ডিম

বাড়ি ফেরার পথে তোমার মৃত্যু হয়।
এটা ছিলো একটা দুর্ঘটনা। তেমন আহামরি কিছু নয়, তবে প্রাণঘাতী। ভালো ব্যাপার হলো মৃত্যুটা ছিলো যন্ত্রণাহীন। মৃত্যুকালে তুমি রেখে গেছ তোমার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে। ডাক্তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো তোমাকে বাঁচানোর। কিন্তু লাভ হয়নি কোনো। তোমার শরীর পুরো চুরমার হয়ে গেছিলো। বিশ্বাস করো, মারা গিয়েই ভালো হয়েছে।
আর তার পরেই তোমার সাথে আমার দেখা হয়।

“ক্কি… কী হয়েছে?” তুমি জিজ্ঞেস করলে। “আমি কোথায়?”

কোনো ভনিতা না করে আমি জানিয়ে দিলাম,“তুমি মারা গেছ”।

“একটা ট্রাক… দ্রুতগতিতে পিছলে আসছিলো…”

“ঠিক” আমি বললাম।

“আমি… আমি মারা গেছি?”

“হ্যাঁ। কিন্তু এটা নিয়ে এত মন খারাপ কোরো না। সবাইকেই মরতে হয়,” আমি বললাম।

তুমি এদিক ওদিক তাকালে। কিন্তু কোথাও কিছুই নেই। শুধু তুমি আর আমি। তুমি জিজ্ঞেস করলে, “আমি এখন কোথায়? এটা কি পরকাল?”

“তা এক রকম বলতে পারো,” বললাম আমি।

“আপনিই কি ঈশ্বর?”

“হ্যাঁ”, বললাম আমি। “আমি ঈশ্বর।”

“আমার স্ত্রী… আমার সন্তানরা,”

“তাদের কী?”

“তারা ভালো আছে তো?” জিজ্ঞেস করলে তুমি।

“মজার ব্যাপার তো,” আমি বললাম। “তুমি এইমাত্র মারা গেছ আর তোমার প্রথম চিন্তা তোমার পরিবার নিয়ে। খুবই ইন্টারেস্টিং।”

তুমি অবাক হয়ে আমাকে দেখছিলে। তোমার কাছে আমাকে দেখতে ঈশ্বরের মত লাগছিলো না। স্রেফ একজন লোক মনে হচ্ছিলো। কিংবা একজন মহিলা। বা, কোনো অস্পষ্ট কর্তৃত্বশীল ব্যক্তি। অনেকটা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারদের মত। ঈশ্বরের মতো নয়।

“চিন্তা কোরো না। তারা ভালো থাকবে। তোমার প্রতি কোনো অপছন্দ সৃষ্টি হবার জন্য যথেষ্ট সময় তোমার সন্তানরা পায়নি। তাই তাদের কাছে তুমি একজন পার্ফেক্ট বাবা-ই থাকবে। আর তোমার স্ত্রী বাইরে বাইরে একটু কাঁদবে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে প্রসস্তি বোধ করবে। এমনিতেও তোমাদের বিয়েটা ভাঙবে ভাঙবে করছিলো। তোমার সান্তনা এই, যে প্রসস্তি বোধ করার কারণে কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করবে তোমার স্ত্রীর মনে।”

“ওহ! তাহলে এখন কী হবে? আমি কি স্বর্গ, নরক বা অন্য কোথাও যাব?”

“কোনোটাই না,” আমি বললাম। “তোমার পুনর্জন্ম হবে।”

“আহ! তাই বলুন,” বললে তুমি, “তার মানে হিন্দুরাই সঠিক ছিলো”।

“সব ধর্মই নিজের মত করে সঠিক,” বললাম আমি। “আমার সঙ্গে চলো।”

তুমি আমাকে অনুসরণ করলে। আমরা শুন্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

“নির্দিষ্ট কোথাও না,” আমি বললাম “হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে ভালো লাগে, তাই।”

“কিন্তু লাভ কি এতে? জিজ্ঞেস করলে তুমি। “আমি আবার যখন জন্ম নেব, তখন আমি হব একটা ফাকা স্লেট এর মত, তাই না? একটা শিশু। আমার সব অভিজ্ঞতা, আমি এই জন্মে যাকিছু করেছি তার কিছুতে কিছু আসবে যাবে না।”

“মোটেই না!” আমি বললাম, “তোমার মাঝেই তোমার সব অতীত জন্মের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চিত আছে। তুমি স্রেফ সেগুলো এখন স্মরণ করতে পারছো না।”

আমি হাঁটা থামিয়ে তোমার কাঁধে হাত রাখলাম। “তুমি যতটা কল্পনা করতে পারো তোমার আত্মা তারচেয়েও অনেক সুন্দর, অনেক বড়, আর মহৎ। একটা মানব মন তোমার অস্তিত্বের খুব ক্ষুদ্র অংশই ধারণ করতে পারে। এটা অনেকটা একগ্লাস পানিতে তোমার আঙুলের ডগা ডোবানোর মত। যাতে বোঝা যায় পানিটা গরম না ঠান্ডা। তুমি তোমার শরীরের ক্ষুদ্র একটা অংশ গ্লাসটিতে ডোবালে, কিন্তু বের করে আনার পর তুমি সেই ক্ষুদ্র অংশটির পুরো অভিজ্ঞতাটিই পেয়ে গেলে।”

“তুমি একটা মানুষের মাঝে ৪৮ বছরের কম সময় ছিলে। এত কম সময়ে তুমি তোমার সুবৃহৎ চেতনার পুরোটাতে বিচরনের সুযোগ পাওনি। আমরা যদি এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকি, একে একে সবকিছুই তোমার মনে পড়বে। কিন্তু দুই জীবনের মাঝে এই স্মৃতিচারণে কোনো লাভ নেই।”

“আমার কতবার পুনর্জন্ম হয়েছে?”

