তাহার উদর কাটাইলাম।কিন্তু পেট চিরিয়া পেটের ভিতর জাহা দেখিলাম,তাহা দেখে আমার চক্ষু স্থির।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলরন,-কি দেখিলে?

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,কি দেখিলে?

অন্যান্য শ্রোতাগন জিজ্ঞাসা করিলেন, -কি দেখিলে?

ডমরুধর বলিলেন,বলিব কি ভাই,আর দুঃখের কথা,কুমিরের পেটের ভেতর দেখি না যে,সেই সাঁওতাল বুড়ি চারদিন পূর্বে কুমির যাহাকে আস্ত ভক্ষন করিয়াছে,সে পূর্বদেশীয় ভদ্রমহিলার সমুদয় গহনা গুলি আপনার সর্বাঙ্গে পরিয়াছে।তাহার উপর নিজের বেগুনের ঝুড়িটি সে উপুর করিয়াছে,সেই বেগুন গুলির সম্মুখে ভাগ করিয়া রাখিয়াছে।ঝুড়ির উপর বসিয়া বেগুন বেচিতেছে।

ডমরুধর বলিলেন,-হ্যাঁ ভাই!কুমিরের পেটের ভিতর সেই ঝুড়ির উপর বসিয়া সে বেগুন বেচিতেছিল।লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছে?কুমিরের পেটের ভিতর সে খদ্দির পেল কোথায়?

বিরক্ত হইয়া ডমরুধর বলিলেন,তোমার এক কথা!কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল,সে খোঁজ করিবার আমার সময় ছিল না।সমুদয় গহনা গুলি সে নিজের গায়ে প্রিয়াছিল,তাহা দেখিয়া আমার হাড় জ্বলিয়া গেল।আমি বলিলাম,-ও গহনা আমার!অনেক টাকা খরচ করিয়া আমি কুমির ধরিয়াছি,ও গহনা খুলিয়া দে।কেউমেউ করিয়া বুড়ি আমার সাথে ঝগড়া করিতে লাগিল।তাহার পর তাহার পুত্রগন ও তাহার জাতি ভাইগন লাঠি-সোটা লইয়া আমাকে মারিতে আসিল।আমার প্রজাগন কেউ আমার পক্ষ হইল না।সুতরাং আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইল।সাঁওতাল গন সে মাগীকে ঘরে লইয়া গেল।দিন কয়েক শুকুর মারিয়া ও মদ খাইয়া তাহারা আমোদ করিল।পূর্বদেশীয় সে ভদ্রমহিলার আকখানি গহনা আমি পাইলাম না।মনে মনে ভাবিলাম যে,কপালে-পুরুষের ভাগ্যও সকল সময়ে প্রসন্ন হয় না।লম্বোদর বলিলেন,এত আজগবি গল্প তুমি কোথায় পাও বল দেখি?ডমরুধর বলিলেন,এতক্ষণ হা করিয়া এক মনে একি ধ্যানে আজগুবি গল্প কলির ধর্ম বটে।

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,এ কুমিরের গল্প যে সত্য,তাহার কোন প্রমান?নিশ্চয় প্রমান আছে।কোমরের ব্যাথার জন্য এই দেখ সেই কুমিরের দাত আমি পরিয়া আছি।লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,সে কুমির তাল গাছের অপেক্ষা বড় ছিল,তাহার দাত এত ছোট কেন?

ঠিক অন্য কুমিরের দাতের মতো কেন?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,অমেক মানুষ খাইয়া সে কুমিরের দাঁত ক্ষয় হইয়া গিয়াছিল।

 

দুঃখিত!