“ওহ, অনেক বার। অনেক অনেক বার। এবং প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন জীবনে।” আমি বললাম। “এইবার তোমার পুনর্জন্ম হবে খৃষ্টপূর্ব ৫৪০ সালে, এক চৈনিক কৃষক কন্যা হিসাবে।”

“বলেন কি!” তুমি তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলে, “আপনি আমাকে অতীতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন?”

“ইয়ে, টেকনিক্যালি, সময় জিনিসটা তোমার পরিচিত জগতে যেমন, আমি যেখান থেকে আসছি সেখানে তেমন নয়।”

“আপনি কোথা থেকে এসেছেন?” জিজ্ঞেস করলে তুমি।

“অবশ্যই,” আমি ব্যাখ্যা করলাম, “আমিও কোনো যায়গা থেকে এসেছি। ভিন্ন কোনো যায়গা। এবং আমার মত আরো অনেকেই আছে। তুমি হয়তো জানতে চাইবে সেই যায়গাটা কেমন। কিন্তু সত্যি বলতে কি, তুমি বুঝবে না।”

“ওহ,” তুমি কিছুটা হতাশ হলে। “দাঁড়ান, আমি যদি ভিন্ন স্থান কালে পুনরায় জন্ম নিতে পারি তার মানে আমার হয়ত কখনো না কখনো নিজের সাথেই দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?”

“হ্যাঁ। এমনটা তো হামেশাই হচ্ছে। যেহেতু দুইটা জীবনই শুধু নিজের জীবন-কাল এর ব্যাপারে সচেতন, তোমার পক্ষে বোঝাই সম্ভব না যে তুমি নিজের সাথে কথা বলছ।”

“তাহলে আর এসবের মানে কী?”

“সত্যি?” অবাক হলাম আমি। “সত্যিই তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ জীবনের মানে কী? ব্যপারটা কেমন স্টেরিওটিপিক্যাল হয়ে গেল না?”

“হ্যাঁ, কিন্তু এটা একটা গ্রহনযোগ্য প্রশ্ন।” তুমি দাবি করলে।

এবার আমি তোমার চোখের দিকে তাকালাম, “জীবনের মানে, অর্থাৎ যে কারণে আমি এই ব্রহ্মাণ্ডটা বানিয়েছি তা হলো স্রেফ তোমার পরিপক্কতা আনার জন্য”।

“মানে আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন মানব জাতি? আপনি আমাদের পরিপক্কতা আনতে চান?”

“না, স্রেফ তুমি। আমি এই ব্রহ্মাণ্ড বানিয়েছি স্রেফ তোমার জন্য। প্রতিটি জীবনের মধ্য দিয়ে তুমি বড় হও, পরিণত হও এবং আরো মহৎ বুদ্ধিমত্তা হিসাবে গড়ে ওঠো।”

“শুধু আমি? বাকিদের তাহলে কী হবে?”

“বাকি কেউ নেই,” আমি বললাম। “এই ব্রহ্মাণ্ডে স্রেফ তুমি আর আমি।”

তুমি এক রকম ফাকা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালে। “তাহলে পৃথিবীর এত শত মানুষ…”

“সবই তুমি। ভিন্ন ভিন্ন পুণর্জীবন।”

“মানে, আমি-ই সবাই!?”

“এই তো বুঝতে পেরেছ,” তোমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম আমি।

“পৃথিবীতে যত মানুষ এসেছে তার সবই আমি?”

“কিংবা যত মানুষ আসবে তাদের সবাই।”

“আমি-ই আব্রাহাম লিঙ্কন?”

“এবং তুমি জন উইল্কিস বুথ, ও,” আমি যোগ করলাম।

“আমি হিটলার?” তুমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলে।

“সে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিলো তারাও তুমি।”

“আমি যিশুখৃষ্ট?”

“তাকে যারা অনুসরণ করেছিলো তারাও তুমি।”

এবার তুমি থেমে গেলে।

“প্রতিবার তুমি যখন কারো ক্ষতি করো, তুমি আসলে নিজেরই ক্ষতি করেছো। যত বার তুমি কাউকে দয়া দেখিয়েছ, সেটাও নিজেকেই। প্রতিটি আনন্দ, বেদনার অভিজ্ঞতা যা কোনো মানুষ কখনো অনুভব করেছে কিংবা করবে তার সবই তুমি অনুভব করেছ।”

তুমি অনেকক্ষণ ভাবলে।

“কেন?” জিজ্ঞেস করলে। “এত সব করার দরকার কী?”

“কারণ একদিন তুমি আমার মত হবে। কারণ এটাই তোমার পরিচয়। তুমি আমাদের প্রজাতির। তুমি আমার সন্তান।”

“ওয়াহ!” তুমি অবিশ্বাসের সুরে বললে, “আপনি বলছেন আমিও একজন ঈশ্বর?”

“না। এখনো না। তুমি একটা ভ্রূণ। তুমি এখনও বড় হচ্ছো। যখন কালের শেষ অবধি প্রতিটি মানব জীবনের অভিজ্ঞতা তোমার হয়ে যাবে তখন তুমি জন্ম নেবার মত পরিণত হবে।”

“তার মানে পুরো ব্রহ্মান্ডটা,” আপনি বলছেন, “এটা স্রেফ…”

“একটা ডিম,” উত্তর দিলাম আমি। “এখন চলো তোমার পরবর্তী জীবনে যাবার সময় হয়েছে।”

দুঃখিত!